Site icon CPI(M)

Surya Sen: The Man, The Leader

চন্দন দাস

একই সময়ে সূর্য সেন এবং সাভারকার মহারাষ্ট্রে ছিলেন। রত্নগিরিতে। ১৯২৭-’২৮-এ।

নাগপুরে আওরঙ্গজেবের কবর নিয়ে যখন সঙ্ঘ উত্তেজনা ছড়াচ্ছে হিসাব করে, তখন রত্নগিরিতে জীবন্ত মাস্টারদা এবং সাভারকারের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিশেষত মাস্টারদার জন্মদিনে। ১৮৯৪-এর ২২মার্চ চট্টগ্রামের রাউজানের নয়াপাড়ায় তাঁর জন্ম।

সূর্য সেন ধরা পড়েছিলেন কলকাতার রাজপথে, ১৯২৬-এর ৮ই নভেম্বর। অপরাধ — রাষ্ট্রদ্রোহ। প্রথমে তাঁকে রাখা হয়েছিল মেদিনীপুর জেলে। সেখান থেকে রত্নগিরি জেলে। রত্নগিরিতে মাস্টারদা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের প্রাথমিক পরিকল্পনা করেছিলেন।

সেই রত্নগিরিতেই নাথুরাম গডসের সঙ্গে প্রথম আলাপ সাভারকারের। যা স্বাধীন ভারতের প্রথম সংগঠিত অপরাধের একটি টার্নিং পয়েন্ট। রত্নগিরিতে থাকাকালীনই ১৯২৩-এ ‘বীর’ সাভারকার লিখে ফেলেছিলেন সেই বইটি, যার ভিত্তিতে স্বাধীনোত্তর ভারতে গুজরাটে দাঙ্গা কিংবা অনেকগুলি ‘সম্ভল’ তৈরি হয়েছে, হচ্ছে — ‘হিন্দুত্ব: হু ইজ এ হিন্দু’।

অন্যদিকে ১৯২৮-এ জেলমুক্ত হয়ে মাস্টারদা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সংগ্রামে, মূলত সাংগঠনিক কাজে। তারপর? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে সংগঠিত সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটেছিল সেই খর্বকায়, দুটি উজ্বল, তীক্ষ্ণ চোখ ছাড়া আপাত বৈশিষ্ট্যহীন মানুষটির নেতৃত্বে।

সাভারকারও খর্বকায় ছিলেন। তিনিও আপাত বৈশিষ্ট্যহীন। ১৯২১ থেকে তিনি মহারাষ্ট্রের সেই জেলার দুটি জেলে তিন বছর ছিলেন। ১৯২৪-এর ৬ই জানুয়ারি পর রত্নগিরি জেলাতে তিনি অন্তরীণ ছিলেন। তাঁকে জেলের বাইরে রাখা ব্রিটিশ-শাসনের পক্ষে ‘বিপজ্জনক’ ছিল না। কারণ, ১৯২৪-এ তিনি আর একটি মুচলেকা দিয়েছিলেন। তার আগে আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকাকালীন বিনায়ক দামোদর সাভারকার চার বার মুচলেকা লিখেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে। তাই ১৯২১-এ তাকে ভারতের মূল ভূখন্ডে রত্নগিরি জেলে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সেই জেলারই ইয়েরভেদা জেলে। সেই জেলে বসে আবার তিনি  ব্রিটিশ শাসকদের মুচলেকায় লেখেন,‘‘আমি এই মর্মে স্বীকার করছি যে, আমার বিচার সঠিক এবং শাস্তিও ছিল যথাযথ। আমি অতীতে যে হিংসার পথ গ্রহণ করেছিলাম, সেটি আন্তরিকভাবে ঘৃণায় পরিহার করছি এবং সর্বশক্তিতে আইন এবং সংবিধানকে সমর্থন করার কর্তব্যের দায়বদ্ধতা আমি অনুভব করছি এবং ভবিষ্যতে আমাকে যতদূর অনুমতি দেওয়া হবে ততদূর পর্যন্ত সংস্কারকে সফল করতে তুলতে আমি ইচ্ছুক।’’ তাই ইয়েরভাদা জেল থেকে বেরিয়ে রত্নগিরি জেলার মধ্যে থাকার অনুমতি পেয়েছিলেন।

