Site icon CPI(M)

Ten Days that has shaken France

সুমনা সিনহা

গত কয়েক বছর ধরে যা আশঙ্কা করছিলাম আমরা, এই ৯ জুন তা বাস্তবে পরিণত হলো। নাৎসি জার্মানির তরুণ নিওফ্যাসিস্টদের দ্বারা পরিচালিত “নিউ অর্ডার” আন্দোলনে অনুপ্রাণিত, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত চরম দক্ষিণপন্থী দল, পূর্বতন ফ্রঁ নাসিয়নাল (FN)-এর কাস্টমাইজড সংস্করণ রাসম্বলমঁ নাসিয়নাল (RN) ৩১.৩৭% ভোট পেয়ে শীর্ষস্থানে আসলো ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে। যদিও প্রাক-নির্বাচনী অনুমানগুলি এই রকম ফলাফল-ই দেখিয়েছিল, তবুও সবার রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলো, কারণ ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করার জন্য শেষমুহুর্ত পর্যন্ত আমরা মরিয়া হয়ে আশা করছিলাম। কিন্তু তখন দুঃস্বপ্নের সবে শুরু। এই ফলাফল ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেন। এইভাবে একদিকে চাপিয়ে দিলেন দু-রাউন্ডের হঠকারী, প্রস্তুতিহীন অ্যাসেম্বলি নির্বাচন : ৩০ জুন প্রথম রাউন্ড এবং ৭ জুলাই দ্বিতীয় রাউন্ড; আর একই সঙ্গে ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্যবিজয়ে আস্ফালনকরা চরম দক্ষিণপন্থী দল RN-কে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি জয়ের এক খোলাখুলি সুযোগ করে দিলেন।

অসহনীয় উদ্বেগ, আতঙ্ক বর্ণনা করার আগে, পরবর্তী দিনের ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলন বর্ণনা করার আগে, বলা প্রয়োজন “আমরা” কারা, আর কেনই বা RN-কে নিয়ে এত আতংকিত। “আমরা” হলাম ফ্রান্সের মানুষ, নাগরিক এবং বাসিন্দা; বিভিন্ন জাতির – উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত এবং অন্যান্য প্রাচ্য দেশগুলি থেকে, মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে আসা, বিশেষত অ-শ্বেতাঙ্গ মানুষ। “আমরা” হলাম শ্রমিক, চাকুরীজীবি, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক, ক্রীড়াবিদ, শহর, শহরতলী আর গ্রাম থেকে আসা, স্থানান্তরিত কারখানার শ্রমিক, খামার, ধসে পড়া হাসপাতাল আর স্কুল থেকে আসা। “আমরা” হলাম খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু, শিখ, নাস্তিক, আর বিশেষত ইহুদি আর মুসলমান। “আমরা” হলাম পুরুষ, নারী, যুবক, বৃদ্ধ, নারীবাদী, মানবতাবাদী, মুক্ত বিশ্বের মানুষ। “আমরা” মানে বাম দলগুলির নেতা এবং কর্মীরা : সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট, পরিবেশপন্থী এবং মূলত ” অ্যাঁসুমি ” – মানে “বিদ্রোহী”, প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক পার্টি থেকে ভেঙে আসা, জঁ-লুক মেলোঁশঁর প্রতিষ্ঠিত এবং নেতৃত্বের একটি দল ।

“আমরা” ছিলাম আরএন/এফএন-এর টার্গেট, এক দিকে জাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা, আর অন্যদিকে তাদের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিদ্বেষ ভাষণ আর হুমকি। এর ওপর আবার ছিল GUD – গ্রুপ ইউনিয়ন ডিফেন্স – ফ্যাসিস্ট ছাত্র মিলিশিয়া, যারা ১৯৭০ সাল থেকে সক্রিয়, অত্যন্ত হিংস্র, অশ্বেতাঙ্গ, সমকামী, নারীবাদী, বামপন্থী কর্মীদের আক্রমণ ও এমনকি হত্যা করতেও সক্ষম। আমাদের লড়াই ছিল এক বর্ণবিদ্বেসী ফ্যাসিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে যার এজেন্ডা হলো জাতিগত নির্মূলীকরণ।

