২৫ বৈশাখ,২৮২৮
প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রতিভার ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কবিগুরু ছিলেন মানবতাবাদী, ও মানুষের কল্যাণ সাধনে এক নিবেদিতপ্রাণ। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে যখন রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার ও আধুনিক শিক্ষা প্রসারের আন্দোলন নব ভারতে এক নতুন দিশা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। নবজাগরণের ঢেউ তখন উত্তাল। স্বাধীনতা হীনতার জ্বালায় মানুষ যখন প্রতিবাদের পথ খুঁজছেন তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর শৈশবে চৈত্র মেলায় পাঠ করেছিলেন স্বরচিত কবিতা,
যেখানে ধ্বনিত হয়েছিল
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে
বিরাট ক্ষোভ।
"ব্রিটিশ বিজয় করিয়া ঘোষণা।
যে গায় গাক আমরা গাব না।
আমরা ধরিবো আর এক তান।"
এই তান আত্মজাগরণের, আত্মপ্রতিষ্ঠার।
শিশুকাল থেকেই উপনিষদের জীবন দর্শন, রবীন্দ্র মনে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। উপনিষদের আত্মচেতনা ও ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ছিল পরস্পরের বিরোধী। একটি ছিল আধ্যাত্মবাদী ,অন্যটি ছিল বস্তুবাদী চেতনায় ভাস্বর। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের যুগস্বীকৃত তথ্য ও সত্যকে এড়িয়ে যান নি।সব কিছু বিচার করেছেন গভীর অনুসন্ধিৎসা ও অনুভব দিয়ে। বস্তুবাদী চেতনার সঙ্গে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদী চেতনার অপূর্ব সমন্বয় গড়ে তুলে রবীন্দ্রনাথ ভালবাসার প্রকাশ ঘটেয়েছিলেন।
"মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,
মানুষের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই এক পত্রে লিখেছিলেন "স্বর্গের উপর আড়ি করে আমি আমার দরিদ্র মায়ের ঘর আরো বেশি ভালোবাসি-এত অসহায় ,অসমর্থ ,অসম্পূর্ণ ভালোবাসার সহস্ত্র আশঙ্কায়"। সর্বদা চিন্তা কাতর ছিলেন বলেই, দরিদ্র সম্বলহীন মানুষের প্রতি তার আহবান ছিল "এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা ,এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা ,ডাকিয়া বলিতে হবে ---
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্রে দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা -চেয়ে
যখনি জগিবে তুমি তখনই সে পালাইবে ,পালাইবে ধেয়ে।" রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ ছিলেন। গোটা ভারতবাসীর জ্বালা ও যন্ত্রণা দেখে তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক সিংহহৃদয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রিটিশ সদস্যদের হাতে আইরিশ সদস্যদের লাঞ্ছনা দেখে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন।ঘৃণা করতেন ইংরেজদের ঠগবৃত্তি কে।মানুষের দুঃখ-দুর্দশা,অত্যাচার শোষণের রূপ কৈশরকাল থেকেই তার চোখে ধরা পড়ে।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে র্যান্ড হত্যায় গ্রেপ্তার হন বালগঙ্গাধর তিলক ও নাটু ভ্রাতৃদ্বয়। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে আসেন। বোম্বাইতে কোন কৌসুলি তাদের পক্ষে দাঁড়াতে চাইছিলেন না, কারন ইংরেজদের ভয় ।তিলকের মামলার ব্যয়ভার বহনের জন্য রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় অন্যদের সহযোগিতায় চাঁদা তোলেন,এবং কলকাতা থেকে দুজন কৌঁসুলি কে পাঠাতে সক্ষম হন।রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বৃটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে গেলে প্রথম প্রয়োজন জনগণের নির্ভীকতা ও ত্যাগ স্বীকার। তাই কবি কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল-
"এ দুর্ভাগা দেশ হতে হে মঙ্গলময়
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছভয়--
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয়, আর"।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাতেই ঐদিন সমস্ত বাঙালি উপবাস পালন করেন ঐক্যের প্রতীক হিসেবে। হয় রাখি বন্ধন, শোভাযাত্রা হয়। সেই দিন সকালে গাওয়া হয় আমাদের আবেগের সেই গান-
"বাংলার মাটি বাংলার জল"।
