প্রাককথন
ভারতের জাতীয় আন্দোলনে দেশের ব্যাপকতর জনসাধারণকে যিনি সর্বপ্রথম সমবেত করতে পেরেছিলেন তিনি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কীভাবে গান্ধীর মানসিকতা, মতাদর্শ গড়ে উঠেছিল? তাঁর চিন্তা ও রাজনৈতিক কৌশলের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা কোথায়? জওহরলাল নেহরুর ইতিহাস চেতনার বিবর্তন হয়েছিল কীভাবে? জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ঘটনার দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যে এদেশে জাতীয় আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল? এইসকল গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে জাতীয় আন্দোলনঃ মতাদর্শ ও ইতিহাস চর্চা শিরোনামে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি একটি বই প্রকাশ করে। সেই বইয়ের’ই দুটি অংশকে একত্রে আজ ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন হিসাবে প্রকাশ করা হল।
ইরফান হাবিব
১৯২২ সালের মধ্যে দেখা গেল কলকাতায় মুজফ্ফর আহমদ, বম্বেতে এস এস ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার নানাভাবে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করছেন। স্বরাজ্য পার্টির প্রতিষ্ঠাও নিঃসন্দেহে জাতীয় আন্দোলনে একটি বামঘেঁষা রাজনৈতিক বদলের আবির্ভাব প্রমাণ করে। ১৯২২ সালে ডাঙ্গে তাঁর একটা প্রস্তাব উপস্থিত করলেন যে, ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধীনে ইন্ডিয়ান সোশ্যালিস্ট লেবার পার্টি গঠন হোক।’ ১৯২৩ সালের এপ্রিল মাসে লাহোরে ইনকিলাব পত্রিকার সম্পাদক গুলাম হুসেইন প্রস্তাব করলেন লক্ষ্ণৌ শহরে লেবার পেজেন্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করা হোক। কিন্তু এইসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ হওয়ার আগেই এইসব নেতৃস্থানীয় কমিউনিস্টদের ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করল এবন তাঁদের উপর কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করল। ১৯২৪ সালের মে মাসে মুজফফর আহমদ, শওকত উসমানি, এস এ ডাঙ্গে এবং নলিনী গুপ্তের চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল। ‘ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে’ চেট্টিয়ারকে মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হলো পেশোয়ার মামলার মতোই এক্ষেত্রে এইরকম ভারি শান্তি দেওয়া হলেও, দেশের বাকি জাতীয়তাবাদী শিবির থেকে কোনো লক্ষ্যণীয়রকম প্রতিবাদ দেখা গেলনা- নাগরিক অধিকার সম্পর্কে সেইসঙ্গে জাতীয় মুক্তির আদর্শের প্রশ্নেও এক অদ্ভুত উদাসিনতা। পরবর্তীকালে নরমপন্থী জাতীয়তাবাদীদের প্রতি কমিউনিস্টদের যে বিরোধিতা-সে বিষয়ে আজকের দিনে অনেকে সমালোচনা করেন, তাঁরা কিন্তু এই দিকটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা সত্ত্বেও দুটি ঘটনা বামপন্থীদের যথেষ্ট পরিমাণে শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল। প্রথমটি হল ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে স্থানীয় ‘জাতীয়’ কমিউনিস্ট সত্যভক্তের আহ্বানে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট সম্মেলন। সম্মেলন থেকে এম সিঙ্গারাভেলুকে সভাপতি ও এআইসিসি সদস্য জানকীপ্রসাদ বাগেরহাট্টাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয় এবং মুজফফর আহমদ (গুরুতর অসুস্থতার কারণে জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত), এস ওয়াই ঘাটে ও আরো কয়েকজনকে কার্যকরী কমিটিতে নেওয়া হয়। একদিকে যেমন সরকারকে অমান্য করে প্রকাশ্যে সম্মেলন সংগঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলো, সেইসঙ্গে এই সম্মেলন থেকে পেশোয়ার ও কানপুর মামলায় ধৃত ১৩ জন কমিউনিস্টের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হলো। পার্টির ‘লক্ষ্য’ ঘোষিত হলো তার গঠনতন্ত্রে যেখানে দ্বিধাহীন ভাষায় বলা হলো উৎপাদনের উপকরণ ও বণ্টনের সামাজিকীকরণের ভিত্তিতে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য থেকে ভারতকে মুক্ত করার মধ্যদিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
