সুপ্রতীপ রায়
৯ মে সারা বিশ্ব ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয় দিবস হিসাবে পালন করে। ১৯৪৫ সালে এই দিনে মিত্র শক্তি ও কমিউনিস্ট সোভিয়েত সেনা বাহিনীর প্রধানদের কাছে আত্মসমর্পণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল হিটলার বাহিনী। এবছরের আজকের দিনটি বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন- ২৫ বৈশাখ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
২০২৫ সালের ৯মে ফ্যসিবাদের পরাজয়ের ৮০ তম বার্ষিকী পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন নয়া ফ্যাসিবাদ বিপদ রূপে দেখা দিয়েছে। ভারতও চরম বিপদের মধ্যে। নয়া ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে গ্রামশি চর্চা বারবার আমাদের করতে হবে।
আজকের আমরা স্মরন করছি সোভিয়েত লালফৌজের বীরত্বপূর্ণ লড়াই আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। মস্কোতে জনগণের প্রতি জে ভি স্তালিন ভাষণে বলেছিলেন:- ‘কমরেডগণ! দেশের সাধারণ মানুষ ও নারী সমাজ! জার্মানির বিরুদ্ধে মহান বিজয়ের দিন সমাসন্ন। লাল ফৌজ ও মিত্র বাহিনীগুলির কাছে নতজানু ফ্যাসিস্ত জার্মানি পরাজয় বরণ করেছে এবং বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেছে।
৭ মে প্রাথমিকভাবে রাইমস-এ আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ৮ মে বার্লিনে সোভিয়েত বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ড ও মিত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ড ও মিত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডের প্রতিনিধিরা চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণে স্বাক্ষর করেছে। ওইদিন রাত ১২ টা থেকে তা কার্যকর হয়েছে।
যারা চুক্তি ও শর্তগুলিকে ছেঁড়া কাগজের মতো মনে করে, জার্মান শাসককুলের সেই ধূর্ত শ্বাপদসুলভ স্বভাব স্মরণে রেখে তাদের দেওয়া কথা আন্তরিকভাবে মেনে নেওয়ার কোন ভিত্তি নেই। এতদসত্ত্বেও আজ সকালে জার্মানবাহিনী তাদের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের বাহিনীগুলির কাছে দলে দলে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। এটা আর ছেঁড়া কাগজ নয়। এটি জার্মান সশস্ত্রবাহিনীগুলির বাস্তব চুক্তিই।
এটা সত্য যে, চেক অঞ্চলের জার্মান বাহিনীর একটি দল এখনও পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করে চলেছে। কিন্তু আমি আশা রাখি, লালফৌজ তাদের কান্ডঞ্জান ফিরিয়ে আনতে সফল হবে।
জার্মানির ঐতিহাসিক পরাজয়ের দিন, জার্মান সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আমাদের জনগণের মহান বিজয়ের ক্ষণে উপনীত হয়েছি – এই কথা বলার মতো পরিপূর্ণ ক্ষেত্র প্রস্তুত।
আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য আমাদের আত্মত্যাগ মহান। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের জনগন অপরিমিত ক্ষয়-ক্ষতি ও দু:খকষ্ট সহ্য করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ও পশ্চাৎভূমিতে আমাদের মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে নিয়োজিত আমাদের কঠিন পরিশ্রম বৃথা যায়নি- শত্রুর বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ বিজয়ে ভূষিত হয়েছে। স্লাভ জনগণের অস্তিত্ব রক্ষা ও স্বাধীনতার যুগ-ব্যাপী সংগ্রাম জার্মান অত্যাচার ও আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে।