রত্নগিরি জেলে যাওয়ার পথে মাস্টারদার সঙ্গী ছিলেন অনুশীলন সমিতির নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। মাস্টারদা ছিলেন যুগান্তর গোষ্ঠীর ঘনিষ্ট। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট হয়ে ওঠা নিরঞ্জন সেনগুপ্তর বর্ণনায় আছে,‘‘মাস্টারদা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির বটে, কিন্তু দরকার হলে সব ক্ষেত্রেই যে তিনি ইস্পাতের মত কঠিন হতে পারেন তার পরিচয় আমি আগেও পেয়েছি। তবে সবচেয়ে বড় কথা, এ ধরণের দলাদলি তাঁকে স্পর্শ করতে পারত না।’’ মূল লক্ষ্যের সামনে কোনও দলাদলি মাস্টারদা বরদাস্ত করতেন না। কংগ্রেসের চট্টগ্রামের সম্মেলনে একদল পদলোভীর ছোঁড়া চেয়ারের আঘাতে মাস্টারদার মাথা ফেটে গেছে। রক্ত ঝরছে। অনন্ত সিংহ সহ কয়েকজন বদলা নিতে পালটা মারমুখী। আটকালেন সূর্য সেন। কেন? তিনি এই বদলার বিরোধী, আক্রমণকারীরা তাঁর চোখে মূল শত্রু নয়।

সূর্য সেন ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং অবৈরীমূলক দ্বন্দ্ব বুঝেছিলেন পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণে। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক ছিলেন সূর্য সেন। সেই দলটির সাংগঠনিক কাঠামো সম্পর্কে পড়লে মনে হবে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য অর্জনের পদ্ধতির সঙ্গে আশ্চর্য মিল। একই রকম পূর্ণ সদস্য হওয়ার তিনটি পর্যায়, দু’বার পরীক্ষা। যুব বিদ্রোহের অন্যতম সৈনিক বিনোদ বিহারী চৌধুরী লিখেছেন,‘‘প্রথম দুই স্তর পার হয়েও অনেকে সদস্যপদ লাভ করেনি এমন দৃষ্টান্তও যথেষ্ট আছে।’’ শৃঙ্খলা রক্ষা ছিল আবশ্যিক কর্তব্য। সদস্যরা আস্তিক হতেই পারেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোনও স্থান ছিল না। মাস্টারদা নিজেই আস্তিক ছিলেন। চট্টগ্রাম সেই সময়েও ছিল মুসলিম প্রধান এলাকা, গণেশ ঘোষ তাঁর স্মৃতিচারণায় তার উল্লেখ করেছেন। আর মুসলমান নিবিড় গ্রামগুলি ছিল সূর্য সেন এবং তাঁর সংগঠনের কর্মীদের প্রধান আশ্রয় স্থল। মুসলমান রমণী উঠোনের মাজারে লুকিয়ে রেখেছেন সূর্য সেনকে, পুলিশ ভাবতেই পারেনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান রমণী মাজারে কাউকে, বিশেষত কোনও হিন্দুকে লুকিয়ে রাখতে পারেন। অন্যান্য সশস্ত্র সংগ্রামী দলের শপথ নেওয়া হতো ‘ঈশ্বর’-এর সামনে। ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখার শপথে ধর্ম, ভগবানের নামে শপথের কোনও জায়গা ছিল না। তাই মৌলবী মীর আহমদ, আফসারউদ্দিন, আবদুস সাত্তার, কামালউদ্দিন আহমদ, সৈয়দুল হকের মতো অনেকে ছিলেন মাস্টারদার সহযোগী।

সাভারকার চড়া, আকর্ষণীয় ভাষণ দিতে পারতেন। কিন্তু বিপদের মুখে তিনি গুটিয়ে যেতেন, পালানোর পথ খুঁজতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁর আন্দামান জেলে বন্দী থাকার দিনগুলি সম্পর্কে বর্ণনায় লিখেছেন যে, ধর্মঘটে অন্যদের উসকে দিয়ে সাভারকার দূরে থাকতেন। গান্ধী হত্যা, স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় পতাকার বদলে গেরুয়া ঝান্ডা তোলার সিদ্ধান্ত প্রয়োগেও তিনি উসকে দিয়ে ‘কেটে পড়া’র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ রেখেছেন।

সূর্য সেন? শরৎ বসুর অভিজ্ঞতা বলা যাক। ১৯৩০-এর যুব বিদ্রোহের পরে শরৎ বসু লিখে পাঠিয়েছিলেন, ‘দেশের আপনাকে দরকার। আপনি চাইলে চট্টগ্রামের বাইরে দেশে অথবা বিদেশে আপনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যাবে।’ দশ হাজার টাকা যাঁর মাথার দাম, যাঁকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ হন্যে হয়ে খুঁজছে, তিনি জবাবে লিখলেন,‘‘এখনও আমাদের লক্ষ্য অর্জনের বহু বিলম্ব আছে, এই অবস্থায় আমার কর্মক্ষেত্র এই চট্টগ্রাম জেলা ছেড়ে আমার নিরাপত্তার জন্য অন্য কোথাও যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। এই চট্টগ্রামেই আমি এ পর্যন্ত ২০জন সাথীকে হারিয়েছি, আরও কতজনকে হারাতে হবে জানি না। এই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এইখানেই আমাকে সংগ্রাম করে যেতে হবে।’’ অভিভূত শরৎ বসু কলকাতা থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন একটি বাক্স নিয়ে। বাক্সতে ছিল চারটি তাজা টিএনটি বোমা আর দু’ হাজার টাকা। অর্ধেন্দু গুহর হাতে সেই বাক্স দিয়ে শরৎ বসু বলেছিলেন,‘‘এইগুলি সূর্যবাবুকে দিও। বলো, তাঁর জবাবের প্রত্যুত্তরে এ’ আমার গভীর শ্রদ্ধার উপহার। আশাকরি এই উপহার তাঁর অনুপযুক্ত হয়নি।’’

সাভারকারের নামে বিমানবন্দর হয়েছে। আন্দামান জেলে আজ তিনি পূজিত। মাস্টারদাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

তাঁর আর এক সহযোগী আনন্দপ্রসাদ গুপ্তর কথায়,‘‘লোকের চোখে পড়ার মত কোন বৈশিষ্ট্যই তাঁর ছিল না। যে সব রোমাঞ্চকর গুণ থাকলে সহসা লোকের বাহবা পাওয়া যায় তার কিছুই ছিল না মাস্টারদা’র। সভাসমিতিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে আসর গরম করা বা নেতৃসুলভ কর্তৃত্ব ফলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়া—এই সব ব্যাপারে মাস্টারদা মোটেই কৃতী ছিলেন না।…নেতৃত্বসুলভ অহমিকা নিয়ে নিজেকে সমালোচনার ঊর্দ্ধে মনে করা বা নেতাগিরি মাস্টারদা মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন।’’

সাভারকার বিপরীত। সূর্য সেন সংক্রান্ত আলোচনায় তাকে টেনে আনার একটিই উদ্দেশ্য—ভারতের সংগ্রামের ইতিহাস যখন মুছে ফেলার চক্রান্ত পুরোদমে আরএসএস-এর উদ্যোগে চলছে, তখন প্রকৃত বীরদের আলোচনার মাধ্যমে বেইমানদের মুখোশ আরও খুলে দিতে হবে। সময়ের দাবি। নাহলে মাস্টারদার পাশে সাভারকারের কোনও জায়গাই নেই।

মুচলেকা দেওয়ায় সাভারকারকে ‘ক্ষমা’ করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। আর মাস্টারদা? তাঁকে এবং তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসির আগে প্রচন্ড মারধর করা হয়েছিল। তারপর তাঁদের হেঁচড়ে ফাঁসির জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর? চট্টগ্রাম বন্দরের চার নম্বর জেটি থেকে একটি ক্রুজারে মাঝসমুদ্রে নিয়ে লাথি মেরে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছিল তাঁদের দেহ। হ্যাঁ, লাথি মেরে। তার আগে তাঁদের মৃতদেহেও লাথি মারা হয়েছিল।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এতটাই ভয় পেত মাস্টারদাকে, এতটাই তিনি ‘বিপজ্জনক’ ছিলেন।

শেয়ার করুন