Site icon CPI(M)

The last virtue of civilization – Samik Lahiri.

২৫ শে বৈশাখ ১৪১৯, (মঙ্গলবার)

“যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে,
ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,
কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।
মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভরতি করতে
বেরোল দলে দলে।
সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়”। (‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি’)
রবীন্দ্রনাথ, জাপানের চীন আক্রমণ নিয়ে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে লিখেছিলেন এই কবিতা। তার আগেই লিখেছিলেন – ‘জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি জাপানি সৈনিকরা যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধ-মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে; ভক্তির বাণ বুদ্ধকে’। (বুদ্ধভক্তি)।

১ম বিশ্বযুদ্ধ ও রবীন্দ্রনাথ
যুদ্ধ আর ফ্যাসীবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথের কলম ঝলসে উঠেছিল ১ম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই। ১৯১৪ সালে রাশিয়া-ফ্রান্স-জার্মানি-অস্ট্রিয়া-ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধের আবহে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের আশ্রম মন্দিরে সাপ্তাহিক উপাসনার দিন এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন—
“সমস্ত য়ুরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে। কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছিল! অনেক দিন থেকে আপনার মধ্যে আপনাকে যে মানুষ কঠিন করে বদ্ধ করেছে, আপনার জাতীয় অহমিকাকে প্রচণ্ড করে তুলেছে, তার সেই অবরুদ্ধতা আপনাকেই আপনি একদিন বিদীর্ণ করবেই করবে। …মানুষের এই-যে প্রচণ্ড শক্তি এ বিধাতার দান। তিনি মানুষকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছেন এবং দিয়ে বলে দিয়েছেন, যদি তুমি একে কল্যাণের পক্ষে ব্যবহার কর তবেই ভালো, আর যদি পাপের পক্ষে ব্যবহার কর তবে এ ব্রহ্মাস্ত্র তোমার নিজের বুকেই বাজবে। আজ মানুষ মানুষকে পীড়ন করবার জন্য নিজের এই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্রকে ব্যবহার করেছে; তাই সে ব্রহ্মাস্ত্র আজ তারই বুকে বেজেছে। মানুষের বক্ষ বিদীর্ণ করে আজ রক্তের ধারা পৃথিবীতে প্রবাহিত হয়ে চলবে– আজ কে মানুষকে বাঁচাবে! এই পাপ এই হিংসা মানুষকে আজ কী প্রচণ্ড মার মারবে– তাকে এর মার থেকে কে বাঁচাবে!” (পরে এই ভাষণটি ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায় ‘মা মা হিংসীঃ’ শিরোনামে ছাপা হয়।)

প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন –
“…পৃথিবীর ইতিহাসে সম্পূর্ণ একটা নূতন কান্ড ঘটিতেছে – তাহা এক দেশের উপর আর এক দেশের রাজত্ব এবং সেই দুই দেশ সমুদ্রের দুই পাড়ে। এত বড়ো বিপুল প্রভুত্ব জগতে আর কখনো ছিল না। য়ুরোপের সেই প্রভুত্বের ক্ষেত্র এশিয়া ও আফ্রিকা। এখন মুশকিল হইয়াছে জর্মানির। তার ঘুম ভাঙ্গিতে বিলম্ব হইয়াছিল। সে ভোজের শেষ বেলায় হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত।…
আজ ক্ষুধিত জর্মানির বুলি এই যে, প্রভু এবং দাস এই দুই জাতের মানুষ আছে। প্রভু সমস্ত আপনার জন্য লইবে, দাস সমস্তই প্রভুর জন্য জোগাইবে – যাহার জোর আছে সে রথ হাঁকাইবে, আর যাহার জোর নাই সে পথ ছাড়িয়া দিবে। য়ুরোপের বাহিরে যখন এই নীতির প্রচার হয় তখন য়ুরোপ ইহার কটুত্ব বুঝিতে পারে না। আজ তাহা নিজের গায়ে বাজিতেছে। (লড়াইয়ের মূল : রবীন্দ্ররচনাবলী’ ত্রয়োদশ খন্ড, সন ১৩২১/১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)