এখন থেকে জনগণের স্বাধীনতা ও জাতিতে জাতিতে শান্তির মহান পতাকা ইউরোপের আকাশে উড্ডীন হবে।
তিন বছর আগে হিটলার প্রকাশ্যে বলেছিল যে, তার লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ছিন্নভিন্ন করা এবং ককেশাস, ইউক্রেন, বাইলোরুশিয়া, বাল্টিক ও অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা।
হিটলার পরিস্কারভাবে বলেছিল: ‘আমরা রাশিয়াকে এমনভাবে ধ্বংস করব যাতে রাশিয়া কোনদিন মাথা তুলতে না পারে।’ এই ছিল তিন বছর আগের অবস্থা। কিন্তু হিটলারের নির্বোধ ধারণাগুলি অবাস্তবই থেকে গেল। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ধুলোর মতো ছত্রভঙ্গ চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।
প্রকৃতপক্ষে হিটলার-শাহী অপ্রকৃতিস্থ প্রলাপের মধ্যে যেমন স্বপ্ন দেখতো এ হলো ঠিক তার বিপরীত। জার্মানি সম্পূর্নভাবে পরাস্ত হয়েছে। জার্মানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিজয়ী হয়েছে, যদিও জার্মানিকে ছিন্নভিন্ন করা অথবা ধ্বংস করার কোন বাসনাই আমাদের নেই।
কমরেডগণ! আমাদের মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ যুদ্ধ পরিপূর্ণ বিজয়ের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধের দিন শেষ। শুরু হয়েছে শান্তিপূর্ণ অগ্রগতির যুগ।
আমার প্রিয় স্বদেশবাসী নারী ও পুরুষগণ, আমাদের বিজয় অর্জনে আপনাদের অভিনন্দন জানাই।
আমাদের দেশের স্বাধীনতার পতাকা উর্ধে তুলে ধরছে বীরত্বপূর্ণ লালফৌজ। শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনকারী সেই লালফৌজের গরিমা ভাস্বর হোক্।
আমাদের মহান জনগন, বিজয়ী জনগণের গরিমা ভাস্বর হোক্।
চিরভাস্বর হোক্ বীরদের গরিমা- যাঁরা শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন- যাঁরা আত্মদান করেছেন স্বদেশবাসীর স্বাধীনতা ও সুখের জন্য।
মস্কো ৯ মে, ১৯৪৫
নাৎসিদের নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী শুনলে গা শিউরে ওঠে। অসংখ্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক রেখে নির্মম অত্যাচার চালানো হয়েছিল ইহুদি, সোস্যাল ডেমোক্র্যাট এবং কমিউনিস্টদের। গ্যাস চেম্বারে ফেলে মারা হতো। আউসভিত্জ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ৬০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। যুদ্ধে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ার। সোভিয়েত ইউনিয়নের দু’কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল ফ্যাসিষ্টরা।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে করিগুরু শানিত প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ফ্যাসিবাদী পরিণতি সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন- সভ্যতার এই ভিত্তিবদলের প্রয়াস দেখেছিলুম রাশিয়ায় গিয়ে। মনে হয়েছিল নরমাংসজীবী রাষ্ট্রতন্ত্রের রুচির পরিবর্তন যদি এরা ঘটাতে পারে তবেই আমরা বাঁচবো নইলে চোখরাভানীর ভান করে অথবা দয়ার দোহাই পেড়ে দুর্বল কখনোই মুক্তিলাভ করবে না। নানা ত্রুটি সত্ত্বেও মানবের নবযুগের রূপ ঐ তপোভূমিতে দেখে আমি আনন্দিত ও আশান্বিত হয়েছিলুম। মানুষের ইতিহাসে আর কোথাও আনন্দ ও আশার স্থায়ী কারণ দেখিনি।….
‘চিঠিপত্র’, একাদশ খন্ড, ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দ
২৮ জুলাই ১৯৩৬ সালে আরও একটি চিঠিতে তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখেন: যেমন হয়েছে জার্মানীতে, ইটালিতে, তেমনটা ঘটাতে হাত নিশপিশ করেছে ইংলন্ডের নবদস্তোদগত ফ্যাসিস্টদের। বলা যায় না কালক্রমে ইংলন্ডে যদি এই ফ্যাসিস্টদের রাস্তাই প্রশস্ত হয়, তা হ’লে আন্দামানে লোক-বিরলতা ঘটবে না।….সোভিয়েট রাশিয়ার নাম করা এদেশে অপরাধ বিশেষ। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে না করেও থাকতে পারিনে।….সেখানে সোভিয়েত য়ুরোপ এবং সোভিয়েত এশিয়ার মাঝখানে কোনো অসম্মান নেই।
‘চিঠিপত্র’, একাদশ খন্ড
স্পেনে ফ্যাসিবাদী প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লীগ’ এর সভাপতি রবীন্দ্রনাথ আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন: স্পেনে আজ বিশ্বসভ্যতা আক্রান্ত ও পদদলিত। স্পেনের জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়েছে। অর্থ ও জনবল দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্য করছে আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ।……
শিল্প-সংস্কৃতির গৌরবকেন্দ্র মাদ্রিদ আজ জ্বলছে। বিদ্রোহীদের বোমার ঘায়ে তার অমূল্য শিল্পসম্পদ বিধ্বস্ত। এমন কি হাসপাতাল ও শিশুসদনগুলিও রেহাই পাচ্ছে না। নারী ও শিশুদের হত্যা,গৃহহীন ও ভিক্ষুক করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের এই সর্বনাশা প্লাবন রোধ করতেই হবে। স্পেনে কুসংস্কার, জাতিবিদ্বেষ, বর্বর লুন্ঠনবৃত্তি এবং যুদ্ধবাদকে মহনীয় করে পুন:প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা চলছে তাকে চূড়ান্ত প্রত্যাঘাত হানতেই হবে।…..
স্টেটসম্যান’ কলকাতা, ৩ মার্চ ১৯৩৭
কবিগুরু বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে লিখলেন-
নাগিনীরা চারিদিকে ফেলেতেছে বিষাক্ত নি:শ্বাস
শান্তির ললিতবাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস –
বিদায় নেবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
‘প্রান্তিক’-১৮: ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, তৃতীয় খন্ড, সন ১৩৩০/১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায খবর পেয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-
জার্মানির বর্তমান শাসকের দাম্ভিক ন্যায়হীনতায় বিশ্বের বিবেক আজ গভীরভাবে আহত। বর্তমান পরিস্থিতি পূর্বের অনেকগুলি ক্ষেত্রে দুর্বলের অসহায় পীড়নের চূড়ান্ত পরিণতি।……
আমি কেবলমাত্র এই আশা প্রকাশ করতে পারি যে মানবজাতি এই পরীক্ষায় জয়যুক্ত হোক। সর্বকালের জন্য জীবনের শুচিতা এবং অত্যাচারিত জনগণের স্বাধীনতা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হোক!পৃথিবী এই রক্তস্নানের ধারায় চিরতরে কালিমামুক্ত হোক!
‘মডার্ন রিভিউ’, অক্টোবর ১৯৩৯
হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণ ও মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিনই প্রমথ চৌধুরীকে এক চিঠির সূচনায় রবীন্দ্রনাথ (২ অক্টোবর,১৯৩৯) লিখেছিলেন- ‘এখানে শরৎকালের দুর্গতির একশেষ- ঘোর শ্রাবণ হিটলারের মতো এর করিডর অধিকার করে বসে আছে-একেবারে সারেন্ডার।’
ফ্যাসিবাদ বলতে কি বোঝায়? ফ্যাসিবাদ শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘ফ্যাসিসকো’ থেকে। এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘ফ্যাসেইস্’ থেকে- যার অর্থ ‘বান্ডল’। প্রাচীন রোমে এক গোছা লোহার দন্ডকে একটি কুঠারের গায়ে জড়িয়ে বাঁধা হত এবং তার সাহায্যে ‘কর্তৃত্ব’ বোঝানো হতো। প্রাক-প্রথম মহাযুদ্ধের কালে ইতালিতে কিছু নির্দষ্ট লক্ষ্যে গঠিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ‘ফ্যাসিই’ বলা হতো। ১৯১৯ সালে মুসোলিনী প্রথম ফ্যাসিসমো শব্দ ব্যবহার করেন। লৌহদন্ড সজ্জিত কুঠারকে দলের প্রতীক হিসাবে গ্রহন করা হয়।
