গৌতম রায়
রাত তখন প্রায় দশটা। আর শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নামলেই ঝুপ করে যেন মাঝরাতের নিশুত নেমে আসতো তখনও। সাতের, আটের দশকের শান্তিনিকেতন। তখনও আজকের মতো কেবলমাত্র টুরিস্ট স্পট হয়ে ওঠেনি শান্তিনিকেতন। আশ্রমিক পরিমন্ডল তখনও অনেকটাই বজায় আছে। রবীন্দ্র সান্নিধ্যে আসা মানুষজনেরা অনেকেই জীবিত। সে এক অন্য শান্তিনিকেতন। মনে হতো প্রাচীন ভারতের এক শান্ত, স্নিগ্ধ তপোবনে রয়েছি।
এমন সময়কালেই একদিন রাত দশটা নাগাদ মোহরদি জানতে পারলেন, তাঁর বন্ধু আসছে। জানবার সঙ্গে সঙ্গে পড়িমরি করে নিজের শোবার ঘরের দিকে ছুটলেন। হাসিখুশি মুখে কেবল একটাই কথা, এতরাতে সুচিত্রা!
ঘরে ঢুকে আগল দিয়ে দিয়েছেন মোহরদি। সুচিত্রাদি এসে শত ধাক্কা দিলেও দুয়োর খুলছেন না। মজাটা বুঝতে পেরে সুচিত্রাদিও তখন গলা ছেড়ে গাইছেন; কে দিলো আবার আঘাত দুয়ারে মম-- তবু দুয়ার আগলমুক্ত হচ্ছে না। সুচিত্রাও গান থামাচ্ছেন না। বেকায়দা দেখে মোহর বলে উঠলেন; গোরা, সুচিত্রাকে বলো, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।
আর যায় কোথায়? চারিদিকে হাসির রোল। আমরা যারা ইতিহাসের নির্মাণের সাক্ষী, আমরাও হাসি আটকাটে পারছি না। কারণ, সুচিত্রাদির এত রাতে ‘আনন্দধারা’-তে আগমণের জোগারযন্তের দৌলতে মোহরদির এই শুতে চলে যাওয়ার আসল ব্যাপারটা তো আর আমাদের অজানা নয়।
পরের দিন সকালে আবার এসেছেন সুচিত্রা। মোহর বললেন, আমি কিন্তু সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমি তো জানি তুমি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই গোরাকে তোমার ঘুমিয়ে পড়বার খবরও আমাকে দিতে বলেওছিলে, বন্ধু সুচিত্রার উত্তরে এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলেন না মোহর। সুচিত্রা আর কণিকার সেই উচ্ছল হাসি, যেন তাঁদের ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আরো অনেক অনেককাল আগের শান্তিনিকেতনে। যে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের মাত্র কয়েকদিন পরে আসা সুচিত্রাকে দেখে শহুরে মেয়ের থেকে একটু দূরেই আছেন মোহর। সুচিত্রার পায়ে সেই সময়ের হাল ফ্যাশনের চটি। মোহর তখন হালি পায়েই লাল মাটিতে হেঁটে চলে বেড়াতে বেশি অভ্যস্থ।
কন্ঠ সম্পদের বাইরে কেমন ছিলেন মোহরদি- এই আগ্রহ যতদিন যাবে ততই বাড়বে বই কমবে না। বিশেষ করে তাঁর জীবনের শেষের কয়েকটা বছর, শারীরিক নানা সমস্যার কারণে যখন তিনি নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন বাইরের পরিমন্ডল থেকে, কিন্তু আপন খেয়ালে গান করা আর ছাত্রছাত্রীদের শেখানো চলছেই, কিন্তু বাইরের অপরিচিত মানুষেরা সহজে তাঁর কাছে আর যেতে পারেন না। মোহর নিজেই একটা আগল তুলে দিয়েছেন তখন।
এই আগল যে কেবল তাঁর শারীরিক কারণেই ছিল-- আমার কিন্তু তা মনেহয় না। তিনি তখন আরো অনেক বেশি নিজের ভিতরে নিজে আত্মস্থ হচ্ছেন। তাই আত্মস্থতার নিবিড় সাধনায় মগ্ন মোহরদি তখন ধীরে ধীরে বহিঃবিশ্ব থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। আরো বেশি বেশি করে ডুবে যাচ্ছেন তাঁর গুরুদেবের গানে। আর সেই কারণেই বাইরের মোহ আবরণ খুলে ফেলতেই একটা আবরণে মুড়ে ফেলতে শুরু করেছেন তখন তিনি।
মোহরদির সারল্য, এটা যেন একটা প্রবাদতুল্য বিষয় হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তাঁকে চিকিৎসার জন্যে আনা হচ্ছে কলকাতায়। চিকিৎসা পাবেন এসএসকেএমে। ট্রেনে উদ্বিগ্ন মোহরদির জিজ্ঞাসা গোরাদাকে; হাওড়া স্টেশন থেকে আমরা পি জি হাসপাতালে কি করে যাবো গোরা? মজা করতে ছাড়লেন না গোরাদাও। বললেন; তোমাকে সাইকেলে করে নিয়ে যাবো!
