Site icon CPI(M)

ওরা কাজ করে, দেশে দেশান্তরে (পর্ব-২): শমীক লাহিড়ী

পর্ব -২

১৩১ বছর বাদে

২০১৭ সাল। ১১ই আগষ্ট। হরিয়ানার এক আদালত মারুতি-সুজুকি কারখানার ১৩ জন ইউনিয়ন নেতাকে সেখানকার ম্যানেজারকে খুন করার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। এই ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনই ঐ কোম্পানীর শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকর্তা। আরও ১৮ জন শ্রমিককে বিশৃঙখলা, আগুন লাগানো ইত্যাদি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করলো। এই কোম্পানির শ্রমিকরা দাবী করেছিলো – শ্রমিক ইউনিয়নের স্বীকৃতি, স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে অত্যন্ত কম মজুরির চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে। শ্রমিকদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। না, কোনটাতেই রাজি হয়নি মালিক-ম্যানেজমেন্ট। হয় চুপ ক’রে কাজ করো, না হয় ছাঁটাই।

১৮ই জুলাই, ২০১২। কারখানায় আগুন লাগলো, একজন ম্যানেজারের দুঃখজনক মৃত্যু হ’লো। হরিয়ানার তৎকালীন বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার মারুতি কোম্পানির ম্যানেজমেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে প্রথমে ৯১জন জন এবং পরে আরো ৫৭জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করলো। ৫বছর ধরে মামলা চলাকালীন কাউকে জামিন পর্যন্ত দেওয়া হ’লনা। ১০ই মার্চ, ২০১৭ আদালত ৩১জন শ্রমিককে বিভিন্ন অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করলো এবং ১১৭ জনকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করলো। ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৪ জনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং বাকিদের ৪ বছরের কারাদণ্ড দিল আদালত।

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা

যে প্রশ্নগুলো উঠলো এই মামলাকে ঘিরে – ১১৭ জন যাদের আদালত নিঃশর্ত মুক্তি দিল, তারা কেন বিনা দোষে ৫ বছর জেলে থাকলো? কেন ৫ বছরে মামলা চলাকালীন কাউকে জামিন দিলনা আদালত? কোম্পানি ৯১জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল। বাকি ৫৭জন শ্রমিককে কার অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখ হরিয়ানা পুলিশের পক্ষ থেকে কোথাও করা হয় নি।

বিচার প্রক্রিয়ায় কাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা হ’ল? ৪ জন লেবার কনট্রাক্টার। একটা অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল এই ৪ জনের সাক্ষ্যদান পর্বে। বীরেন্দ্র যাদব নামে লেবার কন্ট্রাক্টর সাক্ষ্য দিল যে ২৫জনকে ভাঙচুর করতে ও আগুন সে লাগাতে দেখেছিল, তাদের প্রত্যেকের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি A থেকে G এর মধ্যে। ইয়াদ রাম তাঁর সাক্ষ্যে যে ২৫ জনকে চিহ্নিত করে, তাদের প্রত্যকের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি H থেকে P এর মধ্যে, আকাশ নামে আর এক সাক্ষী যে ২৬ জনের নাম নেয় তাদের প্রত্যেকের আদ্যক্ষর ইংরেজি P থেকে S এবং আর এক সাক্ষী রাকেশ যে ১৩ জনের নাম নেয় তাদের নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি S থেকে Y এর মধ্যে ছিল। ঠিক যে ক্রমিক ধরে সুজুকি কোম্পানি ৯১ জন শ্রমিকের নামে অভিযোগ জানিয়েছিল, ক্রমান্বয়ে সেই ক্রমিক নং ধরেই ৪জন সাক্ষী বলে, তারা এই ৯১ জনকে ভাঙচুর ও আগুন লাগাতে দেখেছে।

(সূত্রঃ হিন্দুস্তান টাইমস মার্চ১৭, ২০১৭)

পাঠক কোনও মিল পাচ্ছেন এই দুটো মামলায়! তফাৎ ১৩১ বছর। দূরত্ব ১১,৯৪০ কিলোমিটার।

শ্রম কখন লাশ হয়

তেলেঙ্গানার লঙ্কা ক্ষেতে কাজ করতো ১২ বছরের জামলা মাকদম। ২০২০ সালের ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা ৮টা। হঠাৎ সব বন্ধ – ট্রেন বাস সব। এর পোষাকী নাম ছিল লকডাউন। মানুষকে বাঁচানোর জন্যই নাকি সব বন্ধ করতে হয়েছিল। এখন কি করবে সে? এদিকে কাজ বন্ধ, তাই মজুরিও বন্ধ। খাবে কি? নিরুপায় জামলা রওনা দিয়েছিল ছোট্ট ছোট্ট পায়ে বাড়ির দিকে। কত দূরে বাড়ি সে জানত না। ৪দিন, ৪রাত হেঁটেই চললো জামলা বড়দের সাথে। জানতো না আর মাত্র ১৪ কিলোমিটার পেরোলেই তার বাড়ি। সেখানেই তার মায়ের আঁচল পাতা ঘর। হলো না বাড়ি যাওয়া। তার গাঁয়ের ১৪ কিলোমিটার আগেই ১২বছরের জামলার নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ছিল।

ছয় জনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছবু মন্ডল। গুরগাঁওতে কাজ করতো। বাড়িতে অর্থ পাঠালে বাড়ির ৬ জনের পেট চলে। লোক বাঁচাতে সব বন্ধ হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এক ভাষনে, মাত্র ৪ঘন্টার নোটিশে। বিহারের পরিযায়ী শ্রমিক, ৩৫ বছরের ছবু রঙ মিস্ত্রীর কাজ হারিয়ে, আড়াই হাজার টাকায় তার মোবাইল ফোন বিক্রি করে দেয়। এই টাকা স্ত্রীর হাতে তুলে দেয় অনাহারক্লিষ্ট পরিবারের খাবারের জন্য। আর কাজ না পাওয়ার আশঙ্কায় কপর্দকহীন ছবু সেদিন আত্মহত্যা করেছিল।

আনুমানিক এমন ১০কোটি জামলা-ছবু, যাদের পোশাকি নাম পরিযায়ী শ্রমিক, সেদিন দেশের রাস্তায় ঘাটে বসে ছিল। কে মরেছিল আর কে বেঁচে ফিরেছিল তার কোনও হিসাব রাষ্ট্রের কাছে নেই। ২৪ কোটি শ্রমিকের কাজ গিয়েছিল।

রাষ্ট্রের কাছে এরা ততক্ষণই মূল্যবান, যতক্ষণ এরা মুখ বুজে উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য, পুঁজির মালিকদের হাতে তুলে দেবে। যেদিন মুখ খুলবে সেদিনই হে মার্কেট বা সুজুকি মামলার মতো সাজানো মামলায় এদের সাজা হবে। যেদিন এদের শ্রম অপ্রয়োজনীয় মনে হবে, সেদিন জামিলা বা ছবু’র মতো লাশ রাস্তায় পড়ে থাকবে – সে রাস্তা নিউইয়র্কের নাইনটিনাইথ স্ট্রীটের হার্লেমই হোক বা দক্ষিণ ইতালির মেজ্জোগিয়ারনোই হোক বা কলকাতার ধর্মতলাই হোক।

রাস্তাঘাট শুনশান। শহরগুলোর ব্যস্ততম রাস্তাগুলোয় পিচ গলে ধোঁয়া উঠছে এখন। ৪২/৪৩ডিগ্রী তাপমাত্রার ভয়ে দরজা-জানালা এঁটে এসি’র ঠান্ডা বাতাস আর বরফ ঢালা নরম পানীয় হাতে নিয়ে খাবারের অপেক্ষায় আছে অনেক ফ্ল্যাটবাসী। তার মাঝেই রাস্তায় মোটর বাইকের আওয়াজ। বেজে উঠছে কলিং বেল। পাছে বাইরের গরম বাতাস ভেতরে ঢুকে পড়ে, তাই দেড় ইঞ্চি দরজা ফাঁক করে কোনোক্রমে হোম ডেলিভারির খাবারের প্যাকেট দরজার এপারে নিয়ে নেয় ব্যস্ত গৃহস্থ। নোংরা হাতে আনা খাবারের প্যাকেট সহ বেল-গ্রীল সব ভালো করে স্যানিটাইস ক’রে খেতে বসছে শহরগুলোর ১৫/২০ তলার অনেক বাসিন্দা। বাইক চালিয়ে আবার ছুট দিয়েছে ডেলিভারি বয়। পেটে নিয়ে খিদে, পিঠে নিয়ে খাবার – ১২/১৪ ঘন্টা রাস্তায় ঘুরেও ৫০০ টাকা আয় নেই। মনে পড়ছে ১৯৪৭ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য্য-র লেখা ছাড়পত্র গ্রন্থের রাণার কবিতার সেই পঙক্তি? পিঠেতে আছে যে টাকার বোঝা, তবু সে টাকা যে যাবে না ছোঁয়া। সেই রাণার আজও ছুটছে ক্ষুধায় ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে।

বিশ্বজুড়ে মুখগুলো সব একই

মিল পাচ্ছেন? স্পাইস, ফিসার, এঞ্জেলস, জামলা, ছবু, ডেলিভারি বয়………। শুধু ফ্রেমগুওলো সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায়। চেহারা একই। মিলছে না – সেই হে মার্কেট বিচার, হরিয়ানার সুজুকি মামলার বিচার? মিলছে না হার্লেম পয়েন্ট বা জাতীয় সড়কের ধারে পড়ে থাকা লাশের মুখ আর মুখোশের পেছনে লুকিয়ে রাখা শাসকের মুখগুলো?

স্পাইস-এঞ্জেলেসরা বলেছিলেন শুধু ৮ঘন্টা লড়াইয়ের দাবীর মধ্যেই শ্রমিকদের আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। প্রয়োজন যারা এই অমানবিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে, তাদের উচ্ছেদ করা। একমাত্র এর মধ্যে দিয়েই কেবল ৮ ঘন্টা কাজের দাবীই নয়, শ্রমিকদের জীবনের যাবতীয় দুর্দশার নিরসন করা সম্ভব।

এ যুগের স্পার্টাকাসদের লড়াই

সে লড়াই দীর্ঘস্থায়ী। সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে, এক এক করে দাবী ছিনিয়ে নিতে হয়। ছিনিয়ে আনা দাবীগুলো যাতে রক্ষা করা যায় তার লড়াই লড়তে হয়।

এই লড়াইতে স্পাইস, ফিশার, এঞ্জেলস, সুজুকির শ্রমিক নেতা, জামলা বা ছবুরা সাময়িকভাবে হারলেও, লড়াই থেমে যায় না। একটা হার আর এক একটা লড়াইয়ের ভিত্তিভূমি তৈরী করে। স্পার্টাকাসও সেই লড়াইতে জিততে পারে নি। কিন্তু যারা স্পার্টাকাসকে হারিয়েছিল, তারাও দাস সমাজব্যবস্থা হাজারো অত্যাচারেও টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ভেঙেছে, ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

এটাই কালের নিয়ম, ইতিহাস-সমাজ-অর্থনীতি এই নিয়মেই চলে। চাইলেও ইতিহাসের চাকা কেউ উল্টো পথে ঘোরাতে পারে না। হয়ত কিছু সময়ের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে পারে। এই অবশ্যম্ভাবী নিয়মকে ভরসা করেই বোধহয় রবি ঠাকুর বলেছিলেন – বিধির বাঁধন কাটবি তোরা কি এমন শক্তিমান!

শেয়ার করুন