মুসোলিনি সম্পর্কে সাময়িক মোহ
১৯২২ সালে ইতালির ক্ষমতা দখলকারী ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি’র শাসন কার্যের প্রতি সাময়িক ভাবে হলেও আকর্ষিত হ’য়ে পড়েছিলেন কবি, ফ্যাসীবাদের প্রচার চাতুর্যে ।

১৯২৫ সালে ফিলসফিকাল সোসাইটি অব মিলানের আমন্ত্রণে ইতালি গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতালীয় অধ্যাপক, সংস্কৃত ভাষা ও ভারত বিশেষজ্ঞ কার্লো ফার্মিকি’র সাথে। মুসোলিনি সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় অধ্যাপক ফার্মিকি বিশ্বভারতী আসেন এবং একইভাবে রবীন্দ্রনাথ ৩০শে মে, ১৯২৬ রোমে যান। ৩১শে মে তিনি মুসোলিনির সাথে সাক্ষাৎ করেন। মুসোলিনির ব্যবহার ও কথায় কবি আপ্লুত হয়ে পড়েন। সাক্ষাৎকার শেষে রবীন্দ্রনাথ অধ্যাপক ফারমিকি-কে বলেন – “আমার কোনও সন্দেহ নেই যে উনি একজন অসাধারণ ব্যক্তি।”

এরপর নানা স্থানে কবি বক্তৃতা করেন এবং একটি সভায় মুসোলিনি উপস্থিতও ছিলেন। আসার আগে কবি অধ্যাপক বন্ধুকে বলেন – মুসোলিনি যতদিন আছেন, ইতালি নিরাপদ থাকবে। ফেরার আগের দিন অর্থাৎ ১৩ই জুন মুসোলিনির সাথে সাক্ষাতে কবি তাঁকে বলেন – আপনাকে নিয়েই পৃথিবীতে সব চাইতে বেশী কুৎসা রটনা করা হয়। উত্তরে মুসোলিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন – আমি জানি, কিন্তু আমি কি করতে পারি! মুসোলিনিকে নিজের হাতে স্বাক্ষর করা একটি ছবিও উপহার দিয়েছিলেন কবি।
ফ্যাসিস্ট সরকার তথা মুসোলিনির প্রতি সৌজন্য ও কৃতজ্ঞতাবশত এবং খানিকটা প্রতারণা ও বিভ্রান্তির শিকার হয়ে রবীন্দ্রনাথ ইতালি’র উদ্দেশ্যে যে সমস্ত প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, সেটা শতগুনে পল্লবিত ক’রে ইতালির ফ্যাসিস্ট সংবাদমাধ্যম এমন প্রচারের ঢক্কানিনাদ করেছিল যে, বিশ্ববাসীর মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ বোধহয় ফ্যাসিবাদের একজন প্রবল সমর্থক। কিন্তু বিশ্ব মানবতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও কবি মোটেই তা ছিলেন না।

মুসোলিনির ব্যঙ্গচিত্র – রবি ঠাকুর

কবির মোহভঙ্গ
এরপর কবি গিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু র‍্যঁমা র‍্যঁলা কাছে। তিনি কবিকে বিস্তারিতভাবে জানালেন ফ্যাসিস্টদের খুন-অত্যাচার-মত প্রকাশের অধিকার হরন ইত্যাদি বিষয়ে। কিন্তু কবির মত এসব শুনেও পাল্টায়নি। এরপর সর্বজন শ্রদ্ধেয় ম্যাত্তিওত্তির খুনের বিচারের প্রহসনের সত্যতা নির্ধারনের জন্য ম্যাত্তিওত্তির দেশান্তরী আইনজীবী মদগিয়ালনির স্ত্রীর সাথে দেখা করাবার জন্য কবিকে জুরিখে নিয়ে যান তাঁরা। সেখানে মদগিলিয়ানির সাথেও সাক্ষাৎ হয় কবির। এরপর ভিয়েনাতে তাঁর সাথে দেখা হয় অ্যাঞ্জেলা বালবানাফের। তাঁর কাছেও ফ্যাসিস্টদের অত্যাচারের কাহিনী শুনে, রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালের ৫ই আগষ্ট, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি চিঠি লেখেন এবং ফ্যাসিবাদ সর্ম্পকে তাঁর মোহভঙ্গের কথা তিনি ব্যক্ত করেন। এর ফলশ্রুতিতে ক্ষিপ্ত মুসোলিনির ভাই ওদের দলের মুখপত্র পোপোলো, ‘দ্য ইতালিয়ার’ পত্রিকায় কবিকে কুৎসিত নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেন। তবে কবিকে এই কদর্য আক্রমণ বিচলিত করতে পারেনি।
পরবর্তীতে আইনস্টাইন, র‍্যঁমা রঁল্যা এবং ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক অঁরি বারব্যুঁস-এর সভাপতিত্বে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী অধিবেশন। এখানকার গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী ‘স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রে’ প্রথম এশীয় যিনি সই করেন, তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৯৩৭ সালে রোমা র্যঁলা ও বারব্যুঁস এর নেতৃত্বে পৃথিবী জুড়ে গঠিত হয় ‘লীগ এগেনস্ট ফ্যাসিসম অ্যান্ড টেরর’। তার ভারতীয় শাখার সভাপতি হন কবি। ফ্যাসিস্ট শাসকবৃন্দ স্পেনীয় ফ্রাঙ্কো, জার্মানীর হিটলার, ইতালির মুসোলিনি আর জাপানের তোজোর বিরুদ্ধে বারবার ঝলসে উঠেছে কবির কলম। আমৃত্যু তিনি ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর মত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন।

ফ্যাসিস্টদের প্রচার কৌশল ও বাক চাতুর্যে অনেক বিদ্বান মানুষও সাময়িকভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন নানান সময়ে। ধীরে ধীরে সত্য উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের দেশে এখন তাই হচ্ছে। তবে শুভ বুদ্ধির উদয় হবেই দ্রুত। অসত্যের উপর কোনকিছুই বেশী দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।

