পর্ব ২
জমির লড়াই, মানের লড়াই
গোটা দেশে ভূমিহীনের হাতে যত জমি দেওয়া হয়েছে তার ২২ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের। অথচ দেশে মোট চাষজমির মাত্র ৩ শতাংশ রয়েছে রাজ্যে। দেশে মোট খাদ্যশ্যের ৮ শতাংশ উৎপাদন হতো এরাজ্যেই। দেশে এমন নজির গড়ল কি’করে পশ্চিমবঙ্গ?
১৯৭৭’র ২৯ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় জমি আইনে সংশোধনী বিল পেশ করল বামফ্রন্ট সরকার। মূল আইন কংগ্রেসেরই। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ করা হয়নি। তিনটি উদ্দেশ্য জানালেন সে সময়ে রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। জমির ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করে বাড়তি জমি খাস করবে সরকার। সেই জমি হাতে নেবে এবং তা বিলি করা হবে ভূমিহীনদের। বর্গাদার, যাঁরা ভাগচাষ করেন, উচ্ছেদ করা যাবে না তাঁদের। বিনয় চৌধুরী বললেন, কংগ্রেস সরকার নিযুক্ত পিটিশন কমিটি ৮০ লক্ষ বর্গাদারের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছিল। কংগ্রেস সরকার তা করেনি। অনেক আগেই এই বিল আসা উচিত ছিল।
বিনা বাধায় বিধানসভায় পাশ হয়নি আইন। বলতে উঠলেন
বিরোধী জনতা পার্টির নেতা কাশীকান্ত মৈত্র। বললেন, এই আইন পাশ হলে বাংলার সামাজিক ভিত্তি ভেঙে যাবে। গ্রামের গতিশীলতা নষ্ট হবে। কংগ্রেসের সত্য বাপুলি বললেন, এই আইন হবে কালাকানুন। ক্ষুদ্র চাষীরা জমির মালিকানা হারাবে। আরও বললেন, ভাগচাষী উচ্ছেদ হবে না আমরাও তা চাই।
বিশ্বনাথ মুখার্জি সিপিআই’র পক্ষে আইনের পক্ষে কড়া সওয়াল করলেন। মনে রাখা ভালো সেসময় সিপিআই বামফ্রন্টের শরিক ছিল না। মুখার্জি বললেন, সামাজিক গতিশীলতা বলতে যদি বোঝানো হয় কৃষক উচ্ছেদ করে গ্রামে পুঁজিবাদ কায়েম হবে তা’হলে এই আইনে অসুবিধা আছে।
জবাবী ভাষণে বিনয় চৌধুরী জানালেন, লেবার ট্রাইবুনালের মতো বিশেষ ব্যবস্থায় জমি বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিশ্চিত করা হবে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি জমির মালিকদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা সেই বক্তব্যকেই সত্যি প্রমাণ করেছে। বস্তুত সীমার বাইরে থাকা জমিকে খাস ঘোষণা করে ভূমিহীনের মধ্যে দেওয়ার এই প্রক্রিয়া গ্রামাঞ্চলে রাজনৈতিক-সামাজিক ভারসাম্য সাধারণ এবং গরিব কৃষিজীবীর অনুকূলে আসার প্রক্রিয়া শুরু করে। যার অর্থ, গ্রামের গরিবকে আর চাইলেই তুই-তোকাড়ি করা যায় না। বড় জমির মালিক, গ্রামের সম্পত্তিবান চাইলেই নিজের শর্তে খাটতে বাধ্য করতে পারেন না গরিবকে।
অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ একটি নিবন্ধে জানিয়েছেন, ঊর্ধ্বসীমার ওপরে থাকা জমি সরকারের হাতে এসেছে যা গোটা দেশে তার ১৬.৯৪ শতাংশই ছিল পশ্চিমবঙ্গের। অনেক রাজ্যে চাষ হওয়া কঠিন এমন জমি দেওয়া হয়েছে ভূমিহীনদের। যে কারণে বিলি হওয়া জমির মধ্যে সেচসেবিত ১.৭৯ শতাংশ সারা দেশের গড়। পশ্চিমবঙ্গে এই হার ছিল ৭.৯২ শতাংশ। তাঁর মত, ১৯৫৫ সালেই পাশ হয়েছিল ভূমি সংস্কার আইন। তার দু’বছর আগে পাশ হয়েছিল এস্টেট অধিগ্রহণ আইন। জমিদারি সম্পত্তি কিছু বাজেয়াপ্ত হলেও আসলে এই ভূস্বামী বর্গ গ্রামে রাজ করত। যার কারণ পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার গুরুতর অভাব।
কিভাবে হতো বর্গা নথিভুক্তি? বর্গাদারদের রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীদের কাছে যেতে হতো না। তার বদলে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীর চলে যেতেন সরাসরি কৃষকদের কাছে। শুনতেন তাঁদের সমস্যা। গ্রামের মানুষকে ডেকে সভার আয়োজন করত সরকার। দরখাস্ত লিখে নিতেন। তারপর সবার সঙ্গে সবার সামনে প্রকাশ করা হতো নামের তালিকা। সুরক্ষিত হতো ভাগচাষীদের অধিকার। ভূমিসংস্কারের আরেক লক্ষ্য ছিল আদিবাসীদের জমির হস্তান্তর বন্ধ করা। গ্রামাঞ্চলে প্রভাবশালী শ্রেণিগুলি যাতে নিঃসহায় আদিবাসীদের শেষ সম্বল জমিটুকু কেড়ে নিতে না পারে।
কেবল ওই এক আইনেই গ্রামের গরিবের হাতে জমি তুলে দেওয়া যায়নি। ১৯৮১ এবং ১৯৮৬-তে পাশ করতে হয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় সংশোধনী। জমির সংজ্ঞা বদলাতে হয়। যাতে সব জমিকে ঊর্ধ্বসীমার আওতায় আনা যায়। সীমা দিতে না পারলে বাড়তি কতটা বোঝা যাবে কি করে, কি করেই বা সরকার সেই জমিকে খাস করবে। কী করে জমি দেওয়া যাবে ভূমিহীনদের। জমির অধিকারের লড়াই কেবল আইনি বৃত্তেই সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বামফ্রন্ট, কৃষকসভার মতো বামপন্থী কৃষক সংগঠন অবিরত চালিয়েছে লড়াই। গ্রামাঞ্চলে বড় জমির মালিক, সীমার আওতায় পড়ে যাওয়ায় জমি হারানো জোতদার-জমিদাররা অবিরত মদত জুগিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী শক্তিগুলিকে। দায়ের হয়েছে একের পর এক মামলা। লড়াই করেই রাখতে হয়েছে অধিকার।
২০১১ পর্যন্ত ১৫ লক্ষ ১৩ হাজার বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত হয়েছে। জমির মালিক চাইলেই ভাগচাষীকে উচ্ছেদ করতে পারবে না। বর্গার আওতায় আনা হয়েছিল ১১ লক্ষ ১৫ হাজার একর জমি। ঊর্ধসীমার বাইরে চিহ্নিত জমির মধ্যে ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একরের বেশি পাট্টা করে দেওয়া হয়েছিল কৃষকের কাছে। পাট্টা প্রাপকদের ৩৭ শতাংশ তফসিলি, ১৮ শতাংশ আদিবাসী, ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু। জনবিন্যাসের প্রতিটি অংশের যা ভাগ তার চেয়ে বেশি পেয়েছিলেন পাট্টা।
পাট্টা দেওয়ার প্রক্রিয়া মহিলাদের অধিকার সুরক্ষিত করা চলছিল। চালু হয়েছিল যৌথ পাট্টা, অর্থাৎ যে আইনি নথিতে পরিবারের প্রধান পুরুষ এবং মহিলা, দু’জনেরই নাম থাকবে। এমন পাট্টা ছিল ৬ লক্ষ ১৮ হাজারের বেশি। অনেকক্ষেত্রে মহিলাদেরই প্রধান করে দেওয়া হয়েছিল পাট্টা। মহিলাদের পাট্টা ছিল ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি।
সপ্তম বামফ্রন্টের সময়ে অনেকক্ষেত্রে জমি কিনে গরিব ভূমিহীন বিভিন্ন পেশার মানুষকে দেওয়া হয়েছে জমি। ‘চাষ ও বসবাসের ভূমিদান’ প্রকল্পে খেতমজুর, গ্রামের মৎস্যজীবী বা কারিগর গরিব ২ লক্ষ পরিবারকে দেওয়া হয়েছে ৫ কাঠা করে জমি। অনেকক্ষেত্রে খাস জমির সমস্যা বা মামলার কারণে আটকে ছিল জমি। সরকার জমি কিনেছে, তারপর দেওয়া হয়েছে ভূমিহীনদের। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারকে ঘিরে জমি নেওয়ার অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। শিল্পের জন্য জমি নেওয়াকে দেখানো হলো ‘জমি কেড়ে নেওয়া’। বামফ্রন্ট সরকারকে হটানোর নতুন কৌশলে তখন মদত নানা দিক থেকে এসেছিল। বাস্তব হলো,
২০০৬ থেকে ২০১০, কেবল এই সময়েই ১৬ হাজার ৭০০ একর জমির পাট্টা বিল হয়েছিল। ওই সময়ে দেশের অন্য কোথায় এমন বিপুল হারে দেওয়া হয়েছিল জমির আইনি অধিকার?