অসন্তোষের হেমন্তে ফ্রান্সে বেজে উঠল সময়ের ঘড়ি
সাড়া দিল ইউরোপ
অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
নব্বইয়ের দশকে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র যখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, রক্তপতাকা নেমে গেল ক্রেমলিনের চুড়া থেকে, তখন দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছিল, ইতিহাসের ইতি হয়েছে। ‘There is no alternative’, কোনও বিকল্প নেই, হয় তুমি নব্যউদারনৈতিক অর্থনীতির ‘অভ্রান্ত’ যুক্তি গ্রহণ করো, ওয়াশিংটন কনসেন্সাসকে বেদবাক্য মেনে নাও, নাহলে যাও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। দামামা পিটে বলা হয়েছিল, সমাজতন্ত্রের স্থান ঐখানেই। ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ কথাটার উপরেই একপ্রকার অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বসে গেছিল। শ্রেণী নিয়ে তুমি কথা বলছো, মানে তুমি প্রাচীনপন্থী, ও আবার কেউ বলে নাকি ? আর ‘ধর্মঘট’ ? সোভিয়েত পূর্ব নতুন বিশ্বব্যবস্থার রচয়িতারা, ঠান্ডা যুদ্ধে বিজয়ী শ্রেণী, বৌদ্ধিক জগত থেকে সংবাদমাধ্যম, সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা তাঁদের একচেটিয়া সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে ব্যবহার করে জনমত গড়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করলেন যে ধর্মঘট বিষয়টিই একটি প্রাগৈতিহাসিক বিষয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ইউরোপে সমাজতান্ত্রিক ব্লকের অবসান সেই মহাদেশের শ্রমিক আন্দোলনকে নব্বই-এর দশকে এক জোরালো আদর্শিক ধাক্কা দিয়েছিল। এই ধাক্কা ও বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়েই এতদিন সাম্যবাদী জুজুর ভয়ে পশ্চিম ইউরোপীয় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি যে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, তাতে মহানন্দে হাতুড়ি চালাতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। সংগঠিত শ্রমিক রাজনীতি এই সময় ক্রমশ ‘তৃতীয় পন্থা’র দিকে চলে যাওয়ায় এই কাজে তারা বাধা তো পায়ই নি, বরং টোনি ব্লেয়ারের লেবার পার্টি অথবা গেরহার্ড শ্রোডারের এস.ডি.পি-এর মতো তথাকথিত শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতারা ‘তৃতীয় পথ’-এর অনুসরণের নামে কার্যত নব্য উদারনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই দলগুলির মধ্যে যাঁরা তখনও সমাজতন্ত্র অথবা শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার কথা বলছিলেন তাঁদের ‘লুনি লেফট’ দাগিয়ে একঘরে করে দেওয়া হয়েছে বারে বারেই।
কিন্তু চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়। ইউরোপের বিজয়গর্বে মত্ত পুঁজিপতি শ্রেণীকে ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মহামন্দা প্রথম বুঝিয়ে দিয়ে গেছিল, সব ঠিক নেই, ইতিহাস শেষ হয়ে যায় নি। এরপর থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক যত অগ্রসর হয়েছে পশ্চিম ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণী তার হারানো লড়াকু মেজাজ ফিরে পেয়েছে। বিশেষ করে গ্রীস, স্পেন, পর্তুগাল এবং বেলজিয়ামে (এবং সাম্প্রতিককালে আশ্চর্যজনক ভাবে পোল্যান্ডে) নতুন নতুন র্যাডিকাল সমাজতন্ত্রী আন্দোলন গড়ে উঠেছে, যা আক্ষরিক অর্থেই ধর্মঘটের মাধ্যমে লিখেছে নতুন ইতিহাস। পুরনো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলগুলির মধ্যেও দেখা দিয়েছে র্যাডিকাল বামপন্থীদের স্পন্দন যাঁরা দলগুলির ভেতর থেকে নেতৃত্বে থাকা নব্য-উদারপন্থার কাছে আত্মসমর্পণকারী ‘তৃতীয় পথ’-এর প্রবক্তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন । মোট কথা ২০১৯-২০-এর আগে থেকেই একথা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের শাসক শ্রেণী আর ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারছে না, ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণী বিনা সংগ্রামে আর সূচাগ্র মেদিনীও ছাড়তে প্রস্তুত নয়। কিন্তু ২০২০-এর কোভিড মহামারি ও ২০২২-এর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সৃষ্টি দুই অর্থনৈতিক সংকটের জোড়া ধাক্কা এই শ্রেণী সংঘাতকে এক নতুন মাত্রা প্রদান করেছে।
২০২২ সালের সূচনা ইউরোপে হয়েছিল একের পর এক জোরালো ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে যার সলতে-তে প্রথম আগুন দিয়েছিল ব্রিটিশ রেলশ্রমিকরা। রেলশ্রমিকদের বামপন্থী ইউনিয়ন আর.এম.টির ধর্মঘটের মধ্যে দিয়েই সূচনা হয়েছিল ইউরোপ জোড়া ধর্মঘট ও আন্দোলনের, যাকে সাংবাদিকরা নাম দিয়েছিলেন ‘Summer of Discontent’ বা ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম’। এরপর থেকে ধর্মঘট ও আন্দোলন থামেনি। একটানা সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের কোনও না কোনও দেশের কোনও না কোনও শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট করেই গেছেন। একটি শেষ হতেই আরেকটি আন্দোলন- ধর্মঘট শুরু হয়েছে। তবুও মাঝখানে গ্রীষ্মকাল শেষ হলে তীব্র আন্দলনের তীব্রতা, ব্যপ্তি ও তার লড়াকু মেজাজে ভাটা পড়েছিল। সেই স্ফুলিঙ্গকেই আবার গনগনে অগ্নিশিখার রূপ দিলেন ফ্রান্সের ধর্মঘটি শ্রমিকরা।
ফ্রান্স, বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স, প্যারি কমিউনের ফ্রান্স, শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাসে যে দেশের শ্রমজীবী জনতার নাম বারে বারে সোনার অক্ষরে লেখা হয়েছে। এই দেশের শ্রমিক শ্রেণী যে তাঁদের এই সোনায় লেখা ইতিহাসের যোগ্য উত্তরাধিকারী, তা বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে সার্কোজি সরকারের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের ঐতিহাসিক সাধারণ ধর্মঘট থেকে ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন হয়ে ২০১৯-এর মাক্রোঁ সরকারের পেনশন সংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। ২০২২-এও ইংল্যান্ডের ‘অসন্তোষের গ্রীষ্ম’ শুরুটা ইংল্যান্ডের রেলশ্রমিকরা করলেও আন্দোলনের তীব্রতায় ইংলিশ চ্যানেলের এপাশে থাকা তাঁদের ফরাসী কমরেডরা ছিলেন অনেকটাই এগিয়ে। সাময়িক ভাবে আন্দোলন ধর্মঘটে কিছুটা ভাটা পড়লেও শ্রমিক শ্রেণী ছিল লড়াকু মেজাজেই ।
সেই মেজাজেরই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল গত ২৭-শে সেপ্টেম্বর, যখন একদিকে আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর অন্যদিকে দীর্ঘকাল ধরে নামমাত্র বৃদ্ধি পাওয়া বেতনের মধ্যে বাড়তে থাকা বৈষম্য আর সহ্য করতে নারাজ শ্রমিকরা রুখে দাঁড়ালেন। এই ধর্মঘটের সূচনা হয়েছিল Total Energies গ্রুপের শ্রমিকদের মধ্যে থেকে। ১৯৯৪ সালে, যখন শ্রমিক শ্রেণী দুর্বল এবং দিশেহারা , তখনই জনগণের অর্থে গড়ে ওঠা Elf এবং Total নামে দুটি তেল ও শক্তি উৎপাদক কোম্পানির বেসরকারীকরণ করা হয়। তার থেকেই জন্মগ্রহণ করে এই Total Energies গ্রুপ। বর্তমানে আয়ের নিরিখে এটি ফ্রান্সের বৃহত্তম কোম্পানি এবং জনগণের পয়সায় বানানো পরিকাঠামো ব্যবহার করে বছরের পর বছর লাভের মুখ দেখেও এই কোম্পানি রাষ্ট্রকে নামমত্র কর প্রদান করে। ২০১৯ থেকে তো কর্পোরেট ট্যাক্স হিসেবে একটি পয়সাও Total Energies রাষ্ট্রকে দেয় নি। ২০২২ সালের প্রথমার্ধেই এই কোম্পানির মুনাফা ছিল ১৮.৮ বিলিয়ন ইউরো, ২০২১-এর প্রথমার্ধের তুলনায় তিনগুণ বেশি। কোম্পানির সি.ই.ও-এর বেতন বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫২ শতাংশ, এদিকে কোম্পানির শ্রমিকদের ২ থেকে ৩ শতাংশের অধিক বাড়েনি। গত ২৭-শে সেপ্টেম্বর পাঁচটা Total Energies এবং দুটি মার্কিন Exxon কোম্পানির রিফাইনারিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। যথারীতি অগ্রভাগে ছিল ফরাসী সাম্যবাদী ট্রেড ইউনিয়ন ‘Confédération Générale du Travai’ বা CGT। তাঁদের দাবী অন্ততঃ ৭.৫% থেকে ১০% শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি।
প্রথম দিকে এই ধর্মঘট রিফাইনারিগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সরকার চাইল জোর করে রিকুইজিশনের মাধ্যমে এই ধর্মঘট ভেঙে দিতে। মাক্রোঁ ভুলে গিয়েছিলেন তাঁরা আর নব্বই-এর দশকে নেই। যা ইচ্ছে তাই করার দিন গত হয়েছে। এই নগ্ন ভাবে পুঁজির স্বপক্ষে সরকারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ফ্রান্সের শ্রমিক শ্রেণী আবারও দেখিয়ে দিল সাম্প্রতিক সময়ে তাদের শ্রেণী ঐক্য সংগ্রামের আগুনে কতটা মজবুত হয়েছে। প্রথমে SNCF-এর রেলশ্রমিকরা পাশে দাঁড়ালো ধর্মঘটের, তারপর ক্রমশ CGT-এর উদ্যোগে সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থন ছড়িয়ে পড়ল শ্রমিক শ্রেণীর সব অংশের মধ্যে। প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হল এমন সাধারণ ধর্মঘটের যা ফ্রান্স স্তব্ধ করে দিতে পারবে। বেতন বৃদ্ধির প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে জোড়া হল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে VAT-এর হার অন্ততঃ ৫.৫% হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে পেনশন বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা – যে দুই খাতে নব্বইয়ের দশক থেকে বছরের পর বছর ব্যয় বরাদ্দ কমানো হয়েছে তাতে আবার যথাযথ অর্থ ব্যয়ের দাবীও। যে কর্পোরেশনগুলি প্যানডেমিকের সময় সুপারপ্রফিট অর্জন করেছে কোনও কর না দিয়েই, দাবী তোলা হল তাঁদের আয়ের উপরে কর বসানোরও। ২০১৯-এ বিভিন্ন কোম্পানি রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়েছে প্রায় ১৫৭ বিলিয়ন ইউরো, রাষ্ট্রীয় বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। তাদের জন্য রাষ্ট্রের টাকা আছে আর শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়, পেনশন ও বেতন বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি এবং কর ছাড়ের মাধ্যমে জনগণকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার অর্থ রাষ্ট্রের নেই – এই যুক্তি আর শ্রমজীবী জনতা মেনে নিতে রাজি ছিল না। ১৮-ই অক্টোবর আহ্বান করা হল সাধারণ ধর্মঘটের।
যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল শুধু বেতন বৃদ্ধির দাবী, তা একটি রাজনৈতিক মাত্রা পেয়ে গেল জঁ-লুক মেলশোঁ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত বামজোট ‘Nouvelle Union populaire écologique et sociale’ বা ‘নয়া পরিবেশ ও সামাজিক গণ ইউনিয়ন’ বা সংক্ষেপে NUPES -এর উপস্থিতিতে। গত জুন মাসের নির্বাচনে এই জোট ফ্রান্সের প্রধান বিরোধী শক্তি এবং প্রধান বামপন্থী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রায় ৩১ শতাংশ ভোট এবং ১৫১-টি আসন জয়ের মধ্যে দিয়ে। যে র্যাডিকাল সমাজতন্ত্রী রাজনীতি এই জোট সমর্থন করে, তা যে তারা নিছক পার্লামেন্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে ইচ্ছুক নয়, তা স্পষ্ট হয়ে গেল যখন ১৬-ই অক্টোবর ধর্মঘটের সমর্থনে পারির রাস্তার দখল নিল NUPES-এর সমর্থকরা। প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার জনতার যৌথ অগ্রগতিতে এলিজে প্রাসাদ টলে উঠল। মেলেশোঁর পাশে দাঁড়িয়েই ধর্মঘটের সমর্থনে রাজপথে হাঁটলেন সদ্য সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী অ্যানি এরনোঁ-র মতো ব্যক্তিত্বও। আর ১৮-তারিখ সাধারণ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করলেন পারমাণবিক বিদ্যুৎ, গণপরিবহণ, তৈল শোধন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য-এর সঙ্গে যুক্ত প্রায় তিন লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পুরো দেশ স্তব্ধ করে দেওয়া এবং তাতে তাঁরা বহুলাংশে সফলও হয়েছেন। সাধারণত রাজনীতিতে থাকতে চাননা, এমন অনেক মানুষেরও সমর্থন ছিল ধর্মঘটে। উৎসাহিত C.G.T পরের ধর্মঘট ডাকে গত ২৮-শে অক্টোবর। এই ধর্মঘটও সফল হয় আশাতীত ভাবে।
মাক্রোঁ সরকার পরপর দুটি দেশ স্তব্ধ করে দেওয়া সাধারণ ধর্মঘটের পরেও উত্থাপিত খুব সাধারণ দাবীগুলি, যাকে কোনো ভাবেই বৈপ্লবিক বলা হাস্যকর, একবার বিবেচনা করে দেখতেও নারাজ। সরকারী তরফে বলা হচ্ছে আলোচনার সময় অতীত হয়ে গেছে, শ্রমিকরা হয় কাজে ফিরুক, নাহলে বলপ্রয়োগ করে ফেরানো হবে। অর্থাৎ আলোচনা না, সরকার চাইছে ধর্মঘটীদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। এই প্রেক্ষিতে CGT প্রস্তুতি নিচ্ছে আগামী ১০-ই নভেম্বর আরেকটি সাধারণ ধর্মঘটের। CGT-এর সাধারণ সম্পাদক ফিলিপ মার্টিনেজ জানিয়েছেন দাবী আদায় না হওয়া অবধি তাঁরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। ‘La France Insoumise’ (বিদ্রোহী ফ্রান্স) বা LFI, যা NUPES-এর প্রধান দল এবং পরিচালক ও ফরাসী পার্লামেন্টের বৃহত্তম বাম দল, তার পরিষদীয় নেত্রী মাটহিল্ড পানো জানিয়েছেন – ‘যদি রাষ্ট্রপতি জনতার উপর সামাজিক যুদ্ধ চালাতে চান, আমরা সমস্তরকম ভাবে তার প্রত্যুত্তর দিতে প্রস্তুত।‘
এই লড়াইয়ে আশা করা যায় শ্রমিক শ্রেণীই অন্তিমে বিজয়ী হবে। কিন্তু তাঁরা যদি অসফলও হন, ফ্রান্সে মাত্র দশদিনের ব্যবধানে পরপর দুটি ব্যপক ভাবে সফল সাধারন ধর্মঘট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। ‘L'humanité’-পত্রিকার সম্পাদকীয়তে সেবাস্টিয়ান ক্রেপেল লিখেছেন যে ফ্রান্সে ২০০৮ সালে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলা সার্কোজি গর্ব করে বলেছিলেন ‘আজকাল ফ্রান্সে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হলেও তা টেরই পাওয়া যায় না।‘ সেই ফ্রান্সেই প্রায় তিন লক্ষ মানুষের সাধারণ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ ও রাস্তায় সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে মানুষের ঢল প্রমাণ করে লড়াকু শ্রমিক আন্দোলন তার নব্বই-এর দশকের হারানো আত্মবিশ্বাস বহুলাংশে ফিরে পেয়েছে। তারা আর স্থিতাবস্থা মেনে নেবে না। মেলেশোঁ যখন প্রকাশ্যে নতুন পপুলার ফ্রন্ট এবং ষষ্ঠ ফরাসী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিচ্ছেন, তার সমর্থনে আকাশে উঠে আসছে শত শত মুষ্টিবদ্ধ হাত। নব্বইয়ের নৈরাশ্য পরিত্যাগ করে এক নতুন বিকল্প অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ফ্রান্সের শ্রমজীবী জনতার একটি বড়ো অংশই আগ্রহী।
একদা বলা হত ফ্রান্স কাশলে ইউরোপের সর্দি হয়। একথা আজও একেবারে মিথ্যা নয়। মার্টিনেজ নিজেও বারে বারে বলেছেন এই সমস্যা নিছক ফরাসী সমস্যা নয়, সমগ্র ইউরোপীয় শ্রমিক শ্রেণীরই সমস্যা। তাই দেখি লড়াকু শ্রমিক ধর্মঘট ও আন্দোলন এখন ছড়িয়ে পড়ছে মলডোভায়, গ্রীসে, সাইপ্রাসে, ক্রোয়েশিয়ায়, এমনকি সুইজারল্যান্ডের মতো দেশেও। আন্দোলন ঘনীভূত হচ্ছে ডেনমার্ক এবং বেলজিয়ামেও। ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়নগুলিও গ্রীষ্মকাল থেকেই লড়াকু মেজাজে রয়েছে, ইতালির ট্রেড ইউনিয়নগুলি নবাগত নব্য-ফ্যাসিস্ট অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি চালাচ্ছে জোর কদমে স্কোয়াদ্রিস্তি ধাঁচের ফ্যাসিস্ট হামলা অগ্রাহ্য করে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম জার্মানি। বিমান পরিবহনকর্মীরা এবং রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার শ্রমিকরা ধর্মঘট করলেও তা ফ্রান্সের মতো সাধারণ ধর্মঘটের রূপ নেয় নি। কিন্তু একদিকে লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি অন্যদিকে থমকে থাকা বেতনের সিলা ও কারিবডিস-এর মাঝে আটকে পড়া শ্রমজীবী জনতা এবং অপরদিকে ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা থেকে সৃষ্ট যুদ্ধের সুযোগ রাষ্ট্রকে নামমাত্র বা শূন্য কর প্রদান করে মহামুনাফা লুটে নিয়ে যাওয়া কর্পোরেশনগুলির মধ্যে থাকা যে দ্বন্দ্ব, তা আজ হোক বা কাল, পশ্চিম ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির শ্রমিকশ্রেণীকেও বাধ্য করবে পক্ষ নিতে। তাঁরাও তাঁদের ফরাসী সাথীদের মতোই রস্তায় দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরতে বাধ্য হবেন - ’Partage des richesses, ou alors ça va péter’- ‘হয় সম্পদের বন্টন, নয়তো বিস্ফোরণ’। শ্রেণী সংগ্রামের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে ছিটকে পড়ছে সারা ইউরোপ জুড়ে, বাড়ছে শ্রমিক শ্রেণীর অসন্তোষের বারুদের স্তুপও। আজ ফ্রান্স তথা ইউরোপের ধনিক শ্রেণী বেতন বৃদ্ধি সহ সাধারণ দাবীর পঞ্চ গ্রাম দিতে অস্বীকার করছে, কিন্তু যেদিন স্ফুলিঙ্গ বারুদের উপর পড়ে খাণ্ডবগ্রাসী অগ্নিশিখা জ্বলে উঠবে, সেইদিন রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তিনাপুরই তাঁদের ছেড়ে দিতে হবে একথা তাঁরা যেন বিস্মৃত না হন।