EMS Cover

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে রুশ বিপ্লবের প্রভাব

ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ

অন্যান্য উপনিবেশ, আধা-উপনিবেশ ও নির্ভরশীল দেশের মতোই ভারতেও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উপর মহান অক্টোবর বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া সাথে সাথেই অনুভূত হয়েছিল। যেহেতু এই আন্দোলন ইতিমধ্যেই কয়েকটি ধাপ পর পর পেরিয়ে এসেছিল, তাই এর নেতৃত্বকারী অংশ এই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাকে সাদরে গ্রহন করেছিল।

জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়:

ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে রাজন্যবর্গ, যারা অঞ্চলের পর অঞ্চলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল, এবং সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত জমির মালিক অভিজাত সম্প্রদায় এক সাথে মিলে নিপীড়িত জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত্ত বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দিয়েছিল । এদের মধ্যে যে গোষ্ঠীটি ছিল সর্ব্ববৃহৎ এবং যাদের কেন্দ্র ছিল উত্তর ভারতে মোগল সম্রাটদের রাজধানী দিল্লীতে তারা যোগ দিয়েছিল সর্বশেষে। অংশগ্রহণকারীদের অনন্য সাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন সত্ত্বেও এই সংগ্রাম পরাস্ত হয়েছিল।

এরপর আন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন এক শ্রেণী উদীয়মান বুর্জোয়ারা। বৃটিশদের অধীনে লালিত-পালিত নতুন বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায়, বৃটিশ শাসন নীতির নির্ঘুম সমালোচনা করতো এবং এভাবেই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেছিল। দাবীর ক্ষেত্রে নম্র, এবং অস্তিত্বের দিক দিয়ে “মহামহিম মহারাণীর একান্ত অনুগত প্রজা” এই সম্প্রদায়, এতদসত্ত্বেও, ভারতকে একটি উদার ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার উপযোগী এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনে আগ্রহী ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নামক দেশজোড়া সংগঠনে নিজেদের সংগঠিত করলো।

যারা নিজেদের নরমপন্থী বলে দাবী করতো তাদেরই দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত সংগঠনটির জন্মের দুই দশকের মধ্যেই সাধারণ সদস্যদের মধ্যে উদ্দীপনা সঞ্চারিত হলো। “আবেদন-নিবেদন”-এর রাজনীতির বিপরীতে “জঙ্গী” রাজনীতির প্রবর্ত্তক লেনিনের লেখা “বিশ্ব রাজনীতির অগ্নিময় বিষয় বস্তু” নামক প্রবন্ধে যেমনটি উল্লেখ আছে, সেই রকম এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও এক নতুন প্রজন্ম রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিল।

নব্য বিপ্লবী গোষ্ঠী:

সাধারণ সদস্যরা আরও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েই ক্ষান্ত হলো না, তারা নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে শুরু করলো । নতুন প্রজন্মের কাছে বোমার ও রিভলভারের উপর অন্ধ বিশ্বাসটিই গ্রহণযোগ্য হলো। এরা নিজেদের বিপ্লবী গোষ্ঠীতে সংঘবদ্ধ করতে লাগলো এবং শাসকদের ব্যক্তি বিশেষকে সশস্ত্র আক্রমণ করতে লাগলো। ১৮৫০-এর দশকের মধ্যবর্তী সময়ে আন্দোলনের আগের যে পর্যায় শেষ হয়েছে তাতে অংশগ্রহণকারীদের নির্মম হত্যার পর এদের মধ্যে থেকেই প্রথম প্রজন্মের শহীদরা দেখা দিল।

এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলিতে এক ব্যাপক বিপ্লবী উদ্দীপনা দেখা দিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়ে বিপ্লবীদের মধ্যে আরও বেশী তৎপরতা দেখা গেল । তারা ইউরোপে ব্রিটেনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানীর সাথে যোগাযোগ করলো এবং বার্লিন ভারতীয় প্রবাসী বিপ্লবীদের সংগঠিত তৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হলো । আমেরিকা এবং অন্যান্য দেশ থেকে সংগৃহীত অস্ত্রের সাহায্যে দেশ জোড়া বিদ্রোহের প্রস্তুতি দেশের অভ্যন্তরে এবং প্রবাসে করা হলো। সুসংগঠিত হওয়া সত্ত্বেও ১৮৫০-এর দশকের মধ্যবর্তী পূর্বেকার প্রচেষ্টার মতো এই উদ্যোগও ব্যর্থ হলো ।

অক্টোবর বিপ্লবের প্রেরণা:

এই রকমের এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতীয় বিপ্লবীরা পৃথিবীর প্রথমতম শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের জন্মদাতা অক্টোবর বিপ্লবের কথা শুনলো। এই ঘটনাকে অভিনন্দন জানালেন তিলকের মতো রাজনৈতিক নেতারা এবং (রবীন্দ্রনাথ ) ঠাকুরের মতো শিক্ষিত ব্যক্তিরা। যেসব তরুণ বিপ্লবীরা ইতিমধ্যেই জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে আত্মবলিদানকারী যোদ্ধা হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলো তারা বিশ্ববিপ্লবের এই নতুন কেন্দ্রবিন্দুর উদ্ভব থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করলো। এদের মধ্যে অনেকেই হিমালয়ের কষ্টকর পথ অতিক্রম করে বিপ্লবের নতুন দেশে উপস্থিত হলো। ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে আগত এই সব বিপ্লবীদের প্রতি লেনিন ও তার পরিচালিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক বিশেষ মনোনিবেশ করে তাদের সাহায্য করলো ।

মস্কোতে উপস্থিত ভারতীয় বিপ্লবীদের মধ্যে থেকে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর সোভিয়েত উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে সি পি আই নামে এক সংগঠন গড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তুর্কিস্তান ব্যুরো কর্তৃক ২০শে ডিসেম্বর স্বীকৃত এই কমিটি ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কমিউনিস্ট গোষ্ঠীগুলিকে শিক্ষিত করা এবং তাদের কাছে পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবী ও কমিউনিস্টদের মধ্যেকার পার্থক্য ব্যাখ্যা করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং এভাবেই পরবর্তীকালে ভারতে পার্টিকে সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

নেতৃত্ত্বপদে গান্ধীঃ

ইতিমধ্যে সারা দেশজুড়ে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণের ঢেউ বয়ে যায়। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে এক নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটে। প্রতিরোধ আন্দোলনের ইতিহাসে এই প্রথম লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক আকৃষ্ট হলো। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের সংগঠক হিসাবে খ্যাত মোহনদাস করমচাদ গান্ধী ভারতে প্রত্যাবর্তন করলেন এবং কংগ্রেস ও তার গণআন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। গ্রাম ও শহরের ব্যাপক জনগণের সাথে একাত্মতা গড়ে তুলে, তিনি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে পূর্ণ অসহযোগ এবং বিদ্যালয় ও কাছারীসহ সমস্ত সরকারী সংস্থা বর্জনের ডাক দেন। বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য এই রকম ব্যাপক জন জাগরণ আমাদের দেশে আগে কখনো দেখা যায় নি।

জমিদার ও পুঁজিপতিরা তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তির অছি গান্ধীর এই তত্ত্ব এবং যে কোনও মূল্যেই হোক অহিংসা তাঁর এই জেদ, জঙ্গী আন্দোলন দ্বারা আকৃষ্ট জনগণের তৎপরতাকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকে দানবীয় বলে তিনি নিন্দা করলে, জনগণ যখন তাকে জঙ্গী আন্দোলনের আহ্বান বলে ধরে নিল, এবং সেই পথে লিপ্ত হলো, গান্ধী তখন তাকে “পর্বত প্রমাণ ভুল” বলে স্বীকার করে নিয়ে গণ আন্দোলনের আহ্বানকে প্রত্যাহার করে নিলেন।

কমিউনিস্ট আন্দোলন:

তাসখন্দে গঠিত হবার পর, ভারতের কমিউনিস্টপার্টির প্রবাসী নেতারা এবং ভারতের অভ্যন্তরে কর্মীবাহিনী, এই পর্যায়ে সারা ভারত জুড়ে বিদ্যমান সংগঠন- গুলিকে উজ্জীবিত করে এবং নতুন নতুন কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তুলে কাজে নেমে পড়ে। বোম্বাই, কলকাতা, মাদ্রাজ, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে নেতৃস্থানীয় গোষ্ঠীগুলি গড়ে উঠলো। ১৯২১ সালে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনের উদ্দেশ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নামে এক ইস্তাহার প্রচার করা হলো। আহমেদাবাদ অধিবেশনে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জনগণের সামনে আত্ম- প্রকাশের পরেই কানপুরে অনুষ্ঠিত পরবর্তী অধিবেশনকে কমিউনিস্টরা পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করার কাজে লাগালো। যদিও এই অধিবেশনে তা বাতিল হলো, তাহলেও এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে কমিউনিস্টরা সাংগাঠনিক ভাবে ক্ষুদ্র ও দুর্বল হলেও, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জনগণের উপর তাদের উত্থাপিত দাবীর প্রভাব কোনও মতেই উপেক্ষা করার মতো নয়।

আমাদের দেশের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গোষ্ঠিকে সংঘবদ্ধ করা এবং তাদের কার্য-কলাপকে ট্রেড ইউনিয়ন, কিষান সংগঠন এবং সর্বোপরি কংগ্রেস নামক জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনে প্রসারিত করার কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রচেষ্টাকে ব্রিটিশ সরকার বিপজ্জনক বলে সিদ্ধান্ত করেছিল আর তাই তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিত করেছিল। পেশওয়ারে ১৯২১-২২ সালে তিনটি কমিউনিস্ট  ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯২৫ সালে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, তারপর ১৯২৫ ও ১৯২৭ সালে আবার পেশওয়ারের দুটি মামলা এবং সর্বোপরি ১৯২৯-৩৩ সালে তারা মীরাটে সর্ববৃহৎ কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করে।

যদিও এই সব আক্রমণের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠনগত ভাবে জোটবদ্ধ হওয়া এবং অগ্রগতি স্তিমিত হয়েছিল, কিন্তু তত্ত্ব, আদর্শ, এবং এক বিশিষ্ট কর্মকাণ্ড হিসাবে কমিউনিজম-এর জনপ্রিয়তা আটকানো যায় নি। বরং আরও অধিক সংখ্যায় আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয় বিপ্লবীরা সংগঠনভুক্ত ও প্রশিক্ষিত হতে লাগলেন । এই বিষয়ে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কার্যকরী সমিতির কর্মধারা এবং তাদের মুখপত্র "ইম্প্রেকোর" (ইন্টারন্যাশনাল করস্পন্ডেন্স- আন্তর্জাতিক সংবাদবার্তা ) এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। এই কারণেই যখনই কোনও আক্রমণের পর সংগঠন সাময়িক ভাবে দুর্বল হয়েছে, তার পরবর্তী কালেই পুনর্গঠন ও পুনরুজ্জীবন দেখা গেছে। ষড়যন্ত্র মামলাগুলি এবং এ সম্পর্কে সরকারী প্রচারই জনসাধারণকে দেখিয়েছিল যে এমন একটি শক্তি আছে যা স্বাধীনতার দাবীতে অটল এবং তার জন্য ধারাবাহিক ভাবে সংগ্রাম করে। এটা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পটতর হচ্ছিল যে একদিকে কমিউনিজম আর অন্যদিকে গান্ধীবাদ ও বোমার উপর অন্ধ বিশ্বাস এই দুই-এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার কমিউনিস্টদের প্রচারিত বিবৃতিটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আদালতে দাঁড়িয়ে ভারতের বিভিন্ন সমস্যাগুলি তুলে ধরার পাশপাশি  কমিউনিস্টরাকিভাবে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ও কুৎসার সম্যক জবাব দিতে সেই বিবৃতি দেয়। এর ফলে যারা কমিউনিজম কি তা জানতে আগ্রহী ছিলেন তাদের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নীতিগুলি সম্পর্কে অনেক মিথ্যাপ্রচারের মোকাবিলায় পার্টির বক্তব্য কি তা সর্বপ্রথম এখানেই ব্যাখ্যা করা হয়।

কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ণ ছিল শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা, যুব সংগঠন গড়ে তোলা, কংগ্রেসীদের মধ্যে প্রচার আন্দোলন চালানো প্রভৃতির মতো কমিউনিস্টদের দ্বারা গৃহীত বাস্তব কর্মসূচীগুলি। এই সব কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের জন্য কমিউনিস্টরা ওয়ার্কার্স এণ্ড পেজেন্টস পার্টি (শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন) নামে এক ব্যাপক মঞ্চ গড়ে তোলে যাতে কংগ্রেসী নেতা সহ বহু অ-কমিউনিস্টরা সক্রিয় ছিলেন। এই সব কর্মকাণ্ড সাধারণ কংগ্রেসীদের চিন্তা-চেতনায়, এবং কাজে-কর্মে ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতে ছিন্ন করে আনা বা সম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে জাতীয় লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করার দিকে তাদেরকে ক্রমান্বয়ে ঠেলে দেয়।

বহু শ্রেণী নিয়ে গড়া নিয়মানুগ পথে চলা সংগঠনের সমান্তরালভাবে গোপনে সক্রিয় একটি মাত্র শ্রেণীর (শ্রমিক শ্রেণীর) সংগঠন হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি নিজেকে গড়ে তোলে। অস্পৃশ্যতার মতো সামাজিক প্রশ্নের সাথে সংযুক্ত রেখেই ভারতীয় বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে রচিত এক খসড়া কর্মসূচীও গ্রহণ করে। এই সংগঠন দেশের বিভিন্ন কমিউনিষ্ট গোষ্ঠীগুলির মতাদর্শগত সংঘবদ্ধতার ভিত্তি রচনা করে।

জাতীয় আন্দোলনে মত পার্থক্য:

ইতিমধ্যে জাতীয় কংগ্রেস সংগঠনে একটা মত পার্থক্য— বাম ও দক্ষিণের মধ্যে প্রভেদ দেখা দিচ্ছিল। বামপন্থীরা ক্রম প্রস্ফুটিত শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করছিল এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শক্তির প্রতি সহমর্মীতা জানাচ্ছিল। দক্ষিণপন্থীরা বামপন্থীদের অগ্রগতি আর ঠেকাতে পারছিলো না। এর ফলেই কংগ্রেসের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্তর্জাতিক সংঘে যোগদান, (কমিউনিস্ট) ষড়যন্ত্র মামলাগুলিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনগত সমর্থনে কংগ্রেস নেতাদের অংশগ্রহণ, পূর্ণ স্বাধীনতাকে প্রথমে (মাদ্রাজ, ১৯২৭) চরম লক্ষ্য হিসাবে এবং তার পরে (লাহোরে, ১৯২৯) আশু দাবী হিসাবে গ্রহণ করা, লাহোর অধিবেশনে সভাপতি হিসাবে বামপন্থী জাতীয় নেতা জহরলাল নেহরুর নির্বাচন, করাচী কংগ্রেসে (১৯৩০) মৌলিক অধিকার সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ,  ফয়েজপুর অধিবেশনে কৃষি কর্মসূচী গ্রহণ ইত্যাদি।

গণআন্দোলনের ঢেউ:

১৯৩০ সালে পূর্ণ স্বাধীনতাকে আশু দাবী হিসাবে গ্রহণের পর কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দেশজুড়ে আইন অমান্যের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরি কল্পনা গ্রহণ করে। এর রূপায়ণে সারাদেশ জেগে উঠলো। সকল জাতের, সকল ধর্মীয় গোষ্ঠী, সকল ভাষাভাষী ও সংস্কৃতি বিশিষ্ট গোষ্ঠীর পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ ও যুবকদের হাজারে হাজারে আকর্ষিত করলো। এক দশক আগে দেশব্যাপী যে আন্দোলনের স্রোত বয়ে গিয়েছিল, এ ছিল তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যপ্ত, অনেক বেশ সংগঠিত। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যে গুণগত ভাবে উচ্চতর পর্যায়ে পৌছে গেছে, ১৯২০-এর প্রারম্ভের আর বর্তমানের এই দুই প্রত্যক্ষ গণসংগ্রামের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ তফাৎ তা দেখিয়ে দিয়েছিল।

আগের সংগ্রামের ঢেউ গান্ধী-নির্দেশিত সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল এ কথা স্মরণ রেখেই, নেতৃত্ব এবারে জঙ্গীপনা বর্জিত সংগ্রামের অনুমতি দিয়ে গণ-আন্দোলনের হুমকিটুকু বজায় রেখেছিল। এত সাবধানতা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে এর অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা হয়। কাপড় কলের সংগ্রামী শ্রমিকরা স্থানীয় প্রশাসনের তোয়াক্কা না করে কয়েকদিন ধরে শহর দখল রাখে। আবার পূর্ব- বাংলার (বর্তমানের বাংলাদেশ) চট্টগ্রামের তরুণ বিপ্লবীরা পুলিশকে তুচ্ছ করে অস্ত্রাগারে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালায়। দেশের অন্য আরেক অংশে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে পাঠানরা খান আব্দুল গফ্ফর গানের নেতৃত্বে সম্পূর্ণ গান্ধীবাদী পথে সংগঠিত হয়েছিল, কিন্তু আন্দোলন এখানে অন্য রূপ নেয়। পাঠানদের উপর গুলি চালানোর হুকুম দিলে গারোয়ালী সেনারা হুকুম তামিল করতে অস্বীকার করে, যা প্রমাণ করে যে দেশপ্রেম সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নাড়া দিয়েছিল। গারোয়ালী সেনাদের নেতা চন্দর সিং পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এইসব এবং আরও অনেক ঘটনা প্রমান করে যে সংগ্রামের আহ্বান জনগণের মধ্যে জঙ্গী উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল এবং নেতাদের নির্দেশিত সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল।

আপস আলোচনার উপর আস্থাঃ

ইতিমধ্যে বুর্জোয়া নেতৃত্ব জনগণের জঙ্গীপনাকে ব্যবহার করে ব্রিটিশ শাসকদের সাথে আলোচনার রাস্তা তৈরী করার কৌশল ভালভাবেই রপ্ত করেছিল।

আলোচ্য সংগ্রামের আগেই কয়েক দফা আপস আলোচনা হয়। ব্রিটিশ রাজের প্রতিনিধির সাথে আলাপ ও মত বিনিময় হয় এবং ১১ দফা দাবীপত্রে পূর্ণ স্বাধীনতাকে স্বাধীনতার মর্মবস্তুতে পরিণত করা হয়।

সংগ্রামে নামতে বাধ্য হলেও, নেতারা এমন কি জেলের ভিতরে থেকেও এভাবেই আপস আলোচনা শুরু করে এবং এক বছরের মধ্যেই একটা মীমাংসায় আসে। ব্রিটিশ শাসকরা পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে দেশকে ভাগ করার শয়তানী চক্রান্ত শুরু করে।

