দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪২, কার কি ভুমিকা....
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক ঘটনাবলী নিয়ে একটা ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা হয়। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে কেন কমিউনিস্ট পার্টি অংশ নেয় নি, তাকে অনেক সময়েই ভুলভাবে আর এস এসের অংশ না নেবার সাথে তুলনা করা হয়। এই তুলনার কোন রকম ভিত্তিই নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই কমিউনিস্ট পার্টি দেশব্যাপী বিভিন্ন যায়গায় যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচী গ্রহণ করে। বরং এদেশে কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথম যুদ্ধবিরোধী কর্মসূচী নেয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের যুদ্ধবিরোধী বড় বড় সমাবেশ সংগঠিত হয়। ১৯৪০সালে বম্বেতে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে প্রায় ৯০ হাজার মানুষ অংশ নেন। সুভাষ বসু যুদ্ধবিরোধী এই বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন ঘোষনা করেন। কলকাতায় ছাত্রদের যুদ্ধবিরোধী মিছিলে অংশ নেন। ঢাকায় যুদ্ধবিরোধী সমাবেশে অংশ নেন জ্যোতি বসু। সমাবেশে অংশ নেবার পথে বিশিষ্ট লেখক সোমেন চন্দ খুন হন। এরকমের বহু ঘটনা।
ফ্যাসিষ্ট জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করল তখন যুদ্ধের চরিত্র বদলে গেল। ফ্যাসিষ্ট শক্তিকে পরাভ‚ত করতে পারাটাই তখন জরুরী। ফ্যাসিষ্ট শক্তিকে পরাভ‚ত করতে না পারলে দুনিয়ার গণতান্ত্রিক শক্তি বিপদে পড়বে। আবার ফ্যাসিষ্ট শক্তিকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে, সোভিয়েতের জয় যেমন সুনিশ্চিত হবে, তেমনই দুনিয়াব্যাপী স্বাধীনতার লড়াই, গণতন্ত্রের জয়ও বেগবান হবে। কমিন্টার্ন তখন সক্রিয়। যুদ্ধের আন্তর্জাতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করে দুনিয়ার কমিউনিষ্ট, মুক্তিকামী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করার জন্য আহ্বান জানালো। বিশ্বমানবতাকে রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাজিত করা জরুরি লাল ফৌজ অসামান্য লড়াই লড়ছে। দুনিয়ার মুক্তিকামী শক্তি ভরসা করছে তাকেই। বস্তুতপক্ষে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে দেশে দেশে ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভ‚ত হয়েছে। শুধু ভারতই না, একের পর এক দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ সত্য অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই।
যুদ্ধ শেষের সাথে সাথেই কমিউনিস্ট পার্টি বাড়তি গতি নিয়ে সংগঠিতভাবেই কৃষক এবং শ্রমিক সংগ্রামগুলিকে বিকশিত করেছে। একের পর এক সংগ্রামের ধাক্কায় বৃটিশ বাহিনীকে পরাভ‚ত করেছে। সে আলোচনা পরে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল কমিউনিস্টদের। বৃটিশ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিল।
এই প্রসঙ্গে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষ্যে সংসদের সেন্ট্রাল হলে ১৯৯২ সালে রাষ্টপতি শংকর দয়াল শর্মার বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বলছেন - ‘After large scale strines mills in Kanpur, Jamsedpur, Ahmedabad etc, a despatch from selhi date Sept 5, 1942, to the secretany of state in London, reported about the behaviour of Communist Party of India. The behaviourof many of CPI members proces what has always been clear, namely that it composed of anti British revolutionaries.’
আর এই সময়ে কি ছিল সঙ্ঘের ভুমিকা? নির্লজ্জভাবেই বৃটিশের তাবেদারি করে গেছে সঙ্ঘ। ১৯৩৯ সালের ৩রা অক্টোবর সাভারকার দেখা করলেন ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোর সাথে এবং বৃটিশের সাথে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। লিনলিথগো লন্ডনে চিঠি লিখে সে বিষয়ে জানালেন - 'The situation, (Savarkar) said, was that His majestys Government must now turn to the Hindus and work with their support…. But now that our interests were so closely bound together the essential thing was for Hindusim and Great Britain to be friends, and the old autagonism was no longer necessary.’
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গী বিষয়ে গোলওয়ালকার লিখছেন - ‘সংঘের দৈনন্দিন কাজকর্ম তখনও যথনিয়মে চলত। সংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল প্রত্যক্ষভাবে কিছু করা হবে না।' উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বরে ১৯৪২সালে বিক্ষোভস্থল থেকে পুলিশ আটক করে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে। গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য তিনি মুচলেকা দিলেন। বললেন, তিনি আন্দোলনে আদৌ যুক্ত নন। বেশ মজা হচ্ছে ভেবে পথের পাশে দাড়িয়ে দেখছিলেন কেবলমাত্র। বরং ধরিয়ে দিলেন ভারত ছাড়ো আন্দোলনের স্থানীয় দুজন নেতাকে। শিবকুমার এবং লীলাধর বাজপেয়ী। মুচলেকা দিয়ে পেলেন বাজপেয়ীজি। তিনি বলছেন ' Sangh is my soul'।
হিন্দু মহাসভার নেতা এবং তৎকালীন বাংলার ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ জোট সরকারের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪২ সালে আগষ্ট আন্দোলনের বিরোধীতা করে এই আন্দোলন গুড়িয়ে দেবার পরামর্শ দিয়ে চিঠি লিখলেন বাংলার গভর্নর জন হার্বাটকে। লিখলেন, “আন্দোলনের ফলে এই প্রদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে আমাকে এখন তার উল্লেখ করতে হবে। যুদ্ধের সময় যদি কেউ গণঅনুভবকে এমন ভাবে নাড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করে যাতে অভ্যন্তরীন বিশৃঙ্খলা বা নিরাপত্তাহীনতা ঘটতে পারে, তবে যে কোন সরকার, তার কার্যক্রমের মেয়াদ যদি স্বল্পকালীনও হোক, তবু সে অবশ্যই এই আন্দোলন প্রতিহত করবে।………. ইংল্যন্ডের প্রতি ভারতবর্ষের মনোভাবের প্রসঙ্গে বলা যায়, পরস্পরের মধ্যে যদি কোন লড়াইও থাকে, এই সন্ধিক্ষনে সেটা ঘটতে দেওয়া অনুচিত।” লিখছেন -“যে স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস এই আন্দোলন শুরু করেছে তা ইতিমধ্যেই জনগণের প্রতিনিধিত্ব পাঠানোর মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। জরুরী অবস্থার জন্য তা কিছু ক্ষেত্রে সঙ্কুচিত হতে পারে। ভারতীয়রা ব্রিটিশদের বিশ্বাস করেছে বৃটেনের জন্য নয়, বৃটেন যাতে কোনও সুবিধা পায় তার জন্যও নয়, কিন্তু প্রদেশের প্রতিরক্ষা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্যই।” সঙ্ঘের ভুমিকা বোঝার জন্য আর কোন তথ্যের কি প্রয়োজন হয়?
১৯৪৩ সালে হোম ডিপার্টমেন্ট অফিসিয়াল রিপোর্ট লিখছে – ‘আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে আর এস এস একটি বাধা - এই যুক্তি গ্রহণ করা কঠিন’। ৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলনের হিংসা বিষয়ে হোম ডিপার্টমেন্ট জানাচ্ছে -‘The Sangh
has scrupulosly kept itself within the law, and in particular has retrained from taking part in
the disturbance that book out in August.1942,’
চল্লিশের দশক , স্বাধীনতার উত্তুঙ্গ লড়াই
বস্তুতপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের পর ঔপনিবেশিক শক্তির জোয়াল থেকে একের পর এক দেশ মুক্ত হলো। গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার আকাংখা তীব্র হলো। আমাদের দেশেও এই সময়ে বৃটিশবিরোধী মনোভাব যেমন বাড়ছে, তেমনই ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে সংগ্রামের গতিধারা।
এই রকম সময়ে কৃষকদের বিরাট সংগ্রাম বিভিন্ন প্রদেশে। বাংলায় তেভাগা আন্দোলন। হায়দ্রাবাদে তেলেঙ্গানা আন্দোলন। ট্রাভাঙ্কোরে পুন্নাপ্পা - ভয়লার কৃষক সংগ্রাম। মহারাষ্ট্রের ওড়লি বিদ্রোহ। একের পর এক। সবগুলোর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি। বৃটিশ ভয় পেল। বুঝে গেল - বেশি দিন টিকে থাকতে পারব না।
১৯৪৫-৪৭ পর্বে শ্রমিকদের সংগ্রামও এই সময়ে বেগবান হচ্ছে। তীব্র শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৪৫ এর দ্বিতীয়ার্ধেই প্রায় ৮৫০টি ধর্মঘটে আট লক্ষাধিক শ্রমিক অংশ নেন। রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট। বম্বে, কানপুরে কাপড়ের কলের শ্রমিক ধর্মঘট। বিহারের কয়লা খনি এবং মহীশূরের সোনার খনিতে ধর্মঘট। কলকাতায় বন্দর শ্রমিকদের ধর্মঘট। এই সমস্ত শ্রমিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালো মধ্যবিত্ত - কর্মচারী অংশ। বৃটিশ প্রমাদ গুনল। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৪৬ এর ২৯শে জুলাই ডাক-তার কর্মীদের সর্বভারতীয় ধর্মঘট। সমর্থনে কলকাতায় সাধারণ ধর্মঘট। এর তাৎপর্য বিশাল। অভুতপূর্ব শ্রমিক ঐক্য। ৩১শে জুলাই বৃটিশ ক্যাবিনেট এই সমগ্র পরিস্থিতিকে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক পরিস্থিতির লক্ষণ বলে বর্ণনা করল। ভাইসরয় ওয়াভেল ভারত সচিবকে জানালেন - এই মুহূর্তে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা প্রয়োজন। নচেৎ কমিউনিস্টদের এবং কংগ্রেসের মধ্যকার বামপন্থী শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।
বৃটিশ সরকার ইতিমধ্যেই মানুষের মনোভাব এবং সংগ্রামের আঁচ বুঝতে পারছে। কৃষক-শ্রমিক সংগ্রামের পাশাপাশি উত্তাল ছাত্র-যুব সহ সর্বাংশের মানুষ। বৃটিশ সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের বিচারের ব্যবস্থা করল। শাহনওয়াজ খান, প্রেম সায়গল আর গুরুবক্স সিং ধীলন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল রাস্তায়। মুক্তি দিতে বাধ্য হল বৃটিশ সরকার। ৪৬'এর ফেব্রুয়ারী, আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন আব্দুর রশিদকে সাত বছরের কারাদন্ড দিল। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল মানুষের। আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির দাবীতে উত্তাল গণসংগ্রাম। ১২ই ফেব্রুয়ারী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক ধর্মঘট কলকাতা ও শিল্পাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। ৪৬’এর নৌবিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা বৃটিশের পতাকা নামিয়ে দিল। উড়িয়ে দিল কংগ্রেস-কমিউনিস্ট-মুসলিম লীগের পতাকা। গঠিত হল ষ্ট্রাইক কমিটি। ২১শে ফেব্রুয়ারী ষ্ট্রাইক কমিটি আহ্বান জানালো কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, মুসলিম লীগকে। পাশে দাঁড়ালো কমিউনিস্টরা। বম্বে শহরে ষ্ট্রাইক ডাকল। সমর্থন করল কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দলও। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিরোধীতা সত্ত্বেও সফল।
লড়াই সংগ্রামের এই উত্তুঙ্গ অবস্থানের উপর দাঁড়িয়েই শেষমেশ ভারতের স্বাধীনতা। আর এই সংগ্রামে সবচেয়ে গৌরবময় ভুমিকা মানুষের। মানুষের আন্দোলনে নেতৃত্বের উজ্জ্বলতম ভুমিকায় কমিউনিস্ট পার্টি। স্বাধীনতার লড়াইতে গৌরবজনক ভুমিকা। দেশপ্রেমের নজির তো বটেই।
কিন্তু কি ছিল এই সময় আর এস এস অথবা হিন্দু মহাসভার ভুমিকা? গণসংগ্রামের কোন স্তরে, কোথাও কি এরা আছে? অবশ্যই না। চল্লিশের দশকের আন্দোলন থেকে দূরে থাকাই শুধুমাত্র নয়, সাভারকর অথবা হিন্দু মহাসভার লক্ষ্য ছিল
গভীরতর। বৃটিশ প্রশাসনের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আসলে ভবিষ্যতে হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়েই তারা কার্যকলাপ চালিয়েছে। ১৯৩৯ সালে বড়লাট লিনলিথগোর চিঠি লিখলেন বৃটিশ স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে সাভারকরের জবানিতে - ‘সাভারকর আরও বলেন যে, হিন্দু মহাসভা যুদ্ধ শেষে ডমিনিয়ন মর্যাদা মেনে নিতে দ্ব্যর্থহীনভাবে রাজি।’
বস্তুতপক্ষে, আর এস এস বা হিন্দু মহাসভায় বৃটিশ বিরোধী কোন প্রস্তাব কখনও প্রকাশিত ছিল না। বৃটিশের কাছ থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য তাদের ছিল না। বরং তারা বৃটিশ রাজের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক বজায় রেখে সুবিধা আদায় করতে চেয়েছে। বৃটিশ বিরোধীতাকে এরা বেঠিক এবং প্রতিক্রিয়াশীল কাজ বলে চিহ্নিত করেছে।
গোলওয়ালকার বলছেন - ‘ Hindus, dont waste your energy fighting the British, save your energy
to fight our internal enemies that are Muslims, Christians and Comunists.’
সম্পূর্ণ লেখাটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত...
আগামী অন্তিম পর্ব