২৫ শে বৈশাখ ১৪২৮ (৯ মে ২০২১)রবিবার...
১৯১৬ সালে আমেরিকায় সফররত রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে অনুপস্থিত তখন কারো উদ্যোগে হিন্দুমহাসভা একটি ম্যাজিকলণ্ঠন প্রদর্শনী করে। ‘আইটি সেলে’র বহু আগেই হিন্দুত্ববাদীদের প্রচারযন্ত্র কত তৎপর ছিল তার প্রমাণ, সেই প্রদর্শনীতে ফলাও করে হিন্দুদের ওপর মুসলিমদের অত্যাচারের অনেক নিদর্শন(?) দেখানোর পরে সরাসরি মুসলিমনিধনের আহ্বান জানানো হয়। উপস্থিত সুসংস্কৃত প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা শুধু যে কোনো প্রতিবাদ করেননি তাই নয়, দৃশ্যগুলির সত্যতা নিয়ে তাঁদের কোনো সংশয় ছিল না। জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ স্নেহের পাত্র কবি-লোকগবেষক জসিমউদ্দিন, যিনি তখন শান্তিনিকেতনে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন।
.
প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের বিশ্বাসের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনিও যে হেনস্থার শিকার হন তাও আমরা তাঁর কাছেই জানতে পারি। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকলে এধরনের একটি অনুষ্ঠানে তিনি কখনোই সম্মতি দিতেন না। প্রশ্ন হল, কবি কি জানতেন যে তাঁর আস্থাভাজন কাছের লোকেরা—যাঁরা নিঃসন্দেহে সুশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান্-- এত সহজে এমন সাম্প্রদায়িক প্রচারের বশীভূত হতে পারেন?
ঘটনাকালে আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে বক্তৃতাগুলি দিচ্ছিলেন। ভারতে জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গে তিনি আনেন সামাজিকস্তরে ‘দাসপ্রথা’র চোরাবালির ওপর রাজনৈতিক স্বাধীনতার হাওয়াই মিনার গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কথা। মনে রাখতে হবে এর বেশ ক’বছর আগেই তাঁর প্রবন্ধে আমরা পেয়ে গেছি ‘হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানটাতে কতবড়ো যে একটা কলুষ আছে’ সেই বিষয়। ‘বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাসে হিন্দু-মুসলমানে বসে না, ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়’। জাতীয়তাবাদের বক্তৃতায় জাতিভেদপ্রথার কথাই শুধু নয়, উঁচুতলার মানুষের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক জাতবিচারের প্রশ্নও কি তিনি তুলছেন না? একই প্রবন্ধে তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলিম বিবাদের দায় শুধু ইংরেজের নয়, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান থাকিতে হইবে’। তাঁর হাতে-গড়া শান্তিনিকেতনেও যে উচ্চস্তরেই এমন ছিদ্র আছে যেখান দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার শনি প্রবেশ করতে পারে তা তাঁর হয়তো অজানা ছিল না।
১৯২৬ সালে মুসোলিনি সম্বন্ধে তাঁর প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের আসল চেহারার খোলাখুলি সমালোচনা করতে গিয়ে আরো স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথ আনেন পেশিবল ও অর্থনৈতিক প্রতাপের সঙ্গে ধর্মকে যুক্ত করার ভয়াবহ বিপদের প্রসঙ্গ।
ভারতেও ধর্মীয় মেরুকরণের ফলে অমানবিক অন্ধশক্তির তাণ্ডব শুরু হচ্ছে এই সাবধানবাণী ইতালীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই আসে। ১৯৩০ সালে জায়নিজ্ম্ প্রসঙ্গে তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, প্যালেস্টাইনে প্রজাতন্ত্র তখনই সফল হবে যখন আরব ও ইহুদিরা যার যার ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে শান্তিতে একত্র থাকতে পারবে। তাঁর মননে গভীরভাবে সংযুক্ত এই বিষয়গুলি নিয়ে এই সময়কালে কবির চিন্তার গতিপথকে কি চিহ্নিত করার চেষ্টা করা যায়?
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও দখলদারির সঙ্গে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের এক গভীর সম্পর্ক তিনি দেখেছিলেন। ক্ষমতার একক ভরকেন্দ্র ঘিরে একটি দেশের বা জাতির সমস্ত মানুষকে সংগঠিত করার জঙ্গি পরিকল্পনাই ‘জাতীয়তাবাদ’।
এরই সুযোগ নিতে তিনি দেখেছিলেন ইউরোপের ফ্যাসিবাদকে। ‘একের অনলে বহুরে আহুতি’ দেবার স্বকীয় কাব্যিক উচ্চারণসত্ত্বেও তাঁর মনে এই আশঙ্কা ছিল যে পাশ্চাত্য জাতীয়তাবাদের দখলদারি আদল আকৃষ্ট করবে পরাধীন দেশের সেই শ্রেণিগুলিকে যারা বহু শতক ধরে সামাজিক ক্ষমতায় আসীন, ইংরেজ আমলেও যারা সুবিধাভোগী; তা বিপন্ন করবে আমাদের বহুত্বের দীর্ঘ ঐতিহ্যকে। শুধু ইংরেজের কারসাজিতে নয়, সমাজ-অভ্যন্তরের ‘কলুষে’র কারণেই ধর্মেরও একটি ভয়ংকর বিভাজনমূলক ভূমিকা যে সেখানে থাকা সম্ভব, তারও অনেক ইঙ্গিত বিশ শতকের কুড়ি ও ত্রিশের দশক জুড়ে কবি পেয়েছিলেন। তিনি দেখে যাননি ইউরোপে ফ্যাসিবাদের পরাজয় এবং সাম্রাজ্যবাদের অধীন দেশগুলির সার্বভৌমত্ব অর্জন, তিনি দেখে যাননি দেশভাগের ক্ষতে রক্তাক্ত স্বাধীন ভারতীয় প্রজাতন্ত্র, তিনি দেখে যাননি গদিয়ানদের বিরুদ্ধতা ও চক্রান্তের জাল ছিঁড়ে ভারতীয় জনগণ নিজেদেরই উপহার দিচ্ছে নিজস্ব এক সমতার সংবিধান। কিন্তু তাঁর এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না যে বিপদটা শুধু বাইরের নয়, গদিয়ানের ক্ষমতালিপ্সা আমাদের ভিতরের অন্ধকারকে উশকে দিতেই থাকে, তাকে ঘিরে ধর্ম ও জাতিবাদ মারাত্মক সম্মোহ সৃষ্টি করে, ফ্যাসিবাদের সৃষ্টিও তারই থেকে। সত্তর বছরের স্বাধীনতার উত্তরাধিকার সত্ত্বেও ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণ যখন দেশকে আবার সাম্রাজ্যবাদী অক্ষের অতলে আকর্ষণ করছে তখনও যুগান্তর থেকে কবির কণ্ঠস্বর স্বাধীন মহিমায় আমাদের এই অন্ধ আত্মসন্তুষ্টিকে কাঁপিয়ে দেয় যে আমাদের সংস্কৃতিই আমাদের রক্ষা করবে।