Site icon CPI(M)

UCC and India : Pervej Rahaman

৭ আগস্ট ২০২৩ সোমবার

চতুর্থ পর্ব

আইন কমিশনের মত

দেশের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ দেশের ২১ তম আইন কমিশন গঠন করে । চেয়ারম্যান করা হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বলবীর সিং চৌহানকে । ১৭ ই জুন, ২০১৬ তারিখে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি যাচাই করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আইন কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হয় । অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিষয়টি যেহেতু বিশাল, এবং এর সম্ভাব্য পরিণতিও যেহেতু অতীতে কখনও পরীক্ষা করা হয়নি। তাই দু বছর ধরে বিস্তারিত গবেষণা এবং বহু মানুষ , সংগঠন এর সাথে পরামর্শ করে,মোট ৭৫,৩৭৮ জনের কাছ থেকে বিভিন্ন মত গ্রহণ করে এই কমিশন । তাদের বেশিরভাগের মতে ব্যক্তিগত আইনগুলিতে বিভিন্ন উপায়ে সংস্কার কার্যকর করা যেতে পারে। যা ইঙ্গিত দেয় যে জনগণ এখন পারিবারিক আইনগুইতে সংস্কার চায় | তারা এখনই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চায় না। কমিশন একটি আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছে, “নারী গোষ্ঠীর সাথে আমাদের আলোচনায় উঠে আসে যে, যে ধর্মীয় পরিচয় মহিলাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির সাথে ব্যক্তিগত আইনগুলি প্রায়শই এই পরিচয়ের একটি অংশ এবং ‘ধর্মের স্বাধীনতার’ অভিব্যক্তি হিসাবে বিরাজ করে ।” সমস্ত বিষয়কে বিবেচনা করে কমিশন ৩১.০৮.২০১৮ তারিখে “পারিবারিক আইনের সংস্কার” নামক পরামর্শপত্র উপস্থাপন করছে ।


আইন কমিশন তাদের পরামর্শপত্রের ভূমিকার 1 .15 নং অনুচ্ছেদে বললেন, “যদিও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে এবং তা থাকা উচিত । এই প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সমাজের দুর্বল অংশগুলি অবশ্যই যেন সুবিধাবঞ্চিত না হয়ে পড়েন । এই সমাজে যে পার্থক্যগুলি ( বৈচিত্র ) বিদ্যমান আছে তার সমাধান কখনও পার্থককের বিলুপ্তি হয় না । এই কমিশন তাই অভিন্ন সিভিল কোড চালু করার বিষয়ে আলোচনার পরিবর্তে বৈষম্যমূলক আইনগুলির সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা করেছে । কমিশন খুব স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছে, “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি (UNIFORM CIVIL CODE) এই পর্যায়ে প্রয়োজনীয় বা কাম্য নয়।” পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এখন পরিচিতির পার্থক্যের স্বীকৃতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । এই নিছক পার্থক্যের অস্তিত্বকে বৈষম্য বোঝায় না, বরং এটি একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রর নির্দেশক হিসাবে বিরাজ করে ।
আইন কমিশন এর পাশাপাশি আরও বলে, যে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চালুর আকাঙ্ক্ষা থাকার পাশাপাশি অবশ্যই সমানভাবে এই প্রচেষ্টার প্রতিবন্ধকতাকেও স্বীকার করা প্রয়োজন । এক্ষেত্রে প্রথম সমস্যা হল সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের সাপেক্ষে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ 371 (A) থেকে (I) এবং সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে সংবিধান আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং গোয়ার ক্ষেত্রে পরিবার আইন লাগু করার ক্ষেত্রে কিছু সুরক্ষা প্রদান করেছে বা এর কিছু ব্যতিক্রম রেখেছে |
‘ভারত সরকার আইন, 1915’-কে 1919 সালে সংশোধন করে সেখানে ধারা 52A যুক্ত করা হয়েছিল । যে ধারায় ‘ভারত সরকার আইন 1915’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে “অনগ্রসর স্থান” কে ছাড় দেওয়া হয়েছিল । সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে গারো পার্বত্য জেলা, নাগা পাহাড় সহ উত্তর-পূর্বে পশ্চাদপদ অঞ্চল, শিলং পৌরসভা ও সেনানিবাস ব্যতীত শিলং জেলা এবং খাসি ও জনতিয়া অধ্যুষিত পার্বত্য জেলাকে “অনগ্রসর স্থান” হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ।
‘ভারত সরকার আইন, 1935’-তেও পশ্চাৎপদ এলাকাকে “বাদ দেওয়া এলাকা” বা “আংশিকভাবে বাদ দেওয়া এলাকা” দিয়ে প্রতিস্থাপন করে অনুরূপ বিধান রাখা হয়েছিল । ‘ভারতীয় (অস্থায়ী সংবিধান) আদেশ 1947’, অনুরূপ বিধানটি ধরে রেখেছে ।
সংবিধান প্রণয়নের সময় আইন প্রণেতারা উপলব্ধি করেন যে, ভারতের কিছু আইন অন্য প্রেক্ষাপটে অনুপযুক্ত হবে । এই আইনের বলে বাইরের এলাকা থেকে আসা অভিবাসী সম্প্রদায় দ্বারা ওই অঞ্চলের নিরীহ জনসাধারণের শোষণের আশঙ্কা থেকে যায় ।


সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিল গৃহীত হওয়ার সময় তা স্বায়ত্তশাসিত জেলা এবং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল তৈরী করার বিধান দেয় । এই অঞ্চলগুলিতে জেলা পরিষদ এবং আঞ্চলিক পরিষদগুলিকে উত্তরাধিকার, বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের অধিকারের পাশাপাশি বিচার প্রশাসন পরিচালনা করারও অধিকার দিয়েছিল । এই ধরনের কাউন্সিলগুলি ফৌজদারি এবং অন্যান্য মামলার বিচারের পদ্ধতি, আদেশ এবং রায় কার্যকর করা/বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়ম প্রণয়ন করতে পারে ।
1962 সালে 13 তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ধারা 371A সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল | যেখানে বলা হয়েছিল যে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে সংসদে পাশ হওয়া আইন নাগাল্যান্ডে লাগু হবে না, যদি না তাদের রাজ্য বিধানসভা তা অনুমোদন করে ।
(i) নাগাদের ধর্মীয় বা সামাজিক অনুশীলন,
(ii) নাগা প্রথাগত আইন ও পদ্ধতি,
(iii) নাগা প্রথাগত আইন মোতাবেক দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিচার বা প্রশাসনিক অনুযায়ী সিদ্ধান্ত এবং
(iv) জমির মালিকানা এবং হস্তান্তর এবং এর সম্পদ,
সংবিধানের 371A অনুচ্ছেদ নাগাল্যান্ডের সামাজিক অবস্থা এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপকে মাথায় রেখে একটি ভিন্ন ভাবনার কথা বিবেচনা করেছে । সংবিধানের অনুচ্ছেদ 371 B- 371 I তে অনুরূপ প্রস্তাবে উত্তর পূর্বের অন্যান্য রাজ্যেকেও ছাড় দেওয়া হয়েছে ।
2012 সাল থেকে নাগাল্যান্ডে কোনও স্থানীয় সংস্থা নির্বাচন হয়নি কারণ কয়েকটি নাগা গোষ্ঠী মহিলাদের জন্য এক তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছিল, যা তারা নাগা প্রথাগত আইনের বিরুদ্ধে বলে মনে করে। নাগা মহিলা সমিতির নেতৃত্বে এবং সারা দেশের মহিলা সংগঠনগুলির সমর্থনে নাগা মহিলারা এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণের বিধানের জোরালো দাবি জানিয়ে বলেছেন যে এটি একটি পুরুষ শাসিত ব্যাখ্যা এবং এই জাতীয় সংরক্ষণের বিরুদ্ধে নাগা প্রথাগত আইনে কিছুই নেই। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশনের শুনানি চলছে। গত কয়েক দিন আগে এই বিষয়ে হলফনামা জমা না দেওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ আদালত কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করেছে। ‘মুসলিম কন্যাদের’ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী ‘নাগা কন্যাদের’ নিয়ে পুরোপুরি নীরব। কন্যাদের সংরক্ষণের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে । কেন্দ্রীয় সরকার এ ব্যাপারে নীরব কেন? এই বছরের এপ্রিলে, নির্বাচনের পরপরই, নবনির্বাচিত সরকার বিজেপি যার অংশীদার ছিল, তার উপ-মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্থানীয় সংস্থাগুলিতে মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার একটি প্রস্তাব পাস করেছিল। বিজেপির রাজ্য সভাপতি তেমজেন ইমনা তাঁর সরকারকে সমর্থন করে বলেছেন যে আদিবাসী সংগঠনগুলির সাথে আলোচনা করার জন্য আরও সময় প্রয়োজন ।
যখন বিজেপির পক্ষে উপযুক্ত হয়, তখন “দ্বৈত ব্যবস্থা” ঠিক, আর যখন তারা কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে টার্গেট করতে চায়, তখন তারা “এক আইন”-র কথা বলে! নাগাল্যান্ডের এই উদাহরণ কী প্রমাণ করে? প্রথমত, মহিলাদের অধিকারের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে প্রচারিত বিজেপির তত্ত্বের চরম ভণ্ডামি। দ্বিতীয়ত নাগাল্যান্ডে, নাগা “কন্যারা” দাবি করলেও মহিলাদের এক তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে ।
যখন দেশে একই আইনের পক্ষে কথা বলা হয় তখন দেখা যায় দেশে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় আইন যেগুলি প্রথাগত / স্থানীয় আইনের সাথে সংঘাত তৈরী করে সেই আইনগুলি প্রযোজ্য নয় বলে ধরে নেওয়া হয় । উদাহরণস্বরূপ, ‘ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থা অ্যাক্ট 1993’ আইনটির সঙ্গে নাগাল্যান্ড ‘বিচার প্রশাসন নিয়ম 1936’ এবং ‘সিভিল প্রসিডিউর কোডের’ ধারা 1(3) র দ্বন্দ্ব থাকার কারনে ঋণ পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত দেশের এই ‘ব্যাংক এবং আর্থিক সংস্থা অ্যাক্ট1993’ আইনটি নাগাল্যান্ড এবং উপজাতীয় এলাকায় প্রযোজ্য হয় না।
একইভাবে, ‘Code of Criminal Procedure (CrPC)1973’, নাগাল্যান্ড রাজ্য এবং উপজাতীয় এলাকায় প্রযোজ্য নয়। আদিবাসী ক্ষেত্রগুলিকে সংবিধানের অধ্যায় 1-এ উল্লেখ করা হয়েছে ৷ সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের 20 অনুচ্ছেদ এ উল্লিখিত অংশের বাইরেও শিলং পৌরসভার স্থানীয় সীমার মধ্যে বাইরের আইন লাগু হয় না । শিলং শহরে CrPC প্রযোজ্য শুধুমাত্র তখনই যদি অপরাধ শিলং পৌরসভার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে হয় । শিলং পৌরসভার বাইরের সংঘটিত অপরাধ জেলা পরিষদ আদালত এবং জেলা প্রশাসকদের দ্বারা বিচার করা হবে, তাদের আঞ্চলিক আইন দ্বারা, CrPC দ্বারা নয় ।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ 50 বিচার বিভাগ এবং নির্বাহী বিভাগকে পৃথকীকরণের ব্যবস্থা করেছে | সুপ্রীম কোর্ট ধারা 50 এর বিধান কার্যকর করার নির্দেশ বেশ কয়েকবার দিয়েছে । তবুও এই প্রক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণ হয়নি ।
নাগাল্যান্ডে, মহিলারা এখন স্ব-অর্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হতে পারে । এক্ষেত্রেও বিরুদ্ধ মত আছে । কিছু উপজাতি মহিলাদের সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে বলা হয় যে, তারা গ্রামের জমির উত্তরাধিকারী হয় এবং তারপর তাদের গোত্রের বাইরে বিয়ে করে চলে যায় ।


নিঃসন্দেহে, বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সাম্য ও মানবতার নীতির ক্ষেত্রে সার্বজনীন এবং আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলার মনোভাব দেখা যাচ্ছে । অনেকে আবার এই যুক্তিও দেন যে UCC জাতীয় ঐক্য বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে ভালো পদক্ষেপ হতে পারে কিন্তু সাংস্কৃতিক পার্থক্য যখন মানুষের পরিচয়কে বহন করে তখন তাকে সংরক্ষণ জাতির অখণ্ডতা সুনিশ্চিত করতে গ্যারান্টি দেয় । আইন তৈরী করতে হবে সংবিধানের কাঠামোর মধ্যে থেকে । সাংবিধানিক ব্যতিক্রম হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সামাজিক স্বার্থকে মাথায় রেখে ন্যায্য এবং ভারসাম্যকে যাতে আঘাত করা হয় না হয়।
উদাহরণস্বরূপ, মেঘালয়ের গারো এবং খাসি উপজাতি হল মাতৃতান্ত্রিক, অর্থাৎ, তাদের বংশ ও সম্পত্তির মালিকানা গড়ে ওঠে মহিলাদের কেন্দ্র করে । সম্পত্তি উত্তরাধিকারসূত্রে কনিষ্ঠ কন্যা সম্পত্তির অধিকার পায় । গারোদের মধ্যে, জামাই তার স্ত্রীর বাবা-মায়ের সাথে অর্থ্যাৎ শশুর বাড়িতে থাকতে আসে। যদিও এই ধরনের প্রথাগুলি ‘মূলধারার’ ধারণার সাথে খাপ খায় না । এগুলিকে মেঘালয়ে সাধারণ অনুশীলন হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং এই ধরনের বিবাহগুলিও মেঘালয় রেজিস্ট্রেশন অফ ম্যারেজ অ্যাক্ট 2012, এর অধীনে নিবন্ধিত করা বাধ্যতামূলক যা উপজাতীয় সংস্কৃতির পার্থক্যকে স্বীকৃতি দেয় ।
পঞ্চম তফসিল এলাকায়, ‘পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ আইন 1996’ (Panchayats Extension to Scheduled Areas (PESA) Act, 1996) প্রণয়নের মাধ্যমে স্ব-শাসনের মাধ্যমে প্রথাগত ও সামাজিক অনুশীলনের সুরক্ষার জন্য গ্রাম সভাগুলিকে আইনি অধিকার দেওয়া হয়। একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সারা ভারত জুড়ে উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য এই সাংবিধানিক এবং আইনী রোখ্যাকবচের বিধানগুলির সাথে সরাসরি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। মধ্য ও পূর্ব ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায়গুলি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে আক্রমণের শিকার হয়েছে যা তাদের বন ও জমি দখল করছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা কখনও বহুত্বের বিপরীত হতে পারে না । ধর্মনিরপেক্ষতা সাংস্কৃতিক পার্থক্যর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সুনিশ্চিত করে ।


প্রকৃতপক্ষে, যদি কেউ লিঙ্গ-ন্যায্যতার নিয়মগুলি খুঁজতে চায়, তাহলে উপজাতীয় প্রথার অনেকগুলি শিক্ষামূলক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ আরোও উল্লেখ করা যায়, মিকিরদের মধ্যে যদি কোনও মেয়ে উত্তরাধিকারী এবং একমাত্র কন্যা হয় তবে সে বিবাহের পরে তার বাড়ি ছেড়ে যায় না।
নারীদের জন্য জাতীয় কমিশন উপজাতীয় আইনের অধীনে নারীদের অবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবেদনে তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, “সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে ডিমাসা এবং গারো উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষরা সামাজিক মালিকানাকে (CPR ) স্বীকৃতি দেয় কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যক্তির সাথে আনুষ্ঠানিক আইনের ভিত্তিতে যোগাযোগ করতে হয় । আকারা তাদের ঐতিহ্যর ক্ষেত্রে খুবই সঙ্গবদ্ধ । তারা তাদের প্রথাগত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ষষ্ঠ তফসিল তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। সংবিধানের 371A ধারা অঙ্গামিদের প্রথাগত আইন মোতাবেক চলতে দেয় কিন্তু এও দেখা যায়, যে আধুনিকতার সুযোগ নিয়ে পুরুষরা একে তাদের মতো করে ব্যাখ্যা করেন । আদিবাসী যাদের পূর্বপুরুষরা ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড় থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসাবে আসামের চা বাগানে কাজ করতে গিয়েছিলেন তারা তাদের প্রচলিত আইন ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলেছেন । মঙ্গোলয়েড উপজাতিরা আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হলেও তাদের মধ্যে এখন একটি পরিচয় সংকট অনুভব করা শুরু হয়েছে কিন্তু আদিবাসীরা এর সবচেয়ে খারাপ প্রভাব অনুভব করেছে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, ভূমি বিচ্ছিন্নতার কারণে যা তাদের আসামে অভিবাসন করতে বাধ্য করেছিল |” তাদের পরিচযের উপর আক্রমণ আজও অব্যাহত রয়েছে ।”
প্রথমত, এই আইন কমিশন বিদ্যমান ধর্মনিরপেক্ষ আইনগুলি , যেমন বিশেষ বিবাহ আইন, গার্হস্থ্য সহিংসতা থেকে সুরক্ষা আইন এবং অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ আইন যা সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের জন্য প্রযোজ্য সেগুলিকে শক্তিশালী ও প্রসারিত করার বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ করেছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু, মুসলমান (সুন্নি ও শিয়া উভয়), খ্রিস্টান, পার্সি, শিখ, বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য বিভিন্ন ব্যক্তিগত এবং প্রথাগত আইনগুলির বিশদ অধ্যয়নের পরে, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানদের হেফাজত, দত্তক গ্রহণ, উত্তরাধিকার ইত্যাদির মতো পারিবারিক আইন সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতে সংস্কারের পক্ষে সুপারিশ করেছে ।
প্রতিবেদনে বিদ্যমান হিন্দু ব্যক্তিগত আইনে হিন্দু নারীরা যে একাধিক বৈষম্যের মুখোমুখি হন তার বিশদ বিবরণ দেওয়া হয়েছে । 2005 সালের সংস্কারের পরেও এটি মহিলাদের প্রতি অন্যায্য বলে মনে করে হিন্দু আইনের কো-পারসেনারি ধারণাটি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে; এটি হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের (UHF) ধারণা থেকে কর ছাড় বিলুপ্তিরও সুপারিশ করেছে ।
21তম আইন কমিশন মনে করে যে ব্যক্তিগত আইনের বৈচিত্র্য রক্ষা করাই হতে পারে এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায়, কিন্তু একই সাথে, নিশ্চিত করা যে ব্যক্তিগত আইনগুলি ভারতের সংবিধানের অধীনে গ্যারান্টি দেওয়া মৌলিক অধিকারগুলির বিরোধিতা না করে। কমিশন আরও যোগ করেছে, এটি বাঞ্ছনীয় যে পারিবারিক বিষয়গুলির সাথে সম্পর্কিত সমস্ত ব্যক্তিগত আইনগুলিকে প্রথমে যথাসম্ভব সর্বাধিক পরিমাণে কোডিফাই করতে হবে এবং কোডিফাইড আইনে যে বৈষম্যগুলি তৈরি হয়েছে, তা সংশোধনের মাধ্যমে তা প্রতিকার করা উচিত।


এই ধরনের সুপারিশের কারণেই বিজেপি-র ঝুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে বেড়াল, ‘মুসলিম নারীদের’ অধিকার প্রদানের জন্য মুসলমান ব্যক্তিগত আইনকে বাতিল করে দেশে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ লাগু করা প্রয়োজন| তাই 21তম আইন কমিশনের রিপোর্টকে ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে | তিন তালাকের বিরুদ্ধে আইন করে ‘আমাদের মুসলিম কন্যাদের’ সাহায্য করার জন্য একমাত্র সরকার কাজ করেছে বলে মোদী সরকারের দাবি আরও বিব্রতকর, আইন কমিশনের রিপোর্ট সরাসরি তুলে ধরেছে যে, সুপ্রিম কোর্টই এটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছিল কারণ এটি একটি অপরিহার্য ধর্মীয় অনুশীলন ছিল না। মোদী সরকারের আইনের সরাসরি সমালোচনা না করলেও, রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মুসলিম মহিলা ভুক্তভোগীকে রক্ষা করার জন্য যা প্রয়োজন তা হ’ল গার্হস্থ্য সহিংসতা প্রতিরোধে নাগরিক আইনের বিধানগুলি প্রয়োগ করে করা উচিত। কারণ মোদী সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাক বাতিলের সংশ্লিষ্ট যে আইন এনেছে, তাতে বেআইনিভাবে তালাক প্রাপ্ত ওই মহিলাকে কোনও স্বস্তি দেওয়া হয় না– এটা শুধু মুসলিম পুরুষকে জেলে পাঠায়। এক্ষেত্রে আরও একটি মিথ্যা কথাকে প্রচার করা হচ্ছে, যে আদালত “তিন তালাক”কে বাতিল করেছে । আসলে আদালত “তিন তালাক”কে বাতিল করেনি, বাতিল করেছে ” তাৎক্ষণিক তিন তালাক” কে ।
এদিকে সমস্ত বিচারাধীন ধর্মনিরপেক্ষ আইন যা সমস্ত মহিলাদের জন্য সমতা বাড়িয়ে তুলবে তা উপেক্ষা করা হয়েছে বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যেমন মহিলা সংরক্ষণ বিল, তথাকথিত সম্মান সম্পর্কিত অপরাধের বিরুদ্ধে আইন, বিবাহের সময় তৈরি সমস্ত সম্পত্তির মালিকানার জন্য আইন (বিয়ের সময় অর্জিত সমস্ত সম্পত্তির যৌথ মালিকানা) এবং বৈবাহিক ধর্ষণের অপরাধীকরণ। মোদী সরকার তার প্রথম মেয়াদে বা দ্বিতীয় মেয়াদে এখনও পর্যন্ত একটিও নারী-বান্ধব আইন গ্রহণ করেনি।
এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনাকে তার এজেন্ডা নির্ধারণের মাপদণ্ড করে মোদী সরকার 2018 সালে সরকারের কাছে উপস্থাপিত এই মূল্যবান প্রতিবেদনটি উপেক্ষা করেছে এবং কোনও একক আইন বা কোনও সম্প্রদায়ের সাথে ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের জন্য গুরুতর পরামর্শকেও সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করেছে।


21 তম আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির (UCC) প্রস্তাবকে নাকচ করে দেওয়ার পর 20 ফেব্রুয়ারী 2020 কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রিতু রাজ অবস্থিকে চেয়ারম্যান করে 22তম আইন কমিশন গঠন করেছে | প্রকারান্তরে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে কমিশনক। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কমিশন অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি “এমন আইনগুলি চিহ্নিত করবে যা আর প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিক নয় এবং অবিলম্বে বাতিল করা যেতে পারে; রাষ্ট্রীয় নীতির নির্দেশক নীতিমালার আলোকে বিদ্যমান আইনগুলি পরীক্ষা করা এবং উন্নতি ও সংস্কারের উপায়গুলির পরামর্শ দেওয়া এবং নির্দেশক নীতিগুলি বাস্তবায়ন এবং সংবিধানের প্রস্তাবনায় নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনগুলির পরামর্শ দেওয়া। ” স্পষ্টতই এজেন্ডাটির সাথে মহিলাদের অধিকারের কোনও সম্পর্ক নেই এবং সমাজকে মেরুকরণের জন্য নির্বাচনী এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সমস্ত কিছু করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিচারপতি রিতু রাজ অবস্থি 2021 সালের অক্টোবরে কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন এবং 2022 জুলাই মাসে অবসর গ্রহণ করেন। ওই বছরের মার্চ মাসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার ওপর রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার বেঞ্চের সভাপতিত্ব করেন তিনি। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করার বিষয়টি লক্ষ্য করলেও বোঝা যায় যে এর পেছনে কোনও মহৎ ভাবনা নয় নির্দিষ্ট মেরুকরণ তৈরী করার উদ্দেশ্যে গ্রাউন্ড প্রস্তুতি করার উদ্দেশ্যে আছে । অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিষয়ে জনসাধারণের মত জানানোর জন্য আরও সময় বৃদ্ধির ঘোষণা করেছে 14.07.2023 তারিখে । আগে এই আইন কমিশন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সংগঠনের কাছে 30 দিনের মধ্যে মতামত চেয়ে পাঠিয়েছিল ।

সম্পূর্ণ প্রতিবাদান টি ৬ টি পর্বে প্রকাশিত

শেয়ার করুন