প্রাককথন
বাম মনোভাবাপন্ন শিল্পীরা সরাসরি পৌঁছে গেছিলেন সন্দেশখালি। সেই দলে ছিলেন বাদশা মৈত্র, দেবদূত ঘোষ, সৌরভ পালোধী, জয়রাজ ভট্টাচার্যেরা। তারা সন্দেশখালির মানুষের সাথে কথা বলেছেন, নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছেন সেখানকার পরিস্থিতি। সন্দেশখালি থেকে ফিরে কলকাতায় অন্যান্য শিল্পীদের সাথে সমবেত হয়ে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে তারা ইতিমধ্যেই নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সেই দলেরই একজন প্রতিনিধি জয়রাজ ভট্টাচার্যের সাথে রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। তিনি নিজের অনুভব লিখে জানাবেন বলেন, আমরা কাজটা দ্রুত করতে চাওয়ায় সেই লেখা ছোট আকারেই সম্পন্ন হয়।
শিল্পী পাতা পড়ার শব্দে কেঁপে উঠবেন- এমনটাই দস্তুর। আমরা মনে করি সন্দেশখালিতে যা ঘটেছে তাতে শুধু শিল্পীরা নন, যেকোনো মানুষই শিউরে উঠবেন। এমন ভাবনা থেকেই আজকের প্রতিবেদন।
এই লেখায় জয়রাজ নিজের মতামত জানিয়েছেন। প্রতিবেদনের শিরোনাম ওয়েবডেস্কের নিজস্ব।
জয়রাজ ভট্টাচার্য
মুসলমান মানুষদের সম্পর্কে মমতা বলেছিলেন- ❝যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি সহ্য করতে হয়।❞ প্রশ্ন হচ্ছে, যে গরু এখন আর দুধ দেয় না, তার সম্পর্কে গোয়ালিনীর কী মনোভাব? তার লাথি সহ্য করা দূরের কথা, তাকে খাওয়ার জন্য খড়, খোলটুকুও কি আর দেওয়া হয়? খাটালে কি তারজন্য আর জায়গা আছে? মমতা আজ যাকে এসেট মনে করছেন, কাল ব্যবহার করে ফেলার পর, সে লায়াবিলিটি হয়ে ওঠে। লায়াবিলিটি মমতা কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলেন। এই যে পার্থ বালু অনুব্রত এদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা ওদের কোনও নৈতিক স্ট্যাণ্ড নয়, ❝কাজের বেলা কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি❞ স্ট্যাণ্ড। তাপস পালের স্ত্রী জানাচ্ছেন- মমতা এখন ওঁদের দিকে ফিরেও তাকান না। এই যে মমতা এখন ওঁদের সংশ্রব এড়িয়ে যাচ্ছেন, তা কিন্তু তাপস পাল যখন ❝ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেবো❞ বলেছিলেন তখন সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। এখন তাপস পাল আর ডিভিডেন্ড দেন না, তাই ওঁদের দিকে ফিরেও তাকান না। এই একই পরিনতি হবে শেখ শাহজাহানের। শাহজাহানকে এখনও এসেট মনে করছেন, কারণ শাহজাহান নামের গরু (যতই বাঘ বলা হোক) এখনো দুধ দিচ্ছে।
যতবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমেছে, যশ হোক, আম্ফান হোক, এই এলাকায় ত্রাণ নিয়ে গেছি। প্রতিবার একই অভিজ্ঞতা। গ্রামের মানুষ যখন বাঁধ মেরামত করতে হাত লাগিয়েছে, তখন তৃণমূলের দুস্কৃতিরা ঝড় আসার আগেই উদ্যোগ নিয়েছে কোথায় কোথায় বাঁধ কেটে দেওয়া যায়! নোনাজল ঢুকিয়ে ফসলি উর্বর জমিকে ভেড়ি বানিয়ে নেওয়া যায়। এই ব্যবসা বহুমুখী। চাষের জমিকে মাছের ভেড়ি বানিয়ে নেওয়া, সরকারের থেকে ক্ষতিপূরণ নেওয়া, যে বাঁধ নিজে কেটেছি, তা মেরামতি করার জন্য টাকা নেওয়া, এবং বছরের পর বছর ইউনেস্কোর সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের টাকা গায়েব করা।
শোনা যাচ্ছে- ইউনেস্কো মমতার নতুন ফরেন গরু, যে প্রচুর দুধ দিচ্ছে। সুন্দরবনের একই কুমিরছানা বারবার দেখানো যাচ্ছে, ম্যানগ্রোভ বাঁধের কুমিরছানাও দেখানো যাচ্ছে। সন্দেশখালি সহ দুই চব্বিশ পরগণার সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের টাকা দেদার চুরি হয়। কিন্তু এর ফলে শুধু টাকা চুরি নয়, সুন্দরবনের চরিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বদলে যাচ্ছে, প্রতি সাইক্লোনেই মানুষকে বিপন্ন হয়ে ত্রিপল খাটিয়ে ভাঙাচোরা বাঁধের ওপর থাকতে হচ্ছে। সেই ত্রিপলও তৃণমূলের লোকেরা চুরি করে বড়বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। একটা সিস্টেম্যাটিক অপরাধচক্র তৈরি করা গেছে, যার পার্ট প্রশাসন নিজে।
ধর্ষণের অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে আগেও উঠেছে, কিন্তু সন্দেশখালির ঘটনায় আমাদের স্তম্ভিত হতে হয়। বছরের পর বছর গ্যাং রেপের একটা ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে! নীলকর সাহেবরা যেমন নীলকুঠিতে ভারতীয় কৃষক পরিবারের মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে যেত, সেরকমই তৃণমূলের পার্টি অফিসে নিয়ে যাওয়া হতো এলাকার মহিলাদের। তাঁদের জমি লুঠ করা হয়েছে, টাকা লুঠ করা হয়েছে, কিন্তু এখন কথা বলার সুযোগ পেয়ে সেই প্রান্তিক কৃষিজীবী মহিলারা জানাচ্ছেন- ওখানকার মহিলাদের ইজ্জত লুঠ করা হয়েছে। আজ ওঁরা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার মহিলাদের এই করুণ গাথা সুন্দরবনের ভাঙাচোরা নদীবাঁধে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শুনে এলাম। ওঁরা তেভাগায় লড়েছেন, জলে কুমির ডাঙায় বাঘের সাথে লড়াই করে শতাব্দীর পর শতাব্দী সভ্যতা গড়ে তুলেছেন, আজ চারটে অসভ্য তৃণমূলি জঙ্গলরাজ কায়েম করে পার পেয়ে যাবে, সেটা আর হচ্ছে না। জোট বেঁধেছে সন্দেশখালির মহিলারা। মানুষের মত দেখতে অথচ স্বভাবে জানোয়ার তৃণমূলের বাহিনী নিস্তার পাবে না।
সাধারণ মানুষের লড়াইতে সমস্ত শক্তিকে সংহত করে বামপন্থীদের থাকতে হবে। বিজেপি ফায়দা তুলতে যাকে পাঠাচ্ছে, সেই শুভেন্দু অধিকারী আসলে শেখ শাহজাহানের নেতা। এখানে ধর্ম নির্বিশেষে গরীব মানুষ নিপীড়নের শিকার হয়েছে। বিজেপি ধর্ম, জাতপাতের কথা তুলে মানুষকে বিভাজিত করতে চাইছে। ওখানের সাধারণ মানুষ এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধেও এককাট্টা। বাংলার অসাম্প্রদায়িক কৃষক বিদ্রোহের ঐতিহ্যকে সযত্নে রক্ষা করা আমাদের এই মুহূর্তের কর্তব্য।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া