কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য - শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ

১৬ জানুয়ারি ২০২১, শনিবার

শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ: কুৎসা বনাম বাস্তব
পর্ব-১


স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে একনম্বর স্থানে ছিল।স্বাধীনতার দুই দশকের মধ্যেই শিল্পে পেছনের সারিতে চলে যায় আমাদের রাজ্য। ১৯৫০ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতবর্ষের মধ্যে প্রথম পশ্চিমবঙ্গ ১৯৬৬ সালে অষ্টম স্থানে নেমে যায়। রাজ্যে ও কেন্দ্রে তখন কংগ্রেস সরকার। অথচ শিল্প ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার ক্ষেত্রে এরাজ্যের ক্রমাগত অবনতির জন্য বামপন্থীদেরই দায়ী করে দক্ষিণপন্থী দলগুলি এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়া। কিন্তু এই অবনতির জন্য বামপন্থীদের দায়ী করা কি আদৌ যুক্তিসংগত? একদিকে লালঝাণ্ডার বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদগার করা হয়েছে আর অন্যদিকে পর্দার আড়ালে চলে গিয়েছে মাশুল সমীকরণ ও লাইসেন্সিং প্রথার মত কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায় নিয়ম নীতিগুলি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে নব্বই এর দশকের গোড়া পর্যন্ত এই নীতিগুলি বলবৎ ছিল। এই দুটি নীতি চালু শিল্পগুলির ওপরে অত্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছিল এবং ভবিষ্যতে শিল্পায়নের সম্ভাবনাকে দুর্বল করে দিয়েছিল।



১. মাশুল সমীকরণ নীতি
১৯৫৬ সালে মাশুল সমীকরণ নীতি চালু হয়। এর সুবাদে সারা ভারতে খনিজ দ্রব্য ও ইস্পাতের পরিবহন মাশুল সমান হয়ে যায়। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ কয়লা এবং ইস্পাতের ক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থানগত যে সুবিধা পেত তা থেকে বঞ্চিত হল।
    1. ১৯৭২ সালের ১৩এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় অর্থনীতিবিদ,
The Agony of West Bengal গ্রন্থের লেখক রণজিৎ রায় "পয়লা নম্বরের সমস্যাসঙ্কুল রাজ্য" শীর্ষক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, 'রেলপথের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ পরিবহনের হার (১৯৭০ সালের প্রচলিত হিসেবে) জামশেদপুর থেকে হাওড়া পর্যন্ত ১টন ইস্পাত এর জন্য ৩০ টাকা এবং জামশেদপুর থেকে মুম্বাই পর্যন্ত এক টন ইস্পাতের জন্য ১২০ টাকা অর্থাৎ এই দুই শহর পর্যন্ত পরিবহন করা দুই টন ইস্পাতের জন্য মোট ভাড়া ১৫০ টাকা। কেন্দ্রের মূল্য সমীকরণ নীতি অনুযায়ী কলকাতা ও বোম্বাই এর খরিদ্দারকে দিতে হচ্ছে ৭৫ টাকা করে। মোট ফল কলকাতার শিল্পপতি তার বোম্বাইয়ের প্রতিদ্বন্দীর চাইতে টনপ্রতি ৯০ টাকা করে যে অবস্থানগত সুবিধা ভোগ করতো সেটুকু সে হারিয়েছে। শুধু তাই নয় বোম্বাইয়ের শিল্পপতিকে সে টনপ্রতি ৪৫ টাকা করে ভর্তুকি দিতেও বাধ্য হচ্ছে।' কয়লার ক্ষেত্রেও ঠিক একইভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি। অথচ দেশের প্রধান কয়লা উৎপাদক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার। তবে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গা থেকে তুলা কিংবা তৈলবীজ কিনতে হল অতিরিক্ত মাশুল দিয়েই। এই চরম বৈষম্যমূলক নীতি গোটা পূর্বাঞ্চলকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেয় ।

কেউ বলতে পারেন যে সারাদেশে সুষমভাবে শিল্প উন্নয়নের স্বার্থে কয়লা সহ খনিজ সম্পদ এবং ইস্পাতের মাশুল সর্বত্র এক করে দেওয়া সঠিক কাজ হয়েছে। তাহলে তুলো, তৈলবীজ বা সিমেন্টের ক্ষেত্রে এই একই কাজ করা হলো না কেন? অর্থাৎ নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যের ব্যবসায়িক লবির স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্বাঞ্চলের সর্বনাশ করা হয়েছে।
Source: Garred Jason et al
"Access to raw materials and local comparative advantage:The effects of Freight Equalization Policy"2015
<
    ১৯৫০-১৯৭০পর্যন্ত মাশুল সমীকরণ নীতির ফলে দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য শিল্পে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের ক্রমাবনতি


২. লাইসেন্সিং প্রথা
শিল্প তৈরি করবার জন্য লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়েও ভয়ঙ্কর অবিচারের শিকার হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।১৯৫৬থেকে ১৯৬৭  সাল পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে দেওয়া হয়২৭৪১টি লাইসেন্স,আর পশ্চিমবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়১৬৪৯টি লাইসেন্স। ফিলিপ্স কোম্পানি যখন কলকাতার কারখানায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকারের অনুমতি চায় তখন বিদেশি কোম্পানি বলে তাকে সেই অনুমতি দেওয়া হয় না। অথচ সেই একই ফিলিপ্স কোম্পানি কে পুনেতে উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে কোনো রকম বাধা সৃষ্টি করেনি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার।

৩. পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের আরো নজির
দেশের প্রধান পাটশিল্প জাত পণ্যের উৎপাদক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, অথচ দেশভাগের ফলে পাটশিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা অধিকাংশ পাটকল পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত হলেও প্রধান পাট উৎপাদক অঞ্চল ছিল পুর্ববঙ্গে। সেক্ষেত্রে এরাজ্যের পাটশিল্পকে বাড়তি সুবিধে দেওয়ার বদলে পশ্চিমবঙ্গকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে কেন্দ্রীয় সরকার। পাটের রপ্তানি শুল্ক তথা আয়কর থেকে পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য অংশ নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলা হয়। অথচ এই দুই ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রের আয় মোটেই কমে যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের প্রাপ্য অর্থ বন্টন করে দেওয়া হয় অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে।১৯৬৬-৬৭সালে কেন্দ্র চারটি প্রধান খাতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্ব আদায় করে ৫৫৪কোটি টাকা। কিন্তু রাজ্যকে ফেরত দেয়া হয়েছিল মাত্র  ৩৯ কোটি টাকা। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও  সুপরিকল্পিত বঞ্চনার শিকার হয় পশ্চিমবঙ্গ। চতুর্থ পরিকল্পনায় সব রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ ছিল সর্বনিম্ন(৬৯টাকা) যা  সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে মাথাপিছু ৫০ টাকা কম। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পে কেন্দ্রীয় বিনিযোগ ক্রমাগত কমতে থাকে। চতুর্থ পরিকল্পনায় এই পরিমাণ ছিল সারা দেশের মোট কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের মাত্র ৯.৮৬%,পঞ্চম পরিকল্পনায় আরো কমে হয় মাত্র ৬%। আর এসব অন্যায় ঘটেছে তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় । কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচারের বিরুদ্ধে তারা কখনও সরব হননি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ে। বরং যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গ গড় আয়ের বিচারে দেশে অষ্টম থেকে ষষ্ঠ স্থানে উন্নীত হয়।



একদা শিল্পসমৃদ্ধ রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা আরও করুণ হয় সত্তরের দশকে।  স্বাধীনতার পর কংগ্রেস সরকারের আমলে পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা ছাড়া আর কোনো উল্লেখযোগ্য বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠেনি। ক্ষুদ্র শিল্পের অবস্থাও সাতের দশকে  ক্রমশ শোচনীয় হতে থাকে। ক্ষুদ্র শিল্পের অল ইন্ডিয়া সেন্সাস এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সালের মধ্যে ৯৬২৮ টি ক্ষুদ্রশিল্পের ইউনিট রাজ্যে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। ছাঁটাই,লক আউট লাগামছাড়া ভাবে বেড়ে যায়।বেকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে ব্যাপক হারে। ১৯৭৪থেকে ১৯৭৫সালের মধ্যে কেবল শিল্প কারখানাতেই ১৫হাজার কর্মী কাজ হারান। 'ইকোনমিক টাইমস' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৭৭সালে পশ্চিমবঙ্গের  চার কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মধ্যে তিন কোটি মানুষই দারিদ্র্যের প্রান্তসীমায় বাস করতেন(ইকনমিক টাইমস,২৩আগস্ট,১৯৭৭)। এই অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে রাজ্যকে নতুন দিশা দেখানোর দুরূহ কাজে হাত দেয় প্রথম বামফ্রন্ট সরকার।

(শিল্প পর্বের ধারাবাহিক লেখা পুনরায় সোমবার প্রকাশিত হবে।)


শেয়ার করুন

উত্তর দিন