এতটাই মাটির মানুষ ছিলেন মোহরদি যে তিনি ভাবতেই পারতেন না, তাঁর জন্যে সরকারি ব্যবস্থাপনা থাকবে। হাওড়া স্টেশনে অসুস্থ মোহরকে দেখবার জন্যে সেবার যে মানুষের ঢল নেমেছিল, সেটা যে তাঁকে দেখবার জন্যেই, এটাও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেন নি তিনি।
এই অতি সারল্য অনেকক্ষেত্রে দেখেছি তাঁকে বিপদের ভিতরেও ফেলে দিয়েছে। মনোজ, মনীষা নায়ার দক্ষিণী পুরস্কার পাবে। পুরস্কার নিতে যাবার আগে এসেছে মোহরদিকে প্রণাম করতে। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করলেন মোহরদি। ওঁরা চলে যাবার পর গোরাদা বললেন, ওরা যাচ্ছে যাক। পুরস্কার তো শেষপর্যন্ত পাবে না।
‘দক্ষিণী’র যে পুরস্কার মনোজেরা পেতে চলেছিল, সেই পুরস্কারের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল, কারো ক্যাসেট (সি ডির যুগ তখনো আসেনি) প্রকাশিত হলে, তিনি আর পুরস্কার পাবেন না। নিউ ট্যালেন্টদেরই ওই পুরস্কার দেওয়া হতো। মনোজদের তখন ক্যাসেট প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল।
মনোজরা চলে যাওয়ার পর গোরাদার ওই উক্তি একটু বিরক্তই করলো মোহরদিকে। বললেন, ওদের সামনে বললে না কেন? বেচারী ছোট ছেলেমেয়ে দুটো এতদূর থেকে গিয়ে শুধু শুধু কষ্ট পাবে।
মোহরদি কখনো চাতুর্য পছন্দ করতেন না। সরাসরি তাঁকে সুচিত্রার মত সমাজমনষ্ক শিল্পী বলা যাবে না। তিনি গানের দুনিয়ার বাইরে কখনো সেভাবে নিজেকে প্রকাশ করেন নি। রাজনীতি থেকে শতহাত দূরে থাকতেন। কোনো রাজনীতির মানুষদের সঙ্গেই তাঁর অতিরিক্ত সখ্যতাও ছিল না। আবার বিবাদ বিসংবাদও ছিল না। সুচিত্রা শান্তিনিকেতনে গান শিখতে প্রথম যাওয়ার পর,তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্যে দেখা হলেই ক্ষিতীশ রায়, সুচিত্রাকে রেড সেলুট দিতেন। এমন তরো রাজনৈতিক সচেতনতাও কখনো মোহরের ভিতরে আমরা দেখি নি।
মোহরদি কখনো কোনো দ্বন্দ্ব বিবাদের সঙ্গে নিজেকে জড়াতেন না। রূঢ় সত্য উচ্চারণেও তিনি ছিলেন একটু অন্তরালবাসিনী। শান্তিদেব ঘোষ বা সুচিত্রা মিত্র যেভাবে কঠিন সত্যটা স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করে নিজেদের শত্রু সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন, মোহরদির ব্যক্তি চরিত্রটা ঠিক তেমনটা ছিল না। স্বজন মন্ডলেও তিনি খুব একটা কঠিন কথা বলতে পারতেন না। এজন্যে হয়তো অনেক মূল্য তাঁকে জীবনে দিতে হয়েছে। বিশেষ করে শেষ জীবনে, যখন প্রায় শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়লেন, কিন্তু কন্ঠে তিনি তখনও অষ্টাদশী, এমন সময়ে