প্রাককথন
কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির প্রয়াণ শুধু ভারত না, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনেরও একটি বড় রকমের ক্ষতি। সোভিয়েত পতন পূর্ব সময়ে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি যখন বিভ্রান্ত ও ছত্রভঙ্গ, তখন তাদের মধ্যে একতা ও সংহতি ধরে রাখার প্রশ্নে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। যোগাযোগ রক্ষা করেছে যাঁরা সোভিয়েত বিপর্যয়ের পরেও রক্ত পতাকা ফেলে দিয়ে হার মেনে নিতে রাজি ছিল না, সেই লড়াকু দলগুলির সঙ্গে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পার্টির আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সাধারণ সম্পাদক রূপে (এবং তার পূর্বেও) কমরেড ইয়েচুরি সচেতন ছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি চিরকাল থাকবে না, দিন আবার পাল্টাবে – এই বিশ্বাসকে লালন করা এবং ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ’ বুকের মধ্যে এই প্রত্যয়কে ধরে রাখা, প্রত্যেক কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব বলে তিনি মনে করে এসেছেন। এই দায়িত্ব প্রসঙ্গেই তিনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন ২০১৬ সালের ২৪-সে সেপ্টেম্বর, গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টির যুব সংগঠন কে.এন.ই-এর আয়োজিত ৪২-তম ‘ওদিগিতিস’ সাংস্কৃতিক উৎসবে। সেই ভাষণেরই বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল।
সীতারাম ইয়েচুরি
কেকেই-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক, কমরেড কুতুম্পাস
কেকেই-এর নেতৃত্ববৃন্দ,
কেএনই-এর নেতৃত্ববৃন্দ,
আমার প্রিয় কমরেড ও বন্ধুরা,
যে বৈপ্লবিক উদ্দীপনা, তেজ এবং আশাবাদের এখানে এত প্রকট প্রাচুর্য, চমৎকার লাগছে তার মধ্যে এসে।
আপনাদের সবাইকে সিপিআইএম শত সহস্র সদস্য এবং সিপিআইএম-এর নেতৃত্বে থাকা নানা গণ-সংগঠনে সক্রিয় প্রায় চার কোটি সাথীদের তরফ থেকে আপনাদের সকলকে আমার বিপ্লবী অভিবাদন।
সংগ্রাম, জ্ঞানার্জন, সাহস, সহ্যশক্তি-কে আপনারা এই উৎসবের মূলভাব হিসেবে বেছে নিয়েছেন। সত্যিই, মানব সভ্যতার সমস্ত অগ্রগতিই এসেছে একমাত্র শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে। এই সংগ্রাম কখনই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, সাহস এবং সহ্যশক্তি ছাড়া সফল হতে পারে না। এটাই তো মার্কসবাদের মূলভাব – ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’ –এর মাধ্যমে আমাদের বর্তমানের পৃথিবীকে এমন এক পৃথিবীতে পাল্টে দেওয়া যেখানে মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং জাতির দ্বারা জাতির শোষণের অস্তিত্ব নেই – এক উন্নততর পৃথিবী, সমাজতন্ত্রের।
যুবকরা ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারী। নিজেদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে হবে তোমাদেরই। তোমারই তো এই উন্নততর পৃথিবীর ভবিষ্যৎ।
ইতিহাস, সময়ের মতো সর্বদা সরলরৈখিক ভাবে এগিয়ে চলে না। কোনও বিশেষ সময়ে শ্রেণি বাহিনী এবং শ্রেণি সংগ্রামের তুলনামূলক শক্তির পারম্পর্যের ভিত্তিতে শোষক শ্রেণি সাময়িক ভাবে মানব সভ্যতার অগ্রগতিকে স্থগিতও করে দিতে পারে। আমরা এমনই এক সময়ে বাঁচছি, যখন প্রতি বিপ্লবী শক্তি তার নগ্ন আগ্রাসন, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, নয়া-উদারনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়ের লুন্ঠনবৃত্তি, অসম চুক্তি এবং পূর্বতন শ্রেণি সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত মানবাধিকারগুলির উপর আক্রমণ সমগ্র বিশ্বের বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে দারিদ্র্য ও দুর্দশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ চেষ্টা করছে ইতিহাসের ঘড়িকে পেছনে ঘুরিয়ে দিতে। সারা বিশ্বে জনতা এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে রয়েছে। ভারত থেকে আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি এই সংগ্রাম আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে চালিয়ে যাচ্ছি।
পুঁজিবাদী ভাবাদর্শীরা প্রচার করেন যে এ হল ‘মতাদর্শের ইতি, ইতিহাসের ইতি’। তাদের উদ্দেশ্যে, ভারতে আমরা বলে থাকি মার্কসবাদ হল একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। যখন মাতৃ গর্ভ থেকে শিশু জন্ম নেয়, তখন সেই শিশু নানা প্রকার বিকলাঙ্গতায় ভুগতে পারে, কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই সেই শিশুকে পুনরায় মাতৃ গর্ভের স্বস্তিপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। একই কথা মানব ইতিহাস প্রসঙ্গেও। একবার যখন সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদের গর্ভ দীর্ণ করে জন্ম নিয়ে ফেলেছে, তখন তার যা-ই দুর্বলতা থাকুক না কেনো, মানব ইতিহাস আবার পুঁজিবাদের গর্ভে ফিরে যেতে পারবে না। শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্রতর করেই মানব ইতিহাসকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেই সংকল্পই আজ এখানে প্রবল ভাবে দেখতে পাচ্ছি। যখন আমাদের শ্রেণি শত্রুরা প্রশ্ন করবে, ‘সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী ?’, আমাদের উত্তর হবে, ‘সমাজতন্ত্রই ভবিষ্যৎ’।
আমি আমাদের সকল শ্রেণি ভাই এবং বোনদের সঙ্গে আপনাদের এখানে আজ যোগ দিয়েছি পুনঃউৎসর্গ করতে আমাদের সংগ্রামকে শক্তিশালী করার সেই সংকল্পকে যার মাধ্যমে অর্জিত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ – সমাজতন্ত্র।
এখানে উপস্থিত আপনাদের সকলকে ও সারা বিশ্বজুড়ে যারা তীব্র শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের সকলকে আমার বিপ্লবী লাল সেলাম।
প্রাককথন ও অনুবাদঃ রবিকর গুপ্ত