ব্রিটিশের ‘গ্রেটেস্ট ডেঞ্জার’ এবং ‘অনুতপ্ত’ সন্তানরা - চন্দন দাস

আগস্ট ১৫ ,২০২০ শনিবার কমিউনিজম কী? ‘গ্রেভেস্ট ডেঞ্জার টু দ্য সিভিলাইজেশন অফ দ্য মর্ডার্ন ওয়ার্ল্ড।’ বইটির ভূমিকায় এই উত্তরটি লেখা হয়েছিল। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৩৩। দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৩৫-এ। লেখকের নাম — এইচ উইলিয়ামসন। কে তিনি? সেই সময়ে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর। অর্থাৎ তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোয়েন্দা প্রধান। তার লেখা সেই বইটির নাম — ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড কমিউনিজম।’ কেন এক গোয়েন্দা প্রধানকে এই দীর্ঘ, বিস্তর নথীপূর্ণ বইটি লিখতে হয়েছিল? উইলিয়ামসন তারও জবাব দিয়েছেন। তার উপলব্ধি — শুধু আইন জারি করে, জেলে ভরে, বেআইনী ঘোষণা করে কমিউনিস্টদের আটকানো যাবে না। যাদের মোকাবিলা করতে হবে কমিউনিস্টদের, সেই আমলা, প্রশাসকদের জানতে হবে ভারতে কমিউনিস্টরা কি করে, কি ভাবে কাজ করে, কেন করে। তাই একটি আস্ত বইয়ের প্রকাশ। প্রথমে তা ছিল ‘কনফিডেন্সিয়াল।’ পরে তা, প্রয়োজন বুঝে ব্রিটিশ শাসনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
গান্ধীজি এবং চিত্তরঞ্জন দাস
কারন — ব্রিটিশ বুঝেছিল কমিউনিস্টরাই তাদের শাসনের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক। বুঝবে নাই কেন? ভারতে প্রথমবার পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন কমিউনিস্টরা। ১৯২৫-এ। তারপর লাগাতার তারা কংগ্রেসের অধিবেসনে এই প্রস্তাব তুলেছে। বারবার নাকচ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯২৯-এ তা গ্রহণ করতে বাধ্য হয় কংগ্রেস। কোথায়? লাহোর অধিবেসনে। কেন? কারন — কমিউনিস্টদের দাবি ততদিনে মানুষের সোচ্চার স্বপ্নে পরিণত হয়েছে — ‘চাই পূর্ণ স্বাধীনতা — ছিন কে লেঙ্গে আজাদি।’
পূর্ন স্বরাজের দাবি ১৯২৫
  ১৯২০-তে তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। আর ১৯২৪-র মধ্যে চারটি ‘ষড়যন্ত্র মামলা’ জারি করে ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। পূর্ণ স্বরাজের দাবির কথা গান্ধী থেকে চিত্তরঞ্জন দাশ — সেই সময় ভাবতেই পারেননি। জিন্না অথবা সাভারকার, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের প্রশ্নই ওঠেনা। কারন ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ, দেশ, মানুষকে বিচার করার কৌশলী এই দুই শক্তির কাছে স্বাধীনতার প্রাক শর্ত ছিল বাটোয়ারা — কাঁটাতার। মানে — দেশের মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে বেইমানি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম আসলে এক গণ আন্দোলন — তা গান্ধীর নেতৃত্বে কিছুটা প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেই সংগ্রাম ধারাবাহিক, তাতে নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে শ্রমিক এবং কৃষকদের — তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। উদাহরণ? একের পর ধর্মঘট, কৃষক সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন কমিউনিস্টরা। যার প্রতিটিই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ, অনুঘটক। পরাধীন ভারতে দীর্ঘতম, ছ’ মাসের ধর্মঘট বাউরিয়া মিলে। সংগঠক কারা? সেই কমিউনিস্টরা। ফলে পরাধীন ভারতে কমিউনিস্টদের প্রতি আকর্ষণ ক্রমাগত বাড়ছিল সংগ্রামী মানুষের। ‘ইন্ডিয়া ইন কমিউনিজম’-এ গোয়েন্দা প্রধান জানাচ্ছেন, ‘সন্ত্রাসবাদী’দের অনেকে কমিউনিজমে আকৃষ্ট হচ্ছেন। আর অগ্নিপুরুষ সতীশ পাকড়াশি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন — ‘‘নব বিপ্লব-আদর্শের প্রেরণা আমাকে সামনের দিকে ডাকে। শেষ অবধি কমিউনিস্ট পার্টির জয় হলো। গণ-বিপ্লবের মহান আদর্শের অনুপ্রেরণায় ভারতের লাঞ্ছিত গণ-মানবের মুক্তি-সাধনায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকেই বেছে নিলাম আমি। একমাত্র কমিউনিস্ট পার্টির বিপ্লব-প্রচেষ্টাই ভারতের চল্লিশ কোটি নরনারীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে — এই বিশ্বাস দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হওয়ার পর আমি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম।’’ তিনি একা নন। তিনি ব্যতিক্রম নন। গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্তর মত অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী বেছে নিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টিকে।
কল্পনা দত্ত
তাই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সামনে ‘সবচেয়ে বড় বিপদ’ ছিলেন কমিউনিস্টরাই। প্রমাণ? একটি পোষ্টারের গল্প। ১৯২৯-র গোড়ার দিক। এক উজ্বল সকালের কলকাতা দেখলো পোষ্টারে লেখা — ‘লং লিভ রেভেলিউশন।’ ভারতের রাজনীতিতে পোস্টারের অবয়বে ওই স্লোগানের প্রথম প্রকাশ সেইদিন। সেদিন সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে কলকাতায় মহামিছিল। স্টেটসম্যান পত্রিকা লিখলো লক্ষাধিক মানুষ ছিলেন মিছিলে — পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ছিলেন শ্রমিকরা। মিছিলে কংগ্রেসের সমর্থক, কর্মীরা ছিলেন। ছিলেন জাহাজের শ্রমিকরা। কলের মজুররা। ট্রেড ইউনিয়নগুলিও ছিল। সেই মিছিলে স্লোগান উঠলো — ‘কমিশন নয়/ পূর্ণ স্বাধীনতা চাই।’ ‘সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’ ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ।’ সেই মিছিলেই ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’-র ইংরাজি তর্জমার প্রথম এবং প্রবল উপস্থিতির সাক্ষী হলো দেশ। পোস্টার বানিয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। বয়েছিলেন কমিউনিস্টরা। তুলে ধরেছিলেন কমিউনিস্টরা।
গণেশ ঘোষ
মাস খানেকের মধ্যে আঘাত হানলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ১৯২৯-র ১৯ মার্চ রাত ৩টের সময় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলো। ২০ মার্চ ভোর থেকে শুরু হলো গ্রেপ্তার। ‘মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ হয়ে উঠলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দমননীতি এবং কমিউনিস্টদের দেশপ্রেমিক চরিত্রের ঐতিহাসিক প্রমাণ।  
Portrait of 25 of the Meerut Prisoners taken outside the jail. Back row (left to right): K. N. Sehgal, S. S. Josh, H. L. Hutchinson, Shaukat Usmani, B. F. Bradley, A. Prasad, P. Spratt, G. Adhikari. Middle Row: Radharaman Mitra, Gopen Chakravarti, Kishori Lal Ghosh, L. R. Kadam, D. R. Thengdi, Goura Shanker, S. Bannerjee, K. N. Joglekar, P. C. Joshi, Muzaffar Ahmed. Front Row: M. G. Desai, D. Goswami, R.S. Nimbkar, S.S. Mirajkar, S.A. Dange, S.V. Ghate, Gopal Basak.
  একদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা গ্রেপ্তার করলো কমিউনিস্টদের। তার আগে পুনে, বোম্বাই, বেঙ্গল, বার্মার মত প্রভিন্সগুলির শাসকদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে এত বড় মামলার বিষয়ে মতামত চেয়ে নিয়েছিল বড়লাট। অনুমোদন মিলেছিল লন্ডন থেকেও। পৃথিবীর ইতিহাসে দীর্ঘতম এবং বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় বিচার ছিল এই মামলা। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন মুজফফর আহমেদ, ধরনী গোস্বামী, শামসুল হুদা, শিবনাথ ব্যানার্জি, এসএন ঠাকুর, ফিলিপ স্প্রাট, বিএফ ব্র্যাডলি, এসএ ডাঙ্গে, পিসি যোশী প্রমুখ। অভিযোগ কী? ব্রিটিশ শাসকদের উৎখাতের চেষ্টা। জিন্না, শ্যামাপ্রসাদ এবং স্বাধীনতা... ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকদের মহান বানানোর সচেতন উদ্যোগ আছে। দুর্বল, দোদুল্যমান এলিটদের দুর্দান্ত হিসাবে তুলে ধরার নিরন্তর প্রয়াসও আছে। কারন — ইতিহাস যে গড়ে আর ইতিহাস যারা লেখে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অভিন্ন নয়। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে মুক্তির সংগ্রামে রূপান্তরিত করার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের বিবরণ ইতিহাসবিদরা দেননি। এও এক সচেতন অবহেলা।
সতীশ পাকরাশি
  কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও কিছু নিদারুণ চক্রান্ত আড়াল করা যায়নি। যেমন গান্ধী-জিন্নার চিঠি। গান্ধী বারবার জিন্নাকে একই প্রশ্নে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিলেন। জিন্না আইনজীবী। বুদ্ধিমান। তিনি কিছুতেই প্রসঙ্গটির ব্যাখ্যায় যাচ্ছিলেন না। শুধু গোঁ ধরে থাকা যুক্তিহীনের মত লিখে যাচ্ছিলেন — ‘মুসলমানরা একটি জাতি।’ ১৯৪৪। সেপ্টেম্বর। সেই সময়কার ইতিহাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ‘স্বাধীনতা লাভের’ উপায় অন্বেষণে শাসকদের বিবাদমানতার বিবরণ। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী-মুহাম্মদ আলি জিন্নার চিঠিতে তার কিছু প্রকাশ আছে। ১৯৪৪-র ১৫ই সেপ্টেম্বর গান্ধী লিখলেন,‘‘...আমাদের আলোচনার ভিতর আপনি ঐকান্তিকভাবে বলিয়াছেন যে, ভারতে হিন্দু ও মুসলমান এই দুইটি জাতি আছে। ভারতে মুসলমানদের নিজ বাসভূমি আছে, যেমন আছে হিন্দুদের। যতই আমাদের আলোচনা চলিতেছে, ততই আপনার চিত্র আমার নিকট আশঙ্কাজনক হইয়া উঠিতেছে। ইহা সত্য হইলে লোভনীয় হইত। কিন্তু আমার ভয় হইতেছে, ইহা সম্পূর্ণ অবাস্তব।’’ জিন্না জবাবে বললেন,‘‘আমরা মনে করি ও বিশ্বাস করি যে, জাতির যে কোন সংজ্ঞায় ও পরীক্ষায় দেখা যাইবে এ হিন্দু ও মুসলমান দুইটি প্রধান জাতি। আমরা ১০ কোটি মানুষের একটি জাতি।’’ মুসলিম লীগ প্রস্তাবিত পাকিস্তান সম্পর্কে আলোচনায় গান্ধী লিখলেন,‘‘ভারতীয় মুসলমানের সঙ্গে অন্য ভারতবাসীর ধর্ম ব্যতীত আর কী পার্থক্য আছে? তুর্কি বা আরব হইতে সে কি আলাদা?’’ জিন্না জবাব দিলেন,‘‘আমি আগেই ইহার উত্তর দিয়াছি যে, ভারতের মুসলমানরা একটি জাতি।’’ আশ্চর্য! জিন্নার এই বক্তব্যের সঙ্গে নিদারুণ সাদৃশ্য আর একজনের বক্তব্যের। নাম — দামোদর বিনায়ক সাভারকার। ভারতে ‘হিন্দুত্বের’ ধারনার উদ্গাতা তিনি। গান্ধী-হত্যার ন’ জন অভিযুক্তের অষ্টম ব্যক্তি। ১৯৩৭-এ হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেসনে সাভারকার সভাপতির ভাষণে বললেন, ‘‘আমাদের অপ্রীতিকর সত্যর মুখোমুখি হতে হবে সাহসিকতার সঙ্গে। কারন এই সত্য অপ্রীতিকরই। আজ ভারত কিছুতেই একটি একইরকম এবং সমগোত্রীয় রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হতে পারে না। বরং উল্টো। এখানে, এই ভারতে এখন প্রধানত দুটি রাষ্ট্র: হিন্দুদের এবং মুসলিমদের।’’ পরের বছর নাগপুর অধিবেসনে আরও স্পষ্ট হলো তাঁর ঘৃণার ধারনা —‘‘হ্যাঁ, আমরা হিন্দুরা নিজেরা একটি জাতি। কারন, ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহাসিক ঘনিষ্ট সম্পর্কগুলি আমাদের সুদৃঢ়ভাবে একটি সমপ্রকৃতির রাষ্ট্রে বেঁধেছে...। আমরা একটি জাতি...আমরা ভারতে একটি জাতি — হিন্দুস্তানে, এবং মুসলিমরা সংখ্যালঘু, একটি গোষ্ঠী।’’ কী তফাৎ আছে তবে জিন্না আর সাভারকারে? মুসলিম লীগ আর হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে? মৌলিক প্রভেদ কিছু নেই। বরং বিভিন্ন সময় আইনসভায় তারা হাতে হাত মিলিয়েই কাজ করেছেন।
জিন্না এবং গান্ধীজি
এই প্রশ্নে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এক চিত্তাকর্ষক উদাহরণ। ১৯৩৬। সে’ বছর ২১ আগস্ট কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলে একটি সভা হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তিনি আমন্ত্রণ জানান মহম্মদ আলি জিন্নাকে। ছাত্রদের সমাবেশে জিন্না বলবেন, এই ছিল শ্যামাপ্রসাদের আকাঙ্খা। জিন্না বললেনও। কিন্তু তার আগে জিন্নাকে সভাপতি হিসাবে বরণ করলেন উপাচার্য মুখার্জি। এবং স্বাগত ভাষণে জিন্নার পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘একজন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী...নিজেদের গড়ে তোলা লক্ষ্যপূরণের জন্য যাঁরা দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করতে জানেন, তেমনই একজন সংগ্রামী।’’ অভূতপূর্ব। অসাধারণ! জিন্নার সঙ্গে মুখার্জির আবার দেখা হয় মুম্বাইতে, তৎকালীন বোম্বেতে, জিন্নার বাসভবনে। তিন ঘন্টা নিবিড় আলোচনা হয় তাদের। ততদিনে জিন্না পাকিস্তানের পতাকা প্রকাশ করে ফেলেছেন। এই সঙ্ঘঘোষিত ‘ভারতকেশরী’ ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলার মন্ত্রীসভায় যোগ দেন ১৯৪১-এ। আর ১৯৪০-র ২৩ মার্চ মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেসনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ উত্থাপিত হয়। উত্থাপন করেন কে? সেই ফজলুল হক। সেই প্রস্তাব পেশের পর ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা থেকে শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু পদত্যাগ করেননি। পরবর্তীকালে ক্লেদাক্ত দেশভাগের পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন ফজলুল হক। বোঝাপড়া শুধু দু’ পক্ষেরই নয়। আর এক পক্ষ বাকি। তারা ব্রিটিশ। ভারত ছাড়ো আন্দোলন ‘মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে’ — এই ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একান্ত ইচ্ছা। তার জন্য তিনি চিঠি লিখলেন জন হার্বার্টকে। হার্বার্ট ছিলেন বাংলার গভর্নর। ১৯৪২-র ৮ আগস্ট ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা। আর ২৬ জুলাই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি গভর্নরকে চিঠিতে লিখলেন,‘‘এটি ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ এবং ভারতে তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদিত যে, এখনও পর্যন্ত ব্রিটেন এবং ভারত যে ভাবে এগিয়েছে তাতে ভারতের স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। তাই, আগের মত তাদের সাথে আমাদের অতীতের সম্পর্কের কোনও ঝগড়া নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলায় এই ধরনের আন্দোলনকে কিভাবে মোকাবিলা করা যায়? প্রশাসনকে এমনভাবেই পরিচালিত করতে হবে যাতে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ পরেও রাজ্যে এই আন্দোলন কোনও শিকড় ছড়াতে ব্যর্থ হয়। আমাদের পক্ষে, বিশেষত দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের পক্ষে মানুষকে বোঝানো সম্ভব, যে স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেস এই আন্দোলন করছে, জনগনের প্রতিনিধিরা তার ইতিমধ্যেই অধিকারী হয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে জরুরি অবস্থার জন্য এটি(স্বাধীনতা) কিছুটা সীমাবদ্ধ। ভারতীয়দের ব্রিটিশকে বিশ্বাস করতে হবে...।’’
সভারকার

চিঠিটিই বলে দিচ্ছে শুধু একটি আন্দোলনের প্রতি নয়, ভারতীয় জনগনের প্রতি, শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি বেইমানি করছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। সাভারকারের অনুগত ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। ১৯৩৯-এ সাভারকার কলকাতায় আসেন। শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। ১৯৪৩-এ হিন্দু মহাসভার সভাপতি হন সাভারকারের পরে। সেই তিনিই গান্ধী-হত্যার তদন্তের বিষয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেলকে শ্যামাপ্রসাদ চিঠি লেখেন ১৯৪৮-র ৪ঠা মে। কারন? গান্ধী-হত্যার চক্রান্তে সাভারকারকে যাতে রেহাই দেওয়া হয়, এই ছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্য মুখার্জির চিঠির মোদ্দা কথা। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে বারবার হাঁটু মুড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করা হিন্দুত্ববাদের একটি বৈশিষ্ট্য। সাভারকার তার গুরুতর উদাহরণ। ১৯১১-র ৪ জুলাই বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে নিয়ে যাওয়া হয় আন্দামানে। একবছর কাটতে না কটতেই তিনি প্রথম মুচলেকাটি পাঠান শাসকদের কাছে। দ্বিতীয় ক্ষমা প্রার্থনাটি তিনি জমা দেন ১৯১৩-র ১৪ নভেম্বর। গভর্নর জেলারেলের কার্যনির্বাহী পরিষদের হোম মেম্বার রেগিনাল্ড দ্রাভকের উদ্দেশ্যে লেখা চিঠিতে সাভারকারকে বলতে শোনা যাচ্ছে,‘‘সরকার যেমনভাবে চাইবেন ঠিক সেই শক্তিতে তাদের হয়ে কাজ করবো। যেহেতু এ আমার বিবেকের উচ্চারণ সেই কারনে আমার ভবিষ্যৎ আচরণও তেমনি হবে আশা রাখি। আমাকে জেলে রাখলে আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছুই পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে অন্য ক্ষেত্রে হয়তো কিছু হতে পারে। পরমশক্তিধরের পক্ষেই সদয়তার মহত্ব দেখানো সম্ভব। কাজেই অনুতপ্ত পুত্র তার পিতৃমাতৃসদৃশ সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরতে পারে?’’ সাম্রাজ্যবাদ হলো ‘পরমশক্তিধর’, ‘পিতৃমাতৃসদৃশ।’ ব্রিটিশ অত্যাচারী শাসকের কাছে ‘সদয়তার মহত্ব’ প্রত্যাশা করলেন ‘অনুতপ্ত পুত্র’। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বীরের কী ভয়ঙ্কর অবদান — তা এই থেকে অনেকটা স্পষ্ট হয়। কিন্তু তাৎপর্যবাহী হলো — ‘আমাকে জেলে রাখলে আমার কাছ থেকে বিশেষ কিছুই পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে অন্য ক্ষেত্রে হয়তো কিছু হতে পারে’ — এই দুটি বাক্য। ব্রিটিশকে কী পাইয়ে দিতে চাইছিলেন সাভারকার? সাভারকারকে আন্দামান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় প্রথমে রত্নগিরি জেলে। তারপর সেখান থেকে পুনের ইয়েরাভাড়া জেলে। বোম্বের গভর্নর জেনারেল জর্জ লয়েড তাঁর কাউন্সিলরদের নিয়ে এই জেলে সাভারকারের সাক্ষাৎকার নেন। সাভারকার নিজেকে যথেষ্ট বাধ্য প্রমাণ করেন। পাঁচ বছর কোনও রাজনৈতিক কাজে থাকবেন না — এমন শর্তে সই করে ১৯২৪-র ৬ জানুয়ারি জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর তার সঙ্গে শিরগাঁও গ্রামে দেখা করতে যান কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। তাদের দীর্ঘ আলোচনা হয়। ততদিনে সাভারকারের ‘হিন্দুত্বের’ ধারনা প্রকাশিত। সাভারকার-হেডগেওয়ারের আলোচনার বিষয় বিশদে জানা যায় না। কিন্তু হিন্দু মহাসভা থাকতেও, সেই ১৯২৫-র বিজয়াদশমীর দিন জন্ম হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের(আরএসএস)-র। প্রথম সরসঙ্ঘচালক সেই হেডগেওয়ার।
শ্যামাপ্রাসাদ

আরএসএস পূর্ণ স্বরাজ দাবি করেনি কখনও। বরং তারা বরাবর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুগত। ১৯৪২-এ বাংলার দুর্ভিক্ষের কারনে যখন ব্রিটিশের নীতি প্রবল সমালোচনার মুখে সরসঙ্ঘচালক মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তারা শক্তিশালী ব্রিটিশের নীতির সমালোচনার পক্ষে নন। কারন ‘বড় মাছ ছোট মাছকে খাবেই। বড় মাছের সমালোচনার অর্থ কী?’’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে ‘সুপুত্র’ ছিল হিন্দুত্ববাদ। আর ‘বৃহত্তম বিপদ’? কমিউনিস্টরা।
শেয়ার করুন

উত্তর দিন