রবীন্দ্রনাথ ও র‍্যঁমা র‍্যঁলা

ফ্যাসিবাদের স্বরূপ উন্মোচনে কবি
মুসোলিনির স্বরূপ কবির সামনে উদ্ঘাটিত হওয়ার পর কবি তাঁর একটি ব্যাঙ্গচিত্র আঁকেন। তিনি আরও লিখলেন – “ইতালির বর্তমান সমৃদ্ধিকে মানিয়া লইয়াও যদি দেখা যায় উহা অর্জনের জন্য যে-পন্থা ও প্রক্রিয়া অনুসৃত হইয়াছে তা নীতিবিবর্জিত এবং ধরিত্রীর অবশিষ্টাংশের পক্ষে বিপদস্বরূপ, তবে তাহাকে বিচার করিবার অধিকার আমাদের অবশ্যই আছে। গভর্নমেন্টের বাক-স্বাধীনতা অপহরণের কুৎসিৎ অপরাধ এবং বিশ্বশান্তির পক্ষে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী উচ্চাকাঙ্ক্ষায় আমি উহারই প্রকাশ উপলব্ধি করিয়াছি”। (দ্য স্টার’, লন্ডন, ৫ আগস্ট ১৯২৬)
ফ্যাসিবাদের উত্থানে উদ্বিগ্ন হয়ে বন্ধু চার্লস ফ্রেয়ার এন্ড্রুজকে ১৯২৬ সালের ৫ই আগস্ট তিনি এক চিঠিতে লিখেছিলেন-
“ফ্যাসিবাদের কর্মপদ্ধতি ও নীতি সমগ্র মানবজাতির উদ্বেগের বিষয়। যে আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করে, বিবেক-বিরোধী কাজ করতে মানুষকে বাধ্য করে এবং হিংস্র রক্তাক্ত পথে চলে বা গোপনে অপরাধ সংঘটিত করে – সে আন্দোলনকে আমি সমর্থন করতে পারি এমন উদ্ভট চিন্তা আসার কোনো কারণ নেই। আমি বারবারই বলেছি পশ্চিমের রাষ্ট্রগুলি সযত্নে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব লালন-পালন করে সারা পৃথিবীর সামনে ভয়াবহ বিপদের সৃষ্টি করেছে।“ (ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’, লন্ডন, ৫ আগস্ট ১৯২৬)
১৯২৭ সালের ১০-১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলস শহরে অনুষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের পক্ষ থেকে অঁরি বারব্যুঁস রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লেখেন ‘মুক্ত চেতনার প্রতি আবেদন’-এ স্বাক্ষরদানের জন্য। আবেদনে বলা হয়েছিল –
“…আমরা সর্বত্র লক্ষ্য করছি যে ফ্যাসিবাদের নামে, স্বাধীনতার সমুদয় বিজয়কে হয় ধ্বংস নতুবা বিপদাপন্ন করা হচ্ছে। সংগঠন গড়ার অধিকার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ ও বিবেকের স্বাধীনতা – যাহা শত শত বৎসরের আত্মত্যাগ ও আয়াসে অর্জিত হয়েছে – আজ সেই পথকে নিষ্ঠুরভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। প্রগতির এই দেউলিয়া অবস্থায় আমরা আর নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকিতে পারি না।“
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সেই আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে রবীন্দ্রনাথ অঁরি বারব্যুঁসকে একটি সুন্দর উত্তর দেন – “বলাই বাহুল্য যে আপনার আবেদনের প্রতি আমার সহানুভূতি আছে। আমি স্পষ্ট বুঝছি এই আবেদন আরও অসংখ্যের কণ্ঠ ধ্বনিত করছে – সভ্যতার অন্তঃস্থল থেকে হিংসার আকস্মিক বিস্ফোরণে যাঁরা বিষন্ন।…” (বিশ্বভারতী কোয়ার্টার্লি’, শান্তিনিকেতন, জুলাই ১৯২৭)

অঁরি

ইতালির আবিসিনিয়া আক্রমণের প্রেক্ষিতেই তিনি লিখেছিলেন ‘আফ্রিকা’ কবিতা।
“আজ যখন পশ্চিম দিগন্তে
প্রদোষকাল ঝঞ্ঝাবাতাসে রুদ্ধশ্বাস,
যখন গুপ্ত গহ্বর থেকে পশুরা বেরিয়ে এল
অশুভ ধ্বনিতে ঘোষণা করল দিনের অন্তিমকাল,
এসো যুগান্তের কবি,
আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে
দাঁড়াও, ওই মানহারা মানবীর দ্বারে;
বলো ‘ক্ষমা করো’_
হিংস্র প্রলাপের মধ্যে
সেই হোক তোমার সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী।”
পঁচাত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথও স্পেনে ফ্যাসিস্ট শাসক ফ্রান্সিস্কো ফ্রাঙ্কো আই বাহমনডে’র অত্যাচারের ঘটনায় নীরব ছিলেন না। স্পেন উঠে এসেছিল তাঁর কলমে –
“যুদ্ধ লাগল স্পেনে ;
চলছে দারুণ ভ্রাতৃহত্যা শতঘ্নীবাণ হেনে।
সংবাদ তার মুখর হল দেশ-মহাদেশ জুড়ে
সংবাদ তার বেড়ায় উড়ে উড়ে
দিকে দিকে যন্ত্রগরুড়রথে
উদয়রবির পথ পেরিয়ে অস্তরবির পথে।” (‘চলতি ছবি’, সেঁজুতি কাব্যগ্রন্থ, ১৯৩৭/৩৮ইংরাজী)

