টাকা দিন, স্বাস্থ্য নিন

বৈদূর্য বিশ্বাস

১৯৭৮ সালে ১৩৪ টি দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত কাজাখস্তানের আলমাটি (পূর্ব: Alma-Ata) শহরে একটি অঙ্গীকারে গোটা বিশ্ব চুক্তিবদ্ধ হয় যে ২০০০ সালের মধ্যে “সবার জন্য স্বাস্থ্য” প্রতিষ্ঠিত হবে (Alma-Ata Declaration,1978) । তার একটি রূপরেখাও গৃহীত হয়েছিল । যেটিতে বলা হয়, আরো প্রাথমিক কেন্দ্র ভিত্তিক চিকিৎসার প্রাধান্য বাড়াতে হবে । রোগ মোকাবিলা অবশ্যই জরুরী কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ প্রিভেনশন বা রোগ হওয়ার পূর্বেই রোগ হওয়ার কারণ গুলিকে দমন করা । কিন্তু রোগ হওয়ার মুখ্য কারণগুলি কি কি সেটা জানা খুব জরুরী।

প্রথমে জেনে নাওয়া যাক, স্বাস্থ্য কি ! শুধু শরীর সুস্থ থাকাই কি স্বাস্থ্য ? না । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, “স্বাস্থ্য হল সম্পূর্ণ শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সুস্থতার একটি অবস্থা এবং শুধুমাত্র রোগ বা দুর্বলতার অনুপস্থিতি নয়।"  তার অর্থ হলো একজন মানুষের আর্থ সামাজিক প্রতিটি অবস্থা তার স্বাস্থ্য নির্ধারণ করে ।

রুডলফ ভিরচাউকে আমরা কিন্তু ছোটবেলা থেকে কোষবিদ্যার একজন পথিকৃৎ হিসেবেই জেনেছি। কিন্তু তিনি যে সামাজিক চিকিৎসাবিদ্যার একজন রূপায়ক এটা সবাই ভুলে যায় । ১৮৪৯ সালে তিনি বলেছিলেন, “ মেডিসিন হলো একটি সমাজ বিজ্ঞানের ধারা, এবং রাজনীতি আদতে বৃহৎ পরিসরে এর ওপরেই নির্ভরশীল।”

আপনার স্বাস্থ্য কেমন হবে পুরোটাই নির্ভর করে কয়েকটি সূচকের ওপর। এগুলির মধ্যে রয়েছে :

১. অর্থনৈতিক অবস্থা

২. সামাজিক অবস্থা

৩. লিঙ্গ

৪. শিক্ষা

৫. চাকরি

৬. সামাজিক ন্যায়

৭. মানুষের মৌলিক অধিকার ইত্যাদি ।

আজকের দিনে ভারত হোক আর পশ্চিম বাংলা হোক, মানুষের চাকরি নেই, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। সাধারণ মানুষের পয়সা লুটে বড়োলোকরা আরো বড়লোক হয়েছে । মানুষ আরো গরীব হয়ে পড়ছে।  প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরে সামান্য যা উপার্জন হয় সেই টাকায় যেকোনো মানুষের পক্ষেই পরিবার চালানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

আর স্বাস্থ্য? আজকে আপনার অন্ন বস্ত্র বাসস্থান কিরকম তার ওপরেই নির্ভর করে আছে আপনার বা আপনার পরিবারের কারোর স্বাস্থ্যের অবস্থা কি হবে! ভারতবর্ষ এদিকে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তালিকায় ১১১ তম স্থানে রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষের কাছে খাবার নেই। পেটে দানা না পড়লে সবার জন্য স্বাস্থ্য কোনোদিন আমরা পৌঁছাতেও পারবো না ।

COVID-19 অতিমারীর কথা আমাদের সকলেরই মনে আছে । ভারতের পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মুহূর্তের মধ্যে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে সকলেই দেখেছি। বিশ্বে কোরোনা আক্রান্ত দেশের তালিকায় ভারত দ্বিতীয় স্থানে ছিল। মৃত্যুর তালিকায় তৃতীয়। হাসপাতালে বেড ছিল না, অক্সিজেন সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছিলো না, বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে গগনচুম্বী খরচ- এ সবই মানুষ দেখেছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দেখলে স্বাস্থ্য যেটি সকল নাগরিকের একটি সার্বিক অধিকার হওয়ার কথা, সেখানে স্বাস্থ্য আপনাকে ট্যাকের পয়সা দিয়ে কিনতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বর্তমান সময়ে নিতান্তই বাজারের পণ্য !

আবার ফিরে যাই Alma-Ata এর সেই অঙ্গীকারে। “সবার জন্য স্বাস্থ্য” কিংবা “Health for all”। রাজনীতির মাথায় যারা বসে রয়েছেন অর্থাৎ বড়লোক মালিক গোষ্ঠীর খেয়াল হয় যে চিকিৎসা এমন একটি জিনিস যেটি সবারই কোনো না কোনো পর্যায়ে দরকার হয়। অতএব এটি নিয়ে ব্যবসা করলে প্রচ্চুর মুনাফা। তখন এদের হাতের পুতুল সরকার ঘোষণা করে যে না “Health for All” নয়, “Health Coverage for All” ! মানে টা কি দাঁড়ালো? অর্থাৎ সরকার আর স্বাস্থ্য বিষয়ক ক্ষেত্রে আরো infrastructure বানানোর পেছনে খরচ করবে না। তারা একটি পরিমাণে বীমা মাধ্যমে টাকা দিয়ে দেবে । তার মধ্য দিয়ে আপনি আপনার কি চিকিৎসা করাবেন, নিজের দায়ে দেখে নিন!

