Site icon CPI(M)

’৭৮-এ ১৭ হাজার আসনে বিরোধীদের জয়? – চন্দন দাস

১৪ অক্টোবর ২০২২ ,শুক্রবার

তৃতীয় পর্ব

মমতা ব্যানার্জির ঘোষিত জীবনী জানাচ্ছে, তখন তিনি রাজ্য মহিলা কংগ্রেস(আই)-র এক সাধারণ সম্পাদিকা। সেবার পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। সেটিই ছিল রাজ্যে প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। নির্বাচন হয়েছিল জুনে। ৪ঠা জুন, ১৯৭৮।

মমতা ব্যানার্জি নিশ্চয়ই বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রচার করতে সেবার কোনও না কোনও গ্রামে গিয়েছিলেন। বামফ্রন্ট সরকারের তখন এক বছরও হয়নি। রাজ্যের প্রায় প্রতি ইঞ্চি জমিতে পার্টিকর্মীরা আছেন। প্রতিটি পঞ্চায়েতকে বিরোধী শূন্য করা তখন সিপিআই(এম)-র কাছে নস্যি।

কিন্তু তা হয়নি। নির্বাচন হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল।

রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তরের একটি তথ্য সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৭৮-র সেই নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন ১লক্ষ ৭৩ হাজার ৬০০জন। মোট আসন ছিল ৫৫, ৯৫১টি। অর্থাৎ আসন পিছু গড়ে তিনজনের বেশি প্রার্থী ছিলেন।

এবারের অবধারিত প্রশ্ন, কোন কোন পার্টি, দল কত আসন দিয়েছিল? বামফ্রন্টের বিরোধীরা কী দাঁড়াতে পেরেছিল?

এর জবাব দিতে গিয়ে আপনি সিপিআই(এম)-র কর্মী হলে আপনার গর্ব করার অধিকার আছে। আপনি পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রৌঢ় মানুষ হলে আপনার বুক বাজিয়ে বলার যথেষ্ট কারণ আছে, আমরা নির্বাচন দেখেছি। ‘গ্রামে সরকার’ গড়ার নির্বাচনে আমরা লাইন দিয়ে নির্ভয়ে ভোট দিয়েছি। আপনি যুবক কিংবা কিশোর হলে? আপনি বলতেই পারেন, একটি পার্টির দুর্দান্ত গণভিত্তি থাকাকালীন, একটি ফ্রন্টের সরকারের মাত্র কয়েক মাসের সরকার থাকলেও এইভাবে নির্বাচন হতে পারে? এত প্রার্থী হতে পারে?

পারে। প্রমাণ তথ্য। যদিও বামফ্রন্ট বিরোধী সংবাদপত্র, কংগ্রেস (আই)-র স্নেহধন্য সাংবাদিকও ছিলেন।

রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তরের তথ্য বলছে, সেই নির্বাচনে কংগ্রেস (আই), কংগ্রেস(আর্স) ছিল বামফ্রন্টের প্রধান দুই বিরোধী দল। ছিল জনতা দলও। নির্দলরাও ছিলেন অনেক আসনে। তবে তারা মূলত কংগ্রেস(আই), জনতা দলের লোক ছিলেন। ‘নির্দল’ হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন।

১৫টি জেলা পরিষদ ছিল। জেলা পরিষদে আসন ছিল ৬৪৮। ৩৪৪টি পঞ্চায়েত সমিতি ছিল। সমিতির মোট আসন ছিল ৮৪৬৭। পঞ্চায়েত ছিল ৩৩৫১টি। সেই পর্যায়ে মোট আসন ছিল ৪৬,৮৩৬। অর্থাৎ মোট আসন ছিল ৫৫,৯৫১।

সেবার পঞ্চায়েতের তিনটি পর্যায়ে সি পি আই-র প্রার্থী ছিলেন ৫,৯৬০জন। কংগ্রেস (আই)-র প্রার্থী ছিলেন ২৬,৫৬৮জন। মমতা ব্যানার্জির মতই রাজ্যের বর্তমান পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জি, সুদীপ ব্যানার্জি, বি জে পি নেতা মুকুল রায় — এরা সবাই তখন কংগ্রেস (আই)-র নানা মাপের নেতা। কংগ্রেস(আর্স)-র মোট প্রার্থী ছিলেন ৩,৮৩২জন। অর্থাৎ এই দুই কংগ্রেস মিলে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন ৩০,৪০০জন। এছাড়া তিনটি পর্যায়ে কংগ্রেস, কংগ্রেস (আই), জনতা দলের সহায়ক নির্দল প্রার্থী ছিলেন ৭৩,০৪৩ জন।

আর সিপিআই(এম)-র? তিনটি পর্যায় মিলিয়ে তাদের প্রার্থী ছিলেন ৪৬,১৭১জন। আরএসপি-র প্রার্থী ছিলেন ৫,১৯৬জন। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী ছিলেন ৫,০৯০জন।

