বিকল্পের লক্ষ্যে - শান্তনু দে ....

১০ ডিসেম্বর ২০২০ , বৃহস্পতিবার

হিন্দুত্ব ‘জাতীয়তাবাদ’, জরুরি বিকল্প ভাষ্য

ভারতের জাতীয়তাবাদের ধারণা তৈরি হয়েছিল উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের সময়, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যা ছিল অভিনব এবং অনন্য। সবমিলিয়ে এক নতুন ফেনোমেনন, যা দুনিয়া অতীতে কখনও দেখেনি।

ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধির আগ্রাসী ইউরোপীয় রূপের বিপরীতে এটি অপরিহার্যভাবেই ছিল গণতান্ত্রিক ও সমমাত্রিক— সমস্ত মানুষই সমান, সবার জন্য সমান অধিকার ও সমান সুযোগ-কেন্দ্রিক।



প্রথমত, এতে ছিল না ‘শত্রু ভিতরের’ ধারণা, বরং ছিল সকলকে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে জড়িয়ে রাখা। দ্বিতীয়ত, অপরের ভূখণ্ডকে যুক্ত করা, বা দখল করার মানসিকতা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠার ছিল না কোনও পরিকল্পনা। এবং তৃতীয়ত, এই ধারণা কখনও ‘মানুষের’ উপর স্থান দেয়নি ‘জাতি’কে, ‘জাতীয়’ উন্নয়নের কেন্দ্রে ছিল জনকল্যাণ।

এখন আসল প্রশ্ন, কেন উপনিবেশ-বিরোধী ‘জাতীয়তা’র কর্মসূচী বেলাইন হলো? কেন কোনঠাসা হলো ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই অনিন্দ্যসুন্দর ধারণা? কীভাবে জাকিয়ে বসল হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ? বছরের পর বছর ধরে যা ছিল সীমাবদ্ধ, হটাৎ করে কীভাবে তা এতটা শক্তিশালী হলো? এবং কীভাবেই বা এর মোকাবিলা সম্ভব?

উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদের প্রতিশ্রুতি ছিল সমমাত্রিক বিন্যাশের: শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও।

পুঁজিবাদী উন্নয়ন সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। নয়া উদারবাদ একেবারে তার শিকড়ে আঘাত করেছে।

একুশ শতকের ভারতে অসাম্য ছাপিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ রাজকে। ব্রিটিশ রাজ থেকে এখন বিলিওনেয়ার রাজ।

ভারতের আয়কর তথ্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেত্তি ও লুকাস চ্যানেলের সমীক্ষায়: এমনকি ১৯৮২-৮৩’র শেষেও, দেশের জনসংখ্যার শীর্ষ ১ শতাংশের আয় ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র ৬.২ শতাংশ। নয়া উদার পুঁজিবাদ বদলে দিয়েছে সবকিছু: ২০১৩-১৪, শীর্ষ ১ শতাংশের ভাগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.৭ শতাংশে। ১৯২২ সালে ব্রিটিশ ভারতে আয়কর আইন চালু হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ।

এই ব্যবধান এখন আরও বেড়েছে। আয়ের অসাম্য এখন চরমে। চলতি বছরে অক্সফামের অসহায় আর্তনাদ, সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের দরিদ্রতর ৭০ শতাংশ, অর্থাৎ ৯৫ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের চেয়ে চারগুণ বেশি সম্পদ। ৬৩ জন ভারতীয় ধনকুবেরের মোট সম্পদের পরিমাণ ২০১৮-১৯ আর্থিক বর্ষের বাজেট, অর্থাৎ ২৪ লক্ষ ৪২ হাজার ২০০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। মুকেশ অম্বানির আয় চিকিৎসা-স্বাস্থ্য খাতে কেন্দ্র-রাজ্যের মিলিত বাজেটের চেয়ে বেশি! এই লকডাউনের সময়ে পর্যন্ত মুকেশের আয় ছিল ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা!

নয়া উদার পুঁজিবাদ এভাবেই উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদকে পরিণত করেছে তামাশায়। আর এসময়ই হিন্দুত্বের উপর ভিত্তি করে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের’ উত্থান। যা বদলে দিয়েছে আলোচনার অ্যাজেন্ডা। একজনের বস্তুগত উন্নয়নকে ভুলে ‘হিন্দু’ হওয়ার গর্ববোধ। তোমার সমস্যার জন্য ‘ওরা’ দায়ী, এই প্রচার সহজেই বিভ্রান্ত করছে।

ফ্যাসিবাদী এই উত্থানকে প্রতিরোধ করা তখনই সম্ভব, যদি নয়া উদারবাদের আধিপত্যকে ভাঙা যায়। এবং বিকল্পের একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী মানুষের সামনে উপস্থিত করা যায়।



এই সময়ে শুধু সমাজতন্ত্রের ডাক দিলে হবে না। ওটা দূরায়ত লক্ষ্য। পুঁজিবাদের একমাত্র বিকল্প সমাজতন্ত্র। এতে কোনও সন্দেহ নেই। ঘটনা হলো, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কোনও শর্টকাট রাস্তা নেই। তাকে দীর্ঘ আঁকাবাঁকা পথ চড়াই-উৎরাই ভেঙে এগোতে হয়। অতিক্রম করতে হয় অনেকগুলি ধাপ ও স্তর। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল ধারাগুলির কেউই এখনও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে আশু লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেনি। বিপ্লবের স্তর যে গণতান্ত্রিক, সে বিষয়ে রয়েছে সাধারণ সহমত, তার নাম যাই হোক না কেন।

সেকারণে, বিকল্পের চরিত্র হোক, লেনিন যেমন বলেছেন, উত্তরণের চাহিদা ‘ট্রানজিশানাল ডিমান্ড’, যা এই ব্যবস্থাকে ছাপিয়ে নয়, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে যা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে শাসকশ্রেণি, অথচ যে দাবি আদায় সম্ভব। যেমন বলশেভিকদের স্লোগান ছিল ল্যান্ড, পিস, ব্রেড। জমি, শান্তি, রুটি।

লেনিন বুঝেছিলেন জনগণের মেজাজ। কৃষকরা চাইছেন জমি। শ্রমিকরা রুটি। আর নাবিক-সেনারা শান্তি।

কোভিডের পরিস্থিতিতে বামপন্থীসহ ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ দাবির সঙ্গেই চাই: সবার জন্য মাসিক ন্যূনতম মজুরি ২১,০০০ টাকা। সবার জন্য মাসিক পেনশন ১০,০০০ টাকা। কৃষকের জন্য কেবল এককালীন ঋণমকুব নয়। সঙ্গে ফসলের দেড়গুণ দাম। ভূমিহীনদের জন্য জমি। সব গ্রামে, সব শহরে রেগা। একশ দিন না। দু’শ দিন। কাজের নিশ্চয়তা। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা। প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা। কাজ হোক স্থায়ী চরিত্রের। ঠিকাব্যবস্থার অবসান। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ। সর্বজনীন গণবন্টন। কেজি থেকে পিজি। পুরোপুরি সরকারি খরচে অবৈতনিক অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা। কারখানা থেকে ক্যাম্পাস। চাই ইউনিয়নের অধিকার। গণতন্ত্রের অনুশীলন, চর্চা হোক কলেজ থেকে, যারা নেবে ভবিষ্যতে দেশ-রাজ্যের দায়িত্ব।

একইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বিকল্প। যা সর্বজনীন। যে দায়িত্ব নিতে হবে রাষ্ট্রকে।

১. স্বাস্থ্যের অধিকার। সবার জন্য। বিনামূল্যে। যেমন আছে ব্রিটেনে, স্ক্যান্ডেনেভিয়ার দেশগুলিতে। জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার মাধ্যমে কোয়ালিটি স্বাস্থ্য পরিষেবা।
২. শিক্ষার অধিকার। সবার জন্য। বিনামূল্যে। শুরু হোক সেকেন্ডারি দিয়ে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
৩. কাজের অধিকার। কাজ দিতে না পারলে ন্যূনতম মজুরির সমান বেকার ভাতা।
৪. খাদ্যের অধিকার।
৫. বার্ধক্যভাতা ও প্রতিবন্ধীভাতা।


সরকারকেই নিতে হবে এর দায়ভার। রাখতে হবে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ।

কেউ বলতে পারেন এটা কী করে সম্ভব? পালটা আমাদের বলতে হবে, কেন অসম্ভব! এটা বাস্তব দাবি। মানুষের জীবনের ন্যূনতম দাবি।

এর জন্য প্রয়োজন সাকুল্যে ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। জিডিপি’র ১০ শতাংশও নয়।

এই দাবি কি আদৌ আকাশকুসুম? মোটেই না।

জরুরি হলো প্রতিটি মানুষের মনে এই সর্বজনীন অধিকারের স্বপ্ন নির্মাণ। এই দাবিতে সর্বত্র প্রচারাভিযান। লড়াই-আন্দোলন।

বিলিওনিয়ারদের উপর পরিমিত কর চাপালেই যথেষ্ট। সহজেই সুনিশ্চিত করা সম্ভব সবার জন্য পাঁচটি মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকার। মাত্র দু’টি কর। সম্পদ কর আর উত্তরাধিকার কর।

সুপাররিচ ১ শতাংশের উপর ২ শতাংশ সম্পদ কর, সঙ্গে ৩৩ শতাংশ উত্তরাধিকার কর চাপালেই যথেষ্ট। অনায়াসে উঠে আসতে পারে জিডিপি’র ১০ শতাংশ অর্থ। এজন্য প্রয়োজনীয় ১৫ লক্ষ কোটি টাকা। (এ প্ল্যান টু রিভাইভ ব্রোকেন ইকনমি: হর্ষ মান্দার, জয়তী ঘোষ, প্রভাত পট্টনায়েক/ দ্য হিন্দু, ১৪ মে ২০২০)।

তাছাড়া, শুধু গত পাঁচ বছরেই (২০১৪-১৯) প্রত্যক্ষ করবাবদ অনাদায়ী পড়ে রয়েছে ৬ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। অতীতের বকেয়া যোগ করলে প্রকৃত অর্থের পরিমান আরও অনেক বেশি। তাই টাকার অভাব নেই।

আর দেরি হওয়ার আগে পরাস্ত করতে হবে হিন্দুত্ব ‘জাতীয়তাবাদ’কে। পুনুরুজ্জীবিত করতে হবে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদকে। আর সেজন্য সমতার ব্যবস্থা আনার লক্ষ্যে শীর্ষ নিয়ে আসতে হবে বিকল্প অর্থনৈতিক কর্মসূচী।

এক সর্বজনীন অধিকারের দাবি। ভারতের একজন নাগরিক হিসেবে যেখানে থাকবে এক গর্ববোধ, যেখানে থাকবে সবার সমান সুযোগ।

বুদ্ধিবৃত্তির লড়াইয়ের সঙ্গে গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামকে জুড়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের লড়াই গড়ে তুলতে না পারলে আজকের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঠেকানো কঠিন।



সেকারণেই গড়ে তুলতে হবে বিকল্প ভাষ্য। বিকল্প ভাষ্য মানে বিকল্প অ্যাজেন্ডা। বিকল্প আখ্যান। এই বিকল্পের জন্য চাই অবিরাম সংগ্রাম।

::::::::::::::::::::::::::::::

ধারাবাহিক চলবে .....
আগামী পর্ব - কেরালা, বিকল্পের বাতিঘর




শেয়ার করুন

উত্তর দিন