অভয় মুখোপাধ্যায়
২৫শে মে বাঁকুড়া জেলার দুটি লোকসভা কেন্দ্রে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই লড়াই দেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের কাছে দেশ বাঁচানোর লড়াই।
আগামী ২৫শে মে আপনার মূল্যবান ভোটটি দেওয়ার আগে বাঁকুড়ার মানুষ ভাবছেন -
বিগত দশ বছর আমাদের দেশে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার, আর আমাদের রাজ্যে চলছে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকার। গত দশ বছরে দেশের সংবিধান বিপন্ন। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির স্বার্থে। জাত-পাত ধর্ম সম্প্রদায় কে অস্থিরতা তৈরির জন্য কাজে লাগানো হচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভয়াবহ। বিশ্বজুড়ে সব থেকে বেশি গরীব, নিম্নবিত্ত মানুষ থাকেন ভারতে। ঋণশোধ করতে না পেরে শুধু ২০২২ সালে ১.৭১ লক্ষ কৃষক আত্মহত্যা করেছে, আর কর্পোরেটের ঋণমুকুব হয়েছে ১৫.২৩ লক্ষ কোটি টাকা। গত ৯ বছরে চালের দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ, ডাল ১২০ শতাংশ, দুধ ৬১ শতাংশ। ২০১৪ সালের পেট্রোলের অন্তঃশুল্ক ছিল ৯.৪৮ টাকা ও ডিজেলে ৩.৫৬ টাকা। তা আজ বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ৩২.৯৮ টাকা ও ৩১.৮৩ টাকা। গরীব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমেছে। স্বাধীনতার পর বেকারত্বের এই তীব্রতা দেখেনি দেশ। ২০২২-২৩ দেশে বেকারত্বের হার ৭.৫ শতাংশ। করোনাতে ৭০ লক্ষ মানুষের কাজ চলে গেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দপ্তরে ১০ লক্ষের বেশী শূন্যপদ। বছরে ২ কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি চমক ছাড়া কিছুই নয়। শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ চলছে। শ্রমকোডের মধ্য দিয়ে শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে সরকার। দেশে মহিলাদের অবস্থা ভয়াবহ। নারী নির্যাতনে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেশের স্থান প্রথমে। ইলেক্টোরাল বন্ডের নামে যে দুর্নীতি হয়েছে তা দেশ এমনকি দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন। এরও লভ্যাংশের অধিকাংশ তৃণমূল-বিজেপির পকেটে।
মনে পড়ে, এই বিজেপি ১৫ লক্ষ টাকা সব মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকবে বলেছিলো? কালো টাকা উদ্ধার করবে বলেছিলো? ভ্রষ্টাচার মুক্ত ভারতের কথা বলেছিলো। বাস্তবে কি হয়েছে সবাই দেখেছেন। নির্বাচনের ঠিক আগে গতবার পুলওয়ামার ঘটনা ছিলো তুরুপের তাস আর এবার তা রামমন্দির! সাধারণ মানুষের রুটি-রুজি-স্বাস্থ্য-শিক্ষা নিয়ে ওদের কোনো বক্তব্য নেই।
বিগত ১৩ বছরে বাংলার অবস্থাও শোচনীয়। তৃণমূলের সন্ত্রাসের রাজনীতি, ভোটলুঠ, মিথ্যাচার, নারী নির্যাতন, শিল্পের আকাল, বেকারত্ব, গণ- পরিবহন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ, সরকারী কোষাগারের টাকা লুঠ, ১০০ দিনের কাজের টাকা লুঠ, পঞ্চায়েত ও পৌরসভাতে ব্যাপক দুর্নীতির শিকার রাজ্যের মানুষ। বিজেপির মতো একটা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এই রবীন্দ্রনাথ নজরুলের বাংলায় জায়গা করে দিয়েছে তৃণমূল। বিজেপি-তৃণমূলের সেটিং রাজ্যের মানুষের কাছে স্পষ্ট। এই নির্বাচনে তৃণমূলের ৪২ টি প্রার্থীর মধ্যে ৩ জন বিজেপির বর্তমান বিধায়ক। ১০০ দিনের টাকা পাবার জন্য বিজেপির বিরুদ্ধে একটা মামলাও হাইর্কোটে করে না তৃণমূল সরকার। উল্টোদিকে রাজ্যে একের পর এক দুর্নীতি করেও ছাড় পাচ্ছে তৃণমূল। আর বর্তমান সময়ে রাজ্যের কী অবস্থা তার জ্বলন্ত উদাহরণ হলো সন্দেশখালি।
গত লোকসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া এবং বিষ্ণুপুর দুই কেন্দ্রে বিজেপি জয় যুক্ত হয়েছিল। বাঁকুড়া লোকসভার সাংসদ ডাঃ সুভাষ সরকার কেন্দ্রের মন্ত্রী ও ছিলেন কিন্তু বাঁকুড়া জেলার মানুষের অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। দুজন সাংসদ ই বাঁকুড়া জেলার মানুষের জন্য কোনো কাজ করেননি। এমনকি করোনা মহামারি সময়েও এই দুজন সাংসদকে মানুষের পাশে দেখা যাইনি। বাঁকুড়া জেলার জঙ্গলমহলের উন্নয়নের স্বার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ছাতনা - মুকুট মনিপুর রেলপথ। সিপিআই(এম) এর সাংসদ বাসুদেব আচারিয়ার উদ্যাগে এই কাজ শুরু হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ৮৩২ একর জমির মধ্যে ৬৩০ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল ২০০৯ সালে। ২০১৪ - ২০১৯ তৃণমূলের সাংসদ ও ২০১৯-২০২৪ বিজেপি সাংসদের আমলের এই কাজে একটুকুও অগ্ৰগতি ঘটেনি। একই ভাবে বিষ্ণুপুর তারকেশ্বর রেলপথের কাজ ও গত দশবছর ধরে থেমে আছে। এই নির্বাচনের সামনে দাঁড়িয়ে তৃণমূল বিজেপির প্রার্থীদের কাছে কোনো সদুত্তর নেই। জেলার মানুষ তৈরি হচ্ছে এর জবাব দেওয়ার জন্য। আমাদের জেলায় প্রায় ১০০ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা একশো দিনের কাজের বকেয়া পড়ে আছে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অপদার্থতার কারনে জেলার গরীব মানুষেরা এই টাকা থেকে বঞ্চিত হলো। এই নির্বাচনে এর জবাব দিতেও বাঁকুড়ার মানুষ প্রস্তুত হচ্ছেন।
জেলার ল্যাম্পসগুলো তৃণমূল সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দুপাতা ও অন্যন্য বনজ সম্পদকে ভিত্তি করে জেলার যে মানুষেরা জীবিকা অর্জন করতো তারা এখন ভয়ঙ্কর অবস্থার মুখোমুখি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে জেলায় বহু আদিবাসী বিদ্যালয় ও আদিবাসী হোস্টেল চালু হয়েছিল। বর্তমানে প্রায় সব জায়গাতে আদিবাসী হোস্টেলগুলি বন্ধ। আদিবাসী ছাত্র - ছাত্রীরা হোস্টেল গুলিতে বিনে পয়সায় থাকা ও খাওয়ার সুযোগ পেতেন। ফলে বর্তমানে বহু ছাত্র,ছাত্রী পড়াশোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে জল, জমি, জঙ্গলের অধিকার থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। জেলায় তসর ও বাবুই চাষ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলের জমি লিজ দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটদের কে। কংসাবতীর জল চাষীদের সেচের কাজে না দিয়ে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ প্রস্তুত হচ্ছেন এর বিরুদ্ধেও।
জেলার বিভিন্ন নদী থেকে বালি, মাটির নিচে কয়লা চুরি হয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে। বিষ্ণুপুর ও জঙ্গলমহলকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের যে সম্ভবনা ছিলো তারও কোনো অগ্ৰগতি ঘটেনি। জেলার কুটির শিল্প গুলি ধ্বংসের মুখে। জেলার সমস্ত চালু শিল্প ও শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলি ধ্বংসের মুখে। বিষ্ণুপুরের দ্বারিকা শিল্পাঞ্চল এখন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। কাজের তীব্র অভাব। জেলার যুবরা দলে দলে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিছু গ্ৰাম যুবক শূন্য গ্ৰামে পরিনত হয়েছে।
বিগত দশ বছরে তৃণমূল ও বিজেপি সাংসদের আমলে জেলার উন্নয়ন প্রায় স্তব্ধ। খাতড়া শহরকে পৌরসভাতে উন্নিত করা, বাঁকুড়া ও বিষ্ণুপুর হাসপাতালকে আধুনিক হাসপাতাল রুপে গড়ে তোলা, জেলায় একটি ইনডোর স্টেডিয়াম গড়ে তোলা- যা জেলার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি তা কোনো কিছুই এরা রুপায়ন করতে পারেনি।
জেলায় তৃণমূল ও বিজেপি বোঝাপড়া ও মেরুকরণের রাজনীতি ক্রমশ মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বর্তমানে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী ও সাংসদ ২০১৪ সালে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন। জেলায় তৃণমূল ও বিজেপির আঁতাত এর আগের নির্বাচন গুলিতে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন।
অন্যদিকে কংগ্ৰেস সমর্থিত বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম)-এর বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত ও বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী শীতল চন্দ্র কৈবর্ত নিবিড় প্রচারের মাধ্যমে ও বামপন্থীদের নীতির কারনে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেন। লালঝান্ডার সভা ও সমাবেশ গুলিতে সাধারণ মানুষের নজরকাড়া অংশগ্রহণ তৃণমূল ও বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ ব্যক্ত করার ইঙ্গিত।
বাঁকুড়া জেলার মানুষ চাইছেন এই আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্ৰস্থ তৃণমূল কংগ্রেস ও দেশকে ধ্বংসকারী বিজেপির বিরুদ্ধে বিকল্পের সন্ধান। চুরি, দুর্নীতি, ধর্ম, মন্দির, মসজিদ নয় - মানুষ চায় কাজ, খাদ্য, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার। অভিজ্ঞতাই জেলার মানুষকে শেখাচ্ছে বামপন্থাই বিকল্প। লাল ঝান্ডাই বিকল্প। এই নির্বাচনে জেলার মানুষের ভোট দানের মধ্য দিয়ে লালমাটির বাঁকুড়া আবার লাল হয়ে উঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।