১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সপ্তম কংগ্রেসে জর্জ দিমিত্রভ বলেছিলেন—‘ফ্যাসিবাদ যে কোন মুখোশই ধারণ করুক, যে কোনো রূপেই নিজেকে উপস্থাপিত করুক এবং যে কোনো পথেই ক্ষমতায় আসুক, তবুও ফ্যাসিবাদ হলো শ্রমিকশ্রেনীর এবং সমস্ত মেহনতী মানুষের সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু।’ কিন্তু তবুও ‘ফ্যাসিবাদ অনেকক্ষেত্রে জনগণকে আকর্ষন করতে সমর্থ হয় কারণ, জনগণের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন ও দাবিগুলির কাছে সে বাগাড়ম্বরে আবেদন করে। ফ্যাসিবাদ শুধু জনগনের মধ্যে গভীরভাবে বদ্ধমূল সংস্কারগুলিকেই উসকিয়ে দেয় না, উপরন্তু নানাভাবে তাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকেও কাজে লাগায়।’ সতর্ক করে দিয়ে এও বললেন– ‘ফ্যাসিবাদের ক্ষমতা লাভ এক বুর্জোয়া সরকার থেকে অপর এক সরকারে মামুলি উত্তরন মাত্র নয়, এ হলো বুর্জোয়াদের শ্রেনী কতৃত্বের একটি রাষ্ট্রীয় রূপ। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের স্থলে অন্য একটি রাষ্ট্রীয় রূপের প্রকাশ্য সন্ত্রাসমূলক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা।’ ঐ সপ্তম কংগ্রেসে দিমিত্রভ ফ্যাসিবাদের সংক্ষিপ্ত সংঞ্জা দিয়ে বলেছিলেন:-
‘ফ্যাসিবাদ হলো নিপীড়িত মানুষের উপর লগ্নী পুঁজির আক্রমণ। সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবোধ ও তার দ্বারা প্ররোচিত আগ্রাসী যুদ্ধ……..। সব থেকে রক্ষণশীল সঙ্কীর্ণ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবিপ্লব। ফ্যাসিবাদ হলো-শ্রমিক শ্রেনী ও নিপীড়িত সমস্ত মানুষের পয়লা নম্বরের দুশমন।’
পৃথিবীতে প্রথম ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছিল ইতালিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইতালি ছিল বিধ্বস্ত ও অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত। ভার্সাই শান্তি চুক্তি ক্ষতি করেছিল। ইতালিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টির দ্রুত বিস্তার ঘটেছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। এই রকম পরিস্থিতিতে বেনিটো মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে ফ্যাসিস্ত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল। ১৯২২ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি ১১৬ টি আসন এবং সোস্যালিষ্টরা ১২২ টি আসন লাভ করেছিল।আর মুসোলিনির ফ্যাসিষ্ট পার্টি পেয়েছিল ৩৫ টি আসন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্রতা লাভ করল । একদিকে সফল রুশ বিপ্লব অন্যদিকে ইতালিতে কমিউনিস্টদের শক্তিবৃদ্ধি ইতালির পুঁজিপতি শ্রেনীকে আতঙ্কিত করে তুলল। কমিউনিস্টদের শক্তি খর্ব করতে পুঁজিপতিরা মুসোলিনির হাত ধরল। ১৯২২ সালের অক্টোবরে ‘ব্লাক শার্ট’ বাহিনীকে নিয়ে মুসোলিনী রোম অভিযান করলেন। রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল মুসোলিনির হাতে প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশ দপ্তরের দায়িত্ব তুলে দিলেন। মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে শুরু হল কমিউনিস্ট নিধন অভিযান। মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার লক্ষ্যে অগ্রসর হলেন। কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অমানবিক অত্যাচার,গণতন্ত্র হত্যা, উগ্র জাতীয়তাবাদের শ্লোগান, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য পুনরায় প্রতিষ্ঠার শ্লোগান, অন্ধ দেশ ভক্তির শ্লোগান—এগুলির মধ্যে দিয়ে মুসোলিনি ১৯২৬ সালে ” ডুসে” হিসাবে ইতালিতে এক নায়কের শাসন প্রতিষ্ঠা হল। ইউরোপে প্রথম ইতালিতে শুরু হলো ফ্যাসিস্ত শাসন।
ইতালির পর জার্মানিতে হিটলারের নেতৃত্বে কায়েম হয় ফ্যাসিবাদ। জার্মানিতে আর্থিক সঙ্কট ও কমিউনিস্ট বিরোধিতার হাত ধরে ফ্যাসিবাদের উদ্ভব হয়। ১৯২৯-৩০ সালে জার্মানির অর্থনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি,উৎপাদন হ্রাস স্বাভাবিক ঘটনায় পরিনত হয়েছিল। ফলে জনগণ বিপদে ছিলেন। কোনো দিশা ছিল না। ১৯১৮ সালে জার্মান রাজতন্ত্রের পতন ঘটে ।১৯১৮-১৯ সালে জার্মানিতে ব্যর্থ কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর ক্ষমতায় আসে ভাইমার রিপাবলিক। সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা ভাইমার প্রজাতন্ত্রের মূখ্য শক্তি হলেও এককভাবে এরা সরকার গড়তে পারেনি। ১৯২০-৩০ সাল পর্যন্ত কোয়ালিশন সরকার গড়ার মধ্য দিয়ে সমস্ত সরকারগুলির নেতৃত্ব এরা দিলেও সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারেনি। জনগন এদের উপর ক্ষুদ্ধ হলো, পুঁজিপতি শ্রেনী এবং সামরিক বিভাগকেও সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, জার্মানিতে তৎকালীন সময়ে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ফলে জার্মানির পুঁজিপতিরা কমিউনিস্ট বিপ্লবের সম্ভবনায় আতঙ্কিত ছিল। এইরকম এক আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জার্মানিতে হিটলারের আর্বিভাব ঘটল। হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদী শ্লোগান জনগণকে আকৃষ্ট করেছিল।
১৯২৩ সালে হিটলার এক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে জার্মানির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। দেশদ্রোহীতার অভিযোগে হিটলারের পাঁচ বছর জেল হয়। জেলে বসেই হিটলার তাঁর মতাদর্শ ব্যাখ্যা করে “মাইন ক্যাম্প” নামক বইটি লেখেন। এই বইটিতে নাৎসী দর্শন ও কর্মপন্থার কথা বলা হয়। হিটলার ভার্সাই শান্তি চুক্তি বাতিলের দাবি জানালেন। তিনি শ্লোগান দিলেন”লিবেন শ্রম” বা জার্মান জাতিকে বাঁচার মতো জমি দিতে হবে।
হিটলার তাঁর নাৎসী তত্ত্বকে জনপ্রিয় করতে মিথ্যাচার আর চটকের আশ্রয় নিয়েছিলেন। জনমানসে উগ্র ভাবাবেগ সৃষ্টি করেছিলেন।
হিটলার ছিলেন চরম কমিউনিস্ট বিদ্বেষী এবং ইহুদী বিদ্বেষী। নাৎসী মতাদর্শের চরম বিরোধী হবে কমিউনিস্টরা এটা হিটলার বুঝেছিলেন এবং হিটলারের ক্ষমতা দখলের পথে কমিউনিস্টরাই প্রধান বাঁধা হয়ে উঠবেন এটাও উপলব্ধি করেছিলেন। জার্মানির পুঁজিপতিরা , শিল্প মালিকরা, চার্চ, সামরিক প্রধানরা ছিলেন চরম কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। ফলে তাঁদের কাছে হিটলার ছিলেন পছন্দের ব্যাক্তি।
হিটলার বিদ্বেষের রাজনীতি করে জনগণকে উত্তিজত ও বিপথগামী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই বিদ্বেষের মূলকথা ছিল “বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব। জার্মানিরাই খাঁটি আর্য। ইহুদিরা নিকৃষ্ট। এছাড়া হিটলার প্রচার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি ব্যাঙ্ক মালিক, শিল্পপতিদের অসহযোগিতা এবং জার্মান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে ইহুদি সৈনিকদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় ঘটেছে। একই সঙ্গে প্রচার করা হয়েছিল ইহুদিদের প্রশ্রয়দাতা কমিউনিস্টরা। হিটলার জনসভায় বক্তৃতা করে বলতেন-হয় কমিউনিস্ট ও ইহুদিরা নাৎসীদের মৃতদেহের উপর দিয়ে হেঁটে যাবে, না হয় নাৎসীরা তাদের মৃতদেহের উপর হেঁটে যাবে।
হিটলারের রাজনৈতিক সংগঠন তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়েছিল -(ক) তহবিল,(খ) প্রচার বাহিনী,(গ) ঘটিকা বাহিনী। খাঁকি পোশাকের “এস-এ” অর্থাৎ “স্টরম ট্রুপার্স” বাহিনীটি ২৫ লক্ষ যুবককে নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল। এদের অধিকাংশই বেকার ছিলেন। এদের অন্যতম কাজ ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সভা, সমিতি ভন্ডুল করা। এরা প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি ও কমিউনিস্টকে খুন করেছিল। ১৯৩৪ সালে হিটলার জার্মানিতে তাঁর চরম স্বৈরাচারী শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হিটলারের অভ্যুত্থানের অব্যবহিত পরেই সমগ্র বিশ্বে ফ্যাসিবাদ আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩৫ সালে মুসোলিনী আবিসিনিয়া আক্রমণ করেন এবং ১৯৩৬ সালে এই দেশটি দখল করে নেন। ১৯৩৬ সালে মুসোলিনী ও হিটলারের প্রত্যক্ষ মদতে স্পেনের ফ্যাসিষ্ট নেতা জেনারেল ফ্রাঙ্কো সেখানকার নির্বাচিত বামপন্থী রিপাবলিকান সরকারের বিরুদ্ধে অক্ষশক্তি গড়ে তোলেন এবং সেখানে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন।
ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে কমিউনিস্টদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা মুছে ফেলা যাবে না। কমিউনিস্টরাই ফ্যাসিবাদের বিপদ শুরু থেকে উপলব্ধি করেছিল বলেই ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত পরাজয় সম্ভব হয়েছিল। নাৎসীদের হাতে কমিউনিস্টরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। নাৎসীরা রাইখস্ট্যাগে আগুন ধরিয়ে কমিউনিস্টদের অভিযুক্ত করে। জর্জ ডিমিট্রভকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়। স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিস্ট বিপদ উপলব্ধি করে ফ্যাসিবিরোধী সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তিকে নিয়ে পপুলার ফ্রন্ট গঠন করে। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সে জার্মান দখলের পর ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি রুখে দাঁড়ায়। এমনকি যুদ্ধের প্রথম দিকে ৮০০০ কমিউনিস্ট কারারুদ্ধ হয়। ১৯৪১ সালে ইতালিতে সংযুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তোলেন কমিউনিস্ট ও সোসালিষ্টরা।যুগোস্লাভিয়াতে নাৎসী দখলদারির বিরুদ্ধে সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তিকে এক করার উদ্যোগ নিয়েছিল। বুলগেরিয়া, চেকোস্লাভিয়া,বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে ফ্যাসিষ্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক লড়াইয়ের সামনের সাড়িতে কমিউনিস্টরা ছিলেন। ইউরোপের দেশে দেশে কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল।
ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় গ্রামশি যে পথ দেখিয়েছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। আজকের পরিস্থিতিতে গ্রামশি চর্চা জরুরি। গ্রামশি কেবলমাত্র ফ্যাসিবাদের ঐতিহাসিক সন্ধান করেননি একই সঙ্গে তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর রনকৌশলের সন্ধানও দিয়েছিলেন।
আন্তোনিও গ্রামশি বিশিষ্ট মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও ইতালি কমিউনিস্ট পার্টির সাধারন সম্পাদক ছিলেন। ১৯২১ সালে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে গ্রামশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ফ্যাসিস্ত মুসোলিনি সরকারে এসে গণতন্ত্রের উপর প্রচন্ড দমন পীড়ন শুরু করে। গ্রামশির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠনের ডাক দেয়। কিন্তু ১৯২৫ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করে নির্জন উস্তিকা দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরের বছরেই গ্রামশিকে ২০ বছরের কারাদন্ড দিয়ে বন্দী করা হয়। বন্দী অবস্থায় গ্রামশি তিরিশটি নোটবুক(৩০০০ পৃষ্ঠা) লেখেন,যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘ প্রিজন নোট বুক ‘ নামে পরিচিত। মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ ও হিটলারের নাৎসীবাদ দুটি উৎস সন্ধানে তাঁর গবেষণা আজও প্রাসঙ্গিক। ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানই গ্রামশিকে মার্কসবাদের উপর কঠোর চিন্তাভাবনায় ঠেলে দিয়েছিল। ফ্যাসিবাদ বিশ্লেষন না করে গ্রামশির রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার বিকাশ বোঝা সম্ভব নয়। স্তালিন, গ্রামশিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য মুসোলিনীকে আবেদন জানিয়েছিলেন। গ্রামশির বিচার চলাকালীন, প্রসিকিউটার বলেছিলেন,” ২০ বছর ধরে আমাদের এই মস্তিষ্কেকে কাজ করা থেকে বিরত রাখতে হবে।স্বৈরশাসক মুসোলিনির জন্য, ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামশির মস্তিষ্ক বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন ছিল। যদিও কারাগারেও তার মস্তিষ্ক বন্ধ রাখা যায় নি। গত কয়েকবছরে ভারতীয় রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী প্রবণতার কারনে গ্রামশির কথায় ফিরে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামশি সাংস্কৃতি, আদর্শিক এবং বৌদ্ধিক সংগ্রামের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন।
ইতালিতে ফ্যাসিবাদের বিপদ প্রথম দেখা দিয়েছিল। ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রথম কংগ্রেস থেকে ও প্রধানত গ্রামশি ফ্যাসিবাদের মূল্যায়ন শুরু করেন(১৯২১)। ইতালি কমিউনিস্ট পার্টির দলিলগুলিতে, গ্রামশির রাজনৈতিক তত্ত্ব ও রচনাগুলিতে এবং তোগলিয়াতি,লিওনেত্তি, স্কোকিমারো, জিনোজিনি প্রমুখের সাথে তাঁর পত্রালাপে ফ্যাসিবাদের ভূমিকা নিয়ে প্রথম থেকেই তিনি আলোচনা করেছিলেন। ১৯২০ সালে ‘কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশানাল ‘ ফ্যাসিবাদের বিপদের কথা উল্লেখ না করলেও ইতালির শ্রমিক আন্দোলনের দূর্বলতা যে ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হতে পারে সে বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয় ও ভূমিকাকে গ্রামশি বলেছেন -এ হলো প্রথম মহাযুদ্ধের বিশাল বিপর্যয়ের ফলে পুঁজিবাদী উৎপাদন ও বন্টনে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা মেশিনগান ও পিস্তল দিয়ে সমাধানের চেষ্টা। আশাহত মধ্যবিত্ত সামরিক পথে ও সামরিক বাহিনীর সহায়তা নিয়ে নতুন জগৎ গড়ার যে কল্পনা করে তারই প্রতিফলন ঘটেছে ফ্যাসিবাদে।
মুসোলিনীর কারাগারেই এগারো বছর বন্দি জীবন কাটিয়ে অসুস্থ গ্রামশি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৩৭ সালের ২৭ শে এপ্রিল।
১৯৪৫ সালের ৯ মে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটলেও ফ্যাসিবাদের জন্ম যে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের গর্ভে সেই বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের পতন আজও ঘটেনি। নয়া ফ্যাসিবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিচ্ছে ।
আমাদের দেশে নয়া ফ্যাসিবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। নয়া ফ্যাসিবাদ সম্পর্ক সি.পি.আই(এম)-র ব্যাখ্যা খুব পরিষ্কার। ব্যাখাটি এরূপ:-
(ক) বিরোধী পক্ষ ও গণতন্ত্রকে দমন করতে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। কতৃত্ববাদী আগ্রাসন বাড়ছে।
(খ) সি.পি.আই(এম) নয়া ফ্যাসিবাদ শব্দ বন্ধটির ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে-‘নয়া’র অর্থ নতুন বা পুরানো কিছুর সাময়িক বর্ণনা। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে নয়া-ফ্যাসিবাদী শব্দ বন্ধটি যুক্ত করা হয়েছে। ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল ইউরোপে যুদ্ধের অন্তর্বতী বছরগুলিতে। সেই সময় বিশ্বের পুঁজিবাদী সঙ্কটের পরিণততে ১৯২৯ ও ১৯৩৩ সালের মধ্যে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল, তীব্র হয়েছিল আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বগুলি। দুটি বিশ্বযুদ্ধ ছিল আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের ফসল। দেশে দেশে ফ্যাসিস্তরা ক্ষমতা দখল করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে খতম করে দিয়েছিল। আর্থিক সঙ্কট থেকে বেড়িয়ে আসার পথ হিসাবে যুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ঐ সমস্ত দেশের একচেটিয়া পুঁজি সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিল। ফ্যাসিস্ত শক্তিগুলি চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাদের উপরেই ভরসা করেছিল।
(গ) নয়া -ফ্যাসিবাদের কিছু উপাদানের সঙ্গে মিল রয়েছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ফ্যাসিবাদের। উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আছে ঐতিহাসিক ভুল ও অন্যায় সম্পর্কে ধারণাগত উপলব্ধি,যা একদিকে নিশানা করে ‘অন্যদের’ জাতিগত দিক থেকে অন্যদের বা ধর্মীয় দিক থেকে অন্যদের বা জনগোষ্ঠীগত সংখ্যালঘুদের এবং আরেকদিকে সমর্থন করে অতি দক্ষিনপন্থী বা নয়া ফ্যাসিষ্ট দল বা শক্তিগুলিকে।
(ঘ) নয়া উদারবাদের সঙ্কট থেকেই নয়া-ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি। বি জে পি-আর এস এস পরিচালিত বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি হিন্দুত্ববাদী কর্পোরেট আঁতাতে পরিচালিত কতৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা, যার মধ্যে নয়া-ফ্যাসিস্ত ধাঁচের প্রবনতা দৃশ্যমান।
আজকের পৃথিবীতে লগ্নিপুঁজি এখন গায়ের জোরে তাদের বশংবদদের সরকারে বসায় না, সংসদ ভেঙে দেয় না। ফ্যাসিবাদ ও নয়া ফ্যাসিবাদ উভয়ই আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে কাজ করে। খোলাখুলি স্বৈরশাসন চাপিয়ে দেয় না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে না কিন্তু পঙ্গু করে দেয়। নয়া ফ্যাসিবাদ সোস্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য মিডিয়ায় মাধ্যমে ভুয়া খবর, মিথ্যাচার ছড়িয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে। অভিবাসন বিরোধী নীতি গ্রহন করে বিদেশীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা তৈরি করে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সংস্থাপিত সংসদীয় গণতন্ত্রকে নগ্ন ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদী একনায়কতন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত করাই এর মূল কথা’।
‘ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এত মিল থাকা সত্ত্বেও গোটা দুনিয়া জুড়ে সাম্প্রতিক ফ্যাসিবাদী উত্থানকে আমরা নয়া ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করব, কারণ এই ধরনের ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে এক বিশেষ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে, যা ১৯৩০-এর পরিমন্ডলের থেকে ভিন্ন। সেই যুগে আন্ত:সাম্রাজ্যবাদী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাতাবরণের মধ্যে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল এবং সেইজন্য ফ্যাসিবাদকে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধের আগুনেই তাকে পুড়ে মরতে হয়েছিল। কিন্তু আজকের ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ঘটেছে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্যের যুগে। এই পুঁজি চায় না দুনিয়াটা বিভিন্ন দেশের প্রভাবাধীন অঞ্চলে বিভাজিত হয়ে যাক, বরং এই পুঁজি চায় গোটা দুনিয়াটাই তার অপ্রতিহত সঞ্চালনের জন্য মুক্ত থাকুক। এর আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে তার আধিপত্যের ক্ষমতার সাহায্যে প্রশমিত রেখেছে। সুতরাং আজকের ফ্যাসিবাদ যুদ্ধের আগুনে পুড়ে পরিসমাপ্তি লাভ করবে না। এই ফ্যাসিবাদের আয়ু তুলনায় দীর্ঘ হবে এবং জনগণের বিপুল সমাবেশ ঘটিয়েই কেবলমাত্র একে পরাজিত করা সম্ভব। যুগের তথা পরিস্থিতির ভিন্নতার কারণেই আজকের দিনের ফ্যাসিবাদকে ‘নয়া -ফ্যাসিবাদ’ আখ্যা দেওয়া হয়।
আজকের দিনে দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা গ্রহন করতে হবে।
সূত্র: নয়া-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আসন্ন নির্বাচন, প্রভাত পট্টনায়েক, পৃষ্ঠা ১৯, মার্কসবাদী পথ ৪৩ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০২৪