মোদ্দা কথা — বামফ্রন্টের প্রার্থীর থেকে বামফ্রন্ট বিরোধীদের প্রার্থী বেশি ছিল — অনেকটাই বেশি।

বিরোধীশূন্য করতে পারলে পঞ্চায়েত পিছু টাকা দেওয়ার আহ্বান কোনও মন্ত্রী, সিপিআই(এম) নেতা সেদিন করেননি। যদি একবারও বলতেন— বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ো, বিরোধীরা উড়ে যেতেন। তা হয়নি। কারন — গণতন্ত্র, মানুষের অধিকারের সর্বোত্তম রক্ষক কমিউনিস্টরা, ১৯৭৮ আর ২০১৮-র তফাৎ তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেবে।

তখনও মুখ্যমন্ত্রীই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পুলিশ তবু বিরোধী দলের প্রার্থীদের তাড়া করেনি, মিথ্যা কেস করেনি, জেলে ভরেনি। কোনও মহিলাকে বেধড়ক মার খেতে হয়নি। কী এমন অসুবিধা ছিল? বামফ্রন্ট চাইলে তৎকালীন পুরো প্রদেশ কংগ্রেস অফিসটাই জেলখানা করে দেওয়া যেত।

উলটে রাজ্যবাসী কী শুনেছিল? উদাহরণ ২৩শে মে, ১৯৭৮।

জনসভা হয়েছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরে। যেখানে জেলাশাসকের অফিসের সামনে মনোনয়ন পত্র জমা দিতে গিয়ে শাসক দলের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বামফ্রন্টের প্রার্থীরা, সেখানেই, সেই তমলুকের সভাতে শোনা গিয়েছিল — ‘‘গ্রামের উন্নয়নের কাজ বিডিও, এসডিও, ম্যাজিস্ট্রেট — এদের দিয়ে হয় না। গ্রামের মানুষই ভালো বুঝবেন গ্রামের কোন কাজটা কীভাবে করতে হবে। আমরা চাই গ্রামের যাবতীয় উন্নয়নমূলক কাজে গ্রামের মানুষ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করুন। এখন আমলা, অফিসাররা যা পারেন, যা ভালো বোঝেন করেন, গ্রামের মানুষ কিছু জানতে পারেন না। কোনও কাজে অংশ নিতে পারেন না। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই।’’

যেখানে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করায় সিপিআই (এম)-র আদিবাসী প্রার্থী বুল্টি সিংয়ের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসীরা, সেদিন সেই পাঁশকুড়াতেও সভা হয়েছিল।

আর বক্তার নাম? কমরেড জ্যোতি বসু। সেদিন তিনি বা সিপিআই (এম)-র রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত অন্য কিছু বললে শুধু অবিভক্ত মেদিনীপুর না, পুরো রাজ্যটা ‘অনুব্রতর বীরভূম’ বানিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল সিপিআই(এম)-র। মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর দল তাই করে দেখালো।

প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল কী হয়েছিল?

বামফ্রন্ট জিতেছিল ৩৮,৪৬৮টি আসনে। বিরোধীরা জিতেছিল ১৭,৪৮৩টি আসনে — প্রায় ৩১.২৫%!

বিরোধীদের মধ্যে সিপিআই জিতেছিল ৯৬১টি আসনে। তারা তখন বামফ্রন্টে ছিল না। জনতা জিতেছিল ৯০০ আসনে। কংগ্রেস(আই) জিতেছিল ৫২৫৪টি আসনে। কংগ্রেস(আর্স) জিতেছিল ৬৯৭টি আসনে। অন্যান্য এবং নির্দলরা জিতেছিল ৯৬৭১টি আসনে।

বামফ্রন্টের মধ্যে সিপিআই(এম) জিতেছিল ৩৪,৪৪৫টি আসনে। আরএসপি ২০৫৭টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ১৯০৩টি এবং বামফ্রন্টের অন্যান্য পার্টি জিতেছিল ৬৩টি আসনে।  

ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট সবাই প্রার্থী দিতে পেরেছিলেন। প্রার্থী হিসাবে টিঁকে থাকতে পেরেছিলেন। প্রচার করতে পেরেছিলেন। যা আজকের পশ্চিমবঙ্গে, অন্তত বিগত দুটি পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বলছে প্রায় অসম্ভব।

আসলে, তফাৎ মানুষের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখায়। শিরদাঁড়ায়। একটি নির্লজ্জ, দুষ্কৃতীদের আখড়া, তোলা আদায়ের দল। আর একটি মানুষের পার্টি, মানুষেরই অহঙ্কার, সিপিআই(এম) — গণতন্ত্রের লাইফলাইন।

ক্রমশ……

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক চন্দন দাসের এই প্রবন্ধটি ১২ টি পর্বে প্রকাশিত হবে।


শেয়ার করুন