আজকে একজন মানুষ যখন প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যায় তখন এই স্বাস্থ্য বিমার কাগজ জমা রাখা হয়। অনেক কম খরচে চিকিৎসা হয়ে যায় এটি সত্য কিন্তু আমরা ভেবে দেখিনা যে এই বিমার জন্য যে খরচ হচ্ছে সেটি কিন্তু সরকার নিজে থেকে দিচ্ছে না। বরঞ্চ ট্যাক্সের জন্য মানুষ যে টাকা সরকারি খাতে জমা করছে সেটি থেকেই দেওয়া হচ্ছে।

বিজেপি সরকার আয়ুষ্মান ভারত এবং তৃণমূল সরকার স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে এসেছে ভোটে জেতার হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু মজার বিষয়, চিকিৎসা পরিষেবায় সবথেকে বেশী খরচ হয় আউটডোর চিকিৎসায়। এদিকে আউটডোর চিকিৎসার কোনো খরচই বহন করে না এই বীমা প্রকল্প গুলি। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো দীর্ঘ পর্যায়ের রোগগুলির চিকিৎসা মূলত আউটডোর ব্যবস্থাতেই হয়। কিন্তু এসব কোনোটাই বীমার আওতায় আসেনা।

একটি সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতে স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্রয় করার জন্য প্রায় ৩.৫% মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যায় এবং ৫% পরিবার বিপর্যয়কর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত ব্যয়ের শিকার হয়। ব্যক্তির এই নিজস্ব খরচের ৭২% ব্যয় হয় ওষুধ কেনার জন্য। এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে যদি ওষুধ এবং আউটডোর / বহির্বিভাগ চিকিৎসা জন্য ব্যয়গুলি সরিয়ে ফেলা যায়, তবে শুধুমাত্র ০.৫% মানুষ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যয়ের কারণে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে।

গল্প এখানেই শেষ নয়, PMJAY এর প্রায় ৭৫% অর্থ বেসরকারি খাতেই খরচ হয়েছে। ভারতের মোট ১৯ লাখ বেডের ১২ লাখই বেসরকারি বেড। কেন্দ্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে খরচ বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষিতে ২% কমে গেছে। অর্থাৎ সরকার আর আপনাকে বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছেনা বরং আপনার টাকাতেই আপনাকে ফান্ড করছে। প্রতিবছর বাজেটে বরাদ্দ বাড়ে কিন্তু খরচ অর্ধেকের কম হয়। বাকি টাকা কোথায় যেতে পারে ভেবে নিন।

ওষুধের কোম্পানিগুলি যেমন ফাইজার, অ্যাস্ট্রোজেনেকা, জনসন, সিপলা সহ অন্যান্য বিগ ফার্মা কোম্পানি ওষুধের ওপর পেটেন্ট বসিয়ে বাজারে নির্দিষ্ট ওষুধের ওপর যেমন একদিকে মনোপলি/একাধিপত্য তৈরী করে ওষুধের দাম বাড়িয়েই চলেছে, অন্যদিকে COVID-19 অতিমারির সময় ৯৭% ট্যাক্সের টাকায় ভ্যাকসিন বানিয়ে ৯৪ মিলিয়ন ডলার মুনাফা করে।

এবারে ভাবুন। যে প্রতিষেধক চিকিৎসা সবথেকে জরুরী, সেটিই আপনাকে ঠিকঠাক দেওয়া হচ্ছে না। কিউবা বা চীনের অতুলনীয় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সাফল্যের পেছনে বড় কারণ হলো এই দেশগুলিতে বেশিরভাগ রোগ পূর্বেই প্রতিরোধ করা হয়। আর রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রস্তরেই সমাধান করা হয়। যেখানে ভারতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার অবস্থা নৈব নৈব চ! এখানে সরকার আপনাকে তার পুঁজিবাদী নীতির মধ্য দিয়েই বাধ্য করবে যাতে আপনি আরো বেশী করে মুক্ত বাজার থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা পকেটের টাকা খরচ করে কিনতে বাধ্য হন।

তাই কয়েকটি দাবিতে আন্দোলনে আমাদের অংশ নিতে হবে।

১. ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ারের দাবিতে অনড় থাকতে হবে। কভারেজ না।

২. যার কাছে বেশী মূলধন সে বেশী চিকিৎসা পাবে এটি খুবই অবৈজ্ঞানিক ও নৃশংস। সকলের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিতে হবে।

৩. স্বাস্থ্যখাতে আরো বেশি বাজেট বাড়াতে হবে।

৪. প্রাথমিক বা প্রতিরোধমূলক চিকিৎসায় মূল স্বাস্থ্যখাতের খরচের ৭০% ন্যূনতম খরচ করতে হবে।

৫. আরো প্রয়োজনীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করতে হবে।

সহজ, সোজা কথায়- স্বাস্থ্যপরিষেবা নিয়ে ব্যবসার ঘৃণ্য চক্রান্তকে রুখে দিন।

লেখক কলকাতায় মেডিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষার্থী


শেয়ার করুন

উত্তর দিন