বিভেদের মাধ্যমে শাসনঃ

অবশ্য একাজ অনেক আগেই, এই শতাব্দীর গোড়া থেকেই শুরু হয়েছিল, যখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান ও তাদের সংগঠন মুসলীম লীগকে তারা কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্বের পাল্টা শক্তি হিসাবে ধৃর্ত্ততার সাথে ব্যবহার করা শুরু করে। পরবর্তী কালে মাদ্রাজে ও বোম্বাইতে অব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে, পাঞ্জাবে শিখদের, সারা দেশে খৃষ্টানদের, দলিত সম্প্রদায় প্রভৃতিকে ব্যবহার করে। এছাড়া রাজন্যবর্গ, জমিদার, ভারতীয় ও ইউরোপর ব্যবসায়ী সম্প্রদায় প্রভৃতির মতো স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বদ্ধমূল শত্রুদেরও চাগিয়ে তোলা হয়।

১৯৩০ সালে শুরু হওয়া জঙ্গী আন্দোলনের পাল্টা চাল হিসাবে ব্রিটিশরা ভারতে সংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্ন আলোচনা ও ফয়সলা করার জন্য লণ্ডনে এক গোল টেবিল বৈঠক আহ্বান করলো। আন্দোলনের নেতৃত্বে আসীন কংগ্রেস এই বৈঠক বর্জন করলো। কিন্তু ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে আপস আলোচনায় একটা মীমাংসা হলে কংগ্রেসের পক্ষে দ্বিতীয় দফার গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দেওয়ার সুবিধা হয়। কিন্তু এখানে কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি গান্ধীকে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এক ঘরে করতে সক্ষম হয় এবং তিনি শূন্য হাতে প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে কংগ্রেসকে অনন্যোপায় হয়েই পুনরায় গণআন্দোলন শুরু করতে হয়। কিন্তু এক বছরের কম সময়ের মধ্যেই তাকে দমন করা হয়।

আকর্ষণীয় বিকল্প:

এই সব কাজকর্মে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের সাধারণ সদস্য এবং জনসাধারণ নতুন পথের সন্ধান শুরু করে। এর পক্ষে সহায়ক হয়েছিল গত এক দশক কালে আবির্ভূত ছোট ছোট কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির কর্মকাণ্ড এবং তার চেয়ে অনেক বেশী সহায়ক হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চমকপ্রদ সাফল্য। সারা দেশের রাজনৈতিক সচেতন দেশবাসী ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার গভীর অর্থনৈতিক সংকটের সাথে সুস্পষ্ট ভাবে বিপরীত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিস্ময়কর অগ্রগতি লক্ষ্য করেছিল।

কংগ্রেসের এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক সংগঠনের বামপন্থী অংশ চিন্তা করতে শুরু করেছিল যে ভারতীয় বিপ্লবকে সফল হতে গেলে, শ্রমিক-কৃষকদের স্বতন্ত্র ভূমিকা গুরুত্ব পাবে এমন গণআন্দোলন গ্রহণ করে পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীদের পূর্ব-অনুসৃত পথ পরিত্যাগ করতে হবে। প্রবাদ প্রতীম ভগৎ সিং পরিচালিত দলের মতো অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলিও এই নতুন ধরণের বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকতে লাগলো।

একটি নতুন সংগঠন কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি গঠনের মধ্যে দিয়ে এই ঝোঁকটি দানা বেঁধে উঠলো। যেহেতু এই ঘটনা মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত নেতৃ- স্থানীয় কমিউনিস্টদের মুক্তি এবং তার পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির এক সর্বভারতীয় নেতৃত্ব গঠনের সাথে একযোগে ঘটলো, তাই সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের প্রতি অনুগত সকলের ঐক্যবদ্ধ কার্য্যক্রম নিশ্চিত হলো এর ফলে শুধু ট্রেড ইউনিয়ন- গুলির বিদ্যমান কেন্দ্র এ. আই. টি. ইউ. সি.'র পুনরুজ্জীবন ঘটলো না, সারা ভারত কৃষক সভাও গঠিত হলো। দ্বিতীয় সংগঠনটি রাজ্যস্তরে দ্রুত গড়ে ওঠা কৃষক সংগঠনগুলির এক সর্বভারতীয় কেন্দ্র উপস্থিত করায় সহায়ক হয়েছিল। ছাত্র ফেডারেশন, প্রগতিশীল লেখক সংঘ প্রভৃতি সর্বভারতীয় সংগঠন প্রমাণ করেছিল যে দুটি বামপন্থী সংগঠনের (সি পি আই) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সি. এস. পি-কংগ্রেস সোস্যালিস্ট পার্টি)-র আবির্ভাব সংগঠিত গণ ও শ্রেণী আন্দোলনের বিকাশের সাথে একযোগেই ঘটেছিল।

এই সব ঘটনা ঘটছিল এমন একটা সময়ে যখন ফ্যাসিবাদ ও নতুন যুদ্ধ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে তৎপর সকল শক্তি আন্তর্জাতিক স্তরে আরও বেশী বেশী ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসের ( ১৯৩৫) উদ্দীপ্ত আহ্বান শুধুমাত্র কমিউনিস্ট এবং সমাজবাদীদেরই নয়, জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বিরাট সংস্থার দেশপ্রেমিককে অনুপ্রেরিত করেছিল। কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট এবং কংগ্রেসের বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের এক যুক্ত মোর্চার আবির্ভাব ঘটেছিল এবং জাতীয় সংগঠনটিকে বামমুখী করতে সফল হয়েছিল। এরা সংখ্যায় কম হলেও, সাধারণ সংস্থা ও জনগণের এত সমর্থন তাদের প্রতি ছিল যে সংগঠনের নেতারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আসন্ন কঠিন লড়াইতে বামপন্থীদের সহযোগিতা কাম্য মনে করেছিলেন।

পর পর তিন বছর, কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন বাম জাতীয়তাবাদীদের এক প্রতিনিধি—জওহরলাল নেহেরু দু'বছর (১৯৩৬-৩৮) এবং সুভাস বসু তৃতীয় বছর। বৃহৎ সংখ্যক কমিউনিস্ট ও সমাজবাদীরা রাজ্য, জেলা এবং সংগঠনের পরবর্তী স্তরের নেতৃত্বেই ছিলেন। এই সময়কালটাতেই অগ্রণী জাতীয় সংগঠনে সবচেয়ে বেশ পরিমাণ বামপন্থী প্রভাব ছিল। তা ছাড়া এই সময়েই এই সংগঠন শ্রমিক, কৃষক, গ্রামীন ও শহরে বুদ্ধিজীবী প্রভৃতিদের বৃহৎ সংখ্যক সংগ্রামী সংগঠনের সমর্থন লাভ করেছিল ।

বাম ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে সংগ্রামঃ

এটা অবশ্য ক্ষণস্থায়ী হয়। ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে আপস আলোচনা হবে অথবা তাদের বিতাড়িত করার জন্য জঙ্গী গণআন্দোলন হবে এই প্রশ্নে কংগ্রেসের বাম ও দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯০৯ সালে কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য বাম জাতীয়তাবাদী প্রার্থী সুভাষ বসু যখন প্রশ্নটা এই আকারে তুললেন, তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী নেতারা এক তীব্র, তিক্ত লড়াই শুরু করে দিলেন। এটা বেশ কয়েক মাস ধরে চলে। সুভাষ বসু শুধু কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকেই অপসারিত হলেন না, তাকে সংগঠন থেকেও বহিষ্কার করা হলো। কংগ্রেস থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি ফরোয়ার্ড ব্লক নামে এক নতুন সংগঠন গড়ে তুললেন এবং এমনই কার্যক্রম নিলেন যা শুধু কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের বিরোধী নয়, কমিউনিস্ট এবং সমাজবাদীদের মতো বামপন্থী দল-বিরোধীও বটে।

বিশ্বযুদ্ধের সূচনা:

আরেকটি বিষয় যা নিয়ে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতৃত্ব, সুভাষ বসুর নতুন দল, কংগ্রেস সমাজবাদী এবং কমিউনিস্টরা পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তা হলো ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধের চরিত্র বিশ্লেষণ নিয়ে। যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী নেতারা ব্রিটিশ শাসকদের উপর চাপ দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় দাবীগুলি অর্জন করতে চাইছিলেন। এর বিপরীতে সুভাষ বসু ফ্যাসিবাদীদের সাহায্য গ্রহণ করার বিকল্প উপস্থিত করেন।

এই উভয় পথের বিপরীতে কমিউনিস্টরা ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পদ্ধতি হিসাবে যুদ্ধের প্রথম স্তরে সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জঙ্গী গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেয় এবং নাৎসী জার্মানীর আক্রমণের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলে, ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধে ভারতীয় জনগণকে সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেয়। সমাজবাদীরা একে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোলামী বলে আখ্যা দেয় এবং তীব্র কমিউনিস্ট-বিরোধী ও সোভিয়েত-বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে।

ব্রিটিশ শাসকদের সাথে শেষমেশ আপস করার নীতিটাই যেহেতু তারা অনুসরণ করেছিলেন, তাই গান্ধীর পরিচালনায় কংগ্রেস নেতৃত্ব যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে একটা লোক দেখানো প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু যখন তারা দেখলেন যে যুদ্ধে জাপানের অংশগ্রহণ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে নাৎসী বাহিনীর অগ্রগতি ব্রিটিশদের পক্ষে এক অতীব সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যার জন্য তাদের (ব্রিটিশ) পক্ষে ভারতের জাতীয় নেতাদের সাহায্য ও সহযোগিতা আবশ্যক, তখন তারা (কংগ্রেস) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। তারা দাবী করলেন যে তারা যেটা শুরু করেছেন, তা হলো ‘ত্বরিৎ ও ক্ষিপ্র’ সংগ্রাম। এটা আত্মহত্যার সমতুল্য বলে কমিউনিস্টরা এর বিরোধিতা করায়, তাদেরকে ‘বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতক’ বলে নিন্দা করা হয়।

সুতরাং তরুণ কমিউনিস্ট পার্টি এক অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল। যে লক্ষ লক্ষ মানুষ কংগ্রেসকে আগস্ট বিপ্লবের উদ্‌গাতা, সমাজবাদীদের কংগ্রেসী প্রস্তাবের বাস্তব রূপকার, এবং সুভাষ বসুকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণের সংগঠক ও নেতা হিসাবে দেখতো, তারা কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগ্রামের পথ পরিত্যাগকারী বলে মনে করলো ।

যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই কংগ্রেসের শুরু করা সংগ্রামকে গান্ধী কথিত ‘জান্তব হিংস্রতা’ দ্বারা দমন করা হয়েছিল। কংগ্রেস এবং তার নেতা গান্ধী ব্রিটিশদের সাথে আপস আলোচনা শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলেন। অন্য দিকে জাপানী সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভারতে প্রবেশ করার বসু গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দলটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। ফলে কংগ্রেসের সাথে শক্ত হাতে দর কষাকষি করার মতো পরিস্থিতিতে  ব্রিটিশ শাসকরা ছিল। তারা মুসলীম লীগের পাকিস্তানের দাবিটিকে ধুর্ততার সাথে ব্যবহার করেছিল। কংগ্রেসকে হয় স্বাধীনতার বিনিময়ে দেশভাগ মেনে নিতে হতো অথবা ব্রিটিশ ও মুসলীম লীগের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই চালাতে হতো। কংগ্রেসের প্রধান নেতারা প্রথম বিকল্পের পক্ষে মত দিলেও, গান্ধী এর বিরোধিতা করেন। প্রথম মতটাই প্রাধান্য পায়, এবং তারই ভিত্তিতে মীমাংসা হয়।

যুদ্ধোত্তর গণজাগরণঃ

একে ঠেকানো যেত, যদি যুক্ত-সমাপ্তির পরবর্তী দেশব্যাপী নতুন বিপ্লবী গণ- জাগরণের উপর কংগ্রেস আস্থা রাখতো । সুভাষ বসুর তৈরী ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মী (আই এন এ)-র যে সব সৈনিক ও অফিসারদের ব্রিটিশরা গ্রেপ্তার করেছিল তাদের মুক্তির দাবীতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ এই গণজাগরণের সূচনা করে। কংগ্রেসের দক্ষিণ ও বামপন্থীরা, কমিউনিস্টরা, সমাজবাদীরা এবং ফ্যাসীবাদ বিরোধী অন্যান্যরা যদিও সুভাষ বোসের পন্থার যে পন্থা আই. এন. এ. গঠনে পরিণত হয়েছিল, তার বিরোধিতা করেছিল, তথাপি দেশের স্বাধীনতার জন্ম যারা লড়াই করেছিল, সেই সব অফিসার ও সৈনিকলে বৃটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার অন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হল। এই ঐক্যবদ্ধ দাবীই ব্রিটিশের বন্দী মুক্ত করতে বাধ্য করেছিল—এটাই ছিল যুদ্ধ পরবর্ত্তী বছরে জনগণের প্রথম জয়।

এর অল্প কিছুদিন পরেই রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভী (আর আই এন)-র সৈনিকদের ঐতিহাসিক বিদ্রোহ শুরু হয়। কমিউনিষ্টরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই রকম এক সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলনের শক্তিশালী সমর্থন যেখানে তাদের প্রতি ছিল। এই বিদ্রোহ বোম্বাইতে শুরু হয়, অতি দ্রুত নৌবাহিনীর ঘাঁটি যেখানে যেখানে ছিল, সেইসব কেন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসকরা একে এক অস্পষ্ট সতর্কবাণী হিসাবেই গ্রহণ করে এবং তাদের সময় ফুরিয়েছে বলে সিদ্ধান্ত করে। ঘটনা এত দ্রুত গড়াতে থাকে যে বোম্বাই বিদ্রোহের পরে এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যেই ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা করে যে তারা ১৯৪৭ সালের শেষে দেশ ছেড়ে চলে যাবে।

ইতিমধ্যে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পরপর একাধিক গণসংগ্রাম ফেটে পড়ে। শ্রমিক ধর্মঘট, সরকারী কর্মচারীদের ব্যাপকভাবে ধর্মঘটের আঙ্গিনায় প্রবেশ সহ মধ্যবিত্ত কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশ গ্রহণ, সারা দেশের সমস্ত রাজ্যগুলিতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবীতে ঐ সব রাজ্যের জনগণের দৃঢ় আন্দোলন, সর্বোপরি বাংলা, মহারাষ্ট্র, ত্রিপুরা প্রভৃতি স্থানে আন্দোলন, যা ত্রিবাঙ্কুরের আলেমী (পুন্নাপ্রা ও ভায়েলার) কর্মীদের সশস্ত কার্যক্রম এবং তেলেঙ্গানায় এর চেয়ে অনেক দীর্ঘস্থায়ী ও ধারাবাহিক সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছিল, এসব কিছু (বোম্বাই-এর আর আই এন বিদ্রোহ সহ) ইঙ্গিত করছিল যে জনগণের মধ্যেকার এই নতুন বিক্ষোভ ব্রিটিশ শাসকদের বেশী দিন তিষ্ঠোতে দেবে না।

