৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার
তৃতীয় পর্ব
দেশীয় ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তন ও ভারতীয় সমাজ
যখন হিন্দু ব্যক্তিগত আইনে কিছু পরিবর্তনের উদ্যোগ শুরু হয় আইনসভায় তখন হিন্দু কোড বিলটি হিন্দু রক্ষণশীল মহলের পক্ষ্ থেকে প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে এবং বার বার এর খসড়ায় বদল হয় এবং বহু বিষয়কে বাদ দিয়ে একটি দুর্বল বিল হিসাবে উপস্থাপিত হয় । এক্ষেত্রে যে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল তা হল গণপরিষদ নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা গঠিত ছিল না। গঠিত হয়েছিল মনোনীত সদস্যদের দ্বারা তাই তারা জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধি ছিলেন না। তাই তারা ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তন করার অধিকারী নন |
হিন্দু কোড বিল কমিটি ১৯৪১ সালে গঠিত হয়েছিল কিন্তু আইনটি পাস করতে ১৪ বছর লেগেছিল – এবং এটি সব শেষে যখন পাশ হয়, তখন একটি অভিন্ন আইন হিসাবে নয়, পাশ হয় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আইন হিসাবে:
* হিন্দু বিবাহ বিল বহুবিবাহকে বেআইনি ঘোষণা করে এবং এতে আন্তঃবর্ণ বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের পদ্ধতির বিধান যুক্ত হয় ।
* হিন্দু দত্তক ও রক্ষণাবেক্ষণ বিল এর প্রধান জোর ছিল মেয়েদের দত্তক নেওয়ার উপর, যা তখন পর্যন্ত খুব কমই প্রচলিত ছিল;
* হিন্দু উত্তরাধিকার বিল পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিষয়ে কন্যাদেরকে বিধবা এবং পুত্রের মতো একই পদে স্থাপন করে ।
তদুপরি, হিন্দু অধিকারের বিরোধিতার কারণে সমস্ত সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি
সংসদে 1949 সালে হিন্দু কোড বিলের বিতর্কে 28 জন বক্তার মধ্যে 23 জন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
1949 সালে, হিন্দু অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি ‘সর্বভারতীয় হিন্দু কোড বিল বিরোধী কমিটি’ গঠিত হয়েছিল, যারা অনিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহকে ন্যায়সঙ্গত হিসাবে প্রচার করেছিল ।
রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ 15 সেপ্টেম্বর, 1951 তারিখে বিলটি ফিরিয়ে দেওয়ার বা ভেটো দেওয়ার হুমকি দেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু নতি স্বীকার করেছেন; সংসদে বিল পাস হয়নি। এই সকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ বি আর আম্বেদকর আইনমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ।
অবশেষে 14 বছর পার করে যখন ওই বিল পাস্ হল তখন এটিতে হিন্দু যৌথ পরিবারের সম্পত্তিতে কন্যাদের অংশ দেয়নি। এই সংক্রান্ত সংশোধনীটি আসে 2005 সালে, UPA শাসনকালে |
একই রকম ভাবে মুসলমান সমাজেও তাদের ব্যক্তিগত আইনে পরিবতনের কথা উঠলেই তাদের রক্ষণশীল অংশের কাছ থেকে বিরোধিতা শুরু হয় | যে কারনে 1986 সালে শাহবানু মামলার রায়কে কার্যকর না করে তাকে বাতিল করার জন্য সংসদে আইন আনা হয় তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকারের আমলে |
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রশ্নে আদালত
বিভিন্ন সময় ধরে দেশের বিভিন্ন আদালত এবিষয়ে তাদের মতামত দিয়েছে | কখনও “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি”র পক্ষে কখনও বা বিপক্ষে |
স্বাধীন ভারতবর্ষে বিচারবিভাগ প্রথমবার “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি” র পক্ষে মতামত দেয় ১৯৮৫ সালে মোহাম্মদ আহমেদ খান বনাম শাহ বান বেগম মামলার রায়ে | এই মামলায় শাহ বানো বেগম নামে এক মুসলিম মহিলা, যাকে তার স্বামী তাৎক্ষণিক তিন তালাক দিয়ে বিবাহবিচ্ছেদ করেছিল । তিনি ফৌজদারি কার্যবিধির (CrPC)-র ১২৩ ধারায় তার স্বামীর কাছ থেকে তার ভরণপোষণের দাবি করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল যে CrPC r ১২৫ ধারার অধীনে মুসলিম মহিলার তার স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এই মামলায় ভারতের প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচূড় বলেন “একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি” চালুর মাধ্যমে পরস্পরবিরোধী মতাদর্শের অধীনে থাকা বৈষম্ম্যমূলক আইনগুলিকে সরিয়ে দিয়ে জাতীয় সংহতির লক্ষ্যে সহায়তা করবে ।“ মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে এর বিরুদ্ধে সওয়াল ওঠে | এবং শেষে ‘ যতক্ষণ না সম্প্রদায়ের লোকেরা নিজেরাই এটি ভেতর থেকে দাবি না করে, ততক্ষন পর্যন্ত ব্যক্তিগত আইনগুলি পরিবর্তন করা উচিত নয়’, এই বক্তব্ব্যকে সামনে রেখে Muslim Women (Right to Protection on Divorce) Act, 1986, আইনটি চালু করা হয়। যা ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৫ ধারার অধীনে একজন মুসলিম মহিলার ভরণপোষণের অধিকারকে খর্ব করে।
1995 সালে সরলা মুদগল বনাম ভারত সরকার মামলাতে রায় দিতে গিয়ে বিচারক কুলদীপ সিং বেঞ্চ বলেন, “যখন ৮০ শতাংশেরও বেশি নাগরিককে ইতিমধ্যেই বিধিবদ্ধ ব্যক্তিগত আইনের আওতায় আনা হয়েছে, তখন ভারতের ভূখণ্ডের সমস্ত নাগরিকের জন্য “ইউনিফর্ম সিভিল কোড” প্রবর্তন স্থগিত রাখার কোনও যৌক্তিকতা নেই।”
2021 সালে সৎপ্রকাশ মিনা বনাম আলোকে মিনা মামলাটিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ | এই মামলার প্রশ্ন টি ছিল হিন্দু বিবাহ আইন, ১৯৫৫ আইনের ধারা ২(২) এর অধীনে বাদ পড়া মীনা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে এই হিন্দু বিবাহ আইনের প্রযোজ্যতা সম্পর্কে। রায় দিতে গিয়ে দিল্লি উচ্চ আদালতের বিচারপতি প্রতিভা সিং বলেন, ” সুপ্রিম কোর্ট আশা প্রকাশ করছে যে বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের অভিন্ন কোড প্রণয়নের সময় এসেছে এবং ‘সম্পূর্ণ সংস্কারের’ প্রয়োজনীয়তা সুনিশ্চিতভাবে গ্রহণ করা উচিত । “
আবার বিভিন্ন মামলায় “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি” প্রণয়নের কার্যত বিপক্ষে মতামত প্রদান করেছে আদালত |
1951 সালে বোম্বে রাজ্য বনাম নারসু আপ্পা মালি মামলাটি বম্বে প্রিভেনশন অফ হিন্দু বিগামাস ম্যারেজ অ্যাক্ট, 1946-এর বৈধতা নিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলায় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল যে, এই আইনটি সংবিধানের অংশ ৩ (মৌলিক অধিকার) এর অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫ এবং ২৫ কে লঙ্ঘন করছে । আদালতে যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে মুসলমানদের বহুবিবাহ করার অনুমতি দিয়ে রাষ্ট্র বোম্বে প্রিভেনশন অফ হিন্দু বিগমাস ম্যারেজ অ্যাক্ট, 1946 এর মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে হিন্দুদের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ করছে। হিন্দু আইনে, পুরুষ উত্তরাধিকারী থাকা ধর্মের একটি অংশ এবং তাই এই উদ্দেশ্যে বিবাহ সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়। আদালত এক্ষেত্রে বলেছিল যে, যুক্তিসঙ্গত বৈষম্য থাকতে পারে এবং এখানে হিন্দু সম্প্রদায়কে সামাজিক সংস্কারের জন্য বৈষম্য করা হয়েছে বলে মনে করা হতে পারে এবং তাই তৃতীয় অংশের অধীনে অনুচ্ছেদ ১৪ বা অনুচ্ছেদ ১৫ (I) লঙ্ঘনের দাবি করতে পারে না এবং যদিও অনুচ্ছেদ ৪৪ অভিন্ন সিভিল কোডের কথা বলে, অনুচ্ছেদ ৪৪ কখনই কার্যকর করতে বলা যায় না, কারণ DPSP (রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশক নীতিমালা) প্রয়োগ করা যায় না। যদিও অনুচ্ছেদ 14 এবং 15 (I) সমতার কথা বলে, তবুও সমাজের উন্নতির জন্য যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। হিন্দু আইন এবং মুসলিম আইনের উৎপত্তি ভিন্ন এবং তাই এটিকে ইউনিফর্ম সিভিল কোড- এর আওতায় আনতে বাধ্য করা যায় না। তবে DPSP -র উদ্দেশ্য পূরণের জন্য, প্রাথমিকভাবে হিন্দু আইনে একটি সংস্কার করা হয়েছে এবং এটি অন্যান্য আইনেও ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
1994 সালে টি.এম.এ পাই ফাউন্ডেশন বনাম কেরালা রাজ্য এবং 17 অন্যান্য মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলে, “ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার সারমর্ম হল বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ভাষা এবং বিভিন্ন বিশ্বাসকে একসাথে স্থাপন করা যাতে তারা একসাথে সমগ্র অখন্ড ভারত গঠন করে।” সুতরাং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির জন্য ‘অভিন্নতা’ থাকা আবশ্যক নয়।
1996 সালের মধু কিশওয়ার বনাম বিহার রাজ্য মামলায় আদালত বলে, “এইরকম সংবেদনশীল উপজাতীয় জনগণ তাদের নিজেদের মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে প্রথা, ঐতিহ্য এবং ব্যবহারের মাধ্যমে যে বিভাজন ও দৃশ্যমান ব্যারিকেড তৈরী করেছে, তার বিরুদ্ধে অন্যান্য গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত আইনের মতো নীতি আইনগতভাবে তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একটি অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গি বা একথাও বলা যায় যে সমতার নীতির উপর ভিত্তি করে বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তা মনোমুগদ্ধকর হলেও একটি কঠিন প্রচেষ্টা ।
……আদিবাসীদের রীতিনীতিকে সংবিধানের 14, 15 এবং 21 অনুচ্ছেদ এর আপত্তিকর হিসাবে ঘোষণা করা কাম্য নয় । এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি মামলা পরীক্ষা করে সম্পূর্ণ তথ্য আদালতের সামনে উপস্থাপন করা আবশ্যক ।
2017 সালে শায়রা বানো বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে (TRIPPLE TALAQ) বাতিল করেনি । ‘তালাক-ই-বিদ্দাত’ -তাত্ক্ষণিক তিন তালাক প্রথা বাতিল বলে ঘোষণা করে বৈষম্যমূলক ব্যক্তিগত আইন অনুশীলনের অবসান ঘটানোর দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে । এই রায় ঘোষণা করার ভিত্তি হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট তার 395 পাতার রায়ে জানায় যে “তাৎক্ষণিক তিন তালাক” (INSTANT TRIPPLE TALAQ) ইসলামের ইসলাম ধর্মতত্ত্ব এই পদ্ধতিকে মান্যতা দেয় না ।
ভারতের সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল বেশ কয়েকটি রাজ্যের জন্য নির্দিষ্ট সুরক্ষা দেওয়া আছে । সেখানে কিছু উপজাতীয় আইন অনুযায়ী সেই উপজাতির পরিবারগুলিতে মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলে আবার এই আইনগুলিতে কয়েকটি এমন বিধানও আছে যা মহিলাদের স্বার্থে নয়। ওখানে আরও বিধান রয়েছে যে পারিবারিক আইন বিষয়ে তাদের সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন আছে । এই পারিবারিক আইন স্থানীয় পঞ্চায়েত দ্বারা বিচার ও তাদের নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করতে সাহায্য করে । সুতরাং, একটি আইন প্রণয়নের সময় এটি মনে রাখতে হবে যে সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য যাতে কোনওভাবেই বিঘ্নিত না হয় । অভিন্নতার জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা যেন দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রশ্নে হুমকির কারণ হয়ে না পড়ে । একই সঙ্গে স্থানীয় ক্ষেত্রে বহু ছোট ছোট পরিবর্তন আসছে সমাজের মধ্যে, এই পরিবর্তন যারা আঁচে তাদের শক্তিশালী করাও জরুরি ।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটির কেবল তখনই অর্থবহ হয় যখন এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় গন্ডির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যে কোনো ধরনের পার্থক্যের বহিঃপ্রকাশকে নিশ্চিত করতে পারে, এছাড়াও আঞ্চলিক জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ উচ্চস্বরের অধীনে অন্য স্বর মিশে না যায়; এবং একই সময়ে কোনও বৈষম্যমূলক অনুশীলনকে বৈধতা দানের জন্য ‘ধর্মের চাদরের আড়ালে’ লুকানো না হয় ।
সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত