হ্যাঁ, এটি একটি ইন্দোনেশিয়ান প্রবাদ বাক্য। বাংলা করলে দাঁড়ায় "হাতির দাঁতে খুঁত, কিন্তু হাতির দাঁত"। হ্যাঁ, এই নামে একটি বই লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় কমরেড হীরেন মুখার্জী। এবং হ্যাঁ, সেটি স্তালিনের জীবনী। হাতির দাঁতে খুঁত, তবুও তো তা হাতিরই দাঁত! খুঁত থাকলেও তা অমূল্য! ঠিক স্তালিনের মতই।
কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যা আক্রমণ, তার সিংহভাগই তো শুরু হয় স্তালিনকে দিয়ে। অত্যাচারী! বর্বর! অশিক্ষিত! রূঢ়! সর্বোপরি এতটাই পাষাণহৃদয় যে নিজের সন্তানকেও জার্মান ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনার তথাকথিত 'অনৈতিক' উদ্যোগ নেয় নি!
এ'তো আছেই। তার চেয়ে খুব একটা কম আক্রমণ হয় না সম্পূর্ণ উল্টো এক কারণে! কারণটা হচ্ছে রাশিয়ার মত দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়ে সমাজতন্ত্র নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নেওয়ার 'অপরাধ'!
দুনিয়ার প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, এবং বিপ্লবের পর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা! এতদিন যা ছিল বইয়ের পাতায়, তা বাস্তবে চোখের সামনে গড়ে উঠছে। ইতিহাস তৈরি হচ্ছে 'ইউরোপের উঠোন' খ্যাত রাশিয়ার বুকে। শুধু তাই না, টক্কর দিচ্ছে এতদিনের একচ্ছত্র অধিপতি পশ্চিম দুনিয়ার সাথে! আট ঘন্টা কাজের দাবি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতে অধিকারে পরিণত হচ্ছে, দীর্ঘদিনের জোয়াল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন মায়েরা— যুক্ত হচ্ছেন উৎপাদন ব্যবস্থার মূল স্রোতে। সার্বজনীন শিক্ষা আর স্বাস্থ্য— যা এখনও কল্পনা ঐ পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়ায়— তা' বাস্তবে রূপ পাচ্ছে এই ব্যবস্থায়! দ্রুত উন্নত হচ্ছে ভারি শিল্প, অভাবনীয় উন্নতি এমনকি মহাকাশ বিজ্ঞানেও। কয়েক বছরের মধ্যেই মহাকাশে জয়যাত্রা শুরু হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের, কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবার অলিম্পিকে যোগ দিয়েই গোটা দুনিয়ার নজর কেড়ে নিচ্ছে সোভিয়েত— এই সবটাই সম্ভব হয়েছে ঐ বিকল্প ব্যবস্থার জন্যে, যার ভিত্তি গড়ার অবিসংবাদী নেতা হিসেবে কমরেড লেনিনের পরেই যে নামটা আসে, সেটা অবশ্যই জোশেফ স্তালিন। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিবাদী দুনিয়ার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি, এবং তাইই হয়ে চলেছে!
তার উপর আবার ঐ "পিছিয়ে পড়া দেশে সমাজতন্ত্র" গড়ার 'অপরাধ'টাও আছে। পিছিয়ে পড়া দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব— এ' কথা নাকি ক্ল্যাসিকাল মার্কসবাদের বোঝাপড়ার পুরো উল্টো! এবং এই জন্যেই নাকি সোভিয়েত সমাজতন্ত্র ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে! কারোর কারোর চোখে এই অপরাধের দায় যতটা লেনিনের, তার চেয়ে কম কিছু স্ট্যালিনের না! ফলে...
তাই কি? আচ্ছা, একটু কষ্ট করে 'কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র ১৮৮২ সালের ২য় রুশ সংস্করণের ভূমিকার শেষদিকটা দেখা যাক, যেখানে লেখা আছে— "আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্যভাবে আসন্ন অবদানের কথা ঘোষণা করাই ছিল' কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'র লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়াতে দেখি, দ্রুত বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী জোচ্চুরি ও বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া ভূসম্মত্তির মুখোমুখি রয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি জমি জুড়ে চাষীদের যৌথ মালিকানা। এখন প্রশ্ন হল, অত্যন্ত দূর্বল হয়ে গেলেও জমির উপর যৌথ মালিকানার আদি রূপ এই রুশ অবশ্চিনা (স্বশাসিত গ্রামীণ সমাজ) কি কমিউনিস্ট সাধারণ মালিকানার উচ্চতর পর্যায়ে সরাসরি রূপান্তরিত হতে পারে? নাকি পক্ষান্তরে তাকেও প্রথমে যেতে হবে ভাঙনের সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যা পশ্চিমের ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে?
এর একমাত্র যে উত্তর দেওয়া আজ সম্ভব তা এই— রাশিয়ার বিপ্লব যদি পশ্চিমে প্রলেতারীয় বিপ্লবের সংকেত হয়ে ওঠে যাতে দুই বিপ্লব পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়, তা হলে রাশিয়ার ভূমির বর্তমান যৌথ মালিকানা কাজে লাগতে পারে কমিউনিস্ট বিকাশের সূত্রপাত হিসেবে।"
তাহলে?? ১৮৮২ সালে লেখায় একটি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশ— রাশিয়ার ভবিষ্যৎ বিপ্লব সম্পর্কে মার্কস-এঙ্গলসের মনোভাব কী ছিল? নতুন করে ভাবছি। এই এদ্দিন পরেও।
যাই হোক্, স্তালিন। পশ্চিম দুনিয়ার চোখে অশিক্ষিত। যাঁর লেখা 'লেনিনবাদের ভিত্তি' এবং 'লেনিনবাদের সমস্যা' তো অবশ্যপাঠ্য দুটো গুরুত্বপূর্ণ বই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সংবিধান রচয়িতা স্তালিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসের লেখক/ সম্পাদক স্তালিন। নতুন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার মূল কারিগর স্তালিন।
আজকের আইডেন্টিটি ক্রাইসিস - জাতিসত্বার বাড়বাড়ন্তের সময়ে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নাম স্তালিন। যে ঐক্যের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ছিল পরবর্তী সময়ে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বীজ। 'জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার'— এই শব্দবন্ধটাকে এক শব্দে প্রকাশের নাম স্তালিন!
স্তালিন মানে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম ঐক্য এবং সর্বোপরি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়ের অবিসংবাদী নেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যা পরিণত হয়েছিল মানবতার ভবিষ্যৎ রক্ষার সংগ্রামে— সেই যুদ্ধে লাল ফৌজের অসামান্য বিজয় শুধু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজয় ছিল না, এই জয় মানবতাকে ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল। যে লড়াইয়ের নেতা ছিলেন স্তালিন।
অসংখ্য ভুল ত্রুটি দূর্বলতা তো ছিলই। সব কিছু ঢাকা পড়ে যায় এই একটিমাত্র জায়গাটাকে ধরলেই— স্তালিন মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়েছিলেন।
আজ, ২১ ডিসেম্বর। স্তালিনের ১৪৩তম জন্মদিবস। যেটা উইকিপিডিয়া বলে ১৮ ডিসেম্বর, আমরা আজ।
আজকের এই পরিচিতিসত্ত্বা আর ফ্যাসিস্ট প্রবণতার নতুন সময়টাতে 'আলোর পথযাত্রী' স্তালিনের পুনঃস্মরণের কাজটা জরুরী।
শেয়ার করুন