পরিবৃত্তের দৌলতে অনেক কিছুর সঙ্গে তাঁকে সম্পৃক্ত হতে হয়েছিল, যা তিনি কতোটা বুঝে করেছিলেন, কতোটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন- তা জানবার সুযোগ কখনোই মোহরভক্তেরা পান নি। তবে যে মোহরদি কখনো কারো প্রতি কটু কথা বলতেন না, সেই মোহরদিই কেন বীরভূম জেলা পরিষদের তৎকালীন সভাধিপতি ব্রজ মুখোপাধ্যায়ের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন, তাঁকে ঘিরে যে বৃত্ত তখন তৈরি হয়েছিল, সেই বৃত্তের ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়াই এর পিছনে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করেছিল বলে অনুমান হয়।
আজকের যুগের শিল্পীদের যাপন দেখলে মোহরদির মতো শিল্পীর যাপনচিত্র কেমন আমাদের রূপকথা বলে মনে হয়। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস চালু হয় আটের দশকের গোড়ার দিকে। এই ট্রেনটি শান্তিনিকেতনের মানুষদের কাছে খুব সুবিধার হয়ে উঠলো। মোহরদির পায়ের কাছে বসবার যোগ্যতা নেই, এমন লোকজনও টাকার গরমে ট্রেনের ঠান্ডা কামরাতে চড়ছেন। আর মোহরদি কিন্তু শেষ অসুস্থতার এক দুবার ছাড়া চিরদিন এই ট্রেনের রিজার্ভ চেয়ারকারে করেই যাতায়াত করতেন। আর দশজনের মতোই মাটির ভাঁড়ে চা বা ট্রেনের হকারদের কাছ থেকে কিনে টুকটাক খাওয়া-- এসব ছিল তাঁর বড়ো পছন্দের।
আমার শোনা ঘটনা। অনেক অনেককাল আগের ঘটনা। ধোপাকে কাপড় কাচতে দিয়েছেন। তার বেশ কয়েকদিন পরে বোলপুরের বিচিত্রা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গেছেন মোহরদি। ইন্টারভ্যালে আলো জ্বলতেই দেখেন, দু একটা সিটের পরেই এক মহিলা বসে আছে তাঁরই কাচতে দেওয়া শাড়িটা পড়ে। মোহরদি খুব কনফিউজড। কিন্তু যিনি সেটা পরে আছেন, তিনি তো ব্যাপারটা ঠিকই বুঝেছেন। সিনেমা আবার শুরু হলে, হল অন্ধকার হওয়ামাত্র সেই ধোপার স্ত্রী চম্পট দিয়েছে।
এই যে ধোপার স্ত্রী তাঁর কাচতে দেওয়া শাড়িটা পড়ে সিনেমা দেখতে গেছে, এ নিয়ে ধোপাকে মোহরদি বকাবকি করবেন কি, ধোপা বাড়িতে কাপড় দিতে এলে পাছে সেই গরীব মানুষটি অপ্রস্তুত হয়, তাই মোহরদি ধোপার সামনে বেরই হলেন না।
শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে মানুষ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো অংশেই আলাদা ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের গানের সাধিকা বলতে যা বোঝায়, আজ থেকে ঠিক নিরানব্বই বছর আগে জন্ম নেওয়া মানুষটি ছিলেন একদম তাইইই।
ছবিঃ লেখকের নিজস্ব সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত