কবি বাল্মীকি নাকি এক বিরহাতুর পাখিকে দেখেই লিখেছিলেন ‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।/ যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।’ এটিই নাকি আদি কবিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বার বার এসেছে পাখির কথা। শেলির ‘টু এ স্কাইলার্ক’ বা জন কিটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’-এর বিষয়ও সেই পাখি। কিন্তু কাব্যের জগত আর বাস্তব এক নয়। কাব্যে আদরণীয় অনেক পাখিই আজ বিপন্ন। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রজাতির পাখি।
প্রকৃতির অপরূপ অলংকার হয়ে ওঠা এই পরিযায়ী পাখির ঝাঁক বেঁধে উড়ে চলার দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন জলরঙে আঁকা ছবি। প্রতি শীতে দূর-দূরান্ত থেকে শীতের পাখিরা আসে আমাদের দেশে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ পাখি দেখতে ভিড় করে বিভিন্ন জলাশয়ে। পাখিদের কলকাকলি যেন প্রকৃতির শোভা বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। গাছের সবুজ, জলের নীল আর পাখিদের নানা রং মনে যে বর্ণিল আবেশ তৈরি করে তার রেশ রয়ে যায় অনেক দিন।
পরিযায়ী পাখি নিয়ে লিখতে বসার সমস্যা বিস্তর। আমাদের এদিকে, মানে পশ্চিমবঙ্গ বা পূর্ব ভারতে, কী ধরণের পরিযায়ী পাখি আসে সে সম্পর্কে মানুষের খুব একটা সম্যক ধারণা নেই। অনেকেই মনে করেন শীতকালে এ চত্বরে সাইবেরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বা ক্যাস্পিয়ান সাগর সংলগ্ন অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়।
মূলত পরিযায়ী পাখিরা আসত উত্তরের হিমালয়, সুদূর সাইবেরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার শীতপ্রধান বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, যেখানে শীতকালে তাপমাত্রা অনেক নিচে নেমে যায় এবং জলাশয়গুলোর জল জমে গিয়ে পাখিদের বসবাস ও খাদ্য সংগ্রহের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তারা আসত অপেক্ষাকৃত উষ্ণ জলবায়ুর টানে, যেখানে তাদের বসবাস হবে স্বস্তিদায়ক এবং খাদ্যের কোনো অভাব হবে না। কিন্তু বিগত প্রায় দুই দশক ধরে এসব পাখির আসা কমতে শুরু করে; সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কমে গেছে।
সাধারণ ভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছে, খাদ্যের সন্ধানে এবং শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে শীতল অঞ্চলের পাখিরা আপেক্ষাকৃত উষ্ণ দেশগুলিতে চলে যায়। উষ্ণ দেশগুলিতে এই সময়ে ফল, পোকামাকড়ের প্রাচুর্য থাকায় সহজে খাদ্য মিলে যায়। সাধারণত পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে স্বল্প, মধ্যবর্তী ও দীর্ঘ— তিন ধরনের পরিযান লক্ষ করা যায়। স্বল্প দৈর্ঘ্যের পরিযানের ক্ষেত্রে সাধারণত খাদ্যের অভাবে পাখিরা দলে দলে আশেপাশে চলে যায়। তবে নিয়মিত ভাবে এমনটা ঘটে না। সাধারণত চাতক, পাপিয়া, খয়েরি ডানা পাপিয়া প্রজাতির পাখির মধ্যে এই ধরনের পরিযান দেখা যায়। যে সব পাখি হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে একটি জায়গা থেকে অন্য কোথাও যায় তাদের দীর্ঘ পরিযায়ী পাখি বলে। আর যে সব পাখিরা এই দুই দূরত্বের মাঝামাঝি দূরত্ব যাতায়াত করে তাদের মধ্য পরিযায়ী পাখি বলে। নীল শির, লাল শির হাঁস, লেজ্জা হাঁস, ক্ষুদে গাঙচিল প্রভৃতি পাখিকে দীর্ঘ দৈর্ঘ্যের পরিযায়ী পাখি বলা হয়ে থাকে। এরা পাড়ি দেয় ঝাঁকে ঝাঁকে। বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূল রেখা, পাহাড় শ্রেণি, নদী ও সূর্যের অবস্থান, প্রভৃতি এদের পথ দেখানোর কাজ করে। আবার বিজ্ঞানীদের একাংশের মতে, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রও এদের পথ চিনতে সাহায্য করে।
সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, এই দুই ধরনের পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। তবে কয়েক হাজার প্রজাতির পাখির বিলুপ্তির পরেও পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ৯৯০০ থেকে ১০,০০০ প্রজাতির পাখি বেঁচে রয়েছে। কিন্তু তাদের অবস্থাও ভাল নয়। পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দু’টি বিষয়কে দায়ী করছেন। প্রথম হল পরিবেশ দূষণ। দূষণ নানা ভাবে পরিযায়ী পাখিদের ক্ষতি করছে। আমরা জলাশয় নির্ভর পরিযায়ী পাখিদের কথা বলেছিলাম। এই সব জলাশয়ে দূষণ হলে পরিযায়ী পাখিদের পক্ষে সেখানে কয়েকটি মাস বাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দূষণের জেরে পরিযায়ী পাখিরা তাদের ঘুরে বেড়ানোর মতো উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না।
পরিযায়ী পাখিকে অনেকে অতিথি বিদেশি পাখিও বলে থাকেন। রাজহাঁস, কালেম ডাহুক, ছোট সারালি এগুলিকেও পরিযায়ী পাখি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পরিযায়ী পাখিদের একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে শিকারি পাখিরা। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে একটি শ্রেণি জলাশয় নির্ভর। পশ্চিমবঙ্গে শীতে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় দেখা যায় রবীন্দ্র সরোবর, কুলিক, বর্ধমানের ছাড়িগঙ্গার পাড়ে চুপি, সাঁতরাগাছি বিল, মুকুটমণিপুরের মতো এলাকায়। আর অন্য শ্রেণির পরিযায়ী পাখিরা লোকালয়ের আশেপাশে ভিড় করেন। বাগানে, খেতের আশেপাশে শীতে এদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।
প্রতি বছর পরিযায়ী প্রজাতির পাখিরা একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে, একটি জায়গা থেকে অন্য একটি জায়গায় উড়ে যায়। ঋতু পরিবর্তনের পরে আবার আগের জায়গায় ফিরেও আসে। বিশাল পাখির সাম্রাজ্যে এমন বেশ কয়েকটি শ্রেণির পাখি আছে, যারা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অন্য জায়গায় পাড়ি দেয়। এদের পরিযায়ী পাখি বলে। এই পাখিদের আবাস নিরাপদ রাখতে ও বিচরণ স্বাভাবিক রাখতে প্রত্যেক বছরের ১১ মে দিনটি বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কেন এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হল? ১১ মে-র কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা থেকে পাখিরা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দিকে উড়ে যায়। তাই এই দিনটিকে ‘বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস’ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে এই উদ্যোগ। ২০০৬ থেকে দিনটি পালন করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, এই দুই ধরনের পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। তবে কয়েক হাজার প্রজাতির পাখির বিলুপ্তির পরেও পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ৯৯০০ থেকে ১০,০০০ প্রজাতির পাখি বেঁচে রয়েছে। কিন্তু তাদের অবস্থাও ভাল নয়। পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা দু’টি বিষয়কে দায়ী করছেন। প্রথম হল পরিবেশ দূষণ। দূষণ নানা ভাবে পরিযায়ী পাখিদের ক্ষতি করছে। আমরা জলাশয় নির্ভর পরিযায়ী পাখিদের কথা বলেছিলাম। এই সব জলাশয়ে দূষণ হলে পরিযায়ী পাখিদের পক্ষে সেখানে কয়েকটি মাস বাস করাও কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় প্লাস্টিক দূষণের জেরে পরিযায়ী পাখিরা তাদের ঘুরে বেড়ানোর মতো উপযুক্ত জায়গা পাচ্ছে না। তার জেরে তারা এই সব জলাশয়ে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের সদর শহর বর্ধমানের কৃষ্ণসায়র এবং পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরের বিভিন্ন জলাশয়ে এই দূষণের জেরে বহু পরিযায়ী পাখিরা আসা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে করেন পরিবেশপ্রেমীদের একাংশ। তার সঙ্গে পরিযায়ী পাখিদের চোরাশিকারের মতো ঘটনা তো রয়েইছে। পাশাপাশি, পরিযায়ী পাখিদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরও একটি কারণ হল তাদের আসার জায়গাগুলি হারিয়ে যাচ্ছে। জলাশয় বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে। জলাশয়ের ছোট হয়ে যাচ্ছে। ফলে, পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে। জলাশয় নির্ভর পরিযায়ী পাখি ছাড়াও যে সব পরিযায়ী পাখি লোকালয়ে বাস করে, লোকালয়ে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আবাসনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে সেই সব পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমছে।
এক সময় কলকাতা পুরসভার এম্বলেমে ছিলো একজোড়া হাড়গিলে পাখি। সেটা ছিলো কলকাতা পুরসভার প্রথম ‘এম্বলেম’। কালের নিয়মে ও পরিবেশ সংক্রান্ত উদাসীনতায় হাড়গিলে , শকুনের মত পাখিরা বিপন্ন হয়ে যায়। ১৯৬১ সালে ২২শে ফেব্রুয়ারী কলকাতা পৌরসংস্থার ‘এম্বলেম’ পরিবর্তীত হয়ে আজকের ‘পুরশ্রী বিবর্ধন’ করা হয়। দেখা গেছিলো আমাদের মোবাইলের ব্যবহারের সাথে কমে এসেছিলো আমাদের বাংলার পাখির সংখ্যা।
আমাদের রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় পরিযায়ী পাখিদের কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু পরিবেশের দিকে নজর দেওয়া এবং পরিযায়ীদের জন্য বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারায় আমরা তা হারাচ্ছি। সরকারের এবং সাধারণ মানুষের এই বিষয়গুলি নিয়ে সচেতন হওয়ার সময় এসেছে। পরিযায়ী পাখিরা আমাদের আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশে যে ভূমিকা নিতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখে পরিবেশকে বাঁচিয়ে উন্নয়ন হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এতে এক দিকে, যেমন, সাধারণ মানুষের উপকার হবে, অন্য দিকে তেমনই এই পাখিদের রক্ষার মাধ্যমে রক্ষা পাবে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রও।