সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
সময়টা ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বিনা বিচারে তিন বছরের জন্য পূর্ব সাইবেরিয়ায় শাস্তি স্বরূপ পাঠানো হলো ২৭ বছরের যুবক ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন’কে। কারণ? জার শাসিত রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনে মার্কসবাদ প্রচার ও পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে তৎকালীন বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কাজ তিনি করেছিলেন। তাই দেশে ফিরতেই গ্রেপ্তার ও বিনা বিচারে সাইবেরিয়ায় তাকে পাঠানো হয়।
সেখানে যখন তিনি নির্বাসনে; তখন ১৮৯৮ সালের পয়লা মার্চ (আধুনিক হিসেবে ১৩ই মার্চ) বর্তমান বেলারুশের মিনস্ক শহরের গোপন সভায় মিলিত হয় একাধিক সংগঠন। এর মধ্যে লেনিন ও মার্তভের সেন্ট পিটর্সবার্গের লীগ অফ ইমন্সিপিয়েশন অফ দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস (১৮৮৩ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ইমানসিপিয়েশন অফ লেবার গোষ্ঠীর দেশস্থ শাখা), ইড্ডিশ (পশ্চিম জার্মানীয় ভাষাগোষ্ঠীর ইহুদী ধর্মাবলম্বী ভাষা) ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের জেনারেল জিউইস লেবার বুন্ড, কিয়েভের রাবোচায়া গেজেটা নামক পত্রিকার সমাজ গণতন্ত্রীরা, মস্কো ও নিপ্রোর (Dnipro; পুরোনো ইয়েকাতেরিনাস্লোভা শহর, বর্তমান ইউক্রেনে অবস্থিত) সমাজ গণতন্ত্রীদের সংগঠন ছিল। তৈরী হলো রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (RSDLP)।
রাদচেনকো, এইদেলম্যান ও আর্কাদি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু কাজকর্ম শুরু করার আগেই সবাই গ্রেপ্তার হলেন।
লেনিন তখনও সাইবেরিয়ায়। অবশ্য সব খবরই রাখতেন। এমনকি বার্নস্টাইনের শোধনবাদী তত্বেরও। একই সঙ্গে বিরক্ত হতেন কাউৎস্কির উচ্চবাচ্য না দেখে, আবার প্লেখানভকে চিঠিও লিখতেন এর প্রতিবাদে কলম ধরতে। ইতিমধ্যে ১৮৯৮ সালে সাইবেরিয়ায় এসে পৌঁছান নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া। ১৯০০ সালে লেনিনের মুক্তি হলে লেনিন স্কোভ (PSkov) শহরে চলে যান। এখান থেকেই তিনি অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন একটি দেশজোড়া রাজনৈতিক পত্রিকা তৈরীর।
জুলাই মাসে তিনি চলে যান সুইজারল্যান্ডে। জার্মানিতেও যান। সেখানে প্লেখানভ, পত্রেসভ ও অ্যাক্সেলরদকে রাশিয়ার তৎকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা দেন এবং প্রস্তাব করেন পত্রিকার বিষয়ে। আগস্ট মাসের ২৪ তারিখে জেনেভার সুইস শহর ক্রসিয়েরে সভা হয় পত্রিকা নিয়ে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে মিউনিখ শহর থেকে পত্রিকা প্রকাশ হবে। সেখানে লেনিন পৌঁছে যান সেপ্টেম্বর মাসে। মেয়ার ছদ্মনামে থাকতেন। অতঃপর পয়লা ডিসেম্বর (কারোর কারোর মতে ১১) লিপজিক থেকে প্রকাশিত হলো ‘ ইস্ক্রা’- (স্ফুলিঙ্গ)। এটাই ছিল রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির মুখপত্র। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, গ্রেগরি প্লেখানোভ, ভেরা জাসুলিচ, পাভেল আক্সেলরদ, জুলিয়াস মার্তভ, ভ্লাদিমির লেনিন, আলেকজান্দ্র পত্রেসভ ও দমিত্রি ইলিচ (লেনিনের ভাই)। যদিও প্রথম দিকে এই পত্রিকা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন লেনিন। ক্রুপস্কায়ার মতে পত্রিকা যে সংগঠন গড়তে ভূমিকা নিতে পারে সেটা একমাত্র লেনিন ছাড়া কেউই ভাবেননি। ভেরা জাসুলিচ তো এই নিয়ে রীতিমত ঠাট্টা করতেন।
প্রথম সংখ্যায় লেনিনের একটি লেখা ছিল চীনের বক্সার বিদ্রোহে ইউরোপীয় শক্তির কার্যকলাপ নিয়ে।
প্রথম দিকের সংখ্যায় লেনিন একা নন, রোজা লাক্সেমবার্গ, গ্রেগরি প্লেখানভ, কার্ল কাউৎস্কি, লিও ত্রৎস্কি এমন সকলেই লিখতেন।
এই সেই পত্রিকা যেখানে ভলগা নদীর নামে ভলগিনিন ছদ্মনাম নেওয়া প্লেখানভ’কে দেখে ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ছদ্মনাম নেন লেনিন (লেনা নদীর নাম থেকে নেওয়া)। এভাবেই স্টেলা নদীর নাম থেকে একসময় জোসেফ যুগাশিভিলি ভিসিরাওনয়ভিচ নাম নেন স্তালিন।
ব্যভেরিয়া পুলিশের অতি সক্রিয়তা ইস্ক্রার সংগঠকদের বাধ্য করে লিপজিগ ছাড়াও মিউনিখ ও জেনেভা’তে পত্রিকা কেন্দ্র প্রতিস্থাপন করতে। এমনকি লন্ডনে থাকার সময় বর্তমানে যেখানে মার্কস মেমোরিয়াল লাইব্রেরী অবস্থিত সেখান থেকে ইস্ক্রার সম্পাদনার কাজ চালাতেন।
রাশিয়ায় গোপনে এই পত্রিকা ছড়ানো হতো। প্রায় ৮০০০ সংখ্যা প্রকাশ হতো যা হাতে হাতে কত জনের কাছে পৌঁছত বলা মুশকিল। তবে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের আগে নিশ্চিতভাবে RSDLP কে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না।
প্লেখানভ দীর্ঘদিন রাশিয়ার বাইরে থাকায় ক্রমাগত পরিবর্ত পরিস্থিতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হন। এই সমস্যা প্রায় সবার ছিল। যার স্বাভাবিক ফল ছিল ইস্ক্রা পত্রিকার পত্রিকার পরিচালনায় সমস্যা। এই সমস্যা চরম আকার ধারণ করে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস আহ্বানের প্রাক পর্বে। প্রায় কেউই লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করতে পারেননি। যদিও সবাই যে প্লেখানভের সঙ্গে একমত ছিলেন তা নয়। জাসুলিচ প্লেখানভের সেই প্রথম বিরোধিতা করলেও মুখ খোলেননি খুব বেশী। সমস্যা আপাতত মিটলেও দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসে (১৯০২) গুরুতর আকার ধারণ করে। ৪৯টি সংখ্যা লেনিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হওয়ার পরে ৫০ তম সংখ্যা দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেসের পরে মেনশেভিকদের হাতে চলে যায়। ১৯০৫ এর পরে পত্রিকা বিলুপ্ত হয়।
গোপনে পত্রিকা পাঠানো, অসম্ভব অর্থ খরচ করে পত্রিকা পরিবহন করা সত্বেও ইস্ক্রা ছিল পার্টির একমাত্র প্রচার মাধ্যম। সমাজ পরিবর্তনের সংগঠন হিসেবে পার্টি এবং পার্টির কথা, শ্রমিকদের কথা প্রচারের একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ইস্ক্রা ছিল লেনিনের জীবন। ইস্ক্রা হয়তো সফল হয়নি, কিন্তু যে স্ফুলিঙ্গ সে ছড়িয়ে ছিল, তা পরবর্তী ১২৩ বছর ধরে সারা পৃথিবীর সম্পত্তির তল্পিবাহকদের ত্রাস হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বস্তিতে, কলোনিতে, শ্রমিক মহল্লায়, কারখানার গেটে, শ্রমিকের হাতুড়িতে, কৃষকের কাস্তেতে, ক্ষেতে, খামারে, স্কুলে, কলেজে - লাল পতাকা ও মেহনতীর সাহিত্যে। একে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে ততদিন যতদিন না মেহনতীর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
তথ্যসূত্রঃ
(১) Rice, Christopher (1990). Lenin: Portrait of a Professional Revolutionary. London: Cassell. p.53
(২) Haimson, Leopold (1987). The Making of Three Russian Revolutionaries, Cambridge University Press, p.461
(৩) ed. Mendelsohn, Ezra (1997). Essential Papers on Jews and the Left, New York University Press, p.321
(৪) Israel Getzler. Martov (1967): A Political Biography of a Russian Social Democrat, Cambridge University Press, Op.cit., p.30
(৫) ed. Robert V. Daniels et al. A Documentary History of Communism in Russia: From Lenin to Gorbachev, University of Vermont, Published by University Press of New England, 1993, p.4
(৬) Woods, Alan (3 March 2017) [First published 1999]. "History of the Bolshevik Party: Bolshevism – The Road to Revolution". In Defence of Marxism. International Marxist Tendency. Retrieved 12 March 2019.
(৭) Fischer, Louis (1964). The Life of Lenin. London: Weidenfeld and Nicolson, p.33
(৮) ক্রুপস্কায়া, নাদেঝদা কনস্তান্তিনোভা, স্মৃতিতে লেনিন (ভাষান্তর: সৌমেন মৌলিক), নব পরিচয় প্রকাশনা, কলকাতা, ২০২৩, পৃষ্ঠা ৩১
(৯) পূর্বোক্ত; পৃষ্ঠা ৩১
(১০) The War in China, Lenin Collected Works, Progress Publishers, 1964, Moscow, Volume 4, pp. 372-377
(১১) Fischer, Louis (1964). The Life of Lenin. London: Weidenfeld and Nicolson, pp.3-5
(১২) Ibid, pp. 38-39