শ্যামল চক্রবর্তী
শবদেহ জ্বলে পাশবিক উল্লাসে।
নামহীন অগণিত পোড়া মানুষের ছাই।
ঘুম নেই চোখে ঘুম নেই।
আজও শ্বাসনালী জুড়ে তির তির করে
লক্ষ হৃদয়ে স্বজন হারানো ব্যথা।
আজও তো আমরা
চিতাভস্মের সামনে মৌন।
চোখ ভরে আসে জল
অঙ্গে অঙ্গে যন্ত্রণা সম্ভার।
ঠিক এই ভাষায় না হলেও, এই ভঙ্গিতে না হলেও এই ধরনের একটি কবিতা লিখেছিলেন। তুমি এনসেকি। বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্বাস্থ্য বিভাগের মহিলা কর্মী। ৬ই আগস্ট আণবিক বোমার আক্রমণে নিজেই বিন্ত। এক পায়ের স্যান্ডেল কোথায় উড়ে গিয়েছিল। পা দিয়ে। রক্ত করছে ও শরীরের পিছনে আটকে আছে ভাঙা কাচের বেশ কয়েকটা টুকরো। রক্ত ঝরছে সেখানে থেকেও। বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আহত মানুষের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়া মহিলার অনুভব শক্তিও কমে গিয়েছিল। মুমূর্ষু এক কিশোর বলে ওঠে ‘ওনে চ্যান (বড় দিদি) আমার তো ইাঁটার ক্ষমতা নেই, তুমি আমার চটিটা পর, আমি সুস্থ হলে ফেরত দিও। কিন্তু মৃত্যু তাকে চটি ফিরিয়ে নেবার জন্য অপেক্ষা করতে দেয়নি। সেই রাতেই সে মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘতর করে। মৃতদেহগুলো দ্রুত সরিয়ে নেবার কাজ করছিল যে আহত সৈনিক কাঁচ ফুটে যাওয়ার দিকে সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আর ছয় মিনিট পরে ফুসি এনসেকির সামনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃতদেহ হয়ে যায়।
সেদিন ভয়ঙ্কর
উদিত সূর্যের দেশ। এখন যার নাম জাপান। সূর্য উঠেছিল আকাশে। মেঘলেশহীন নীল আকাশ। রোদ্দুর তখনও নরম। সাগরের মেঘলা পরা মেয়ে নিয়নের শরীরে সেই নরম রোনের আস্তরণ। আকাশের রঙে রঙ মিলিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের নীলাভ জলরাশির কচি ঢেউগুলো নিত্যদিনের মতই ভেঙে যাচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার টানা সরলরেখার মতো গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা ফেনার ফেনায় উচ্ছ্বসিত উল্লাস।
ওটা নদীর অববাহিকায় যুগ যুগ ধরে জমতে থাকা পলিমাটিতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা হিরোশিমা তখন তন্দ্রাহীন রাতের প্রহর কাটাচ্ছে। মাথার উপর বি-২৯ বোমারু বিমানের অবিরাম হানা। পথের ধারে ধারে অসংখ্য বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচার জন্য, আত্মরক্ষার জন্য ট্রেঞ্চ।
নিঃশব্দ, নিষ্প্রদীপ রাতের স্তব্ধতার তপস্যা ভেঙে মাঝে মাঝেই সাইরেনের সুতীক্ষ্ণ আওয়াজ হিরোশিমাকে চিরে চিরে গায়ে গায়ে লেগে থাকা পাহাড়ের মাথায় মাথায় ছিটকে পড়ে, আর সাগরের অন্তহীন সীমানায় বিলীন হয়ে যায়। রেখে যায় শুধু নির্দয় ক্ষতচিহ্ন এক, দুই, তিন, চার। কেউ কি হিসাব রেখেছিল। তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষের শহরের দেহে আর মনে- দগদগে ক্ষতচিহ্ন। অসহায়তা আর আতঙ্ক মেশানো দিন কাটাচ্ছিল হিরোশিমা। হিরোশিমায় তখন আটটা পনের। ১৯৪৫-এর ৬ই আগস্ট। সেদিন ছিল সোমবার। আধা রাত কেটেছে আতঙ্কে, উদ্বেগাকুল এবং তন্দ্রাহারা। ঠিক ১২টা ২৫ মিনিটে অন্ধকার আর নীরবতাকে ছিঁড়েখুঁড়ে বেজে উঠেছিল সর্বনাশের বাঁশি সাইরেন। ঠিক ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট রুদ্ধশ্বাস প্রহর গোনার পর আবার ঘরে ফিরে বিছানায় বিনিদ্ররাত। ঘড়িতে তখন রাত ২ টো বেজে ১০ মিঃ। ঠিক তার ২৫ মিনিট আগে রাতের অন্ধকারে হিরোশিমা থেকে ১৭০০ মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তিননিয়ান দ্বীপ থেকে আকাশে উড়ল তিনটে মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমান।
হিরোশিমায় সকাল আটটা পনেরর ঠিক ছেচল্লিশ মিনিট আগে আবার বেজে উঠলো সেই ভয়ঙ্কর সাইরেন। ঘুম ভাঙা চোখে ঘর থেকে বেরিয়ে সবাই ছুটল ট্রেঞ্চের দিকে কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। ২২ মিনিট রুদ্ধশ্বাস ভয়ার্ত অপেক্ষার পর আবার সাইরেন। ঘোষণা করলো তোমরা ফিরে যেতে পারো বাড়িতে কিংবা কর্মক্ষেত্রে। এই মুহূর্ত হিরোশিমা নিরাপদ, তোমরাও আপাতত বিপদমুক্ত।
তখন সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা নতুন সন্তানকে বুকে চেপে তার ছোট্ট মুখে কোন তরুণী মা নিষিক্ত করছিলেন শরীরের অমৃত। মুখে আদ্দিনের আকাশের মতো উজ্জ্বল প্রশান্তি। শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে, বার্ধক্যে অবনত বৃদ্ধ বাড়ির বাগানে ছোট ছোট গাছগুলোতে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য সিদ্ধান করছিলেন জল। প্রৌঢ়া মহিলা শঙ্কাহীন নতুন দিনের কামনায় নিমীলিত চোখে অর্ধস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করছিলেন ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যে মন্ত্র। ঘড়িতে তখন সকাল আটটা পনের।
হিরোশিমায় তখন তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা বাবা-মায়ের অনিশ্চিত আশ্রয় ছেড়ে শহর থেকে দূরে কোন গ্রামে। বোমা বর্ষণে বাবা-মায়ের ক্ষতি হলেও এই শিশুরা যেন বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে আগামী দিনগুলোর জন্য। যুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে প্রায় পরাজিত জাপানে তখন শিশুদের খাদ্যেও সঙ্কট, অর্ধভুক্ত শিশুরা শুধু অপেক্ষা করছে কবে বাবা-মায়ের উষ্ণ স্নেহের আশ্রয়ে ফিরে যাবে। তাদের কারও চাপা আর্তনাদ, বুক ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস, জলভরা চোখ বারবার অভিশাপ দিচ্ছিল যুদ্ধোম্মাদ মানুষগুলোকে। এদের থেকে ছোট শিশুরা সর্বনাশের আশঙ্কা নিয়েছিল মা-বাবার সদাশঙ্কিত আশ্রয়ে।
আর ওদের তুলনায় বড় ছাত্র-ছাত্রীরা। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু। কত আর বয়স হবে। বড়জোর এগার-বার থেকে পনের-ষোল। তারাও যুদ্ধের সৈনিক। হ্যাঁ। বাধ্যতামূলক। তফাৎ এই যে, তাদের রণাঙ্গনে যেতে হয়নি। মুহুর্মুহু বোমারু বিমানের আক্রমণে হিরোশিমা তো যুদ্ধক্ষেত্রই। টিন-এজার ছাত্র-ছাত্রীরা যুদ্ধের পশ্চাৎভূমি রক্ষায় ব্যস্ত। সারা হিরোশিমায় ঐ বয়সের প্রায় আট হাজার চারশ ছাত্র বিপজ্জনক বাড়িগুলো ভাঙার কাজে নিযুক্ত অথবা কারখানায় কাজ করছে। ৬ই আগস্ট সকাল ৮টা পনেরতে তারা বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।
হিরোশিমা ছিল জাপানী সৈন্যবাহিনীর ঘাঁটি। ৬ই আগস্ট সকালে ছিল ৪০ হাজার সৈন্য। এই সময় হিরোশিমাতে ছিল ৮১৮৬৩ জন কোরিয়ান। এদের বেশিরভাগই বাধ্যতামূলক শ্রমিক। মূলত কাজ করতো পাহাড়ের গায়ে বিজলি উৎপাদন কেন্দ্রে, অস্ত্র কারখানা আর জাহাজ তৈরি বা মেরামতের কারখানায়।
ঠিক ঐ দিন চীন থেকে ধরে নিয়ে আসা চীনা শ্রমিকদের মধ্যে ৩৬০ জনকে জোর করে কাজ করান হচ্ছিল বিজলী কারখানা তৈরি করার জন্য। জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিয়, মালয়, বার্মা এবং ফিলিপাইন থেকে জাপানে পড়তে আসা ২০ জন ছাত্র তখন হিরোশিমায়, তাইওয়ান থেকে আসা বেশ কিছু তাইওয়ান শ্রমিক-ছাত্রও ছিল। সংখ্যাটা কত, কি তাদের পরিচয়- আজও কেউ জানে না। আমেরিকায় আস্তানা গেড়েছিল বাপ-ঠাকুর্দা। তখন আমেরিকার নাগরিক। তাদের বংশধর জাপানী-আমেরিকান। তারা হিরোশিমায় ছিল ৩২০০ জন। আর ছিল জনা কুড়ি আমেরিকান যুদ্ধবন্দী।
সকাল ৮টা বেজে পনের
হিরোশিমার ঘড়িতে তখন সকাল আটটা বেজে পনের। নিষ্কলঙ্ক আকাশের দিকে মাঝে মাঝেই চেয়ে দেখা ভয়ার্ত কিছু মানুষ দেখল সাদা লম্বা একটা লেজ। আর বহুদুর থেকে ভেসে আসা অতি চেনা বি-২৯ বিমানের আওয়াজ। আকাশে তখন তিনটি বিমান মার্কিন বিমান বছরের। তার একটা বিমান “এনোলা গো। এনোলা গে’র পেটের মধ্যেই আছে ‘লিটল বয়’। সেই ভয়ঙ্কর বোমা। পৃথিবীর বুকে বিস্ফোরিত হয়েছে এমন দ্বিতীয় বোমা।
প্রথম আণবিক বোমা বিস্ফোরণ পরীক্ষা হয়েছিল আরও ২২ দিন আগে ১৬ই জুলাই নয়া। মেক্সিকোর মরুভূমি আলমগরোডে। মানবজাতির ইতিহাসে প্রথম আণবিক বোমা। ১৯৪২ থেকে টানা তিন বছর বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফল। কুখ্যাত ম্যানহাটন প্রজেক্ট-এর বিষাক্ত ফল।
মার্কিনী সমর বিশারদদের পৈশাচিক উল্লাস তখন আকাশ ছুঁয়েছে। ফ্যাসিস্তরা পিছু হটছে। পরাজয়ের মানি নিয়ে জাপান ক্রমশ ম্রিয়মাণ। আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি চলছে। ওদিকে চলছে লাল ফৌজের বিজয় অভিযান। তাই সোভিয়েতকে আটকাও। হাতে যখন আণবিক বোমা। তাকে ব্যবহার কর যুদ্ধোত্তর পৃথিবী ভাগের জন্য। তাই মার্কিন সরকারের আদেশ, ‘৫০৯ কম্পোজিট গ্রুপ, ২০ নম্বর বিমানবহর। ১৯৪৫ এর ওরা আগস্টের পর চোখে দেখে বোমা ফেলার মতো অনুকূল আবহাওয়া পেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিম্নলিখিত যে কোনও একটি লক্ষ্যবস্তুর উপর বিশেষ বোমাটি ফেলবে। হিরোশিমা, কোকুরা, নিগাতা এবং নাগাসাকি’।
তারপর ৬ ই আগস্ট হিরোশিমায়, ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে পৃথিবীর ইতিহাসে নিকৃষ্টতম অপরাধটি ঘটে গেল।
লিটল বয়-এর বিস্ফোরণ
ঘড়িতে তখন আটটা পনের। নিচে হিরোশিমা। সমুদ্রের বুক থেকে ১৬০০ মিটার উপর এনোলা গে আর দুটি বি- ২৯’ বিমান। লিটল বয়কে ছেড়ে দেওয়া হলো। সীমা হাসপাতালের ৬০০ মিটার উপরে বোমাটি ফাটল। তারপর?
