সূর্যকান্ত মিশ্র
বামফ্রন্ট সরকার ও তার আগে দুবারের যুক্তফ্রন্ট সরকার বিশেষ করে জোর দিয়েছিল ভূমি সংস্কার ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরনের উপর। জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন “আমরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরন চাই”। পঞ্চায়েত নির্বাচন ও বিকেন্দ্রীকরণ করার জন্য যুক্তফ্রন্ট সরকারের পঞ্চায়েত মন্ত্রক একটি বিলও এনেছিলেন। সরকার ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে তখন লাগু করা যায়নি, তাই বলা হল ‘রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চলবে না’। তিনি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিরোধীদের নীতির বিকল্প কি করে হতে হবে সেই পথ তিনি দেখিয়েছিলেন। শুধু কেন্দ্র থেকে রাজ্য বিকেন্দ্রীকরণ নয়, রাজ্য থেকে আরও নিচে পঞ্চায়েত ও পুরসভার স্তরে মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার বিষয়টিও তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। এ ছাড়াও তৎকালীন সরকার যে বিষয়টির উপর বেশী গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করেছিল যে গ্রামের সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ না করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা সম্ভব নয়। জমির মালিকানায় সামাজিক শ্রেণির যে দুরকম বৈষম্য, সেই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইটা আগে থেকেই গতি পেয়েছিল। এরই ফল ভূমি সংস্কার, পুনর্বন্টন। তাই এই দুটি বিষয়কে একে অপরের থেকে আলাদা করা যায় না।
বলাই যায় ভূমি সংস্কারের সাফল্য ছিল যথেষ্ট। সারা দেশের মোট আয়তন হিসাবে মাত্র দুই শতাংশ জমি পশ্চিমবঙ্গের অংশ, অন্য দিকে দেশের জনসংখ্যার আট শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। তাই জমি নিয়ে একটা চাপ ছিলই। কিন্তু যদি জমি পুনর্বন্টনের হিসাব দেখা হয়, দেখা যাবে সেটা পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ। সারা দেশে মোট পুনর্বন্টিত জমির ২২%ই আমাদের রাজ্যে হয়েছিল, যার আসে পাশে অন্য কোনও রাজ্য আসতে পারে নি।
প্রথমবার সর্বজনিন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় যা আগে কখনও হয় নি। ১৯৭৩ সালে পঞ্চায়েত আইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচন না হওয়ার ফলে সেই আইন তখন কার্যকর করা হয়নি। সেই আইনের উপরে ভিত্তি করে এবং কিছু ছোটখাটো প্রয়োজনীয় সংশোধন করেই পরে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত তৈরি হয়। কাজের মধ্যে দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে আইন সংশোধন হলেও আমাদের সরকার নতুন কোন আইন প্রণয়ন করে নি। রাজীব গান্ধী এই বিষয়ক সাংবিধানিক সংশোধন করতে চাইলেও, বেশ কিছু মত পার্থক্যের ফলে তা আর ফলপ্রসূ হয় নি। পরবর্তী সময়ে নরসিংহ রাও এর সরকারের সময় সকলে একমত হয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। কেবলমাত্র একজনই বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।
সংবিধান সংশোধন হওয়ার আগে আমরাই মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষন করেছিলাম। তফসিলি জাতি, আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণ ও আমরাই করেছিলাম, বামফ্রন্ট সরকার করেছিল। আমরা সকলে সহমতের ভিত্তিতেই এটা করতে পেরেছিলাম। তবে আমরা বুঝেছিলাম শুধু পঞ্চায়েত হলেই হবে না, ক্ষমতাকে আরও বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে যাতে গ্রামের মানুষ কথা বলতে পারেন। সেখান থেকেই তৈরি হল গ্রামসভার ধারণা। প্রকল্প রূপায়নে যাতে তাদের ভূমিকা থাকে, তার জন্য বেনিফিশিয়ারি কমিটি অর্থাৎ উপভোক্তাদের কমিটি তৈরি করা হয়। তাদের স্বতস্ফুর্ত সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই এই প্রকল্প রুপায়ন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়, ঠিকাদারদের দিয়ে নয়।
সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার যারা তাদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া ছিল একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটি শ্রেণী ও সামাজিক ভারসাম্যের পরিবর্তন করেছিল। যারা গরিব ও অপেক্ষাকৃত বেশী বৈষম্যের শিকার তাদের পক্ষে নিয়ে এসেছিল। এটা একটা বড় ব্যাপার যেটা দেখে রাজিব গান্ধীও বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ একটি মডেল রাজ্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও অনেক স্বীকৃতি এসেছিল। এসব অভিজ্ঞতার কথা বলার জন্য আমাদের অন্য রাজ্যে, অন্য দেশেও যেতে হয়েছে।
ভূমি সংস্কার হল কিসের ভিত্তিতে?
তেভাগা আন্দোলনের দাবি ছিল ৩ ভাগ ফসলের ২ ভাগ পাবে বর্গাদার আর একভাগ পাবে মালিক। আর যেটা বামফ্রন্টের সরকার সুনিশ্চিত করেছিল- বর্গাদার যদি নিজের খরচে চাষ করে, তাহলে ৪ ভাগের ১ ভাগ পাবে মালিক, আর তাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। রেকর্ড না করা থাকলে তবেই উচ্ছেদ করা যাবে। রেকর্ড করার এই পদ্ধতি বামফ্রন্ট সরকার করেছিল – যে বা যারা রেকর্ড করতেন, কানুনগো বলা হতো ওনাদের, একদম নিচে গিয়ে তাঁবু পেতে, প্লট ধরে ধরে হিসাব করে, গ্রামবাসীদের নিয়ে সান্ধ্য বৈঠক ডেকে, কোন বর্গাদার কোন অংশে চাষ করেন তা জিজ্ঞাসা করে, মাঠে গিয়ে দেখে তবেই রেকর্ড করতেন।
ভূমি রাজস্ব আধিকারিকরা আগে সাধারণত জমিদার, জোতদারদের বাড়িতে উঠতেন, তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। বামফ্রন্ট সরকার এসে তাদের তাঁবুর ব্যবস্থা করে দেয় যাতে কারোর বাড়িতে না থাকতে হয়। তখন কোন সমস্যার কথা শোনার জন্য ওই তাঁবুতে আমরাও গেছি, রাজ্য স্তরের অফিসাররা গেছেন, মন্ত্রীরাও গেছেন, তাঁবুতেই থেকেছেন। জমির উচ্চ সীমা সংক্রান্ত যে আগেকার যে আইন তা লঙ্ঘন করে যারা জমি লুকিয়ে রেখেছিল, সিলিং বহির্ভূত বিপুল পরিমান জমি, সেই খাস জমির পাট্টা বিলি হল।
সাধারণত ভূমিহীন এবং তার পর এক একরের কম জমির মালিকরা সেই পাট্টা পেতেন। তাদের পাট্টাদার বলা হত। কার্যত তারাই মালিক কিন্তু পাট্টা বিক্রি করার অধিকার তাদের ছিল না। ২০১০ সালের তথ্য অনুযায়ী ৩৫ লক্ষের কিছু বেশি পাট্টাদার ছিলেন। জমির পরিমান ১১.২৭ লক্ষ একর। এর পূর্বেই রেকর্ডভুক্ত ছিলেন এমন বর্গাদারদের জন্য রেকর্ড হওয়া জমির পরিমাণ ছিল ১১.২৫ লক্ষ একর।
কিছু জমি যুক্তফ্রন্ট সরকার থাকার সময় লড়াই করে উদ্ধার হয়েছিল, কিন্তু রেকর্ড হয়নি। সেই জমিতে পাট্টা দেওয়া দরকার ছিল, রেকর্ড করা দরকার ছিল। পরবর্তীতে জমি পাট্টা দেওয়ার ফলে প্রায় ত্রিশ লক্ষ পরিবার উপকৃত হয়েছিল। এর সঙ্গে বর্গাদারদের পরিবার হিসাবে আরও ১৫ লক্ষ মানুষ যুক্ত করলে মোট ৪৫ লক্ষ মানুষ উপকৃত হলেন। শুধুমাত্র জমির পাট্টা বা বর্গা রেকর্ড বিলি তো নয়, ক্ষুদ্র সেচের ব্যবস্থা করার দরকার ছিল। ক্ষুদ্র সেচ মানে শুধু মাটির নীচের জল নয়, মাটির উপরের জল ধরে রাখা। এছাড়া উন্নত বীজ দেওয়া দরকার হয়ে পড়লো, ঐ মিনিকিট বলা হত যাকে, এছাড়াও উন্নত সার ইত্যাদি। সেই কম সুদে ব্যাংক ও সমবায় ঋণের বন্দোবস্ত করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। জোরদার সমবায় আন্দোলনের প্রসঙ্গ সেখানেই।
কৃষি জমির ব্যবহারে যদি দুটি ফসল হয় অর্থাৎ দোফসলি জমি, তার ফল হিসাবে প্রতি ১০০ একর জমিতে ১৮০ একরের সমান চাষ হতে শুরু করল। অর্থাৎ প্রায় ৮০ শতাংশ জমিই দোফসলি জমি। ফলে উৎপাদন বাড়ল। সারা দেশের মধ্যে আমরা চাল উৎপাদনে প্রথম, সব্জি উৎপাদনে প্রথম এমনকি মাছ ও শস্যবীজ উৎপাদনেও প্রথম হই এবং সেই প্রথম পশ্চিমবঙ্গ খাদ্যে স্বনির্ভর হল। আগেকার সরকার যখন ছিল তখন ৭৩ লক্ষ টন চাল উৎপাদন হত, পরে আমাদের সরকারের সময় সেটা বেড়ে হল ১৭৫ লক্ষ টন। তার আগে তো মাইলো খাবার দিনও গেছে।
মানুষের অবস্থার উন্নতি হল, তাদের কেনার ক্ষমতা বাড়লো, তার ফলে বাজার বাড়লো। গ্রামে দোকানপাট বাড়লো। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে আমরা বুঝেছিলাম, শুধু কৃষি, ভূমি সংস্কার, গ্রামন্নোয়ন দিয়ে হবে না। শিল্প, পরিষেবা ক্ষেত্র অর্থাৎ অর্থনীতির মূল ক্ষেত্রগুলিতেও পাশাপাশি বাড়তে হবে। বাম আমলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষায় ৯৯ শতাংশ মেয়েরা ভর্তি হল, মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেয়েদের সংখ্যা পুরুষদেরও ছাড়িয়ে গেল। তারা কোথায় যাবে, কি করবে? শিল্পের দরকার পড়লো। ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প যাকে MSME বলা হয় (Medium Small and Micro Enterprises), আমরা তাতে এক নম্বর হয়েছিলাম এবং শেষ দিন পর্যন্ত আমরাই এক নম্বর ছিলাম। তার কর্মসংস্থানেও আমরা এক নম্বরে ছিলাম। গুজরাট তখন দুনম্বরে থাকলেও আমাদের অনেক পিছনে ছিল।
কিন্তু বৃহৎ শিল্প খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা ছাড়া একেবারেই চলা যায় না। নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই আমরা সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি হল। কর্মসংস্থানের জন্য স্থায়ী শিল্প, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং এসবের সাথে যুক্ত অনুসারী শিল্প দরকার ছিল।
সমাজের একটা অংশ এর বিরোধিতা করছিলেন। তারা প্রথম থেকেই ভূমি সংস্কারের বিরোধিতা করছিলেন কারন তারা ছিলেন গ্রামের ক্ষমতাশালী অংশ এবং আগেকার ব্যবস্থায় তাদের যে মাতব্বরি ছিল সেটা ভেঙে গেছিল। আর এই যে স্বচ্ছ সরকারী ব্যবস্থা তার বিরোধীশক্তিগুলো সারা পৃথিবীতে বাড়ছিলো, আমাদের দেশ ও রাজ্যেও তারা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তবে এখানে তারা খুব বেশী কিছু করে উঠতে পারতেন না যদি না এখনকার মুখ্যমন্ত্রী বিজেপিকে এখানে ডেকে না আনতেন। এটা জ্যোতি বাবু বলতেন “আপনার সব থেকে বড় অপরাধ আপনি বিজেপিকে এখানে ডেকে নিয়ে এসেছেন”। এর পরেরটা সকলেই জানেন যে মোটরগাড়ি তৈরির কারখানা ৯০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর বাংলা থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে তিনি সেই কারখানাকে সানন্দে পাঠিয়ে দিলেন, উপহার দিলেন মোদিকে। এখন ঐ কারখানায় কত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে সহজেই জানা যায়। এর পিছনে দেশের ও দেশের বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি, কর্পোরেটরা এমন অনেকগুলি শক্তি সক্রিয় ছিল।
এর পর রাজ্যে পরিবর্তন হল এবং তার ফলও যা হওয়ার তাই হয়েছে। এখন সব উল্টে বরং খাস জমি, বর্গাজমি আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। এখন যেটা হয়েছে যে সরকার সরকারী জমি বিক্রি করে দিতে পারবে, এটা আইনে হয় না কখনও। আর অন্যদিকে ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন তৈরি করেছে কেন্দ্র সরকার। এ ছাড়াও অবাধ লুঠ তো চারিদিকে চলছেই। বর্তমানে পুঁজির যা চরিত্র, একে বলা যায় লুঠেরা পুঁজি। শিল্প পুঁজি এটা নয়, এটা ম্যানুফাকচারিং নয়। এখন টাকার থেকে টাকা হচ্ছে। আদানি যেমন একটা খুব বড় উদাহরণ। আর দিল্লির শাসক দল বা এখানকার শাসক দল হোক, এরাই এখন নির্বাচনী তহবিলে তাদের অর্থের যোগানদার। এছাড়া কয়লা, বালি, গরুপাচার থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগ সহ অসংখ্য দুর্নীতি, চিটফান্ড এসবও তার সাথে রয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই পুরো পশ্চিমবঙ্গের যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য সেটা ধ্বংস হল। পশ্চিমবঙ্গ সব দিক থেকে এখন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এতবড় ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হল, আমাদের রাজ্যের কয়েক শতাধিক মানুষ ছিলেন ঐ ট্রেনে, তারা এখান থেকে যাচ্ছেন। তাদের বেশীরভাগই পরিযায়ী শ্রমিক। আগেও যে পরিযায়ী শ্রমিক ছিল না এমনটা নয়। আগে এখান থেকে যেমন যেত, বাইরে থেকেও তেমন আসত। বরং আগে বাইরে থেকে যারা আসত সেই তুলনায় কম শ্রমিক এখান থেকে যেত। এখন উল্টে গেছে, এখানে অন্য রাজ্য থেকে আসা এখন কমে গেছে, আর এখান থেকে যাওয়া অনেকটা বেড়ে গেছে। অর্থনীতির যে কটা সূচক আছে অর্থাৎ মোট উৎপাদন, মাথা পিছু উৎপাদন, দারিদ্র, বেকারি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানব উন্নয়ন, সততা, স্বচ্ছতা এই সব মাপকাঠি বিচার করলে পশ্চিমবঙ্গ এখন ধ্বংসের দিকে।
পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়গুলিকে আলাদা করে দেখা যায় না। গাছ লাগানো, জল সংরক্ষনের ক্ষেত্রেও পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পেয়েছিলাম আমরা। পরিবেশের বিষয়ে আমরা পেয়েছিলাম পল গেটি পুরষ্কার, শিক্ষা ক্ষেত্রেও আমরা নোমা পুরষ্কার পাই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এগুলিকেও আমরা বিকেন্দ্রীভূত করেছিলাম। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি কলেজ স্তরেও একটা সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সংখ্যা বেড়েছিল।
স্বাস্থের ক্ষেত্রে বাজেটের অর্থ চিকিৎসার তিনটি স্তরে ভাগ করে খরচ হত। প্রাথমিক স্তর, মধ্যম স্তর ও সর্বোচ্চ স্তর। তবে আমরা বাজেটটা ধীরে ধীরে প্রাইমারি চিকিৎসায় বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন আপনারা চারদিকে শুধু অনেক বিল্ডিং দেখবেন। অথচ চারদিকে ডাক্তারের অভাব। নতুন মেডিকেল কলেজ তৈরি করতে হবে, মেডিকেল কলেজের জন্য নতুন শিক্ষক লাগবে, স্পেসালিস্ট লাগবে সব রকম। অর্থাৎ স্নাতকোত্তরে আসন সংখ্যা বাড়াতে হবে। এই দিক গুলো মাথায় রেখে আমরা এগোচ্ছিলাম। এর পাশাপাশি আমরা চেষ্টা করছিলাম এই পরিষেবা একদম নিচে পর্যন্ত কিভাবে দেওয়া যায়। আর এখন রিপোর্টে দেখছি, মেডিকেল কলেজের নামে শুধু বড় বড় বিল্ডিং বানিয়েছে, সেখানে কোন শিক্ষক নেই। এগুলোর বেশীরভাগই আবার প্রাইভেট, মানে তারা সরকারী কাজ ও কোটাতে আসবে না। আমাদের সময় ও একটা প্রাইভেট কলেজ হয়েছিল। কিন্তু আমরা বাধ্য করেছিলাম, সেখানে সরকারী যে কোটা সেটা রাখতে হবে। গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা এখন কমে গেছে।
সব রাজ্যগুলির শেষ যে রিপোর্ট দেখছি তাতে আমরা অনেকগুলো বিষয়ে পিছিয়ে পড়েছি। এখানে সংগঠিত বেকারি ও দারিদ্র্যের হার যথেষ্ট বেশী। শেষ ২০২২-র যে সমীক্ষা হয়েছে, (ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, ইস্যু নম্বর ৪, ২০২২-তে প্রকাশিত) দেখা যাচ্ছে মোট ৪ টি জেলা নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে। উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, বর্ধমান ও পুরুলিয়া। অর্থাৎ দুটি পিছিয়ে পড়া জেলা আর দুটি অপেক্ষাকৃত উন্নত জেলা। এখনকার হিসাবে ৪৭ টাকা পরিবার পিছু খরচ করার ক্ষমতা যদি দারিদ্রের মাপকাঠি হয় (রঙ্গরাজন কমিটির সুপারিশ) তবে সেই সংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ৭৯.১৭ শতাংশ। দারিদ্রের মাপকাঠিতে, ১৯৭৮ সালের আগে পশ্চিমবঙ্গের হার ছিল ৭৩ শতাংশ। নমুনা সংগ্রহের (NSS)-র হিসাবে বাম আমলে সেই হার অর্ধেকেরও কম জায়গায় পোঁছায়। এখন যে হিসাব তাতে ২০ শতাংশ মত মধ্যবিত্ত আর বিত্তবান বলা চলে ০.৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমছে। এখানে মূল্যবৃদ্ধি সর্বভারতীয় গড়কেও ছাপিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে! এই পরিস্থিতির জন্যই রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে আজকের অবস্থা প্রসঙ্গে এঁদের বিষয়ে বিশদ প্রবন্ধ লিখেছেন অভিজিৎ মিস্ত্রী (ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি, জুলাই ১৭, ২০২১), তাতে উল্লেখ রয়েছে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দশকওয়াড়ি হিসাবে পশ্চিমবঙ্গে নিট অভিবাসন কখনো ঋণাত্মক ছিল না। অর্থাৎ যারা এরাজ্য থেকে বাইরে গেছিলেন তার চাইতে যারা এরাজ্যে এসেছিলেন তাদের সংখ্যা বেশি ছিল। ঐ হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সেই নিট অভিবাসন ঋণাত্মক হয়েছে, এর পরিমাণ ১১ লক্ষ ৭ হাজার, অর্থাৎ এই সংখ্যক মানুষ বাইরে চলে যাচ্ছেন। একথা ঠিকই যে এদের সবাই কাজের জন্য যাচ্ছেন না- কিন্তু বেশিরভাগটা শ্রমিকরাই এটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধা নেই।
বিশ্বের দরবারে ভারত আর দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সাফল্যের হিসাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তালিকার একেবারে নীচের দিক থেকে হয় ৩ না হয় ৪ নম্বরে রয়েছে।