চার্লস ফ্রেয়ার এন্ড্রুজ

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কবির ধিক্কার
জাপানের প্রতি কবির আকর্ষণ ছিল প্রবল, বিশেষত ওকাকুরার জন্যই। কিন্তু জাপানের জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের মতবাদের প্রবল সমালোচক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। জাপান ভ্রমণকালে সে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই উগ্র জাতীয়তাবাদের সমালোচনা করতে কুন্ঠ্যাবোধ করেন নি তিনি। এই কারণে সফর শেষে তাঁর বিদায়কালে উপস্থিত হয়েছিল হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র।
১৯৩৭ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জাপান কতৃক চীনের নানকিং দখলের পর, ২৫শে ডিসেম্বর তিনি লিখেছিলেন,
“… মহাকাল সিংহাসনে –
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কন্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী
কুৎসিত বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন
নিত্যকাল রবে যা স্পন্দিত লজ্জাতুর ঐতিহ্যের
হৃৎস্পন্দনে, রুদ্ধ কন্ঠ ভয়ার্ত এ শৃঙ্খলিত যুগ যবে
নিঃশব্দে প্রচ্ছন্ন হবে আপন চিতার ভস্মতলে।” (‘যেদিন চৈতন্য মোর’)

প্রতিবাদী কবির কলম
কবি কেবলমাত্র আক্রমণকারী ফ্যাসিবাদের নিন্দার মধ্যেই তাঁর কথা সীমিত রাখেন নি। তিনি তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়েছিলেন “লীগ অব নেশনস” উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয়তাকেও। কবি ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতাতে লিখলেন –
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে।“
কবি একই সাথে ঐ কবিতায় সবার বিবেকের কাছে আবেদন রেখেছিলেন –
“ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে। যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খরখড়্গসম
তোমার ইঙ্গিতে। যেন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্হান।“

দানবের সাথে সংগ্রামের আহ্বান
ফ্যাসিস্টদের বর্বরোচিত আচরণের উপযুক্ত একমাত্র জবাব যে পাল্টা আক্রমণ, তা ব্যক্ত করতে কবির মনে কোনও দ্বিধা ছিলনা। ১৯৩৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি লেখেন –
“নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।” (‘প্রান্তিক’)
অস্ট্রিয়া দখলের পর হিটলারের চোখ পড়ে চেকোস্লোভাকিয়ার ওপর। হিটলার মুসোলিনির আঁতাতে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছিল ফ্যাসিস্টরা। এরই মাঝে আসে ২৫শে বৈশাখ, কবির ৭৮তম জন্মদিন। ফ্যাসিবাদের চরম পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা জানিয়ে তিনি লেখেন ‘জন্মদিন’ কবিতাটি –
“ক্ষুব্ধ যারা, লুব্ধ যারা,
মাংসগন্ধ মুগ্ধ যাঁরা, একান্ত আত্মার দৃষ্টিহারা
শ্মশানের প্রান্তচর, আবর্জনাকুণ্ড তব ঘেরি
বীভৎস চিৎকারে তাঁরা রাত্রিদিন করে ফেরাফিরি,
নির্লজ্জ হিংসায় করে হানাহানি।
শুনি তাই আজি
মানুষ-জন্তুর হুংকার দিকে দিকে উঠে বাজি।”

ফ্যাসিবাদের ধংস – কবির স্বপ্ন
জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হ’য়েও ২য় বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কবির উদ্বেগ ছিল গভীর। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন –
“১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। কবি মৃত্যুশয্যায়। তবু উদ্বিগ্ন হয়ে বার বার জানতে চাইছেন, প্রশান্ত মহলানবিশের কাছে – ‘কী পরিস্থিতি রণাঙ্গণের? প্রশান্ত মহলানবিশ জানান, ‘এখনো এগিয়ে চলেছে দস্যু বাহিনী,’ কবি ডুবে যান নীরব বিষণ্ণতায়।…অবশেষে শেষবারের জন্য সংজ্ঞা এলো কবির। চোখে একই স্বপ্ন। কিন্তু প্রশান্ত মহলানবিশের উত্তর এবার ভিন্ন। ‘সোভিয়েত বাহিনী প্রতিরোধ করেছে।’ রবীন্দ্রনাথ উৎসাহে অধীর হয়ে উঠেন, বলেন, ‘পারবে, দানবকে ঠেকাতে ওরাই পারবে।”

শেয়ার করুন