ধর্ম নয়।
নিজের ভাষা-সংস্কৃতিই বাঙালির বড় আপন। এই সংস্কৃতি ধর্মীয় সংকীর্ণতার বিরোধী, সামাজিক রক্ষণশীলতার বিরোধী।
রাজনৈতিক কারণে প্রাচীন বাংলা এখন বিভক্ত। কিন্তু বাঙালির একাত্মতার ভিত্তি প্রধানত রাজনৈতিক নয়। দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐক্য রাজনৈতিক বিভক্তির চেয়ে শক্তিশালী। সাহিত্য, কাব্য, সংগীত ও চিন্তা-নির্ভর সভ্যতার ঐক্যের জোর রাজনীতির থেকে কম নয়। তারই সঙ্গে আছে আমাদের সমাজচেতনার চিন্তামুখি আলোচনা। তার প্রভাব রাজনীতির উপর পরবে না, এমনটি নিশ্চিত নয়। কিন্তু সেই নৈকট্যের ভিত্তি একমাত্র রাজনীতি নয়। বলেছেন অমর্ত্য সেন।
যেমন বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির ঐক্যের নেপথ্যে কবি একান্তভাবে জোর দিয়েছেন ভাষার উপর।
১৯০৭, একটি ভাষণে তিনি বলেন, ‘একবার ভাবিয়া দেখুন, বাঙালিকে আমরা যে বাঙালি বলিয়া অনুভব করিতেছি, তাহা মানচিত্রে কোনো কৃত্রিম রেখার জন্য নহে। বাঙালির ঐক্যের মূলসূত্রটি কী? আমরা এক ভাষায় কথা কই।’ ১৯২৯, আবার একটি অভিভাষণে, তিনি বললেন: ‘তাই বলছি, বাঙালি বাংলাদেশে জন্মেছে বলেই যে বাঙালি তা নয়; বাংলা ভাষার ভিতর দিয়ে মানুষের চিত্তলোকে যাতায়াতের বিশেষ অধিকার পেয়েছে বলেই সে বাঙালি।’ শেষে ১৯৩৮, এ প্রসঙ্গে চূড়ান্ত বক্তব্য রাখলেন রবীন্দ্রনাথ: ‘বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বারেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজেরও মিল ছিল না। তবু এর মধ্যে যে ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। এতকাল আমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে, তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি। শাসনকর্তারা বাংলাপ্রদেশের অংশ-প্রত্যংশ অন্য প্রদেশে জুড়ে দিয়েছেন, কিন্তু সরকারি দফতরের কাঁচিতে তার ভাষাটাকে ছেঁটে ফেলতে পারেননি।’
প্রায় একইসময়, ১৯৩৭। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা দীনেশচন্দ্র সেনের ডাক পরল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীনেশচন্দ্রের বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’।
দীনেশচন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতায় আধুনিক হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের এই জটিলতার বিপরীতে বাংলা ভাষার পুরনো সাহিত্যের নজির হাজির করেছিলেন। তিনি বারবারই বলছিলেন, ইংরেজ উপনিবেশ পর্বে হিন্দু বাঙালি আর মুসলমান বাঙালি পরস্পরের সঙ্গে যে লড়াই করছে, সেই ভেদবিভেদের ইতিহাসের থেকে হিন্দু আর মুসলমান বাঙালির মিলনের ইতিহাস অনেক পুরনো, অনেক দীর্ঘ।
বাঙালির ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি, যার উপর নির্ভর করে বাঙালি বাঙালি হয়ে উঠেছিল, তাতে হিন্দু-মুসলমান দুইয়েরই অবদান আছে। তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘বাঙ্গালার জনসাধারণ বলিতে কাহাদিগকে বুঝিতে হইবে?’ দীনেশচন্দ্র নিজেই সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ইহারা জৈন নহেন, বৌদ্ধ নহেন, খৃষ্টান নহেন, হিন্দু নহেন, মুসলমান নহেন— ইঁহারা বাঙ্গালী।’
বাঙালির চিন্তাধারার পরম্পরার মধ্যে যে দিকগুলি নজর করার মতো, তার মধ্যে একটি গুণ হল বাঙালি সভ্যতার গ্রহণশক্তি এবং সমন্বয়প্রীতি।
অন্যদের সংস্কৃতি গ্রহণ, নতুন সংস্কৃতি চয়ন ও গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের ইতিহাস ও পরম্পরাকে ধারণ করা। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া/ বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।’ এক্ষেত্রে বাঙালির ঐতিহ্যকে হেয় করলে তার প্রতিবাদ জানাতে সে ভুল করে না।
বাঙালি সভ্যতার গ্রহণশীলতা আর প্রশ্ন-প্রবণতা দুই-ই আছে। যে গুণগুলি একসময় বড় রকমের স্বীকৃতি পেয়েছে। তার থেকে বিচ্যুত হলে, সেগুলি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটা পশ্চাৎমুখী চিন্তা নয়। নজরুলের ভাষায় বিদ্রোহী চিন্তার মধ্যেও অতীতের ঐতিহ্যের স্বীকার খুবই প্রয়োজন।
আচ্ছা, বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এটা কত সন? ১৪২৬। এই ১৪২৬ সনের তাৎপর্য কী?
হজরত মহম্মদের মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাওয়ার পর কতগুলো বছর কেটে গিয়েছে, এটি আসলে তারই হিসেব।
অবশ্য, মিশ্র হিসেব। মুসলমানের চান্দ্র-বৎসর আর হিন্দুর সৌর-বৎসর মিলে-মিশেই আমাদের বঙ্গাব্দ।
প্রথম ৯৬৩-বছর গোনা হয়েছিল পশ্চিমের তৎকালীন লুনার ক্যালেন্ডার অনুসারে। আর তার পরের বছরগুলো হিন্দু সৌরমাসের হিসেবে।
নববর্ষের বাংলা সনের এই ‘সন’ শব্দটি আদতে আরবি। যেমন ‘তারিখ’ শব্দটি, মূলত আরবি। সাল কথাটি আদিতে ফারসি। পহেলা বৈশাখের ‘পহেলা’ শব্দটিও ফারসি। আবার নববর্ষ উপলক্ষে বাণিজ্যে প্রচলিত ‘হালখাতা’ শব্দটি আসলে আরবি-ফারসিজাত। হালখাতা মানে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। হাল অর্থ বর্তমান।
এই নববর্ষের সূচনা করেছিলেন সম্রাট আকবর। হিজরি সনের (চন্দ্রবর্ষ) ৯৬৩ সালে। ইংরেজি ১৪ এপ্রিল, ১৫৫৬ থেকে। যখন আকবর সিংহাসনে বসেন, তখন থেকেই বঙ্গাব্দের শুরু। বাঙালির সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী বৈশিষ্ট্য থেকেই বাংলা নববর্ষের সৃষ্টি।
এবং কী আশ্চর্য বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই সমন্বয়টি আজও মানেন। ধর্মীয় আচরণের প্রতি নিষ্ঠাবান কোনও হিন্দু যখন বাংলা সন-এর হিসেবে কোনও হিন্দু তিথি পালন করেন, তখন তিনি এর সঙ্গে হজরত মহম্মদের সংযোগের ব্যাপারটা জানতেও পারেন, আবার না-ও পারেন। কিন্তু বহু শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি সংস্কৃতির এই মিশ্র চরিত্রটাকে এড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব।
যেমন একজন হিন্দু পুজারী যখন ১৪২৮ সনটিকে আহ্বান জানিয়ে ‘বছর ভালো যাওয়ার’ কামনা করবেন, তখন হয়তো জানবেনও না, তিনি আসলেই স্মরণ করছেন মহম্মদের মদিনা যাত্রার দিনের কথা।
দিলীপবাবুরা যতোই ‘হিন্দু নববর্ষ’ বলে বিভেদের বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করুক, ‘বাঙালি’ পরিচিতির ডিএনএ’র মধ্যে আসলেই জড়িয়ে আছে দুই ধর্মের সম্প্রীতি।
এই একুশে, কোন্ননগরে রাজপণ্ডিত পরিবারে ঘর আলো করে আসা শিশুকন্যার নাম যেমন সুফিয়া, তেমনই বরিশালে সুলতানার ভালো নাম স্নিগ্ধা!
‘বাঙালি’ পরিচিতির তন্তুর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই বৈশিষ্ট্য এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এই পরিচিতিকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাঙা অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা তার বড় প্রমান।
রবীন্দ্রনাথের পরে নিঃসন্দেহে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর বেশকিছু কবিতা অসংখ্য বাঙালির মনে অমর হয়ে গেঁথে আছে। নজরুলের বিশ্বজনীন মানবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বামপন্থার প্রতি তাঁর সমর্থন। ১৯২৫, প্রথম প্রকাশিত লাঙ্গল নামে বামপন্থী পত্রিকা নিয়মিত নজরুলের কবিতা ছাপত। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, লাঙ্গল-এর গৃহীত যে নীতি কাগজের প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদ-নিশানে ছাপা হত, সেটা পঞ্চদশ শতকের বাঙালি কবি চণ্ডীদাসের একটি কবিতা থেকে নেওয়া: ‘শুনহ মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
সেই কবে লালনের উচ্চারণ, ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।
বাঙালি পরম্পরা মেনেই আমরা চাই অসাম্প্রদায়িক উপমহাদেশ। চাই সম্প্রীতি। চাই ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি।
বাঙালি সভ্যতার সবদিক থেকে প্রসারতা আমাদের কাম্য। যেমন জসীমউদ্দীনের একটি অপ্রকাশিত কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন অমর্ত্য সেন।
‘কোথায় জ্যোৎস্না-পুলকিত রাতি
কোথায় পুষ্পরথ
অভাবের জালে আজিকে দৈত্য
ঘিরিয়েছে তব পথ।’
শুভ নববর্ষ। আমাদের প্রয়োজন, জসীমউদ্দীনের ভাষায়, ‘জ্যোৎস্না-পুলকিত’ জীবন।
বিশেষ ঋণ: অমর্ত্য সেন, আনিসুজ্জামান।
প্রচ্ছদ ঋণ : তৌসিফ হক