এবার আসি কবিগুরুর মুক্ত ধারা নাটক প্রসঙ্গে। এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ রাজার বিরুদ্ধে প্রজাবিদ্রোহের কথা ঘোষণা করেন। রাজা রঞ্জিত প্রজাদের শিক্ষা দেবার জন্য যন্ত্ররাজ বিভূতির সাহায্যে বহু অর্থব্যয়ে মুক্তধারায় এক বাঁধ নির্মাণ করেন। ফলশ্রুতিতে শিব তোরাই এ জল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এই বাঁধ নির্মাণকালে,উত্তরকূট অঞ্চলে মজুরদের অভাব দেখা যায়। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে যুবকদের জোর করে সেখানে মজুর খাটানো হয়। বাঁধ নির্মাণে বহু যুবকের তাজা রক্তে ভেসে যায় অঞ্চল। শিব তোরাই অঞ্চলে মুক্তধারার জল সরবরাহ বন্ধ হয়। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, ক্ষুব্ধ হয় প্রজারা। এখানে রবীন্দ্রনাথ যন্ত্র কে আঘাত করেননি,আঘাত করেছেন যন্ত্র ব্যবস্থাকে। আমার কথায় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে। এদিকে রাজা শিবচরের শাসনভার যুবরাজ অভিজিতের হাত থেকে সরিয়ে রাজশালক চন্দ্র পাল এর উপর ক্ষমতা প্রদান করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় প্রজারা। প্রজাদের নেতৃত্বে এগিয়ে আসেন ধনঞ্জয়। পূর্বে শিবতরাইয়ের চরম দুর্দিনে, যুবরাজ বহুকাল বন্ধ থাকা নন্দীসংকটে পথ কেটে দেন। যাতে প্রজারা সেখানকার পশম বাইরে বিক্রি করতে পারে। এইভাবে যুবরাজ অভিজিৎ প্রজাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। এদিকে চন্দ্র পাল প্রজাদের উপরে চরম নির্যাতন শুরু করেন। ধনঞ্জয় ও অভিজিৎ কে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু ক্ষুব্ধ প্রজারা বন্দিশালা পুড়িয়ে উভয়কে উদ্ধার করেন। ভেঙে দেওয়া হয় মুক্তধারার বাঁধ। এখানেই বিজয়ী হন প্রজারা।
রক্তকরবী নাটকে রবীন্দ্রনাথের গভীর জীবনবোধ ও সমাজবোধের প্রতিফলন ঘটেছে।এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন মানুষের প্রবল লোভ কিভাবে জীবননের সমস্ত সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে নিছক যন্ত্রে ও উৎপাদনের উপকরণে পরিনত করেছে এবং তার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদ কি রূপ পায় তার ই রূপায়ন রক্তকরবী ।আর ও উল্লেখযোগ্য অধ্যাপক নন্দিনী কে বলেছিলেন "রক্তে তুমি কি লিখন লিখতে এসেছো"।
রবীন্দ্রনাথ বলতেন পরিমাণ পাওয়া যায় গণনায় কিন্তু মানুষের পরিমাণ পাওয়া যায় না ,পূর্ণতাতেই তার পরিমাণ। রবীন্দ্রনাথের মনে ছিল নারী পুরুষের সমান অধিকার,পাশাপাশি নারীর স্বাধিকার। কিন্তু শ্রেণীবিভক্ত সমাজে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রটি কবিগুরু এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি তার হৃদয়কে মুক্ত রেখেছেন।নিষ্ঠার সঙ্গে মত দিয়েছেন নারীমুক্তির। এর অনন্য উদাহরণ রাজা ও রানী নাটকে পাওয়া যায়। রানী সুমিত্রার প্রতি রাজার যে প্রেম যা তার রাজকার্য কে উপেক্ষা করছিল রানী সুমিত্রা তা বারেবারে রাজাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন-"মন দাও রাজকার্যে, বলেছিলেন
এ রাজ্যের
অনাথ আতুর যত তাড়িত খোদিত,
তারাই আমার আপনার। "
রানী সুমিত্রা তার
মধ্য দিয়েই প্রমাণ করেছেন তিনি মহীয়সী।
ধর্মের ভেদাভেদ নিয়েও কবিগুরুর স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল। "মানুষ মানুষের কাছাকাছি বাস করে তবুও কিছুতেই মনের মিল হয় না, কাজের যোগ থাকে না, প্রত্যেকপদে মারামারি ,কাটাকাটি বেঁধে যায়। এটা বর্বরতার লক্ষণ। রবীন্দ্রসাহিত্যে "গোরা" উপন্যাসে , "গোরা" চরিত্র রবীন্দ্রনাথের আত্ম প্রকৃতি। "গোরা" ঘোষণা করেছিল আমার মধ্যে হিন্দু- মুসলমান- খ্রিষ্টান কোন সমাজের কোন বিরোধ নেই। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ছিল, "কালান্তরে হিন্দু-মুসলমান মিলন বিষয়ে কবির হতাশা 'ধর্ম মতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয় , আচারে প্রবল । আচারে মুসলমানদের বাধা প্রবল নয়, ধর্ম মতে প্রবল '। কবিগুরু মিলনের পথ দেখিয়ে বলেছেন, যদি আমরা পাশাপাশি চলি, তাহলেই দেখতে পাব মানুষকে আপন বলে মনে করা সহজ।
বিচার-বিশ্লেষণ ও আলোচনার মাধ্যমে সহজেই বলা যায় রবীন্দ্রনাথের লেখনীর স্পর্শে এক প্রতিবাদী জীবনবোধ জেগে উঠতে বাধ্য। এ কথা বলা যায় কবিগুরুকে চেনা বা জানা এবং বোঝা অত সহজ নয়। এ এক মহা সমুদ্র। এই সমুদ্রের কিনারায় দাঁড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলতে পারি সমুদ্রের যেমন সীমারেখা নেই তেমন কবিগুরুর ও সীমারেখা নেই। তাই এই ব্যাপকতার মধ্যেও আমার লেখার
এক সীমারেখা রয়ে গেল।