কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ও যৌবনের দুর্দম তরঙ্গ

ডঃ নুরুল ইসলাম

"কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।"

এরকম উপমার পাশাপাশি বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে যিনি কবিতা লেখেন তিনি কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তার জন্ম ১৯২৬ সালে ১৫ আগস্ট কলকাতার কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রিটে মাতুলালয়ে । তাঁর ৯৮ তম জন্মদিন আজ। তাঁর সুকান্ত নাম রাখেন জ্যাঠতুতো দিদি। অল্প বয়সে মারা যান তিনি এবং তার কিছুদিন পরেই মাকে হারান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাবা নিবারণ ভট্টাচার্য ছিলেন পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক। বিখ্যাত সারস্বত লাইব্রেরীর স্বত্বাধিকারী ছিলেন তিনি।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিয়া থানার শিমুলতলা গ্রামে। তার পিতা নিবারণ ভট্টাচার্যের পিতা অর্থাৎ কবি সুকান্তের পিতামহ পেশায় ছিলেন একজন আদালতের পেশকার । স্বাধীনতার আগেই তারা স্থায়ীভাবে এপার বাংলায় চলে আসেন।ওপার বাংলার পৈত্রিক ভিটেটি বাংলাদেশের হাসিনা সরকার ২০১০ সালে সংরক্ষণ করে অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। এখানে তাঁদের নানা স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষিত আছে মর্যাদা সহকারে।পাঁচিল ঘেরা বিরাট এলাকা। বুদ্ধবাবু বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছেন স্মৃতির টানে। বাড়ির পাশেই নির্মিত হয়েছে এক বিশাল পার্ক এবং তার নাম কবি সুকান্ত পার্ক। কবি সুকান্তের নামে এক বিশাল অডিটোরিয়াম,গ্রন্থাগার নির্মিত হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহে বেশ কয়েক দিন ধরে সুকান্ত মেলা নামে এক বড় উৎসবের আয়োজন করা হয় সরকারি ব্যবস্থাপনায়। বাড়ির ভেতরে ঢোকার মুখেই পড়বে কবি সুকান্তের বিশাল ভাস্কর্য। সারা বছর ধরেই এখানে দেশ-বিদেশ থেকে নানা পর্যটক আসেন।

কবি সুকান্তের স্বল্প স্থায়ী জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কলকাতার বেলেঘাটা ৩৪ হরমোন ঘোষ লেনের বাড়িতে সেই বাড়িতে এখনো অক্ষত আছে।পাশের বাড়িতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র ভাইয়ের পরিবার পরিজন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জননেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের ভাইয়েরই ছেলে।

তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু উত্তর কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দিরে। পরে তিনি বেলেঘাটা দেশবন্ধু উচ্চ বিদ্যালয় ভর্তি হন।

আমরা শক্তির কথা বলি, জাগরণের কথা বলি।মাত্র কুড়ি বছর কয়েক মাসের জীবন,সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়া একজন কবির মধ্যে কতটা বারুদ থাকতে পারে তা সুকান্তের কবিতা পড়লেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি। বিপ্লব আর স্বাধীনতার দাবিতে চির আপসহীন ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ,মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদির বিরুদ্ধে কবির কলমে ঝলসেছে আগুন।এসবের বিরুদ্ধে তারুণ্যের গান, কবিতার ছন্দ কিছুই বাদ যায়নি তার কলম থেকে। অথচ মাত্র ছয় বছরের লেখার সময়কাল তাঁর।

কমলা বিদ্যামন্দিরে পাঠরত অবস্থায় সাহিত্যে হাতে খড়ি তাঁর,প্রথম গল্প বিদ্যালয় পত্রিকায় প্রকাশ পায়। তারপর বিবেকানন্দকে নিয়ে "শিখা" পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ পায় সুকান্তের । এই পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখাও ছাপানো হয়।

১৯৪৪ সালে সুকান্ত পার্টিতে সদস্য পদ লাভ করেন এবং পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর সাহিত্য সাধনা। ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক ও শিল্পীর সংঘের পক্ষে তাঁর সম্পাদনায় "আকাল" নামের একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৪৫ থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য দৈনিক 'স্বাধীনতা' পত্রিকার 'কিশোর সভা' বিভাগ সম্পাদনা করতেন।

সমাজতান্ত্রিক চেতনায় আস্থাশীল কবি সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র অবস্থান করে নেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্র '১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পর। পাঠক মনে এইসব কবিতা আলোড়ন সৃষ্টি করলে একের পর এক প্রকাশিত হয় তার বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো 'পূর্বাভাস' ১৯৫০, 'মিঠেকড়া'১৯৫১, 'অভিযান' ১৯৫৩,'ঘুম নেই' ১৯৫৪,' হরতাল' ১৯৬২, 'গীতিগুচ্ছ '১৯৬৫ ইত্যাদি।

রবীন্দ্র নজরুল পরবর্তীকালে সুকান্তের কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের বহুমাত্রিকতা একটি নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাব বলয় ভেঙে নতুন সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে নিবেদিত থেকে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করতে সমাজ চেতনা ও মূল্যবোধ জাগরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাঁর জীবন চর্যায় ও সাহিত্য সাধনায়।

সুকান্ত ছিলেন গণমানুষের কবি। তাই জীবদ্দশায় সরকারি রোষানলে তাঁর মূল্যায়ন হয়নি। তবে অকাল মৃত্যুর পর তাঁর লেখা অপ্রকাশিত কবিতা একে একে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে সচেতন সংবেদনশীল পাঠক সমাজ তাঁর কবিতা থেকে সমাজ পরিবর্তনের জোরালো উদ্দীপনাময় রসদ খুঁজে পান।

কুড়ি বছর বয়সে কবি প্রথমে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন, তারপর সেরে উঠলে মারন যক্ষা রোগে কবি আক্রান্ত হন এবং ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে ২০ বছর ৯ মাস বয়সে মারা যান।

সুকান্ত উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা শিশুটির জন্য সূর্যের কাছে তাপ প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু নিজের জন্য কখনো কারো কাছে হাত পাততে চাননি। তাঁর কবিতার বিষয়ে আবর্তিত হত সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ভাবনা থেকে।। এই ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর কলমের ভাষা হয়ে উঠতো তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর। 'ছাড়পত্র' কাব্যে তিনি আকাশের চাঁদকে পূর্ণিমার ঝলসানো রুটি বলে অভিহিত করেন। এ যেন দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে আপামর জনতার খাদ্যের আরতি। সুকান্তের কবিতার মূর্ততা আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারি। তিনি ছিলেন একজন ভালো পাঠকও, নানা বইপত্র পড়তে ভালবাসতেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর অনুরাগী ছিলেন তিনি । একবার মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হলে তিনি চলে যান সেখানে কবি গুরুকে দর্শন করতে। 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কবিতায় কবির অসাধারণ মূল্যায়ন আমাদের সকলকেই মুগ্ধ উজ্জীবিত করে। ফ্যাসিবাদ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি চরণ সেই কবিতায় উদ্ধৃতি আকারে প্রয়োগ করেন সুকান্ত।

' জানি শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস। ' রানার' কবিতায় চরম দারিদ্র পীড়িত মানুষের যন্ত্রণার কাহিনী ছন্দ রূপ লাভ করেছে। "পিঠেতে টাকার বোঝা তবুও যাবে না ছোঁয়া।" 'সিগারেট' কবিতায় দিনে দিনে তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া মানুষেরগভীর মর্ম যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। 'দেশলাই কাঠি' কবিতায় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, শহরে শহরে, মাঠে-ঘাটে সর্বত্র বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। " আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে, আমরা বেরিয়ে পড়বো ছড়িয়ে পড়বো, শহরে গঞ্জে গ্রামের দিগন্ত থেকে দিগন্তে।" নিজের বাড়ির সিঁড়িতে উঠতে উঠতে লিখে ফেললেন তার বিখ্যাত 'সিঁড়ি' কবিতা। একের পর এক সিঁড়িকে মাড়িয়ে চলে যেমন মানুষ উপরে ওঠে সমাজের ধনী বড়লোকরা গরিব জনসাধারণের রক্ত চুষে দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে ওঠে। একবার ভুলেও তারা নিচু তলার মানুষের যন্ত্রণার কথা ভাবে না। "আমরা সিঁড়ি, তোমরা আমাদের মাড়িয়ে, প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও, তারপর ফিরে ও তাকাও না পিছনে দিকে, তোমাদের পদধূলি ধন্য আমাদের বুক, পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।"

১৯৪৬ সালের ভ্রাতৃঘাতী- আত্মঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কিভাবে দুর্বল বিভ্রান্ত করেছিল তার দৃষ্টান্ত পাই সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'ঐতিহাসিক'কবিতায়

"তোমাদের ঐক্যহীন বিশৃঙ্খলা দেখে, বন্ধ হয়ে গেছে মুক্তির দোকানের ঝাঁপ।" পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ কিভাবে সব মানুষকে একইসঙ্গে চরম সংকটে ফেলে এবং সবাই ধর্ম বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে একই খাদ্যের সারিতে দাঁড়িয়ে যায় তার প্রমাণ পাই 'ঐতিহাসিক'কবিতায়। "একদিন দুর্ভিক্ষ এল, ক্ষুধার ক্ষমাহীন তাড়নায়, পাশাপাশি ঘেঁষাঘেষি সবাই দাঁড়ালে একই লাইনে, ইতর -ভদ্র হিন্দু আর মুসলমান একই বাতাসে নিলে নিঃশ্বাস।"

আজ থেকে প্রায় 75 বছর আগে কবি নির্বিচার খুন, হত্যা লীলা, শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন 'দিন বদলের পালা' কবিতায়। সারাদেশ জুড়ে এবং বাংলায় দাঙ্গা হানাহানি,খুন রাহাজানি, চরম দুর্নীতি, অনাচার যেখানে চলছে কবি সুকান্তের সেই কবিতার বাণী মনে হয় যেন আজকের দিনেও সমান প্রাসঙ্গিক।

"অনেক নিয়েছো রক্ত,দিয়েছো অনেক অত্যাচার,

আজ হোক তোমার বিচার।" আরজি করে ডাক্তারি শিক্ষারত ছাত্রী মৌমিতা দেবনাথের ধর্ষণ হয়ে খুন হয়ে যাওয়ার ঘটনা আজকে সারা বাঙালি তথা ভারতবাসী বিশ্ববাসীকে প্রতিবাদে করে তুলেছে মুখর। সবার মুখে একই আওয়াজ "উই ওয়ান্ট জাস্টিস, আমরা চাই প্রকৃত বিচার।"

শ্রমিক কৃষক সম্পদের ভান্ডার তৈরি করে অথচ তারাই থেকে যায় নানান দিক থেকে বঞ্চিত।তার ঘরে জোটে না পেটের খাবার, কেঁদে কেঁদে মরে ক্ষুধার্ত শিশু।জুটেনা মাথা গোজার ঠাই, অসুখে পায় না সামান্য চিকিৎসা। নেই কোন জীবনের নিশ্চয়তা,নারী যেন ভোগ্য পণ্য বিবেচিত হয়। তেমন চিরন্তন বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে 'প্রিয়তমাসু' কবিতায়।

" আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায় রাজ পথে পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য, নিজের ঘরে জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।"

বর্তমান বাংলায় একদিকে যেমন চলছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ছড়াছড়ি একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখার রাজনৈতিক ছলা-কলা। চলছে নির্বিচারে শিল্প কারখানা, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা, খেলা ধুলা সাহিত্য সংস্কৃতি, গণ পরিবহণ ইত্যাদি সবকিছুর বিসর্জন জলাঞ্জলি তেমনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে চলছে কিশোর যুবক-যুবতী, ছাত্র-ছাত্রীর, শ্রমিক কৃষকের জনকল্লোল সমুদ্রের উচ্ছ্বাস, বাঁধভাঙ্গা আলোড়ন, ইনসাফ যাত্রার প্রবল জনস্রোত।

তেমনি বাণী শুনতে পাই সুকান্তের 'আমরা এসেছি' কবিতায় " কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে ভেঙেছে খিল, মিছিলে আমরা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।" এমন অজস্র দৃষ্টান্ত আছে তাঁর নানা বিখ্যাত কবিতায়।

কলকাতা কে নিয়ে ছিল তাঁর কত স্বপ্ন অনুরাগ ভালোবাসা। কলকাতা তাঁর প্রেয়সী কলকাতা, তাঁর সব সময়ের সাথী। তাঁর জীবন প্রবাহ, কর্মধারা ছড়িয়ে থাকতো কলকাতার অলিতে গলিতে।তাকে নিয়ে তিনি বাঁচতে চাইতেন। সুকান্ত বিশ্বাস করতেন এদেশে বিপ্লব হবেই তাই তাঁর কন্ঠে উজ্জীবিত হতো তারুণ্যের জয়গান কৈশোরের জয়গান।আসুন সবাই নব যৌবনের দূত বা আগামী দিনের নিবেদিত প্রাণ সেনানীদের উজ্জীবিত করতে এক সাথে গাই "We shall over come, we shall over come, we shall over come someday." বা " এসো মুক্তো করো, এসো মুক্তো করো, অন্ধকারের এই দ্বার। "


শেয়ার করুন

উত্তর দিন