বিস্ফোরণের পর দশ হাজার সেকেণ্ডের একভাগ সময়ে পর ২৮ মিটার ব্যাসের একটা আগুনের গোলা তৈরি হল। তার তাপমাত্রা ৩ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক সেকেন্ডের পরই আগুনের গোলা ২৮০ মিটার ব্যাসের চেহারা নিল। এক কিলোমিটার ব্যাসের মধ্যে ঘরের বাইরে থাকা মানুষগুলো মুহূর্তের মধ্যে শবে পরিণত হলো। তাদের শরীরের চামড়ার গোটাটাই পুড়ে গেল। শরীরের অন্তর্গত সব অঙ্গ- প্রত্যঙ্গই ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। যারা ঘরের মধ্যে ছিল তারা ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে গেল। বিস্ফোরণের সাড়ে তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা মানুষগুলো স্রেফ ঝলসে গেল।
উত্তাপরশ্মি রান্নাঘরের আগুনের সঙ্গে মিশে দাবানল হয়ে গ্রাস করল সারা শহর। ২ কিলোমিটারের মধ্যে সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল। অবশিষ্ট শহর হয়ে গেল ধ্বংসস্তূপ। গোটা শহরে চারটে বাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলো ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে। আগুনে বাতাসের গতি বিস্ফোরণের জায়গায় ছিল ঘন্টায় প্রায় সতের হাজার কিলোমিটার। আড়াই কিলোমিটার দূরে গিয়ে তা দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১৩২০ কিলোমিটার।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ থেকে
হায় ভগবান! একি দুঃস্বপ্ন
শরীরের ক্ষতে কিলবিল করছে পোকা। মহানন্দে পোকাগুলো গিলছে একটা শিশু।
ক্ষুধার্ত অবোধ শিশুর কাছে সাদা ভাত হয়ে দেখা দেয় পুঁজ মাখা যেয়ো পোকা। —ফুমে এনসেকি
এখনও বেঁচে থাকা কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেখা যাক : ‘আমি আহত কিন্তু সেবায় অক্লান্ত। রক্তমাখা কতকগুলো মানুষ পাগলের মত একটু আশ্রয় খুঁজছে। আমার চারপাশে শুধু উলঙ্গ মানুষের ভিড়। দূর থেকে কয়েকজনকে মনে হয়েছিল গায়ে সামান্য কাপড় আছে। কাছে এসে দেখি সেগুলো চামড়া। চামড়াগুলো ঝুলে পড়ে ভিতরের মাংস বেরিয়ে পড়েছে। জল জল বলে চিৎকার করছে ছিন্নভিন্ন পোড়া শরীরগুলো। একটা আহত বাচ্চা তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে “বাবা তুমি কোথায়? মা তুমি কোথায়?” রাস্তায় অগণিত মৃতদেহ। অন্ধ হয়ে গেছে কিছু মানুষ। একজন সন্তান সম্ভবানা মা প্রসব বেদনায় কাতরে উঠে মৃত শিশুর জন্ম দিয়েই নিজের জীবন হারিয়ে ফেলল’।
ইতিমধ্যে ধেয়ে এলো কালো রঙের বৃষ্টি। অসহ্য গরম থেকে খানিকটা সুরাহা পেতে যারা ঘন কালো সেই বৃষ্টির জলে অসহ্য যন্ত্রণার উপশম চেয়েছিল কয়েকদিন পরে তাদের অনেকেই রক্তবমি করতে করতে যন্ত্রণার চির উপশম ঘটাল।”—নে এনসেকি
জীবিতদের মধ্যে একজন হিরোশিমার স্থানীয় সংবাদপত্র ‘চুগোকু শিমবুন” এর চিত্র সাংবাদিক। হাইপো সেন্টার থেকে বহুদূরে থাকার জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় “স্ত্রীর হাত ধরে বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। সারা গায়ে অজস্র হুল ফোটানোর তীর যন্ত্রণা। …. আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। নিকষ কালো অন্ধকার। স্ত্রীর হাত মুঠোর মধ্যে ধরা । কিন্তু ওর মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি না। ….শুধু পরম নির্ভরতায় আমার হাত ধরা স্ত্রীর শরীর থেকে পাচ্ছি বেঁচে থাকার চাপা আনন্দ।…. আমরা জানতাম না অ্যাটম বোম ফেলা হয়েছে। রাস্তায় শুধু বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ছড়িয়ে রয়েছে মৃতদেহ। ঝলসানো চামড়া ঝুলে পড়া, সর্বাঙ্গ বিকৃত মানুষের ঢল। অর্ধমৃত চলৎ শক্তিহীন।
‘ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আগুন, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে লকলক করছে লেলিহান আগুনের শিখা। কিছু সৈন্যকে দেখলাম রান্নার তেল কিছু লোকের পোড়া শরীরে ঢেলে দিচ্ছে। কোলের শিশুকে জাপটে ধরে অর্ধেকপোড়া মা উম্মাদের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে, চোখ খোল- বাছা-চোখ ঘোল। পিরাকামী মন্দিরে ৩০০ বছর বয়সী একটা বিরাট গাছ ছিল। তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানুষও পরস্পরের হাত ধরে বেড় দিয়ে ধরতে পারত না এর গুঁড়ি। এর দৈত্যাকার শাখাগুলো ব্যাঙ্ক অফ জাপানকে প্রায় গ্রাস করে রেখেছিল। সূর্যের উত্তাপ থেকে ছায়া দিত এই গাছ। অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন তার ছায়ার নিচে বিশ্রাম নিত। সেই গাছ শিকড়সুদ্ধ উপড়ে পড়েছে শাখাপ্রশাখায় আগুন। তার নিচে আর আশপাশে চিরবিশ্রামে অসংখ্য মানুষ’।
‘হিরোশিমা থেকে ৯০০০ এর মতো শিশুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল শহরের বাইরে গ্রামে। মন্দির অথবা কমিউনিটি হলে। কয়েকজন পালিয়ে বাবা-মার কোলে ফিরে এসেছিল। বাকিরা এল ১৫ই আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের পর। যুদ্ধ শেষ। ঘরে ফেরার আনন্দে উচ্ছল উন্মাদনায় প্রাণখোলা হাসি উল্লাসে হিরোশিমাতে ফিরল ছেলের দল। বাবা-মার উষ্ণ আশ্রয়ের নিশ্চিত আশায়। ছেলে-মেয়েদের এক-একটা দল আসছে। কোনওক্রমে সুস্থ, অথবা চলার মতো শক্তি আছে এমন আহত বাবা-মায়েরা ছেলে-মেয়েদের কাছে টেনে নিলেন। আমার ক্যামেরায় তাদের ছবি ধরা রইল। আর ধরা রইল বিষয়, কান্নায় ভেঙে পড়া অসংখ্য শিশুর মুখের ছবি যাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। কিন্তু তাদের অপেক্ষা করতে হবে অনন্তকাল। কারণ হিরোশিমায় সব মৃত মানুষের নাম পাওয়া যায়নি’।
আকহিরো তাকাহাসি নামে তখনকার একজন ১৪ বছর বয়সী ছাত্র এখন লিখছেন : ‘আমরা প্রায় ১৫০ ছাত্র প্রাতঃকালীন সমাবেশে ছিলাম। এটা বিস্ফোরণের জায়গা থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে। বিপন্মুক্ত সাইরেন বাজার কিছু পরেই দলনায়কের নির্দেশে আমরা সবাই ‘এটেনশন’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হঠাৎ আকাশে দেখলাম একটা বি-২১। আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম আর সতর্ক নজর রাখলাম তার দিকে। এমন সময় সেই ভয়ঙ্কর আওয়াজ। আমি প্রায় দশ মিটার দূরে ছিটকে পড়লাম। বন্ধুরা সবাই তাই। কেউ ডাইনে, কেউ বায়ে, কেউ সামনে কেউ বা পিছনে। স্কুলবাড়িটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোনও বাড়িই আর নেই। আর আমি? আমার স্কুল ইউনিফর্ম শতছিন্ন হয়ে খুলে গেছে। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া খুলে কাঁচা মাংস বেরিয়ে পড়েছে। চামড়াগুলো গায়ে ঝুলছে চাদরের মতো। আর দেখলাম আমার বন্ধুদের শবদেহগুলো। যারা বেঁচে গেল তারা আমারই মতো জীবন্ত প্রেতাত্মা—সারা জীবন তেজস্ক্রিয়তার বিষ বয়ে বয়ে জীবনের অস্তিম লগ্ন এখন। আমার ষাট জন সহপাঠীর মধ্যে মাত্র চোদ্দজন আমারই মত হতভাগ্য জীবন নিয়ে বেঁচে আছে’।
প্রেম এসেছিল চলি গেল সে খুলি দ্বার
আর এক জন মহিলা তাওকে তেরামি। তখন নবম শ্রেণিতে পড়তেন। তার কথায়: “আমার সারা মুখ ঝলসে গিয়েছিল। চামড়া খুলে ঝুলছিল- কাঁচা মাংস বেরিয়ে পড়েছিল। অস্থায়ী হাসপাতালে আমার বয়সী মেয়েরা একের পর এক মৃতদেহ হয়ে যাচ্ছে। অনেক সন্তানহারা মা আমাকে দেখিয়ে বলতেন আমার মেয়েটা যদি এমন করেও বেঁচে থাকত। আমার মা আমাকে আয়না দেখতে দিত না। একদিন হঠাৎ একটা আয়না পেয়ে গেলাম। চমকে উঠে দেখি আমি যেন জীবন্ত প্রেতাত্মা। আমার মুখের অনেকটা কাটা। নাকের ডগাও উড়ে গিয়েছে। চোখ থেকে কান পর্যন্ত কোনও চামড়া নেই। মুখের দু’পাশে গজিয়ে পাহাড়ের চূড়ার মতো দুটো মাংসপিণ্ড। আমার তখন ভীষণভাবে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। শুধু বাবা-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে শক্তি সঞ্চয় করছিলাম। আমার দিদিটা সেই ভয়ঙ্কর দিনে মরে গিয়েছিল। বাবা-মা শুধু বলতেন মনে জোর আন মা। তুইও চলে গেলে আমরা কি নিয়ে বেঁচে থাকব? কয়েক বছর ধরে আস্তে আস্তে সেরে উঠলাম। কয়েকবার অপারেশন হলো। দেখতে এখন অর প্রেতাত্মার মতো মনে হয় না। মানুষের চেহারা ধীরে ধীরে ফিরে পেলাম। ২১ বছর বয়সে। প্রথম প্রেমপত্র। আমার কাছে তা ছিল আশাতীত। আনন্দে মেতে উঠলাম দু’জনে। কলেজ জীবনের চার বছর কেটে গেল স্বপ্নের মতো ঘোরে। চোখে তখন ঘরবাঁধার স্বপ্ন।
‘তারপর শুনলাম সেই ভয়ঙ্কর ঘোষণা। আণবিক বোমার আঘাতের মতোই দুর্বিষহ। আমার বয়স তখন পঁচিশ। সংবাদপত্র আর রেডিওতে প্রচারিত হলো সেই সর্বনাশা সত্য। আণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তার সীমায় যারা ছিল তাদের অনেকগুলো আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে হবে। রক্তের ক্যান্সার, সাদাহানি, বন্ধ্যাত্ব, বিকলাঙ্গ সন্তান আর বশে বশে ধরে তেজস্ক্রিয়তার দুরারোগ্য সংক্রমণ।
‘এই ঘোষণাতেই আমার আশা স্বপ্নের সমাধি রচনা হয়ে গেল। আমাকে অনেকে ভয় পেতে শুরু করল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যাকে আমি ভালবাসি তার, তার পরিবারের আর আমাদের সন্ততিদের ক্ষতি করতে পারব না। নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করলাম। বোমা বিস্ত হয়ে বেঁচে থাকবার চেয়ে এই লড়াই কম তীব্র হয়নি। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার ভবিষ্যৎ একা আমারই। তবু তো আমি ভালবাসা পেয়েছি, অনুভব করেছি অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত। সেই স্মৃতিটুকু রোমন্থন করেই আমার জীবন ভরে তুলব। তাকে কাছে রাখবার তীর আর্তি বুকে চেপে রেখে চোখের জল মুছে বিদায় নিলাম প্রেমিকের কাছ থেকে। চির বিদায়’।
তেজস্ক্রিয়তা বংশ-বংশ ধরি
৬ই আগস্ট হিরোশিমায় আণবিক বোমা পড়ে। সবারই ধরণা ছিল এই বোমা অন্য বোমার চেয়ে অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। এর তেজস্ক্রিয়তার কথা সাধারণ মানুষ জানত না। কত লোক মারা গিয়েছে, সেই দিন অথবা সামান্য চিকিৎসা বা বিনা চিকিৎসায় তার পরে আজও কেউ জানে না। প্রথম পাঁচমাসে তেজস্ক্রিয়তার কারণে মারা যায় অনেকে। এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে সেই ভয়ঙ্কর দিন ও তার পরে মৃত মানুষের সংখ্যা এক লক্ষ চল্লিশ হাজারের মতো, এর মধ্যে জাপানী ছাড়াও কোরিয়ান, চীনা এবং ১০ জন আমেরিকান যারা যুদ্ধবন্দী ছিল ঐ সময় হিরোশিমাতে। আণবিক বোমার শিকার হয়েছিল কুড়ি থেকে বত্রিশ হাজারের মতো কোরিয়ান। এর মধ্যে পাঁচ থেকে আট হাজার লোকের মৃত্যু হয়। অনেকে কোরিয়াতে ফিরে গিয়ে তেজষ্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়। এখন তারা জাপানে আসে চিকিৎসার জন্য। আমেরিকা থেকে আসে জাপানী-আমেরিকানরা। এখনও পর্যন্ত ষাট হাজার মানুষের চিকিৎসা হয়েছে।
হিরোশিমা এখন শান্তির শহর। তৈরি হয়েছে পিস মেমোরিয়াল পার্ক – শান্তির স্মরণে উদ্যান। ওটাই আণবিক বোমার শিকারদের প্রতীক। এখানেই মৃতদের ভস্ম রাখা আছে। প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে শান্তির বাণী নিয়ে আসেন প্রতিনিধিরা। নীরবে দাঁড়ান স্মৃতিসৌধের সামনে। চিতাভস্ম রাখার আধারে খোদাই করা শপথের সঙ্গে তাদের মৌনমুখর উচ্চারণ। “Let All the Souls Here Rest in Peace For We Shall Not Repeat the Evil.”
এর ঠিক কি বাংলা হবে জানি না। তবে ভারতের প্রতিনিধি আমি স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের নিজেদের কথা বলে এসেছি— তোমরা ঘুমাও আমরা জেগে আছি।
এসো শান্তি, বিধাতার কন্যা ললাটিকা। নিশাচর পিশাচের রক্তদীপ শিখা করিয়া লজ্জিত।
কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়– একটু পরিবর্তন করে শান্তি, তুমি অগ্নিগিরির লাভা স্রোতের মত লক্ষ প্রাণের রক্ত স্রোতের ভিতর থেকে কুড়িয়ে আনা টকটকে লাল পদ্ম ।
জাপানের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন জেনরোরেন-র সম্মেলন উপলক্ষে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ২০০৪ সালে হিরোশিমায় যান। প্রবন্ধটি ঐ বছরই দৈনিক গণশক্তিতে প্রকাশিত হয়।