স্বাধীনতা ও দেশভাগ:

যেহেতু তাদের পক্ষে এ দেশের শাসন বজায় রাখা আর সম্ভব ছিল না, তাই ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা এমন এক অবস্থায় দেশ ছেড়ে যাবে, যাতে ভারতবাসী শান্তিতে থাকতে না পারে। সুতরাং তারা এমন ভাব দেখায় যেন তারা কংগ্রেসের দাবী, ভারত ত্যাগ করা এবং মুসলীম লীগের দাবী দেশকে হিন্দু সংখ্যাগুরু (ভারতীয় যুক্তরাজ্য) এবং মুসলীম সংখ্যাগুরু (পাকিস্তান) এই দুই রাজ্যে ভাগ করার উভয় দাবীই মেনে নিচ্ছে। হস্তান্তরের পদ্ধতি স্থির করার জন্য দীর্ঘসূত্রী আলোচনা উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক এতই তিক্ত করে তোলে যে এক বৃহত্তম গণহত্যা—যাতে দুই সম্প্রদায় নিজেদের লিপ্ত করেছিল— দুই সদ্য সৃষ্ট দেশের স্বাধীনতার ঊষাকালে ও তার অব্যবহিত পরবর্ত্তী দিনগুলির সাথে যুগপৎ ঘটেছিল। এই পরিস্থিতির মধ্যে স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ায় জনসাধারণ এ ঘটনাকে মিশ্র অনুভূতি সহকারে গ্রহণ করে।

যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অন্তরঙ্গ সহযোদ্ধা ছিল, তারা স্বাধীনতার প্রাক্কালে এবং তার পরেও পরস্পরের সাথে হানাহানি করছে, এই চিন্তা আনন্দ-উৎসবকে বিষণ্ণ করে তুলেছিল। এর পরবর্তী ৩৯ বছর দুই দেশের মধ্যে এবং দুই দেশের অভ্যন্তরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে আছে। দীর্ঘস্থায়ী এক সংগ্রামের পর এই ধরণের স্বাধীনতা অর্জনে যারা হতাশ হয়েছিলেন, মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি স্বাধীনতা- প্রাক্কালের উৎসবে যোগ দিতে অস্বীকার করেন।

নির্বিঘ্ন জাতীয় স্বাধীনতা ও সংহতির জন্য:

এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের একটা পর্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের অবসান হলো। শুরু হলো এক নতুন পর্যায়—রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সুসংহত করার, শ্রমজীবি মানুষের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামের পর্যায়। বিগত চার দশকে আবির্ভূত সমাজ- তান্ত্রিক দেশগুলির এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ৭০ বছরব্যাপী বিশাল সাফল্যগুলি ভারতীয় জনগণকে এই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার জন্য প্রেরণা যোগাচ্ছে।

এই বছর আমরা যখন সারা পৃথিবীর সাথে একযোগে অক্টোবর বিপ্লবের ৭০তম বার্ষিকীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, এবং আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৪০তম বার্ষিকী পালন করছি, তখন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসক চক্র যারা আমাদের এবং তৃতীয় বিশ্বের অন্য সকল দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় সংহতিকে বিপন্ন করছে।

তাদের বিশ্বকে দখল করার উন্মত্ত পরিকল্পনার দিকেও আমরা লক্ষ্য রাখছি। দেশের শাসক চক্র ভারতের গুরুতর বিপদ সম্পর্কে অন্ধ আর বিরোধীপক্ষের অনেকেই সাময়িক নির্বাচনী সুবিধা অর্জনের স্বার্থে বিভেদকামী শক্তিকে সমর্থন করছে। তাই কয়েক দশকের সংগ্রাম দ্বারা অর্জিত স্বাধীনতাকে সংহত করার পথে। যে বিভেদকামী শক্তিরা বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের বিকাশের সহায়ক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ করা সকল প্রগতিশীল শক্তির অবশ্য কৰ্ত্তব্য। তাই- ‘দেশের সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে, অর্থাৎ যারা প্রাক্-পুঁজিবাদী সকল অবশেষকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে, সুষ্ঠুভাবে ও কৃষকদের স্বার্থে কৃষি বিপ্লব করতে বিদেশী পুঁজির সকল চিহ্নকে মুছে ফেলতে এবং ভারতের অর্থনীতি, সামাজিক জীবন ও সংস্কৃতির পথে সকল বাধাকে অপসারিত করতে আগ্রহী’ (সুত্র- পার্টি কর্মসূচী) এমন সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) আহ্বান জানাচ্ছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন