২১ জুন ২১, সোমবার
২০১১-তে রাজ্যে সরকারে পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭৭-এও তাই হয়েছিল।
সংসদীয় গনতন্ত্রে তাই হয়। নির্বাচনে কোনও দল জেতে। কোন দল হারে। এটাই স্বাভাবিক। ১৯৭৭ থেকে টানা ৩৪ বছর রাজ্যে বামফ্রন্টের সরকার ছিল। ২০১১ থেকে আছে তৃণমূলের সরকার। সংসদীয় গনতন্ত্রেই যখন আছি, তখন এতে অস্বাভাবিকতা কী আছে?
১৯৭৭ থেকে পরবর্তী ৩৪ বছরের ইতিহাসে উঁকি মারলে দেখা যাবে বেশিরভাগ সময় বামফ্রন্টকে লাগাতার কেন্দ্রীয় সরকার, সেই সরকারে থাকা দলের বিরুদ্ধে প্রচার করতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেই সরকারে আসীন দল অথবা ফ্রন্ট প্রবল বিরোধিতা, চক্রান্ত চালিয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে।
২০১১ পরবর্তী দশ বছরের ইতিবৃত্ত বলছে, এই ক্ষেত্রেও রাজ্যের শাসক দল এবং কেন্দ্রের শাসক দলের মধ্যে লাগাতার বিরোধিতা দেখা গেছে। তৃণমূল কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে।
তাহলে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের সরকার আলাদা কিসে?
আছে। তফাৎ আছে। বিস্তর, মৌলিক।
একটি প্রভেদ গোড়াতেই স্পষ্ট। তৃণমূল সেই সব শাসক দলের বিরোধিতার প্রচার চালাচ্ছে, যে শাসক দলের সঙ্গে তারা জোটে ছিল। যখন তারা রাজ্যের সরকারে এসেছে তখন তারা দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে ছিল। তার আগে দীর্ঘ সময় তারা বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের শরিক ছিল। অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জি সেই কেন্দ্রীয় সরকার, শাসক দলগুলির নীতির বিরোধী নন। কখনও নন।
‘বিকল্প’র ভাবনার উৎপত্তি এখানে।
কমরেড জ্যোতি বসু কী বলছেন? ২০০৬-র জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তাঁর ছোট প্রবন্ধ ‘ঐতিহ্য অম্লান রাখতে হবে।’ কেন্দ্রে তখন প্রথম ইউপিএ সরকার। বামপন্থীরা সেই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করছে। তখন বসু লিখছেন,‘‘আজকের যা পরিস্থিতি তাতে রাজ্য সরকার পরিচালনা করা খুবই কঠিন। আমাদের পার্টি কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধিতা করে। আবার রাজ্য সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে সেই নীতির পরিধির মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়। এই অবস্থার মধ্যে জনসাধারনের স্বার্থকে রক্ষা করেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এটাই আমাদের বিকল্প পথ।’’
স্পষ্ট — বিকল্প নীতির অভিমুখ কী।
এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ কী? বসু বললেন, যা তিনি বারবার বলেছেন, নানা ভাবে —‘‘একাজে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। সর্বশিক্ষা, সর্বস্বাস্থ্য, স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, গ্রামোন্নয়ন সর্বক্ষেত্রেই আমাদের অভিজ্ঞতা হলো যেখানে গণ-উদ্যোগ তৈরি হয়েছে সেখানে সাফল্য এসেছে। যেখানে তা হয়নি সেখানে যতটা সাফল্য আসা উচিত ছিল, আসেনি।’’
তাহলে কী দাঁড়ালো?
‘বিকল্প’ একটি নীতিগত অবস্থান। সিপিআই(এম)-র সরকার পরিচালনা কিংবা অংশগ্রহণ একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। তার মোদ্দা কথা দেশের শাসকদের অনুসৃত নীতির পরিধির মধ্যে কাজ করতে বাধ্য হয়েও যতদূর সম্ভব মানুষের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কাজ করাই বিকল্পের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য। সে কাজ করতে গেলে প্রধান শক্তি মানুষ, গণ-উদ্যোগ। মানুষকে সংগঠিত করতে না পারলে কর্মসূচী যত ভালোই হোক, তা সফল হতে পারে না।
কেন?
কারন — আমরা স্রোতের উল্টো মুখে আছি।
স্রোতের পক্ষে থাকলে বিকল্পের প্রশ্ন নেই। যেমন তৃণমূলের নেই।
তৃণমূল কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক, রাজনৈতিক নীতির বিরোধিতা করে না। মূলত কোনও দল, কোনও নেতার বিরোধিতা করে। সেটি পুরোপুরি রাজ্যের ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য একটি কৌশলগত অবস্থান। চালাকি। মমতা ব্যানার্জি বলতে পারেন,অটলবিহারী বাজপেয়ী ভালো ছিলেন। কিন্তু মোদী খারাপ। আমাদের কাছে দু’জনেই বিরোধিতার যোগ্য। কারন — তারা দু’জনেই যে আর্থিক নীতি নিয়ে চলেছেন, চলেন — আমরা তার বিরোধী।
বিকল্পের কর্মসূচী,‘দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত’-------------
বামফ্রন্টের ‘বিকল্প’র নির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে।
আমাদের দেশের শাসকরা অর্থনৈতিক বিকাশের পথ হিসাবে ধনতন্ত্রকে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু তা করা হয়েছে সামন্ততন্ত্রকে নির্মূল না করে। তাই আমাদের দেশের শাসনযন্ত্রের দুর্বলতম গ্রন্থি হলো পুঁজিবাদের সঙ্গে সামন্তবাদের সম্পর্ক। সিপিআই(এম) এই দুর্বলতম গ্রন্থিতে আঘাত করে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজগুলিকে যতদূর সম্ভব এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সরকারে অংশ নেয় কিংবা নিয়েছে। জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যের পক্ষে সহায়ক হিসাবেই তা করার চেষ্টা হয়েছে। কমরেড নিরুপম সেনের কথায়,‘‘রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারকে এমন ধরনের কর্মসূচী গ্রহন করতে হবে যা এই দুর্বলতম গ্রন্থিটিকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে। রাজ্য সরকারের হাতে সংবিধানপ্রদত্ত যে ক্ষমতা আছে, সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এই কাজ কতখানি করা যায়, তারই মধ্যে আমাদের বিকল্পের ধারনা নিহিত।’’(‘বিকল্পের সন্ধানে’, ২০০৬)
সেই ‘বিকল্প’ প্রতিষ্ঠার কাজই বামফ্রন্ট লাগাতার করেছে। এই ব্যবস্থায় অন্য যে কোনও সরকারের তুলনায় বামফ্রন্টের সরকারের মাহাত্ম্য এখানেই — বিকল্পের ভাবনায়। বামফ্রন্ট কী কী করেছিল এই লক্ষ্যে?
প্রথমত, ভূমিসংস্কার। অনেকের ভাবনায় আছে — ‘ভূমিসংস্কার? সেই পুরোন কাসুন্দি!’ তা নয়। আমাদের বারবার ভূমিসংস্কারের তাৎপর্য বুঝতে হবে। নাহলে বিকল্পের ধারনা কিছুতেই স্বচ্ছ হতে পারে না। যে ভূমিসংস্কার বামফ্রন্ট করেছিল, সেটি আমূল নয়, এই ব্যবস্থায়, সংবিধানের এক্তিয়ারের মধ্যে থেকে যতদূর করা যায় — সেটিই। কৃষক জমির অধিকার পেয়েছিল। তাতে কী এসে গেছিল? তাতে গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছিল। গ্রাম একটি বড় বাজারে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু শুধু এই? না। ভূমিসংস্কার এই রাজ্যের সামন্ততন্ত্রকে আঘাত করেছিল। দুর্বল করেছিল। দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্ট ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তাও এই ব্যবস্থায় থেকে, আইনের আওতায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু বাকি কেউ করেনি। বামফ্রন্ট পঞ্চায়েতকে গড়েছিল কেন? গ্রামে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য পাল্টে দিতে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত সামন্ততন্ত্রকে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে প্রবল আঘাত করেছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আসলে রাজ্যে শক্তির ভারসাম্যের এক গুরুতর পরিবর্তন। একই কাজ শহরে হয়েছিল। নতুন নতুন পৌরসভা গড়া হয়েছিল। তার পরিচালনভার দেওয়া হয়েছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে।
এই দুটি কাজই এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সরকার পরিচালনার মাধ্যমে গনতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে পরিচালিত বিকল্প প্রতিষ্ঠার কাজ।
এই দুই কর্মসূচী আরও কিছু পরিবর্তন এনেছিল, যার প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজে সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখেছে। যেমন,
বামফ্রন্ট জমিতে মহিলাদের অধিকার সুনিশ্চিত করেছিল।
মহিলাদের নামে পাট্টা দেওয়া হচ্ছিল। দ্বিতীয়ত, ভূমিসংস্কারে পিছিয়ে থাকা তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের অনেকেই জমির অধিকারী হয়েছিলেন। পঞ্চায়েত পরিচালনাতেও মহিলাসহ সমাজের এই পিছিয়ে থাকা অংশের অংশগ্রহণ বাড়ছিল। মহিলা পরিচালিত পঞ্চায়েত গড়ে উঠেছিল। আজকের পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন ধরে সমাজে অবহেলিত অংশের এই ক্ষমতায়ন কী বিরাট অবদান, তা স্পষ্ট হয়। এই ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট যা করেছে তা নিঃসন্দেহে সামন্ততন্ত্র-পুঁজিবাদের গাঁটছড়ায় নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় এক বিকল্পই।
যদি খুব গভীরে গিয়ে বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে গ্রামীণ জীবনে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে সব ধর্ম, জাতের মানুষের মধ্যে এক ঐক্য গড়ে তুলেছিল। কাছাকাছি থাকা, একসাথে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং মত প্রকাশ করতে পারার অধিকার অর্জন গ্রামস্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামাজিক সাম্যের ধারনাকে দৃঢ় করেছিল। অর্থাৎ, এই ব্যবস্থার মধ্যেই ভূমিসংস্কার এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মহিলাদের একটি নতুন শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করেছিল। আবার ধর্মনিরপেক্ষতাকে দৃঢ় করেছিল, জাতপাতের অসাম্যের সামন্ততান্ত্রিক ধারনাকে দুর্বল করেছিল।
অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস বলছে, রাজনৈতিক, সামাজিক আধিপত্য ভোগ করেছে সম্পন্ন, উঁচু জাতের বর্ণ হিন্দুরা। সেই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল বামফ্রন্টের ভূমিসংস্কার, ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কর্মসূচী।
এ’ যদি বিকল্প না হয়, তাহলে এই ব্যবস্থার মধ্যে বিকল্প কী?
এই দুটি কাজ দেশের প্রায় কোথাও হয়নি। শাসকরা করেনি। খেয়াল করলে দেখা যাবে, তৃণমূল এই দুটি পদক্ষেপকে সরাসরি অগ্রাহ্য করতে পারেনি। কিন্তু তারা ভূমিসংস্কার বন্ধ রেখেছে। এই দশ বছরে গ্রামে জমি কুক্ষিগত হচ্ছে একাংশের হাতে — ছলে, বলে এবং কৌশলে। তারা পঞ্চায়েত, পৌরসভা পরিচালনার ব্যবস্থাকেও দুর্বল করেছে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে পঞ্চায়েত, পৌরসভার তৎপরতা রুদ্ধ করেছে। এই নীতি শুধু তৃণমূলের নয়। দেশের শাসকদের। মমতা ব্যানার্জি সেই নীতির অনুসারী।
রাজ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মতামতের গুরুত্ব কমেছে। এক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। কোথাও তা জাতপাত নির্ভর। কোথাও ধর্মীয় পরিচিতিসত্বাকে কেন্দ্র। যা ৩৪ বছরে পিছু হটেছিল, অবদমিত হয়েছিল, তা মাথা তোলার সুযোগ পেয়েছে। গনতন্ত্র দুর্বল হচ্ছে। শক্তির নতুন ভারসাম্য গড়ে উঠছে। ভূমি সংস্কারে উপকৃত, নয়া আর্থিক নীতির সুবিধাভোগী একাংশ ক্ষমতা করায়ত্ব করছে। তার হাত ধরে তৈরি হচ্ছে সুবিধাভোগী এবং বঞ্চিত অংশের দ্বন্দ্ব।
বামফ্রন্ট এবং সামাজিক সুরক্ষা--------------------------
সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা আজকের সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার সেই প্রশ্নে অগ্রাধিকার দিয়েছিল বিকল্প কর্মসূচী হিসাবেই। নয়া আর্থিক নীতি প্রয়োগ শুরুর পরে তা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
রাজ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা চালু হয় ১৯৮০-তে। বার্ধক্য ভাতা দেওয়া শুরু ১৯৭৯-তে। কৃষকদের ভাতা, বিধবা ভাতাও চালু হয়। ১৯৯০-দশকে জাতীয় স্তরে নয়া উদারবাদী নীতির ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল, তখন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলিতে বামফ্রন্ট সরকার জোর দিয়েছিল। ১৯৯৮-এ রাজ্যের বন্ধ কলকারখানা ও চা বাগানের শ্রমিকদের মাসিক আর্থিক সাহায্য দেওয়া শুরু হয়। কোন রাজ্যে এই নজির ছিল না। কৃষি শ্রমিক ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প চালু হয় ২০০১-এ। প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্পে যাঁরা দু’বছর যুক্ত সেই সব শ্রমিকদের জন্য বামফ্রন্ট সরকারই চালু করেছিল স্বাস্থ্যসুরক্ষা প্রকল্প। এছাড়া পরিবহন শ্রমিকদের জন্য পেনশন ও অন্যান্য সুরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিল সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার। প্রায় ২৫ লক্ষ পরিবহন শ্রমিকের জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য চালু করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ প্রকল্প’। কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পেও শ্রমিকদের দেয় অর্থ রাজ্য সরকার দিয়ে দিত। শ্রমিকদের দিতে হতো না। নির্মাণ কর্মীদের জন্যও পেনশন, পারিবারিক পেনশন, গৃহনির্মাণে সাহায্যের মতো একগুচ্ছ কল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করেছিল সরকার। এজন্য গঠন করা হয়েছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ ভবন ও অন্যান্য নির্মাণ কর্মী কল্যাণ পর্ষদ’। ১৯৯৮-এ ভূমিহীন কৃষকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্প শুরু হয়। এর কোনও নজির ছিল না। ২ টাকা কেজি চাল দেওয়ার কাজও বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে শুরু। ২ কোটি ৬৪ লক্ষ গরিব মানুষকে ২টাকা কেজি দরে চাল দেওয়া হত। আদিবাসী পরিবারকে মহাজনের ঋণের জাল থেকে বের করে আনার প্রকল্প নিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার — ২০০৭-০৮-এ। এই প্রকল্পের চরিত্র কী?
কিন্তু শুধু সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প কী এই অবস্থায় গরিব, প্রান্তিক মানুষকে বাঁচাতে পারে? এই প্রশ্ন ছিল। আছে। থাকবে। এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ। তবে কাজের, উপার্জনের সুযোগ যতদূর সম্ভব বাড়ানোর চেষ্টা চালাতেই হবে — এই ছিল বামফ্রন্টের লক্ষ্য।
উদাহরণ?
আদিবাসী মহিলা সশক্তিকরণ যোজনা( অ্যামসি)। গরিব আদিবাসী মহিলাদের জন্য ছিল প্রকল্পটি। ৯ থেকে ২০ জন মহিলা একটি গোষ্টী গড়ে ঐ প্রকল্পের আওতায় ব্যবসা করতে পারতেন। সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার প্রকল্পের অনুমোদন মিলতো এই প্রকল্পে। ভর্তুকি পাওয়া যেত ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। বাকি টাকা রাজ্যের আদিবাসী উন্নয়ন সমবায় নিগম থেকে ঋণ দেওয়া হত। ২০০৩ থেকে ২০০৯ — এই সময়ে রাজ্যের প্রায় ২৩ হাজার পরিবার এই প্রকল্পে লাভবান হয়েছিল। প্রকল্পটি আদিবাসী মহিলাদের স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে খুবই সহায়ক ছিল প্রকল্পটি। ২০০৬-’০৭ এবং ২০০৭-’০৮ আর্থিক বর্ষে ওই প্রকল্পে সারা দেশে যত মহিলা এই প্রকল্পের আওতায় এসেছিলেন তার ৬৫%-র বেশি এই রাজ্যে হয়েছিল। উল্লেখযোগ্য হলো যে ঋণ রাজ্যের আদিবাসী মহিলারা তিন বছরে নিয়েছিলেন তার ৮০%-র বেশি তাঁরা পরিশোধ করেছিলেন।
সেই প্রকল্প তৃণমূলের সময়কালে বন্ধ হয়েছে। স্বনির্ভরতার উদ্যোগ এই শাসনে অবহেলিত।
ওবিসি তালিকায় আর্থিক, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা সংখ্যালঘু মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করার যে কাজ বামফ্রন্ট সরকার করে গেছে, তা ঐতিহাসিক। দেশের কোনও রাজ্য সরকার তা করে উঠতে পারেনি। ২ কোটির বেশি সংখ্যালঘু মানুষ ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। তালিকায় দুটি ভাগ করা হয়েছে — ‘অতি অনগ্রসর’ এবং ‘অনগ্রসর’-দের জন্য। অতি অনগ্রসরদের জন্য ১০%, অনগ্রসরদের জন্য ৭% চাকরিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিল বামফ্রন্ট। সেদিন মমতা ব্যানার্জি এই কাজের বিরোধিতা করেছিলেন।
কেন বামফ্রন্ট সেই কাজ করেছিল? চাকরির ক্ষেত্রে সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে।
শিল্পের লক্ষ্য ’৭৭ থেকেই-------------------
বামফ্রন্ট সরকারের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হয়েছিল ১৯৯০-৯১ পরবর্তী সময়কালে। নয়া উদারনীতির অর্থনীতির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের সমস্যা, বামফ্রন্টের সামনে চ্যালেঞ্জের চরিত্র বদলাচ্ছিল। অনেক কঠিন হয়ে পড়ছিল বিকল্প প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার পরিচালনার কাজ।
১৯৯০-৯১-এ কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের আর্থিক, শিল্পনীতি পরিবর্তন করেন। সোভিয়েতের বিপর্যয়ের হাত ধরে বিশ্বে তখন ‘বিশ্বায়ন’-র যুগ। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বামফ্রন্ট কী করবে? দুটি পথ ছিল — প্রথমত, নয়া আর্থিকনীতির বিরোধী বলে শুধুই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। সরকার পরিচালনা, মানুষকে আর্থিক নীতির ধাক্কা থেকে যতদূর সম্ভব রক্ষা করার কাজ বন্ধ রাখা। দ্বিতীয়ত, যে নতুন পরিস্থিতির উদয় হয়েছে, তারই মধ্যে নিজেদের কাজ করে যাওয়া। উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং একই সঙ্গে সংগ্রাম অব্যহত রাখা। বামফ্রন্ট দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করলো। সুযোগ হিসাবেও। এই সময়েই ১৯৯৪-র ২৩ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় ‘পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোন্নয়নের রূপরেখা সংক্রান্ত একটি নীতি-বিবৃতি’ পেশ হয়। পেশ করেন কমরেড জ্যোতি বসু। ১৯৯৪-এ গৃহীত হলো শিল্পায়নের কর্মসূচী। ১৯৯৫-এ সিপিআই(এম)-র চন্ডীগড় কংগ্রেসে তা অনুমোদিত হয়।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি, রাজ্যের সদ্য গৃহীত শিল্প নীতি সম্পর্কে ১৯৯৪-র ২৫ ডিসেম্বর জ্যোতি বসুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় গণশক্তিতে। সেখানে তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্র লাইসেন্স পদ্ধতি তুলে নিয়েছে এবং মাসুল সমীকরণ নীতি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা হয়েছে সারা দেশের জন্য। কেন্দ্রীয় সরকার যে সর্বনাশা আর্থিক নীতি ও শিল্পনীতি অনুসরণ করছে, তারই অঙ্গ হিসাবে বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ — বিশ্বব্যাঙ্ক ঋণের শর্তের চাপে অনুসরণ করছে, তারই পরিণামে তারা এ পথ অনুসরণ করছে।’’
কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার কী করবে? জ্যোতি বসু বললেন,‘‘ফলে আমাদের কাছে যেটুকু সুযোগ এসেছে, আমরা তা ব্যবহার করে শিল্পায়নে আমাদের ১৭ বছরের কর্মসূচী রূপায়নের চেষ্টা করছি।’’ অর্থাৎ শিল্পায়নের কর্মসূচী নতুন নয়। ১৯৭৭ থেকেই বামফ্রন্ট সরকারের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল শিল্পায়ন, তার অনুকূল পরিকাঠামো, বিদ্যুৎ সরবরাহের অগ্রগতির মত বিষয়।
কিন্তু নয়া আর্থিক নীতির মধ্যে শিল্পের উদ্যোগ মানে বেসরকারি পুঁজিকে সুযোগ দিতে বাধ্য হওয়া, কেন্দ্রীয় নীতিকে মেনে নেওয়া। জ্যোতি বসুর কথায় ছিল তারও উত্তর — ‘‘...এর অর্থ এই নয় যে, আমরা কেন্দ্রের নতুন আর্থিক নীতি ও নতুন শিল্পনীতির সমর্থক হয়ে গেছি। কেন্দ্র যে নতুন আর্থিক নীতি অনুসরণ করছে, তার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বাম-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি মিলে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছি।...আমাদের এই নীতিগত অবস্থানের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের নতুন এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই আমরা। এর মধ্যে স্ববিরোধিতা খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের শত্রুরা যাতে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের এই উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’’
শিল্প শুধু শিল্প নয়। শিল্প মানে কাজের সুযোগ, নতুন চেতনার মানুষ। এও এক বিকল্প ভাবনার প্রকাশ।
‘উন্নয়ন ও সংগ্রাম’ হলো একটি বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তি। শিল্পায়নের অভিমুখও ছিল তাই।
আমাদের মধ্যে একটি ধারনা প্রোথিত করার চেষ্টা হয়েছে যে, শিল্পায়ন মানে শুধুই সিঙ্গুরের উদ্যোগ এবং চক্রান্ত। কিন্তু তা ঠিক নয়। বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে শিল্পায়নের কাজের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৭ থেকেই। তার আগেই রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি খারাপ হয়েছিল। ১৯৭৭-র আগে রাজ্যে সরকারি ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বিনিয়োগ হয়নি। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫-র মধ্যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিনিয়োগ ১১.৭% থেকে নেমে আসে ৭.১%-এ। ছিল মারাত্মক বিদ্যুৎ সঙ্কট। ১৯৭৭-এ রাজ্যে শিল্প বিকাশ কেন্দ্র ছিল ৩টি। ১৯৮৮তেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২টিতে। অর্থাৎ যে সময়ে ভূমিসংস্কারে গতি আসছে, পঞ্চায়েত গ্রামের সরকার হয়ে উঠছে, পিছিয়ে থাকা অংশ সামনে আসার সুযোগ পাচ্ছে, ঠিক তখনই শিল্পে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।
রাজ্যে শিল্পায়নের কর্মসূচী ছিল বিকল্প প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
‘কৃষি বনাম শিল্প’-র ধারনাটিও চক্রান্তের অংশ হিসাবেই ছড়ানো হয়েছিল। কৃষির অগ্রগতির ভিত্তিতে শিল্পের ধারনা তত্বগতভাবে সমাদৃত ধারনা। কিন্তু ভারতের প্রায় কোথাওই এই ধারনার উপর দাঁড়িয়ে শিল্পায়নের প্রক্রিয়া নেওয়া হয়নি। শুধু শিল্প আর শিল্পপতিদের মুনাফার কথা ভেবে শিল্পায়ন এক নীতি। আর এক নীতি হলো নির্দিষ্ট প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পে জোর দেওয়া। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি বিচার করেই বামফ্রন্ট শিল্পায়নের কর্মসূচী নিয়েছিল।
আশির দশকের তুলনায় নব্বইয়ের দশকে কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধির হার কমছিল। ফসলের দামের নিম্নগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছিল। কৃষিতে খরচ বাড়ছিল। কৃষিতে কাজের সুযোগ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল। এরই মধ্যে জমির লাগাতার ভাগ হওয়াও সমস্যা হয়ে উঠেছিল। আক্রান্ত হচ্ছিলেন মূলত গরিব ও প্রান্তিক কৃষকরা। ২০০৬-এই কমরেড অনিল বিশ্বাস ‘কৃষি ও শিল্পের সমন্বয়েই উন্নয়নের কর্মসূচী’ শীর্ষক প্রবন্ধে দেখাচ্ছেন,‘‘অসম হলেও আমাদের রাজ্যেও গ্রামস্তরে নব্য ধনীদের একটি অংশ গড়ে উঠছে।...কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করা আগামী উন্নয়নের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী। কৃষি বনাম শিল্পের ধারনাটি অবান্তর। কৃষি, কৃষক ও গ্রামোন্নয়নের স্বার্থেই শিল্প গড়ে তোলা জরুরী।’’
শিল্পায়নও তাই ছিল এক বিকল্প কর্মসূচী। এবং তা আছে।
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ, অর্থনীতি, মানুষের দাবি বদলে যায় না। কিন্তু তৃণমূল কিংবা অন্য কোনও শক্তির পক্ষেই সেই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে কর্মসূচী গ্রহণ সম্ভব নয়। দরকার নীতি — বিকল্প নীতি। বৈপ্লবিক লক্ষ্যকে অক্ষুন্ন রেখে, কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক নীতির বিরোধিতা করেও এই ব্যবস্থার মধ্যে মানুষের স্বার্থে সেই বিকল্প নীতির ভিত্তিতে সরকার গড়ে তোলায় ভরকেন্দ্র শুধু কমিউনিস্টদের পক্ষেই হওয়া সম্ভব।