সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি'র সাক্ষাৎকার.....

১৯ নভেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার

বিজেপি-কে হারাতে গেলে তৃণমূলকে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করতে হবে: সীতারাম ইয়েচুরি
তৃণমূলের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে, লড়াই না করলে লাভবান হবে বিজেপি-ই। পশ্চিমবঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির এটিই বাস্তবতা। বুধবার গণশক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বললেন সিপিআই(এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবাশিস চক্রবর্তী

গণশক্তি: সদ্যসমাপ্ত বিহার নির্বাচনের শিক্ষা কী?
ইয়েচুরি: বিহার নির্বাচন থেকে অনেকগুলি কার্যকরী শিক্ষা আমরা নিতে পারি। প্রথম কথা ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সম্ভাব্য বৃহত্তম ঐক্য গঠন করা গিয়েছিল। তা বিজেপি-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাজে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, আরজেডি-কংগ্রেস মহাগটবন্ধনের সঙ্গে বামপন্থীরা সামিল হয়েছিল। তিন বামপন্থীদলের এই যোগদান বিহারের নির্বাচনী প্রচারের চিরায়ত ধারাকে বদলে দিতে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রশ্ন সামনে এসেছে। মানুষ সাড়া দিয়েছেন। বিশেষ করে বেরোজগারীর প্রশ্নে যুবকদের সাড়া পাওয়া গেছে। তৃতীয়ত, সারা দেশই জানে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বামপন্থীরাই সবচেয়ে জোরদার কণ্ঠ। ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার লড়াইয়ে বামপন্থীদের বিশ্বাসযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। তার প্রভাব পড়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ভোট এক জায়গায় পড়েছে। আমরা প্রচারে বলেছিলাম বিজেপি-কে পরাস্ত করা বিহারের পক্ষে জরুরী, ভারতের পক্ষে জরুরী। বাস্তবে বিজেপি-জেডি(ইউ) জোট শেষ পর্যন্ত মাত্র ০.০৩ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। বিজেপি যে অপরাজেয় নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে।

গণশক্তি: পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন কয়েক মাসের মধ্যেই হবে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক বিন্যাস নিয়ে কথাবার্তা শুরুও হয়ে গেছে। সিপিআই(এম)-র রাজনৈতিক রণকৌশল কী হবে?

ইয়েচুরি: সিপিআই(এম)-র পার্টি কংগ্রেসে রাজনৈতিক রণকৌশলগত লাইন নির্ধারিত হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বিজেপি-কে পরাস্ত করা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার থেকে তাদের অপসারণ করা। পশ্চিমবঙ্গেও প্রাথমিক লক্ষ্য বাংলা ও ভারতের স্বার্থে তাদের পরাস্ত করা। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এই লক্ষ্য পূরণ করা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিজেপি-কে পরাস্ত করতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেসকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, পরাস্ত করতে হবে। তৃণমূল বাংলায় বিজেপি-কে প্রবেশের রাস্তা করে দিয়েছে। তাদের ওপরে নির্ভর করেই বিজেপি বাংলায় পা রেখেছে। তৃণমূল বিজেপি-র সঙ্গে আঁতাত করেছিল, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এনডিএ সরকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন। বিজেপি-র বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে শূন্য।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে গভীর জনঅসন্তোষ রয়েছে। তৃণমূলের হিংসা ও শাসানির রাজনীতির বিরুদ্ধে মানুষের তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। কেউ যদি বলেন বিজেপি-কে পরাস্ত করতে তৃণমূল সহ সকলকে নিয়ে চলতে হবে তা হবে আত্মঘাতী। সেক্ষেত্রে সমস্ত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, শাসক দলের বিরোধী ভোট বিজেপি-র কাছে চলে যাবে। এই ধরনের কৌশল বিজেপি-র জয়কেই উলটে নিশ্চিত করবে। বাংলায় প্রয়োজন বিজেপি-বিরোধী, তৃণমূল-বিরোধী সমস্ত ভোটকে সর্বোচ্চ সম্ভব এক জায়গায় জড়ো করা। এই লক্ষ্য নিয়েই চলার কথা সিপিআই(এম)-র কেন্দ্রীয় কমিটিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গণশক্তি: কোনো কোনো মহল থেকে কথা উঠছে ‘প্রধান শত্রু’ কারা। সিপিআই(এম) তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার করায় বিজেপি-র সুবিধা হচ্ছে। কীভাবে এই প্রশ্নকে আপনি দেখছেন?

ইয়েচুরি: প্রধান শত্রু বিজেপি। সারা ভারতেই এবং বাংলায় প্রধান শত্রু বিজেপি। রণকৌশলের মুখ্য প্রশ্ন হল এই শত্রুকে আমরা কীভাবে হারাতে পারি। আমি আগেই বলেছি, তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই না করলে, প্রচার না করলে শাসক-বিরোধী ভোটের একটাই রাস্তা খুলে যাবে। তা হলো ভোট চলে যাবে বিজেপি-র কাছে। যে লক্ষ্যের জন্য আমরা কাজ করব, সেই লক্ষ্যই পরাস্ত হবে। এমন কোনো কৌশল নিলে বিজেপি-ই লাভবান হবে।

বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই চায় দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতার একটি ভাষ্য তৈরি হোক। হয় বিজেপি, না হয় তৃণমূল। উভয় শক্তিই এই মেরুকরণকে মদত দিচ্ছে। যাতে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্য জায়গা না থাকে। এই দ্বিমেরুর আখ্যানে শেষ পর্যন্ত লাভ হবে বিজেপি-র। জনগণ কোনো বিকল্প না পেলে বিজেপি-র দিকে যাবেন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নীতি জনস্বার্থবিরোধী। বিজেপি-র নীতি থেকে তা পৃথক নয়। উভয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই তৃতীয় এবং নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি হবে।

গণশক্তি: এমন কথাও কেউ কেউ বলছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে বেশি মনোযোগ দেয়।

ইয়েচুরি: পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হবে না? সরকার তৃণমূলের। জনগণের জীবনজীবিকা, তাঁদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার জন্য লড়াই চলছে। মানুষের বিক্ষোভকে প্রতিফলিত করার চেষ্টা করছে সিপিআই(এম) ও বামপন্থীরা। কিন্তু শুধু রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে, এটি বাজে কথা। কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই করছে সিপিআই(এম)। লকডাউনের সময়ে লড়াই কার বিরুদ্ধে হয়েছে? ২৬নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘট কাদের বিরুদ্ধে হচ্ছে? রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারীকরণ, শ্রম আইনে শ্রমিক-বিরোধী সংশোধনী, নয়া কৃষি আইনের বিরুদ্ধে একটানা লড়াই হচ্ছে। মোদী সরকারের গণতন্ত্রের ওপরে আক্রমণ, সংবিধানকে ধ্বংস করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) একটানা লড়াই চালাচ্ছে। কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে না বলা একেবারেই অসত্য, বিভ্রান্তিকর কথা।

বিপদের কথা আগেই বলেছি। বিজেপি এবং তৃণমূলকে আমরা এক করে দেখছি না। দেশের কোনো রাজনৈতিক দলকেই বিজেপি-র সঙ্গে এক করে দেখা যায় না। বিজেপি সংবিধান ও সাধারণতন্ত্রের কাঠামোকেই ভেঙে দিতে উদ্যত। কিন্তু তৃণমূলের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের মোদী সরকার উভয়ের বিরুদ্ধেই সিপিআই(এম) লড়ছে।

গণশক্তি: পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে কীভাবে দেখছে সিপিআই(এম)? বিশেষ করে বাংলার পূর্ব ইতিহাস এবং জনবিন্যাসের প্রেক্ষিতে?

ইয়েচুরি: বাংলায় দেশভাগের সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে, অত্যন্ত বিষাদময় ও নৃশংস ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে হয়েছে বাংলার মানুষকে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনেও গান্ধীজী কলকাতায় অনশন করছিলেন। নোয়াখালির বর্বর দাঙ্গার জন্য তিনি যেতে চেয়েছিলেন। যেতে দেওয়া হয়নি। তিনি লালকেল্লায় ত্রিবর্ণ পতাকা তুলতে যাননি, কলকাতায় অনশন করছিলেন। এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ক্ষত গভীর ভাবেই বাংলার মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্টরা ও বামপন্থীরা দীর্ঘ সময় তা সংযত করে রাখতে পেরেছে, এমনকি অনেকাংশে মুছেও দিতে পেরেছে। অর্ধশতক ধরে বাংলায় আন্দোলন-সংগ্রাম, জীবনজীবিকার লড়াই, প্রগতিশীল রাজনীতি, সাংস্কৃতিক প্রবাহ সেই ক্ষত মুছতে সাহায্য করেছে। সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গে নিরাপত্তা ও গণতন্ত্র পেয়েছেন। বাবরি মসজিদের সময়ে গোটা দেশে দাঙ্গা হলেও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ বাংলায় আশ্রয় নিয়েছেন। গোটা দেশে যখন সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তার অভাবে ভুগেছেন, তখন বাংলায় সংখ্যালঘুরা জীবনজীবিকা উন্নত করার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির জোর হিসাবে কাজ করেছে সাম্প্রদায়িক সংহতি। এই যে নিরাপত্তাবোধ তা কোনো সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তিকে মদত দিয়ে পাওয়া যাবে না। বিজেপি চেষ্টা করছে অতীতে ফিরে গিয়ে সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে জাগিয়ে তোলার। বাংলায় ওদের প্রচারের অন্যতম উপাদানই তাই। সিপিআই(এম) দৃঢ় ভাবে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়িয়ে থাকবেও।

গণশক্তি: সিপিআই(এম) ও বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ায় যাচ্ছে। এ কি কেবল ভোট বাড়ানোর লক্ষ্যে?

ইয়েচুরি: প্রথম কথা সিপিআই(এম) কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী বোঝাপড়ায় যাচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। সিপিআই(এম)-র দেশব্যাপী অবস্থানই হল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক কাঠামো, সাধারণতন্ত্র রক্ষায় যে-সমস্ত শক্তি ইচ্ছুক, তাদের ঐক্য গড়ে তোলা। একেক রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তার চেহারা স্থির হবে। সিপিআই(এম) কারোর অধীনস্থ নয়, কারোকে আমাদের অধীনস্থ হতেও বলছি না। বিহারের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আরজেডি-কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের ঐক্য হয়েছে। তামিলনাডুতে আমরা ডিএমকে-র সঙ্গে ঐক্য গঠন করব। পশ্চিমবঙ্গেও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির ঐক্য গঠনের আলোচনাই চলছে। বিজেপি-বিরোধী, তৃণমূল-বিরোধী শক্তিগুলির ঐক্য গঠনের প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে। একে শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে ঐক্য বলে দেখা উচিত নয়। এই হল সিপিআই(এম)-র অবস্থান।



***********
সৌজন্যে : গণশক্তি, ১৯ নভেম্বর, ২০২০
রূপান্তরের যাত্রী



শেয়ার করুন

উত্তর দিন