Site icon CPI(M)

UCC and India :Parvej Rahaman

৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার

পঞ্চম পর্ব

অন্যান্য দেশের উদাহরণ


অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে বলতে গিয়ে প্রায় সবাই একটা কথাকে বলেন, যে পৃথিবীর বহু দেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু আছে, তাহলে ভারতে নয় কেন? একথা বলতে গিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড, মিশর, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দেশের নাম উল্লেখ করে বলেন যে, এই দেশগুলিতে যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি থাকতে পারে তাহলে এখানে নয় কেন?
একথা একেবারেই সঠিক তথ্য নয় | পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই ব্যক্তিগত আইন ব্যবস্থা রয়েছে। মুসলিম অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ, খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া এমনকি গ্রীস, মালয়েশিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো মিশ্র দেশ সবই ব্যক্তিগত আইন পরিচালনা করে। ভারত এবং নেপাল, যা প্রভাবশালী হিন্দু ব্যক্তিগত আইন থাকার জন্য বিশ্বে অনন্য |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্য উভয়েরই অভিন্ন পারিবারিক আইন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় অনুশীলনের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ করার অনুমতি দেয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তা অন্যান্য ব্যক্তিদের অধিকারকে খর্ব না করে । সেদেশে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান এবং অন্যদের অধিকার রক্ষা করা, ব্যক্তিগত উপাসনা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত নিয়মের আনুগত্য সহ বিশ্বাসের বিষয়ে তাদের আইনগুলি পালন করার অধিকার রয়েছে ।
আমরা এখানে আমাদের পার্শবর্তী 2টি দেশের আলোচনা এখানে করতে পারি একটু বিস্তারিতভাবে | পাকিস্তান দেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম | তাদের দেশের আইনে প্রধানত ইসলামী রীতি নীতি প্রাধান্য পেয়েছে | কিন্তু সেদেশে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নেই | সেই দেশে হিন্দু বিবাহ নিয়ন্ত্রণকারী দুটি আইন রয়েছে- সিন্ধু হিন্দু বিবাহ আইন 2016 (শুধুমাত্র সিন্ধু প্রদেশে প্রযোজ্য), 2017 সালের হিন্দু বিবাহ আইন (ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল, বেলুচিস্তান, খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং পাঞ্জাব প্রদেশে প্রযোজ্য)। দুই হিন্দুর মধ্যে বিবাহ নিবন্ধনের জন্য কোনও আইন বা সংশোধন করা হয়নি – এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে (ইসলামাবাদ রাজধানী অঞ্চল, বেলুচিস্তান, খাইবার-পাখতুনখোয়া এবং পাঞ্জাব) এর তারতম্য আছে । ‘সিন্ধু হিন্দু বিবাহ বিল’টি 2016 সালের ফেব্রুয়ারিতে সিন্ধু প্রাদেশিক পরিষদ দ্বারা পাস হয়েছিল। এটি ছিল পাকিস্তানে প্রথম হিন্দু বিবাহ আইন। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, পুনর্বিবাহের অধিকার এবং বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্ত্রী ও সন্তানদের আর্থিক সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য 2018 সালে এটি সংশোধন করা হয়েছিল।
আরেকটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ | সেটিরও রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম | কিন্তু সেখানেও কোনও অভিন্ন দেওয়ানি আইন নেই | বাংলাদেশে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং দত্তক গ্রহণ সংক্রান্ত পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে মুসলিম, হিন্দু এবং খ্রিস্টানদের জন্য পৃথক আইন রয়েছে। এই আইনগুলি একই ধর্মনিরপেক্ষ আদালতে প্রয়োগ করা হয়। একটি পৃথক নাগরিক পারিবারিক আইন মিশ্র বিশ্বাসের পরিবার বা অন্যান্য ধর্মের বা কোন বিশ্বাস নেই তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় । সমস্ত ধর্মের মানুষেরা নিজেদের ধর্মের পারিবারিক আইন অনুসারে তাদের বিয়ের আচার-অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশে একজন মুসলিম পুরুষের চারটি স্ত্রী থাকতে পারে, যদিও তাকে আবার বিয়ে করার আগে তার বিদ্যমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের লিখিত সম্মতি নিতে হবে। একজন খ্রিস্টান পুরুষ শুধুমাত্র একজন নারীকে বিয়ে করতে পারে। হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু পুরুষদের একাধিক স্ত্রী থাকতে পারে।

অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং মোদী সরকারের প্রচার


সম্প্রতি ভোপালে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অভিন্ন সিভিল কোড আনার ব্যাপারে তাঁর সরকারের দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন এবং যারা এর বিরোধিতা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে “তুষ্টকরণের” রাজনীতি অনুসরণ করার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘এক বাড়িতে যদি এক সদস্যের একটি আইন থাকে এবং অন্য সদস্যের অন্য আইন থাকে, তাহলে কি সেই পরিবার? তাহলে দ্বৈত পদ্ধতিতে দেশ চলবে কীভাবে?” তিনি এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তার উপলব্ধিতে “দ্বৈত” ব্যবস্থাকে লক্ষ্য বস্তু করা হবে তা ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন, এই কারণেই তিনি বার বার “আমাদের মুসলিম কন্যাদের” শব্দগুলি উল্লেখ করেছিলেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি এতটাই অজ্ঞ যে ভারতের সংবিধানই যে “দ্বৈত ব্যবস্থা” গুলির বন্দোবস্ত করেছে তা তিনি জানেন না? আসলে, প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতকে দেখছেন না, দেখছেন সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন।
এই কারণেই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যের আবেগকে এবং এটি প্রয়োগে সামগ্রিক দেশের বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর উপর অভিন্ন সিভিল কোড আরোপের প্রভাবগুলি উপেক্ষা করেছেন।
ব্যক্তিগত ও প্রথাগত আইনের সংস্কার জরুরি প্রয়োজন। আবার লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে বিজেপি এবং তার সরকারগুলি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধরণের সংস্কারের বিরোধী রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকে সমর্থন করে । যারা নাগাল্যান্ডের ক্ষেত্রে যে কোনও সংস্কারের বিরোধিতা করে বিজেপি তাদের সমর্থন করছে । এমনকি চার্চের সংস্কারের ক্ষেত্রেও বিজেপি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারীদের পাশে রয়েছে। যদিও মুসলিম সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করার পরেই বিজেপি এবং তার সরকার আগ্রাসীভাবে খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করে। নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইনকে পরিবর্তনের লক্ষ্যে সেই সম্প্রদায়ের মধ্যে আলোচনা করে একটা মনোভাব তৈরী করা অত্যন্ত জরুরি | তা না করে এই সরকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যের রক্ষণশীল শক্তিগুলিকে ধর্মের পতাকা উত্তোলন এবং যে কোনও পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একত্রিত হওয়ার জন্য সুযোগ করে দিচ্ছেন ।
7 জুলাই 2023 কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নাগাল্যান্ড সরকারের একটি প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন যে আদিবাসী এবং খ্রিস্টানদেরকে প্রস্তাবিত অভিন্ন দেওয়ানি বিধি র (ucc) আওতার বাইরে রাখা হবে। নাগাল্যান্ড প্রধানত একটি খ্রিস্টান রাজ্য এবং এটি বেশ কয়েকটি জাতিগত এবং উপজাতি গোষ্ঠীর আবাসস্থল। এক্ষেত্রেও বোঝা যাচ্ছে যে, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আসলে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর মানুষের দিকে লক্ষ্য করেই তৈরী করা হচ্ছে |
মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলবাদীরা সংস্কারের জন্য মুসলিম মহিলাদের দাবির সাথে জড়িত হতে অস্বীকার করেছে। তদুপরি, রাজনৈতিক শক্তিগুলিও যারা নিজেদেরকে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসাবে পরিচয় দেয় তারাও কখনও সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেনি এবং বিপরীতে অসম স্থিতাবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদকে ব্যবহার করেছে। এই ধরনের পশ্চাৎপদ অবস্থানগুলি কেবল বিজেপিকে তার লক্ষ্যযুক্ত প্রচারে সহায়তা করে। সব সম্প্রদায়ের নারীদের সমানাধিকারের বাস্তব ও জরুরী ইস্যু থেকে সরে আসার চেষ্টা করে এমন বিভিন্ন প্রবণতার মোকাবেলা করা আরও বেশি প্রয়োজন। ঐতিহাসিকভাবে এটি সবচেয়ে বিতর্কিত ক্ষেত্র কারণ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটি মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবারের মধ্যে মহিলাদের অধীনতার উপর নির্ভর করে। মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে কোনো সমঝোতা হতে পারে না, কিন্তু সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কোনও খসড়া এখনোও প্রকাশিত হয়নি | কিন্তু একে নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে কেন্দ্র সরকারে আসীন বিজেপি দল তাদের নিজস্ব মতাদর্শের রাজনীতির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের সংগঠিত প্রচারকে নামানোর প্রস্তুতি হিসাবেই প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে “দুই আইন” -র ধুয়ো তোলা হয়েছে |
1998 এবং 2019 সালের নির্বাচনের জন্য বিজেপির ইশতেহারে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রণয়নের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল | বেশ চালাকির সাথে একে লাগু করার প্রচেষ্টাও নিয়েছে তারা | 2019 সালের নভেম্বরে বিজেপি সাংসদ নারায়ণ লাল পঞ্চারিয়া সংসদে একটি প্রাইভেট বিল হিসাবে এটিকে উত্থাপন করেছিলেন। বিরোধী সাংসদদের প্রতিবাদের মুখে পরে “কিছু সংশোধনী আনার জন্য” বলে বিলটিকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। 2020 সালের মার্চ মাসে রাজস্থান থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ কিরোদি লাল মীনা দ্বিতীয়বারের জন্য বিলটি সংসদে নিয়ে আসেন , তবে এটি আর উত্থাপন করা হয়নি। 2020 সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, আরএসএসের সাথে মতবিরোধের কারণে বিজেপি এই বিলটি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে।
বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার জন্য উদ্যোগ শুরু করেছে | উত্তরাখন্ড, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাট, মধ্য প্রদেশ, আসাম রাজ্যগুলিতে এনিয়ে উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে| বিভিন্ন স্তরের কমিটি গঠন এবং তার খসড়া তৈরির কাজও দ্রুতগতিতে চলছে | আগামী নির্বাচনের আগেই এগুলিকে সামনে নিয়ে আসা হবে |

সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত

শেয়ার করুন