শরৎ বসুর ‘মাস্টারবাবু’ সঙ্ঘের চোখে কে? চন্দন দাস

‘গভীর শ্রদ্ধার উপহার’ একটি সুটকেসে বয়ে নিয়ে গেছিলেন শরৎচন্দ্র বসু— কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে। ১৯৩১সাল।
কী ছিল সেই ‘গভীর শ্রদ্ধার উপহার’? ছিল ৪টি টিএনটি বোমা এবং দু’ হাজার টাকা। সেই ‘উপহার’ অর্দ্ধেন্দু গুহর হাতে দিয়ে শরৎচন্দ্র বসু বলেছিলেন,‘‘মাস্টারবাবুকে দিও। তাঁকে বলো, আমার প্রস্তাবে যে জবাব তিনি দিয়েছেন তার উত্তরে এ হচ্ছে তাঁকে আমার গভীর শ্রদ্ধার উপহার।’’
‘মাস্টারবাবু’ তখন আত্মগোপনে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কেঁপে গেছে। ভারতের তৎকালীন সচিব স্যার স্যামুয়েল হোরের কথায়,‘‘ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন জোয়ারের সূচনা হয়েছে ১৯৩০ সালের চট্টগ্রাম বিদ্রোহের সময় থেকে।’’
শরৎচন্দ্র বসুর ‘মাস্টারবাবু’ আমাদের সকলের মাস্টারদা— সূর্য সেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য তখন ব্রিটিশ মরীয়া। তিনি আত্মগোপনে ঘুরে বেরাচ্ছেন গ্রামগুলিতে। তখন তাঁর কাছে বার্তা পৌঁছল শরৎচন্দ্র বসুর। বসু সেই সময় কংগ্রেসের সর্বভারতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য। বিপ্লবী অর্দ্ধেন্দু গুহ মারফত শরৎচন্দ্র বসু জানালেন,‘মাস্টারবাবু’কে নিরাপদে বিদেশে আত্মগোপনের সুযোগ করে দিতে পারেন তিনি। জবাব দিয়েছিলেন ‘মাস্টারবাবু’। অর্দ্ধেন্দু গুহকে তিনি জানান,‘‘শরৎবাবুকে আমার সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ে বলবে এখনও আমাদের লক্ষ্য অর্জনের বিলম্ব আছে। এই চট্টগ্রামেই আমি এই পর্যন্ত কুড়িজন সাথীকে দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গ করেছি। আরও কতজনকে করতে হবে জানি না। এই অবস্থায় আমার কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রাম ছেড়ে নিজের নিরাপত্তার জন্য অন্য কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এখানে আমাকে সংগ্রাম করে যেতে হবে।’’
এমনই ছিলেন তিনি— অকুতোভয়, দৃঢ় এবং অবিচল দেশপ্রেমিক। বিনায়ক সাভারকারের মত মুচলেকা তো দূরের কথা, লড়াইয়ের সময়ে সঙ্গীদের রেখে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না তিনি। ১৯৩৪-র ১২জানুয়ারি— অর্থাৎ নব্বই বছর আগে তাঁকে ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

শরৎচন্দ্র বসুর


সেই তিনি কিংবা তাঁর মত মানুষকে কী চোখে দেখে ভারতের বর্তমান শাসক দলের নেতারা? ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ নরেন্দ্র মোদীদের কাছে অকাট্য। বইয়ের লেখক তাঁদের ‘গুরুজী’, আরএসএস-র দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার। বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রসঙ্গে ১৯৩৭-৩৮—এ গোলওয়ালকার লিখছেন,‘‘শুধুমাত্র সেই আন্দোলনগুলিই সত্যিকারের ‘জাতীয়’ যেগুলি বর্তমান অসাড়তা থেকে হিন্দু ধারণার পুনর্গঠন, পুনর্জাগরণ এবং মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত। তারাই জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক, যারা, হিন্দু জাতিকে এবং রাষ্ট্রকে হৃদয় দিয়ে গৌরবান্বিত করার উদ্দীপনায় কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন এবং লক্ষ্যপূরণে সংগ্রাম করছেন। বাকি সবাই হয় জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতক অথবা শত্রু, অথবা, দাতব্য ধারণার বশবর্তী, বোকা।’’
সূর্য সেন তাহলে কে? বেইমান, জাতীয় স্বার্থের শত্রু নাকি বোকা?
সূর্য সেন ‘হিন্দু জাতিকে এবং রাষ্ট্রকে’ গৌরবান্বিত করার কোনও কাজ করেননি। মাস্টারদা নাস্তিক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর সংগঠনে, সংবিধানে, তৎপরতা, ঘোষণায়— কোথাও হিন্দু পুনর্জাগরণের কোনও অঙ্গীকার নেই।


