Liberals on Mamata

মমতাকে সুবিধা পাইয়ে দিতে এখন লিঙ্গ রাজনীতিকে তুলে ধরা হচ্ছে

যে কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে ঘৃণা করি।সেই রাজনীতি যারা করে তাদের ও ঘৃণা করি।ঘৃণা করি প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকদেরও। মোদি আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গার্থক ভাবে ' দিদিইই ই ই ' বললে , সেটা যেমন শুনতে খারাপ লাগে, তেমনিই খারাপ লাগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিং কে প্রকাশ্যে ভ্যাঙানোর পর।

আনন্দবাজারে আজ সেমন্তী ঘোষ মুখ্যমন্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তির্যক ভাবে 'দিদি' বলা কে নারী বিদ্বেষ বলেছেন। অথচ এই মমতাই অতীতে যখন ডঃ মনমোহন কে প্রকাশ্যে ভেঙিয়েছিলেন, বা মোদিকে কোমরে দড়ি পড়িয়ে ঘোরাবেন বলেছিলেন, বা পুরুষ নিরাপত্তা রক্ষী কে প্রকাশ্যে 'চাবকানো উচিত 'বলেছিলেন, এই ভোট কালেও হুইল চিয়ারে বসে মমতার একজন কে মারতে যাওয়ার ভিডিও ঘুরছে-- এগুলো কিন্তু সেমন্তী ঘোষের কাছে পুরুষ বিদ্বেষ বলে মনে হচ্ছে না। হলে নিশ্চয়ই এক লাইন অন্তত লিখতেন।

লিঙ্গ ভিত্তিক উসকানি দিয়ে মমতাকে মহিমান্বিত করবার এই ধরণের লেখা পড়তে সত্যিই অবাক হতে হয়। পুরুষ বিদ্বেষ ছড়ানো কখনো নারীবাদের প্রকৃত সংজ্ঞা হয় না। নারী- পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠার বদলে মমতা নারী প্রেমি আর মোদি নারী বিদ্বেষী- এই অতি সরলীকৃত সিদ্ধান্ত যে মমতাকে ভোট বৈতরণী পার করাবার উদ্দেশ্যেই লেখা হচ্ছে , তা বুঝে নিতে কোনো অবস্থাতেই অসুবিধা হয় না।

মোদির নারী বিদ্বেষের পাশাপাশি মমতার রুচিহীন মনমোহন সিং কে আক্রমণের কথা থাকলে তবেই বুঝতাম গদি মিডিয়ার ইতিবাচক অবস্থান তৈরি হচ্ছে। তেমনটা কিন্তু আমরা একটিবারের জন্যেও দেখলাম না সেমন্তী ঘোষের লেখাতে। বরং সেই অন্নদাশঙ্করের ছড়া, যেখানে যা কিছু ঘটে অনিষ্টি, সকলের মুখে কমুনিষ্টির, গিন্নি বলেন সূচক অনুধ্যান থেকেই উচ্চারিত হয়েছে বিনয় কোঙার থেকে অনিল বসুর নাম।

সেমন্তী ঘোষের মতো রিফাইন্ড জেন্টলম্যান বা লেডি রা পশ্চাৎদেশের যে কোনো রকম উল্লেখেই অশ্লীলতার গন্ধ পান।কিন্তু বাংলাদেশে উনসত্তরের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের শ্লোগান ছিল ,' আইয়ুব খানের হাতে হেরিকেন, পোঁদে বাঁশ'। এই শ্লোগানটিই কার্যত টলিয়ে দিয়েছিল আইয়ুবের তানাশাহী।এই শ্লোগান তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থেকে অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরী, সবাইই উচ্চারণ করেছিলেন। বিরোধী নেত্রীকে পশ্চাৎ দেশ দেখাবার কথা বলে বিনয় কোঙার যদি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারেন, তাহলে ' আইয়ুব খানের হাতে হেরিকেন , পোঁদে বাঁশ ' শ্লোগান দিয়ে পাকিস্থানের দোর্দন্ড প্রতাপ ফৌজি শাসক ইয়াহিয়ার তানাশাহি কাঁপিয়ে দিয়েও ' অপরাধ' ই তো করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব থেকে শুরু করে তাজউদ্দিন, কামরুজ্জামান, মতিয়া চৌধুরীরা, কি বলেন সেমন্তী ঘোষ?

বাংলার কৃষক সমাজ কি আপনাদের মতো রিফাইন্ড ল্যাঙ্গয়েজে কথা বলে সেমন্তী ঘোষ? এই তাহলে বাংলার কৃষক সমাজকে চিনেছেন আপনি বা আপনার মতো মানুষেরা। দুদু মিঞা থেকে সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহেরা কি আপনাদের মতো তৎসম , তদ্ভব শব্দ দিয়ে জানকবুল কৃষকদের সঙ্গে কমিউনিকেশন তৈরি করতেন? যে নেচারস কল কে আপনাদের মতো রিফাইন্ড জেনারেশন ' পটি' বলতে অভ্যস্থ ( উষা গাঙ্গুলীর ' কাশীনামা' র টয়লেট পেপারের দেহাতি উত্তরপ্রদেশি ঘরানার উচ্চারণ ভাগ্যিস এঁদের কান এড়িয়ে গেছে, তা না হলে বিনয় কোঙারের সাথেই উষা গাঙ্গুলীর ও আজ রিফাইন্ড খিস্তি জুটতো!) , সেই প্রকৃতির ডাককে এককালের উচ্চারণ ' হাগতে যাওয়া' (বেচারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও মরে বেঁচেছেন।প্রাকৃতিক কর্মের প্রচলিত লব্জের দায়ে রিফাইন্ড জেনারেশনের কোপে তাঁকে পড়তে হয় নি) কখন কি ভাবে ' মাঠকে যাওয়া ' হয়ে গেল রাঢ় বাংলায়, সেই সামাজিক বিবর্তন, বা হিন্দি বলয়ে ' ময়দান ' যাওয়ার তাগিদ, এসব জানলে, অর্থাৎ, মাটির ভাষা জানলে বিনয় কোঙারের কথা আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ' ধরে চাবকানো উচিতে' র ভিতরে ফারাক টা করতে পারতেন।

মোদির ' দিদিইই' ঠাকের ছন্দোময়তায় অনেক কিছুই আবিস্কার করে বসেছেন সেমন্তী ঘোষেরা । কিন্তু দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যখন 'জগাই' আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যখন 'মাধাই' বলছেন মমতা, সেখানেই থামছেন না তিনি, অমিত শাহ কে বলছেন, হোদলকুৎকুৎ' , তখন জেন্ডার পলিটিক্সের নামগন্ধ খুঁজে পান না সেমন্তী ঘোষেরা। একজন মহিলা বলে কি একজন পুরুষের শারীরিক গঠন নিয়ে একথা বলতে পারেন একজন মহিলা? মুখ্যমন্ত্রী , প্রধানমন্ত্রী , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-- এইসব পদাধিকার যদি ছেড়েই কথা বলি, তাহলে ও তো বলতে হয়, একজন নারীকে টিজ করা যখন দেশের আইনে অন্যায়, তখন তো একজন নারী কর্তৃক পুরুষকে টিজ করাটাও ন্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। রাজনীতি অতিক্রম করে মমতা যেভাবে পুরুষ বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন, আর মমতার সেই পুরুষ বিদ্বেষকে আড়াল করতে সেমন্তী ঘোষেরা যেভাবে লিঙ্গ রাজনীতির অবতারণা করে মমতাকে আড়াল করবার চেষ্টা করছেন, তা মমতাকে তোষামুদির একটা জঘন্যতম উদাহরণ।এইভাবে যিনি সমাজে নারী পুরুষের স্বাভাবিক সম্পর্কটাকে কেবলমাত্র মমতার প্রতি সহানুভূতি তৈরি করতে নষ্ট করে দিচ্ছেন , পুরুষকে কেবলমাত্র কাঠগড়ায় তুলে নারী- পুরুষের সাম্যের চিন্তাটাকে ধ্বংস করে দিচ্ছেন, তেমন মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার।

মমতার ইমেজ রিবিল্ডিংয়ের কাজটা একধরণের কলমচি দীর্ঘদিন ধরেই করে চলেছেন। মমতা যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন তখন থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত মমতার পক্ষে সবসময়েই ইতিবাচক ভাবে কলম ধরতেন রন্তিদেব সেনগুপ্ত। সেই রন্তিদেবের সঙ্গে মমতার রাজনৈতিক ইতিবাচক সম্পর্কটি মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অল্পদিনের ভিতরেই আর বজায় রইলো না।কিছুটা সময় আমরা দেখলাম, রন্তিদেব মমতার প্রতি বেশ সমালোচনামূলক লেখা লিখছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রতি তখন ' বর্তমান' পত্রিকাটিকেও আমরা আর আগের মতো গদগদ দেখলাম না।অল্প সময়ের ভিতরেই অবশ্য পরিস্থিতি বদলে গেল।আর এস এস প্রধান মোহন ভাগবত এলেন রন্তিদেবের বাড়িতে।এই সময়কালেই রন্তিদেব হয়ে গেলেন আর এস এসের বাংলা মুখপত্র ' স্বস্তিকা' সম্পাদক।গত লোকসভা ভোটে তিনি বিজেপির প্রার্থী ও ছিলেন।জেতেন নি।এবারের বিধানসভা ভোটে তাঁর নাম বিজেপি প্রার্থী হিশেবে ঘোষিত হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই নির্বাচন কেন্দ্র ঘিরে নিজের অপছন্দের কথা জানিয়ে রন্তিদেব প্রকাশ্যে ভোটে না লড়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্র রদবদল না করেই, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী রন্তিবাবু বিজেপি প্রার্থী হিশেবে লড়ছেন।

রন্তিদেব থেকে সেমন্তী ঘোষ, এঁরা বা এঁদের মতো সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষরা অতীতে বা বর্তমানে যেভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনীতির বাইরে একটি আইকন হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন বা করছেন, এমনটা কিন্তু অতীতে ভারতের কোনো রাজনীতিককে নিয়েই হয় নি।পন্ডিত নেহরুর যথেষ্ট গুণগ্রাহী মহল ছিল।কিন্তু তা বলে অরাজনৈতিক ভাবে নেহরুকে দেবত্ব আরোপ কখনো করা হয় নি।আর এই দেবত্ব আরোপের বিষয়টি নেহরু পছন্দ করতেন , সমসাময়িক সাংবাদিকদের কারো লেখাতে তেমন কোনো সাক্ষ্য নেই।চেলাপতি রাও , যিনি অত্যন্ত কমিউনিষ্ট বিদ্বেষী সাংবাদিক ছিলেন, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে পর্যন্ত , 'আ কমিউনিষ্ট অফ আ ফেরোসাস টাইপ ' বলে চিহ্নিত করেছিলেন,তিনি ও ব্যক্তি ক্যারিশমা তৈরির সাংবাদিক প্রবণতাকে পন্ডিত নেহরু কতোখানি অপছন্দ করতেন, সে সম্পর্ক লিখে গিয়েছেন।

দেবকান্ত বড়ুয়া একদা 'ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা ' বলেছিলেন।কংগ্রেস সভাপতির এই ব্যক্তিপূজার মানসিকতা সেই দলের একাংশ কে খুব খুশি করেছিল একটা সময় পর্যন্ত।এই ব্যক্তি মাহাত্ম্য যখন নির্বাচনী সাফল্যের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠলো, কংগ্রেস দল , ব্যক্তি আনুগত্য প্রকাশ করেও দেবকান্ত বড়ুয়ার আঙ্গিকে ব্যক্তি পুজোর রাজনীতিকে অতিক্রম করতে শুরু করলো।ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের চিকিৎসক হিশেবে প্রবাদতুল্য ক্যারিশমা কে একটা তাঁর দলের লোকেরা কাজে লাগালেও, ডাঃ রায় নিজে কখনো নিজের আরাধনাকে বরদাস্ত করতেন না।

আজ লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতির নিরিখেই হোক, ঔদার্যের পরাকাষ্ঠা দিয়েই হোক, যেনতেনপ্রকারে একাংশের ভিতরে মোদিকে দেবত্ব আরোপের চেষ্টা চলেছে।আর একাংশ আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন মমতাকে মহামহিম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। প্রত্যেকের ভিতরেই রাজনীতি বিযুক্ত দেবত্ব আরোপের এই প্রবণতা মানুষকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে রুটি ,রুজির প্রশ্ন।ভুলিয়ে দিতে চাইছে কোবিদ ১৯ এর দ্বিতীয় পর্যায়ের করাল হাতছানি কে।বাংলাদেশ সরকার আগামী সপ্তাহে ( ০৫\০৩\২১ থেকে) এক সপ্তাহের জন্যে তাঁদের দেশে সম্পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছে। মহারাষ্ট্র সহ গোটি দক্ষিণ ভারত এখন করোনার দ্বিতীয় পর্যায়ের থাবার গ্রাসে।এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটকে ঘিরে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং কেন্দ্রের শাসক বিজেপি কার্যত কোবিদের নোতুন ঢেউ সম্পর্কে কোনো সচেতনতাই তৈরি করতে দিতে চাইছে না।আর মোদি - মমতার ছদ্মযুদ্ধ , যাকে উপরে কুস্তি আর ভিতরে দোস্তি বলা যায়, তা ঘিরেই গদি মিডিয়ার যতো মাথাব্যথা।

* মতামত লেখকের নিজস্ব


শেয়ার করুন

উত্তর দিন