অবস্থা জটিল হয়ে গেল খুব শীঘ্রই। প্রথমত, গাজায় গণহত্যার পর থেকে, জঁ-লুক মেলোঁশঁ এবং “অ্যাঁসুমি” পার্টির নেতা-কর্মীরা ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহু এবং তার চরম দক্ষিণপন্থী দলের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানান। যাকে কেন্দ্র করে ফরাসি ইহুদি সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক ইহুদি বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ আরএন/এফএন-এর গণহত্যা এবং জাতিনির্মূলীকরণ ইতিহাস ও চরিত্র ভুলে গেলেন বা ইচ্ছে করে ভুলে গেলেন এবং বাম দল “অ্যাঁসুমি” এর বিরুদ্ধে চলে গেলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনকি আরএন/এফএন-কে খোলাখুলি সমর্থনও করলেন।

দ্বিতীয়ত, গুজব ছিল যে রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আরএন/এফএন নেতা জর্দান বারদেলা-কে চেয়েছিলেন। প্রাক্তন ফাইনান্স সেক্টরের কর্মী, রোচিল্ড অ্যান্ড কোম্পানি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং পার্টনার – ভারতের আদানি-আম্বানীদের চাটুকার সমতুল্য – এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কখনোই আমাদের আস্থা অর্জন করেননি৷ যখন তিনি তার রাজনৈতিক দল – পূর্বতন “য়ঁ মার্শ”, এখন “রনেশঁস” গঠন করেন, তখন তিনি তাঁর রাজনৈতিক পথ ঘোষণা করেন : ” বামও নয়, ডানও নয় “, যা সময়ের সাথে সাথে কঠোর দক্ষিণপন্থী এবং তীব্রভাবে বাম-বিরোধী বলে প্রকাশ পায়। তিনি জনগণের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তোলেন, ফলে জনগণের ক্ষোভ ও বিদ্রোহকে আরও বাড়তে থাকে। ম্যাক্রোঁ একের পর এক জনবিরোধী অর্থনৈতিক নীতি মানুষের ওপর চাপিয়ে দেন, যেমন অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৬৪ বছর করা, কোটিপতিদের স্বার্থে সম্পদ-কর বাতিল, সরকারি পরিষেবা এবং সংবাদব্যবস্থার বেসরকারীকরণ, সরকারী উদ্যোগ ধ্বংস, স্কুল, হাসপাতাল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলির জন্য বরাদ্দ ছাঁটাই, ফ্রান্সে অভিবাসনকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে অভিবাসন আইন বাস্তবায়ন ইত্যাদি। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর শাসনকালে সাংবাদিকদের বরখাস্ত করা হয়, প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে মারধর চালায়, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, নারীবাদীদের পদদলিত করে, মেরে পিটিয়ে অন্ধ পর্যন্ত করে দেওয়া হয়। বহুবার, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এবং প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে, রাষ্ট্রপতি ম্যাক্রোঁ এবং তার দলের সদস্যরা প্রকাশ্যে আরএন/এফএন সহ অন্যান্য চরম দক্ষিণপন্থী দল এবং নেতাদের সাথে তাঁদের সখ্যতা দেখিয়েছেন, মৌখিকভাবে বাম দলের নেতাকর্মীদের আক্রমণ করেছেন। ২০২৩ সালের বাস্তিল দিবসে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর প্রধান অতিথি হিসাবে কত আন্তরিকতার সাথে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং লেজিওঁ দ্যনর দিয়ে সম্মানিত করেছিলেন, তা আমরা ভুলিনি। স্পষ্টতই, বহু বছর ধরে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ একদিকে পুঁজিবাদীদের চুম্বন করছেন এবং অন্যদিকে ফ্যাসিস্টদের সামনে মাথা নত করছেন। অন্তিম অবস্থায় পুঁজিবাদের প্রয়োজন হয় ফ্যাসিবাদকে এবং ফ্যাসিবাদের পুঁজিবাদকে।

তৃতীয়ত, এই পুরোপুরি সুবিধাবাদী পরিস্থিতিতে, বহুজাতিক কোম্পানির মালিক কোটিপতি ভ্যাঁসঁ বোলোরে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন এবং রেডিও নিউজ চ্যানেল এবং সংবাদপত্র দখল করে বসে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে CNews, C8-এর মতো টিভি চ্যানেল বর্ণবিদ্বেষী, মুসলিম-বিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী, অভিবাসন-বিরোধী, বাম-বিরোধী বিদ্বেষী বক্তব্য, নিছক মিথ্যা এবং মানহানিকর আক্রমণের এবং চব্বিশ ঘন্টা ব্যাপী প্রচারের মুখপাত্র হয়ে উঠে। আশ্চর্যের কিছু নেই যে প্রাক্তন আরএন পার্টির সদস্য, প্রচারাভিযান ম্যানেজার, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরই এই টিভি শোতে কৌশলগতভাবে নির্বাচিত করা হয় এবং তারাই তথাকথিত সাংবাদিক হয়ে ওঠে। ক্রমাগত বর্ণবিদ্বেষী প্রচারের বিধ্বংসী পরিণতি ফ্রান্সে আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে ফেলেছে। প্রতিবেশী, পথচারী, দোকানদার, অফিসের কর্মী – আমরা যাদের চিনি এবং যাদেরকে আমরা চিনি না, তাঁদের অনেকেই এখন বর্ণবিদ্বেষী গালিগালাজ দিতে আর লজ্জাবোধ করেন না। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ছোট শহর এবং গ্রাম যেগুলি একবারেই “সাদা” বা “নেটিভ ফ্রেঞ্চ” অধ্যুষিত, যেখানে কোনও অ-শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির উপস্থিতি নেই, সেখানেও তাঁদের অনেকেই আরও বেশি বর্ণবাদী ঘৃণা প্রদর্শন করছে, বা বরং অ-শ্বেতাঙ্গদের প্রতি তাদের ভয় এবং বিতৃষ্ণার একটি কল্পনাপ্রসূত বিদ্বেষ পোষণ করছেন। প্যারিস এবং অন্যান্য বড় শহরগুলির বহুসাংস্কৃতিক সামাজিক কাঠামোর বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, টিভি চ্যানেলগুলিতে অবিরাম বর্ণবিদ্বেষী প্রচার চলেছে। প্রায়শই অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত, ধসে যাওয়া শিল্পব্যবস্থা এবং গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী, যাদের মধ্যে আবার অনেকেই আবার কমিউনিস্ট পার্টির পূর্বতন সমর্থক কিন্তু এখন ‘মোহভঙ্গ’ ঘটেছে, বড় অংশের শ্বেতাঙ্গ নেটিভ ফরাসী উগ্র জাতীয়তাবাদী, এই সব অংশের মানুষ বিশেষত যারা উদার অর্থনীতির কারণে বিপন্নতার মুখে – এরাই হল আরএন-এর নির্বাচনী সমর্থনের ভিত্তি। অর্থনৈতিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো ক্ষেত্রেই যেকোনও প্রগতিশীল সাফল্যকেই এরা প্রত্যাখ্যান করে।

ইউরোপীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের বিজয়ের পর থেকে, আরএন/এফএন তাদের দলের সভাপতি, ২৮ বছরের জর্দান বারদেলা-কে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রার্থী হিসাবে উপস্থিত করে। দলটির ফ্যাসিবাদী চরিত্র গোপন করে, মিডিয়ার ভাল অনুগ্রহ লাভ করেছে এবং মিডিয়াই তাদের কালিমা ধুয়ে দিয়েছে।

৯ জুন সন্ধ্যায়, নাগরিক এবং কর্মীরা, “আমরা” সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের উদ্বেগের সাথে সাথে ফ্যাসিবাদী দানবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের সংকল্প প্রকাশ করতে শুরু করি। প্রথমবার “গণ ফ্রন্ট” শব্দটি ব্যবহার করার পর ১০ জুন, বিভিন্ন বাম দলের নির্বাচিত অ্যাসেম্বলি সদস্যরা একটি ‘অনলাইন পিটিশন’ প্রকাশ করেন, যেখানে সব বামপন্থী দলগুলোর নেতাদের কাছে একটি বামফ্রন্ট গঠনের আবেদন জানানো হয়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পিটিশনটিতে কয়েক লক্ষ মানুষ স্বাক্ষর করে। এর সমান্তরালভাবে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে ৩৫০ জন বিখ্যাত ব্যক্তি, যেমন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এস্তের দুফ্লো, নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক অ্যানি এর্নো, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি বামফ্রন্ট গঠনের আবেদন জানিয়ে “ল্য মঁদ” পত্রিকায় একটি লেখা প্রকাশ করেন। পাঁচটি বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন : CGT, CFDT এবং অন্যান্যরাও যৌথভাবে একই আহ্বান জানায়। ১০ জুন সন্ধ্যায় “অ্যাঁসুমি”, গ্রিন পার্টি, সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী নেতারা – এবং অন্য তিনটি বামপন্থী দল জোট গঠন করে, যার নাম দেওয়া হয় “নব গণ মোর্চা / নিউ পপুলার ফ্রন্ট”। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, ম্যাক্রোঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতির পাল্টা নতুন নীতি প্রস্তাব করা হয়। জননেতা জিন জঁ-লুক মেলোঁশঁ, পরবর্তী প্রজন্মের নেতা ক্লেমঁস গেতে, মারিন তন্দলিয়ে, মানুয়েল বম্পার, এবং আরও অনেকে, সারা দেশজুড়ে জনসভায় বক্তৃতা দিতে দিনরাত পরিশ্রম করেন। টিভি চ্যানেল এবং রেডিও চ্যানেলে বিতর্ক করেন, বামফ্রন্টের কর্মসূচির বিস্তারিত বর্ণনা দেন : ন্যূনতম মজুরি ১৬০০ ইউরো-তে বৃদ্ধি, অবসরের বয়স ৬০ বছর, কোটিপতিদের উপর সম্পদ কর, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের স্থির মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিকায়েল জেমুর সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিতভাবে পোস্ট করে এই কর্মসূচিগুলির বিশ্লেষণ এবং সমর্থন করেন। উল্লেখ করতে হয় মানেস নাদেল, মাত্র ১৭ বছর বয়সী একজন স্কুল ছাত্র এবং বামপন্থী দলের তরুণ নেতা, নতুন প্রজন্মের আশা এবং সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে ওঠে। বামপন্থী সংবাদপত্র লিউমানিতে আমন্ত্রিত হয়ে আমিও একটি লেখা দিই।

নেতা, কর্মী, সাধারণ মানুষ – আমরা যারা সকলেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারে যুক্ত থাকি, আমরা কেবল বামফ্রন্টের পক্ষে প্রচারেই সীমাবদ্ধ ছিলাম না, আমাদের প্রতিদিন চরম দক্ষিণপন্থী মানহানিকর প্রচার, হুমকি, বর্ণবিদ্বেষী অপমানের মোকাবিলা অনলাইনে এবং রাস্তায়ঘাটে করতে হয়েছে। প্রচারাভিযানের সময় বেশ কিছু বাম কর্মীকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল, বিশেষত উত্তর আফ্রিকান এবং দক্ষিণ আফ্রিকান বংশোদ্ভূত বেশ কিছু ফরাসি নাগরিককে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

২০২৪ সালের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে প্রথম রাউন্ডে ভোট পড়েছিল ৫৯.৩৯ শতাংশ। ২০২২ সালে এর হার ছিল ৩৯.৪২ শতাংশ। প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনের ফলাফল তখন বিপর্যয়কর হয়েছিল। আরএন/এফএন ২৯.২৬% – ৩৭টি আসন, “নব গণ মোর্চা/নিউ পপুলার ফ্রন্ট” ২৮.০৬% – ৩২টি আসন, রাষ্ট্রপতির দলের জোট ২০.০৪% – ২টি আসন পেয়েছিল। বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী, কেন্দ্রীয় এবং বাম দলগুলি নগণ্য সংখ্যক ভোট পায়।

সুতরাং, আরএন/এফএন সরকার গঠনের ঝুঁকি তখনও ছিল। কোনও মূলধারার মিডিয়া কখনও বামফ্রন্টকে প্রচারের কোনও সুযোগ দেয়নি। বোলোরে মিডিয়া বাম নেতাদের এবং তাদের কর্মসূচীকে হেয় করার জন্য ওভারটাইম কাজ করছিল, প্রতিটি টিভি বিতর্কসভা হয়রানি এবং আগ্রাসনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু প্রতিরোধ চলে। দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস্য এক যোগসেতু তৈরী হয় এবং সাধারণ মানুষ সক্রিয় হয়ে ওঠে। মিডিয়াপার্ট, ব্লাস্ট, ও-পোস্ত-র মতো স্বাধীন মিডিয়াগুলি তথ্য, বিশ্লেষণ এবং চরম দক্ষিণপন্থী প্রচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সোশ্যাল মিডিয়া তাকে আরও ছড়িয়ে দেয় এবং প্রতিরোধের প্রসারিত শক্তি দর্শনীয় হয়ে ওঠে।

জর্দান বারদেলা ভাল আচরণ বজায় রেখেছিলেন, কিন্তু তার পার্টির কর্মসূচী উপস্থাপনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন, কারণ তেমন কোনও কর্মসূচীই ছিল না। কয়েক ডজন আরএন/এফএন প্রার্থী তাদের অসংলগ্ন উত্তরের কারণে নিছক হাসির পাত্রে পরিণত হয়। নাৎসি ক্যাপ দিয়ে নিজেদের জাহির করে, অথবা “আরব” এবং “কৃষ্ণাঙ্গদের” হত্যা করার আহ্বান জানিয়ে তাদের নাৎসি ঘনিষ্ঠতাই প্রকাশ করে। এই ঘটনাগুলি আঞ্চলিক টিভি চ্যানেলগুলি প্রকাশ ও প্রচার করে। ৷

২য় রাউন্ডের নির্বাচনের ছয় দিন আগে, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর দল এবং বামফ্রন্টের মধ্যে এক বড় জোট গঠিত হয়েছিল, তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে৷ ম্যাক্রোঁ নিজেও “আরএন নয়, বামফ্রন্ট-ও নয়” – এই পথ নেন৷ এক সপ্তাহেরও কম সময় ধরে, অনলাইনে এবং রাস্তায়, ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে মানুষ গণআন্দোলনে সামিল ছিল। কবিতা, গান, পেইন্টিং, ট্যাগ দিনরাত্রি েই আন্দোলনকে মাতিয়ে দিয়েছিল, সেই সঙ্গে ছিল বামফ্রন্ট নেতাদের বিদগ্ধ বক্তৃতা।

রবিবার ৭ জুলাই, বিধানসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণের হার ছিল ৫৯.৭১%। ফলাফলের সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী, এক্সিট পোল এবং শেষ মুহূর্তের আরএন/ এফএন প্রচারকে হারিয়ে “নিউ পপুলার ফ্রন্ট” ১৮২ টি আসন, রাষ্ট্রপতির দল ১৬৮ টি আসন এবং আরএন/এফএন ১৪৩ টি আসন পায়।

কোনও দলই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায়, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন হল : এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ কি জনগণের মতামতকে সম্মান জানাতে, “নিউ পপুলার ফ্রন্টে”র বিজয় এবং তাদের প্রস্তাবিত প্রধানমন্ত্রীকে মেনে নিতে যথেষ্ট মর্যাদাবান হবেন?

সংগ্রাম শেষ হয়নি, অনেক পথ বাকি। তবে এই বিজয়ের স্বাদ হল জীবনের স্বাদ, এ হল স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্বের জয়।

লেখিকার জন্ম কলকাতায়। বর্তমানে ফ্রান্সের নাগরিক। প্রখ্যাত গালিমার প্রকাশনার সাথে যুক্ত এবং ফরাসি একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরাসি ভাষার লেখিকা।

১৭ জুলাই, ২০২৪, গনশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত।

শেয়ার করুন