১৯১৮-তে মাস্টারদা এবং তাঁর সহযোগীরা একটি সংবিধান তৈরি করেন দলের। সঙ্গীদের মত নিয়ে সংবিধানটি লিখেছিলেন অনুরূপচন্দ্র সেন। সেই সংবিধানে ধর্মীয় ভাবাবেগের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। যে বিপ্লবী পরিষদ এই সংবিধান রচনা করেছিল, তার প্রথম পাঁচজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হলেন— সূর্য সেন, অনুরূপচন্দ্র সেন, নগেন্দ্রনাথ সেন তথা জুলু সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী এবং চারুবিকাশ দত্ত। প্রথম সারির সদস্যরা ছিলেন— আসরাফউদ্দিন, নির্মল সেন, প্রমোদরঞ্জন চৌধুরি, নন্দলাল সিংহ, অবনী ভট্টাচার্য তথা উপেনদা, অনন্তলাল সিংহ এবং গণেশ ঘোষ। প্রত্যেককে শপথ নিতে হয়েছিল। কী ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন? গীতা নয়— তাঁরা গোপন সেই সংবিধান ছুঁয়ে শপথ নেন বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার।
১৮ এপ্রিল, ১৯৩০-এ চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের সোচ্চার ঘোষণায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভিত কেঁপে উঠল। নতুন পথ দেখায় সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখা। অস্ত্রাগারের বিরাট লোহার গেট দেওয়াল থেকে ভেঙে ধসিয়ে দেওয়ার পর কী স্লোগান উঠেছিল? ১৯৭১-র মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পূর্ণেন্দু দস্তিদারের অভিজ্ঞতায়,‘‘…উল্লসিত বিপ্লবীদের গগনবিদারী ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ও ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে চট্টগ্রামের নৈশ-আকাশ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে।’’
এই দুটি স্লোগান, একই সঙ্গে, বারবার আমরা উচ্চারিত হতে দেখব ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির অভিযানে।
আর কী ছিল সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর গৌরব? সোফিয়ার কথা বলা যাক।
অনন্ত সিংহ যাঁকে আজীবন ভালোবেসেছেন তাঁর নাম সোফিয়া। অনন্ত সিংহকে যখন চট্টগ্রাম পুলিশের ইনস্পেক্টর প্রফুল্ল রায় গ্রেপ্তার করেন, তখন প্রতিদিন আল্লার কাছে সোফিয়া প্রার্থনা করতেন অনন্ত সিংহর মুক্তি। তবে জীবনে কখনও সোফিয়া-অনন্ত সিংহর কথা হয়নি। সোফিয়ার বাবা ছিলেন হানিফ মিঞা। হানিফ মিঞা টেলিফোন বিভাগের কর্মী ছিলেন। তাঁর কাছে পিস্তল এবং বোমার সরঞ্জাম লুকিয়ে রাখতেন অনন্ত সিংহ। হানিফ মিঞার বাড়িতে লুকিয়ে রাখা পিস্তল দিয়েই ইনস্পেক্টর প্রফুল্লকে মেরেছিলেন আর এক বিপ্লবী প্রেমানন্দ।

সোফিয়ার প্রতি অনন্ত সিংহর অপার মুগ্ধতার কথা ছাড়া এই বিবরণের সব কিছুই জানতেন মাস্টারদা। মাস্টারদার অনুমতি ছাড়া কিছুই হত না। তবে একা কোনও সিদ্ধান্ত সূর্য সেন নিতেন না। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির পরিচালন পদ্ধতি অনুসারে সম্মিলিত আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত।
ঘটনার বিবরণ দিচ্ছি কেন? ঘটনার একটি সুবিধা আছে। সত্যকে অনেক সহজে সে হাজির করতে পারে। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহে চট্টগ্রামের সব ধর্মের, জাতের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল— প্রত্যক্ষভাবে, অথবা পরোক্ষে।
গ্রামের গরিবদের মধ্যে চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগ্রামীদের দুর্দান্ত প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক বিরল উপাদান। এই ক্ষেত্রে জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধে অম্বিকা চক্রবর্তীর জীবনের ঘটনা একটি প্রমাণ।


জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ ২২ এপ্রিল। ১২জন শহীদ হন।


জালালাবাদ পাহাড়ের যুদ্ধ ২২ এপ্রিল। ১২জন শহীদ হন। কিন্তু ঘটনার কয়েকদিন পর পর্যন্ত সংখ্যাটি ছিল ১৩। কারণ ব্রিটিশদের পুলিশ মনে করেছিল অম্বিকা চক্রবর্তী মারা গেছেন। কিন্তু অম্বিকা চক্রবর্তীর সেদিন মৃত্যু হয়নি।
গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত, অচেতন অম্বিকা চক্রবর্তী মৃতবৎ পড়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর দেখেন তাঁর সহযোদ্ধাদের দেহ পড়ে আছে। দেখতে পান ব্রিটিশ সৈন্য, যারা আগের দিন হেরে গেছিল, এবার ফিরে আসছে। অম্বিকা চক্রবর্তী বিপদ বুঝে নিজেকে ঢালে গড়িয়ে দেন। তখনও প্রাণ থাকা মতি কানুনগো এবং অর্ধেন্দু দস্তিদারকে সৈন্যদের গুলি করতে দেখেন অম্বিকা চক্রবর্তী।
বিকালে এক গ্রামবাসী অম্বিকা চক্রবর্তীকে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। সেই যুবক মুসলমান ছিলেন। অম্বিকা চক্রবর্তীর লেখা অনুসারে সব ঘটনা জানা সত্ত্বেও সেই যুবক,‘‘পনেরো দিন ধরে সে নানাভাবে আমার শুশ্রূষা করে এবং পরে আমাকে কালুরঘাটের কাছে নিয়ে গোপনে সাম্পানে তুলে দেয়। তখনও আমার গুলিবিদ্ধ অবস্থা। সাম্পানের মাঝির সাহায্যে আমি গ্রাম্য কৃষক আমজাদ আলির বাড়িতে গিয়ে উঠি। তার সঙ্গে পূর্বেই আমার পরিচয় ছিল। সে নিজে ও তার এগারো বছরের ছেলে হোসেন আলির নিকট আমি যে স্নেহ, ভালোবাসা, দরদ ও আশ্রয় পেয়েছি, তা আমার আমরণ স্মরণ থাকবে। বিশেষত ঐ দিনের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী বর্বরতার তাণ্ডবলীলার মধ্যে, আমার গ্রেপ্তারের জন্য ব্রিটিশ সরকার যখন ৫০০০ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সেই লোভ আর সব বিপদকে তুচ্ছ করে দীর্ঘ ২৫দিন সে আমাকে আশ্রয় দেয়। তার পর্দানসীন স্ত্রী আমার সামনে পর্দা খুলে দিয়ে নিজের ছেলের মতো আমাকে দু’বেলা রেঁধে খাওয়াতেন এবং পরম যত্নে আমার সব কাজ করতেন।’’
যুব বিদ্রোহের পর সূর্য সেন যখন আত্মগোপন করে আছেন, তখনও তাঁকে গরিব গ্রামবাসীদের রক্ষা করার একাধিক ঘটনা আছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মী কামালউদ্দিন যুব বিদ্রোহের সেনানী বিধুভূষণ সেনকে জানিয়েছিলেন যে, পুলিশ কানুনগো পাড়া ঘিরে ফেলার পর কামালউদ্দিনের পরিবার তাঁদের উঠোনের বাঁধানো কবরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন মাস্টারদাকে। উপরে তাঁর নানি চাটাই পেতে বসে ঝিমোতে শুরু করেন। পুলিশ ঢুকে খানাতল্লাশি করে এবং ব্যর্থ হয়। কারণ তারা ভাবতে পারেনি সূর্য সেনের মতো এক হিন্দুকে নিজেদের কবরে ঢুকিয়ে দিতে পারে গ্রামীণ মুসলমান!


শেয়ার করুন

উত্তর দিন