মুক্ত 'লুলা'-শান্তনু দে

ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাজা সটান খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডসন ফাচিন। আল জাজিরায় শিরোনাম: ‘আগামী নির্বাচনে লুলার প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দরজা খুলে দিলেন বিচারপতি।’

বিচারপতি ফাচিন সোমবার বলেছেন, ব্রাজিলের দক্ষিণের শহর কারিতিবার যে আদালত দুর্নীতি মামলায় লুলাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং জেলে পাঠিয়েছে, সেই মামলা বিচার করার তার কোনও এক্তিয়ারই নেই।

এপ্রিল, ২০১৮। কোনও তথ্যপ্রমান ছাড়াই অভিযুক্ত ব্রাজিলের বামপন্থী নেতা লুলা দা সিলভা। ভুয়ো মামলায় একতরফা দোষী সাব্যস্ত। বারো-বছরের জেল। মাঝে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। জেলে থেকেই জনপ্রিয়তায় একনম্বরে। ধারেকাছে কেউ নেই। সবচেয়ে কাছের প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ব্যবধান।

লুলার ওয়ার্কার্স পার্টির আশা ছিল তিনি অন্তত জেল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। নির্বাচনী আদালত সেই সুযোগটুকুও দেয়নি। আপত্তি জানিয়েছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিটি। এমনকি পোপ ফ্রান্সিস পর্যন্ত। লাভ হয়নি। ব্রাজিলের ইতিহাসে সবচেয়ে নক্কারজনক আইনি ফাঁদের শিকার হন লুলা। তাঁর নিশ্চিত রাষ্ট্রপতি হওয়া রুখতে দক্ষিণপন্থী বিচারব্যবস্থার ঘৃণ্য স্ট্র্যাটেজির বলি। সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু নির্বাচনী আদালত তাঁর পরিবর্তে অন্য নাম ঘোষণার জন্য সময়সীমা বেধে দেয় মাত্র দশদিন। এবং ‘ব্রাজিলের ট্রাম্প’ বোলসোনারোর জয়।

শেষে, দেড় বছরের মাথায় জেল থেক মুক্তি। সেদিন সাউ বার্নাদো দো ক্যাম্প শহরে এবিসি মেটাল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সদরদপ্তরের সামনে উপচে পড়ে সমাবেশ। হাজার হাজার মানুষ। ৫৮১ দিন আগে এখান থেকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল লুলাকে। উদ্বেল জনতার সামনে লুলা মুষ্টিবদ্ধ হাতটি ছুড়ে দেন আকাশের দিকে। বিরোধী উগ্র দক্ষিণপন্থার উদ্দেশে শোনান হুঁশিয়ারি, ‘আমি শুধু ওদের বলতে চাই: আমি ফিরে এসেছি! দেখা হবে ২০২২ সালে!’ পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে।

লুলার কাছে জেল এই প্রথম নয়। এপ্রিল, ১৯৮০। মেটাল ওয়ার্কারদের ১৭-দিনের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করে সামরিক জুন্টা। ৩১ দিন বাদে মুক্তি। জেলে থেকে বেরিয়েই শ্রমিক আন্দোলনে। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। চোদ্দ বছর বয়েসে একজন শ্রমিক হিসেবে যাঁর জীবন শুরু।  

লুলা মানে ব্রাজিল। আর ব্রাজিল মানে লুলা। এবং তা, তাঁর প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে থেকেই। আর ২০১১-তে যখন রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বিদায় নিচ্ছেন, তখন তাঁর সমর্থনের হার ছিল ৮৩শতাংশ। হ্যাঁ, ৮৩ শতাংশ, ছাঁপার ভুল নয়। স্বাভাবিক। ২০০৩-’১০, রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তাঁর সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে তুলে এনেছে দারিদ্র্যসীমার অন্ধকার থেকে।

অধ্যাপক এমির সাদের সেদিন বলেছিলেন, ‘জেল থেকে আরও শক্তিশালী হয়েছেন লুলা।’ সাংবাদিক দারিও পিগনত্তির কথায়, তাঁর মুক্তি ‘বদলে দেবে ব্রাজিলের রাজনৈতিক ক্যানভাস’।

ফাচিনের রায় ঘোষণার আগেই রবিবার এক জনমত সমীক্ষায় লুলার পক্ষে সমর্থনের হার সর্বোচ্চ। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে ‘নিশ্চিতভাবেই, অথবা ভোট দিতে পারেন’ এমন মানুষের সংখ্যা ৫০ শতাংশ। বোলসোনারোর থেকে ১২ শতাংশ বেশি।

ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টি (পিসিডিওবি)-র সভাপতি, পারনামবুকো প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর লুসিয়ানা স্যান্টোস বলেছেন, ‘সংবিধানের জয়, ন্যায়বিচারের জয়।’ আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘শেষে ন্যায়বিচার, লুলা মুক্ত!’ নোবেলজয়ী আর্জেন্টিনীয় অ্যাডলফো পেরেজ এসকুইভেল বলেছেন, ‘লুলা মুক্ত, নিরপরাধ, ২০২২-র প্রার্থী!’

লুলার মুক্তিতে উত্তাপ ব্রাজিলের রাজনৈতিক থার্মোমিটারে। লাতিনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে মেক্সিকো, আর্জেন্টিনায় এখন প্রগতিশীল সরকার। বাকি ব্রাজিল। বামপন্থায় ফিরেছে বলিভিয়া। চূড়ান্ত নির্বাচনে লড়ছে ইকুয়েদর। এদিকে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে বোলসোনারো সরকার। প্রকট হচ্ছে নীতি-নির্ধারনে ব্যর্থতা। বাড়ছে অসন্তোষ।

সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক স্টুনকেল যেমন বলেছেন, ‘এই রায়ে রাজনৈতিক প্রবণতার প্রভাব যথেষ্ট। সর্বোপরি, রাজনৈতিক হাওয়ার যে পরিবর্তন হচ্ছে, তার লক্ষণ এতে স্পষ্ট। বোলসোনারোর বিরুদ্ধে রয়েছে তুমুল ক্ষোভ।’

অন্যদিকে, লুলার ভাবমূর্তি তৈরি করেছে এক নতুন সম্ভাবনা। এবং লুলা এখন বাইরে। লুলা ঘুরছেন গোটা দেশে। একুশ শতকের প্রথম দশকের মতোই তৃতীয় দশকে ব্রাজিলই হতে চলেছে নির্ণায়ক।  

ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকার ব্যারোমিটার। লাতিনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে জনবসতিপূর্ণ দেশ। একুশ কোটির দেশ। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম। চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইন্দোনেশিয়ার পরেই ব্রাজিল। ব্রাজিল লাতিনের বৃহত্তম অর্থনীতি। বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম অর্থনীতি। ব্রাজিল মানে এই গ্রহের ফুসফুস। রয়েছে তেল, কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং এমনকি নিজস্ব সমরাস্ত্র শিল্প।

ব্রাজিলের দিকে তাকিয়ে গোটা লাতিন আমেরিকা। তাকিয়ে আছেন কমিউনিস্ট, বামপন্থীসহ প্রগতিশীলরা।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন