পুঁজি বনাম করবিনের বিকল্প - শান্তনু দে

৩০ অক্টোবর ২০২০
ওয়েবডেস্কের প্রতিবেদন :
পুঁজি করবিনের বিরুদ্ধে।
তিনি নিজেও সেকথা বলেছেন: ‘এস্টাব্লিশমেন্ট চায় না লেবার জিতুক। তারা চায় না এমন লেবার সরকার, যারা থাকবে মানুষের পাশে। আশার জন্য ভোট দিয়ে মানুষকেই তাই এস্টাব্লিশমেন্টে আঘাত হানতে হবে।’ স্বাভাবিক।
গত ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে করবিনের ইশ্‌তেহারের অভিমুখ ছিল ‘ফর দ্য মেনি, নট দ্য ফিউ’। তাঁর নেতৃত্বে ব্রিটেনের লেবার পার্টি নিজের নীতি তৈরি করেছিল সকলের কথা ভেবে, মুষ্টিমেয় কয়েক জনের উন্নয়ন তাঁদের উদ্দেশ্য নয়।
এরপর পুঁজি কেন চাইবে তাঁকে? কেনই বা তাঁর জন্য উতলা হবে এস্টাব্লিশমেন্ট? বরং তাঁকে নিকেশ করাই হবে পুঁজির অগ্রাধিকার। সেনা অফিসারেরা তাঁর বিরুদ্ধে। যেমন ছিল ২০১৫ সালের ব্রিফিং, শুনিয়েছিল হুমকি: করবিন জিতলে ‘বিদ্রোহ’ হবে। তাঁদের দাবি, করবিন ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’ গত নির্বাচনে লেবার হেরেছিল। স্বাভাবিক। ব্রিটেনের ১৫১ জন বিলওনেয়ারের তিনভাগের একভাগ আর্থিক সাহায্য করেছিল কনজারভেটিভ পার্টিকে। বিবিসি থেকে তাবৎ মিডিয়া ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। একতরফা আগ্রাসন। সরকারি কর্তাদের প্রচার ছিল, লেবার নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য যথেষ্ট বুড়ো। ওয়াশিংটন সরাসরি নেমেছিল করবিনের বিরুদ্ধে। মার্কিন বিদেশসচিব মাইক পম্পেও যেমন প্রকাশ্যে বলেছিলেন, করবিনের জয় ঠেকাতে কাজ করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাজয়ের দায়িত্ব স্বীকার করে দলের নেতৃত্ব ছেড়েছেন কররিন। পুঁজি, এস্টাব্লিশমেন্ট তাতেও খুশি নয়। তারা চায় লেবার পার্টি থেকে তাঁর বহিষ্কার। বৃহস্পতিবার করবিনকে ‘সাসপেন্ড’ করেছে লেবার পার্টি। তিনি নেতৃত্বে থাকার সময় ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের তীব্র সমালোচনামূলক তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পরে করবিন তা প্রত্যাখ্যান করে যেসব মন্তব্য করেছেন, তার জেরে এই দলের এই সিদ্ধান্ত।

আসলে লেবার পার্টির ভিতরে-বাইরে ইহুদি লবির টার্গেট করবিন। এখন তাঁরা সেই লক্ষ্যের কাছাকাছি। দলের মধ্যে যাঁরা প্যালেস্তিনীয়দের পক্ষে, ইজরায়েলের যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে, তাঁদের হয় চুপ করে থাকতে হবে, না হলে পড়তে হবে বহিষ্কারের মুখে।



করবিন জানিয়েছেন, তিনি বরং ইহুদিবিদ্বেষের নিন্দা করেছিলেন। তবে, তাঁর নেত্বেত্বের সময়ে যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছিল ‘রাজনৈতিক ফায়দা নিতে সেগুলিকে অনেক বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে’।
‘যে কোনও ধরনের বর্ণবিদ্বেষের প্রতিই কোনও সহিষ্ণুতা নয়, এই নীতিকেই আমি সমর্থ করে যাব।’ বলেছেন করবিন। সেইসঙ্গেই জানিয়েছেন, ‘আমাকে সাসপেন্ড করার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়ে যাব।’ এমনই করবিন। হেরেও যিনি হারেন না। সেদিন নির্বাচনেও লেবার হেরেছিল। তিনি হারেননি। কানাগলিতে নয়া উদারবাদ।
উগ্র দক্ষিণপন্থা পথ দেখাতে ব্যর্থ। বিকল্প আছে।
অন্যরকম ভবিষ্যৎ সম্ভব। ‘বিকল্প জরুরি’ বলাই শুধু নয়। বিকল্পের নির্দিষ্ট দিশা দেখিয়েছিলেন করবিন।
লেবারের নির্বাচনী ইশ্‌তেহার দেখে বিরোধীরা বলেছিলেন, বিশ শতকের সত্তর দশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইশ্‌তেহার। লেবার বলেছে, একুশ শতকের সত্তর দশকের দিকে তাকিয়ে এই ইশ্‌তেহার: ‘আশার ইশ্‌তেহার’। পুঁজির শক্তি, কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচারে সেদিন হেরেছিলেন মানুষ। কিন্তু, আশা হারেনি।
কী বলেছিলেন করবিন তাঁর প্রচারে, তাঁর ইশ্‌তেহারে?
বাড়তি কর আরোপ করে ‘প্রকৃত পরিবর্তনের’ জন্য ৮,৩০০ কোটি পাউন্ড তোলার কথা বলেছিল লেবার।
নির্বিচারে বেসরকারিকরণের জমানায় লেবার চেয়েছিল রেল, ডাক, ব্রডব্যান্ড পরিষেবা, ৬টি বড় শক্তি সংস্থা সহ জল সরবরাহ ব্যবস্থার জাতীয়করণ।
ব্রডব্যান্ডের জাতীয়করণ বিবিসি’র ভাষায় ‘ব্রডব্যান্ড কমিউনিজম’, যা আরও বেশি মানুষকে টেনে আনবে অনলাইনে, বাড়তি খরচের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বিনিময়ে ব্যয়সঙ্কোচের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে লেবার দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, সঙ্গে কর্মীদের ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি।
গত কয়েক বছর ধরে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার বেপরোয়া বেসরকারিকরণের পর লেবার বলেছিল বিপুল সংখ্যায় স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের কথা। বেসরকারিকরণের অবসান, প্রেসক্রিপশন চার্জ বাতিলের সঙ্গেই দিয়েছিল ফ্রি ডেন্টাল চেকআপের প্রতিশ্রুতি। জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবায় সেই মুহূর্তে শূন্য পদের সংখ্যা ১,০০,০০০। ছিল ৪৩,০০০ নার্সের ঘাটতি। লেবার বলেছিল, স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো হবে ৪.৩ শতাংশ। বিনিয়োগ করা হবে ২,৬০০ কোটি পাউন্ড।

ইশ্‌তেহার ছিল বস্তুতই শ্রমিকমুখী। বলা হয়েছিল শ্রমিক বিরোধী আইন বাতিলের কথা। ফিরিয়ে আনা হবে যৌথ দর কষাকষির অধিকার।
সেইসঙ্গেই কর্মীদের হাতে থাকবে সংস্থার ১০ শতাংশের মালিকানা, যাতে বোর্ড-রুমে থাকতে পারে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব। ইশ্‌তেহার এভাবেই কিছুটা হলেও ক্ষমতা তুলে দিতে চেয়েছিল শ্রমিকদের হাতে।
নিয়োগের প্রথম দিন থেকেই থাকবে কাজের পূর্ণ অধিকার।
ইশ্‌তেহার বলেছিল, শ্রমসপ্তাহ কমিয়ে করা হবে ৩০ ঘণ্টা। সপ্তাহে দু’দিন ছুটি ধরে নিলেও দিনে সাত-ঘণ্টার কম। ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে করা হবে ঘণ্টায় ১০ পাউন্ড। লেবার জিতলে থাকবে কর্মসংস্থানের অধিকার নিয়ে নতুন মন্ত্রক।



লেবারের ভাষায়, এভাবেই শ্রমিক-কর্মচারীদের কণ্ঠস্বর উঠে আসবে মন্ত্রীসভার বৈঠকে। যথারীতি ইউনিয়নগুলি দু’হাত তুলে এই ইশ্‌তেহারকে স্বাগত জানিয়েছিল। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইউনিয়ন ইউনাইটের সাধারণ সম্পাদক লেন ম্যাকক্লুসকি বলেছিলেন, ‘লেবার জেতা মানে নার্সদের জেতা, শিক্ষক, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের শ্রমিক, অটোমোবাইল ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সঙ্গেই তরুণ থেকে পেনশনারদের জয়।’
লেবার বলেছিল, মকুব করা হবে ৯,০০০ পাউন্ড টিউশন ফি। চালু করা হবে সর্বজনীন বিনামূল্যে স্কুল মিল, স্কুলগুলিতে আরও বিনিয়োগ করা হবে। ইশ্‌তেহারে জোর দেওয়া হয়েছিল জীবনভর শিক্ষার উপর। স্কুল শেষ মানেই শিক্ষা শেষ নয়। নতুন শিক্ষা পরিষেবায় প্রত্যেকের জন্য থাকছে কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব। ইশ্‌তেহারে বলেছিল, নতুন ব্রেক্সিট চুক্তির খসড়া নিয়ে হবে গণভোট।
পঁচিশ বছরের কমবয়েসিদের জন্য থাকবে বিনা খরচে বাসে চলাচলের সুযোগ। পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ে সেদিন করবিনের লেবার হেরেছিল। আশা হারেনি। ‘আশার ইশতেহার,’ এখনও যথেষ্টই আশার কারণ, ভোটদানের প্রবণতাতেই সেই লক্ষণ ছিল স্পষ্ট:
এক) ১৮-২৪ বছর:
লেবার ৫৭ শতাংশ/ টোরি ১৯ শতাংশ
দুই) ২৫-৩৪ বছর:
লেবার ৫৫ শতাংশ/ টোরি ২৩ শতাংশ
তিন) ৩৫-৪৪ বছর:
লেবার ৪৫ শতাংশ/ টোরি ৩০ শতাংশ<বর> চার) ৬৫ এবং তার উপরে
লেবার ১৮ শতাংশ/ টোরি ৬২
শতাংশ

ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া-সহ অন্যত্র ব্রিটিশ ও মার্কিন আগ্রাসনের ঘোর বিরোধী করবিন। নয়া উদারবাদের বিরোধিতা করেছেন। তবে পুঁজিবাদের নয়। পুঁজিবাদের মধ্যেই তিনি তুলে ধরেছেন নয়া উদারবাদের বিকল্প।
করবিন, তাঁর অনুগামীরা কী করবেন বলবে ভবিষ্যত। তবে বামমুখী বিকল্প নিয়ে বামপন্থী দল গড়ে তোলার এখনই সময়। যা একমাত্র চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে ব্রিটিশ রাজনীতির উগ্র দক্ষিণপন্থাকে।

১৯২০-তে লেনিন বলেছিলেন, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের লেবার পার্টিতে যোগ দেওয়া উচিত এবং ‘বিপ্লবী পন্থা নিয়ে লেবার পার্টিতে কাজ শুরু করা উচিত।’ যা ‘এই দলকে বহিষ্কার করে বধিত করবে।’ এবং ‘যা হবে ব্রিটেনে কমিউনিস্ট ও বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের জন্য এক মহান জয়।’


শেয়ার করুন

উত্তর দিন