ঐ ঘোষণাপত্রে একটি লক্ষণীয় বিবৃতি ছিল যারা কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্য, তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারবে না। কমিউনিস্ট পার্টিই, সম্ভবত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল যারা সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্যদের নিজ সংগঠনে ঠাঁই দেয়নি।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলায়, সেখানে একটি আরও ব্যাপক ভিত্তিতে একটি বাম মনোভাবাপন্ন পার্টি গড়ে উঠেছিল, ১৯২৫ সালের নভেম্বরে কানপুরে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট সম্মেলনের অল্প আগে। এটির নাম ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধীনে লেবার স্বরাজ পার্টি’, যা ১৯২৬ সালে নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়াল ‘পিজ্যান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পাটি অব বেঙ্গল’। এর প্রাথমিক প্রেরণা এসেছিল বাম মনোভাবাপন্ন স্বরাজ্যপন্থী হেমন্তকুমার সরকার ও বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলামের থেকে মুজফ্ফর আহ্মদ ঐ সংগঠনের মুখপত্র লাঙ্গল-এর সম্পাদক ছিলেন। পার্টির পক্ষ থেকে ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বাধীনতা’-র দাবি উত্থাপন করা হয় এবং কমিউনিস্ট ভাবাদর্শকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি লাঙ্গল পত্রিকা মান্দালয় জেলে ১৯২৪ সাল থেকে বন্দি সুভাষচন্দ্র বসুর সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছিল। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে কৃষকদের অধিকারের বিষয়গুলি প্রচার করা এবং শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। এই মডেলে ১৯২৭ সালের জানুয়ারি মাসে বম্বে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি তৈরি করা হয় এবং একইভাবে উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবে সংগঠন তৈরির পর ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরে অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজ্যান্টস পার্টি গঠিত হয়। এইসব দাবিগুলির অভিন্ন বৈশিষ্ট্য ছিল এগুলির সর্বস্তরে কমিউনিস্টরা ছাড়াও কংগ্রেস সদস্যরা যুক্ত ছিলেন। এই নতুন দলটির শক্তি প্রদর্শিত হলো ১৯২৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, যখন ২০,০০০ শিল্পশ্রমিক কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনের প্যান্ডেলে গিয়ে দাবি করল যে মতিলাল নেহরু রিপোর্টে ডমিনিয়ান স্ট্যাটাসের জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে তা বাতিল করে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করুক। জওহরলাল নেহরু তাদের স্বাগত জানান, সম্বোধিত করেন। এরপরে ২৭শে ডিসেম্বর সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ কংগ্রেসের সভায় নেহরু সভাপতিত্ব করেন এবং ঘোষণা করেন যে কমিউনিজমই ‘একমাত্র রাস্তা’।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম (১৯৪৫-৪৭)
যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের মুখে এবং অক্ষশক্তির পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা, তখন স্বভাবতই কমিউনিস্টদের সামনে জনযুদ্ধের কৌশল থেকে আবার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার কৌশলে ফিরে যাওয়া প্রয়োজন দেখা দিল। ১৯৪৫ সালে সিপিআই কেন্দ্রীয় কমিটি ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারত’-কে ‘চূড়ান্ত ক্ষমতা দখলের অভূতপূর্ব সুযোগের সময়’ বলে বর্ণনা করল। রেড আর্মির সাফল্যে, সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা থেকে পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিকে আলাদা করে ফেলা, চীনে গণমুক্তি ফৌজের সাফল্য, দক্ষিণ এশিয়াতে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম এইসব ঘটনা সাম্রাজ্যবাদের নৈতিক ও বস্তুগত ক্ষমতাকে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং মেট্রোপলিটন দেশগুলিতে জনসাধারণের মনের উপর সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণে বিরাট ক্ষয় হয়। সুতরাং ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও জঙ্গী করে তোলার সম্পূর্ণ যৌক্তিকতা ছিল। যেহেতু সেই প্রতিষ্ঠিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আবার ফিরে আসা হয়েছে অর্থাৎ ভূস্বামী ও রাজ্যন্যবর্গরা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে এবং বুর্জোয়াদের মধ্যেও আপস করার প্রবণতা রয়েছে (ব্রিটিশ বৃহৎ পুঁজি ও তাদের ভারতীয় ভাইদের মধ্যে আঁতাত আসন্নপ্রায় মনে করা হয়েছিল), জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক কৃষকের অর্থনৈতিক সংগ্রাম সংগঠিত করা যেতে পারে (‘ধর্মঘট করা যাবে না’, এই পর্ব অতিক্রান্ত) এই পর্বে কমিউনিস্টরা ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্টের কথা বলেছিল, ‘কংগ্রেস-লিগ ঐক্যে’র পরিবর্তে ‘কংগ্রেস- লিগ-কমিউনিস্ট’ ঐক্যের স্লোগান হাজির করেছিল। যখন আইএনএ বন্দীদের বিচার চলছিল তখন সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় কমিউনিস্ট পার্টি তার তেজ যথেষ্টই দেখিয়েছিল। জনযুদ্ধ পর্বে তাদের সঙ্গে আইএনএ’র বিরোধকে দূরে সরিয়ে রেখে তারা দেশের সাধারণ মানুষের মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আইএনএ-সদস্যদের স্বাধীনতার যোদ্ধা হিসাবেই সম্মান দেখিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ধর্মঘটের পাশাপাশি শিল্প ধর্মঘটও হলো। প্রায় সমান্তরালভাবে বম্বেতে নৌ বিদ্রোহ হলো (১৮-২৩ ফেব্রুয়ারি): কংগ্রেস, লিগ ও কমিউনিস্ট ঝান্ডা উড়তে দেখা গেল নৌবাহিনীর জাহাজে ও দপ্তরগুলিতে। নৌবাহিনীর সাধারণ কর্মীদের সমর্থনে কমিউনিস্টরা শিল্প ধর্মঘটের ডাক দিলে বম্বে অচল হয়ে যায়; ব্রিটিশবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ মারা যায়। এইসব ঘটনা জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে চির অমলিন, কারণ তা স্বাধীনতা অর্জনকে কাছে নিয়ে আসতে অনেকটাই সাহায্য করেছিল।
এই সময়ে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক সংগ্রামও তীব্র হয়েছিল। বাংলায় ১৯৪৪ সালে শুরু হয় তেভাগার আন্দোলন, যার প্রধান দাবি ছিল ফসলের তিন ভাগ কৃষকের এক ভাগ মালিকের এই আন্দোলন পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৪-৪৬ সালে মহারাষ্ট্রের ওরলি আদিবাসীরা বেগার শ্রম, উচ্চ খাজনা ও মহাজনী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধর্মঘটে শামিল হয়। ত্রাভাঙ্কোর-কোচিনে ছোবড়া শিল্প ও অন্যান্য শিল্প শ্রমিকদের উদ্যোগ আরও তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত হয়, এবং ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে রাজ্যজুড়ে ধর্মঘট হয়, সামরিকবাহিনীর গুলিতে শতাধিক স্বেচ্ছা সেবকের মৃত্যু হয়- যাদের আজ ঐ দুই স্থানের নামে পুন্নাপ্পা-ভায়ালার শহীদ বলে স্মরণ করা হয়। ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে তেলেঙ্গানা কৃষকরা নিজাম ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে বিরাট বিদ্রোহ সংগঠিত করল, যা চলেছিল ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এবং ভারতের ইতিহাসে সব থেকে বড় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। এছাড়াও কমিউনিস্টরা অংশ নিয়েছিল শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্সের কাশ্মীর ছাড়ো আন্দোলনে (১৯৪৬ মে)।
এই আন্দোলনের মধ্যে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া (আইএনএ বিক্ষোভ এবং কাশ্মীর ছাড়ো) সবগুলিতেই পুরোপুরি কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব ছিল, কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ সেগুলি সমর্থন করেনি। কংগ্রেস নেতারা নিজেদের শক্তি ও জনগণের মধ্যে বিপুল সমর্থনের উপর ভর করে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে স্বাধীনতা পেতে আগ্রহী ছিলেন। মুসলিম লিগ তার দৃষ্টি নিবন্ধ রেখেছিল কেবলমাত্র পাকিস্তানের স্লোগানে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে (সীমাবদ্ধ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে) এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো যেখানে ‘সাধারণ’ আসনে কংগ্রেস এবং ‘মুসলিম’ আসনে লীগ জিতল; প্রাদেশিক বিধানসভা নির্বাচনে কমিউনিস্টরা মাত্র ২.৫ শতাংশ ভোট পেল। সিমলা কনফারেন্স ও ক্যাবিনেট মিশনে (১৯৪৬) যেভাবে পরিকল্পনা ও পাল্টা পরিকল্পনা বেরিয়ে এল তাতে সিপিআই’র পথে মুসলিম লিগের অবস্থানকে সমর্থন করা উত্তরোত্তর কঠিন হয়ে পড়ল। এটা স্পষ্ট হয়ে গেল লিগ নেতারা আগের মতই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের রয়ে গেছেন। এই বিষয়টি স্বীকার করা হলো রজনী পাম দত্তের (জুলাই ১৯৪৬) লেখা ‘ফ্রিডম ফ্রম ইন্ডিয়া’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধে, যেখানে তিনি বর্তমান লিগ নেতৃবৃন্দকে ‘বৃহৎ মুসলিম ভূস্বামী’ বলে বর্ণনা করলেন, যা ১৯৪২ সালে ঐ একই নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে গঙ্গাধর অধিকারীর মূল্যায়নের সম্পূর্ণ উলটো। বাস্তবের মাটি থেকে দাবি অবনতি হওয়ায় আশঙ্খিত হয়ে পার্টি আরেকবার নেহরুর কাছে আবেদন করে ‘সরকারকে পুনর্গঠিত করে প্রগতিশীল চেহারা’ দেওয়ার জন্য। ১৯৪৮ সালে ৩০শে জানুয়ারি গান্ধি হত্যার পর যাঁরা শোক জানিয়েছিলেন তাদের সামনের সারিতে ছিল কমিউনিস্টরা এবং সব থেকে বেশি দৃঢ়তার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল।
স্বাধীনতার (১৫ আগস্ট ১৯৪৭) পর স্বাভাবিকভাবেই এই পর্বের অবসান হলো, নেহরু সরকার স্থিতিশীল হলো তখনই পার্টির সামনে বৃহৎ পুঁজিপতি, ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণের অবশিষ্টের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রশ্ন উঠে এল। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে বি টি রণদিভে এক নতুন চরমপন্থী লাইন উপস্থিত করলেন এবং সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশীকে সরিয়ে তিনি সাধারণ সম্পাদক হলেন। এর থেকে বোঝা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন এসেছে, যেখানে জাতীয় আন্দোলনের লক্ষ্য অনেকাংশেই পূর্ণ হয়েছে, এক্ষেত্রে নতুন নীতি গ্রহণ করতে হবে।
তাই যখন স্বাধীনতা এল, কিন্তু ক্ষমতা চলে গেল সম্পত্তিবান শ্রেণির কাছে, সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অনেক প্রভাবই রয়ে গেল, কমিউনিস্টরা প্রতিজ্ঞা করল যে দেশের সম্পূর্ণ মুক্তির জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে, যে লক্ষ্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনে উঠে এসেছিল, জনসাধারণকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এই সংগ্রাম চলতে থাকায় জাতীয় আন্দোলনে তারা নিজেরা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য কী অবদান রেখেছিল তা বিস্মৃতিতে চলে যেতে থাকল। তাই আজ সোজা কথা সোজা বলাই ভালো, আজ স্মরণ করা দরকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সেইসব অজস্র সদস্য ও বন্ধুদের যাদের আত্মত্যাগ সেই মহান সংগ্রামের অংশ, যা শেষ পর্যন্ত দেশকে স্বাধীন করেছিল।