মহাত্মা, তার মাহাত্ম্য এবং একটি বিপথগামী আন্দোলন
ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ
“মহাত্মা, তার মাহাত্ম্য এবং একটি বিপথগামী আন্দোলন” – মূল রচনাটি ইংরেজিতে, ১৯৯৪ সালে ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত। ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত ই এম এস নাম্বুদিরপাদের রচনাগুলি একত্রে ‘ফ্রন্টলাইন ইয়ার্স’ শিরনামে লেফটওয়ার্ড একটি বই-এর আকারে প্রকাশ করে। সেই বই থেকেই একটি লেখার সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ ২রা অক্টোবর গান্ধী জয়ন্তী দিবসে পার্টির রাজ্য ওয়েবসাইটের পক্ষে পুনঃপ্রকাশ করা হল।
মহাত্মা জীবিত থাকলে এবছর ২রা অক্টোবর তার ১২৫ বছর বয়স হতো। ঐ দিন সারা দেশের সর্বত্র প্রতিবেদন, প্রবন্ধ এবং বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীজীর অবদান বর্ণনা চলে এবং সবশেষে তাকে “জাতির জনক” বলে অভিহিত করা হয়। বলা হয় সদ্য স্বাধীন ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতা তিনিই।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গান্ধী হলেন সেই একজন ব্যাক্তি যিনি ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট স্বাধীনতার প্রাক্কালে গোটা দেশে যে উৎসব পালিত হয়েছিল তাতে যোগ দেন নি। তার জীবনীলেখক তেন্ডুল্করের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া চলে “ গোটা দেশে উৎসব পালিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই মানুষটি, যিনি বৈদেশিক শক্তির হাতে থেকে দেশের মুক্তিলাভের জন্য অন্য সকলের চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি এইসব আনন্দোৎসবে অংশ নেন নি। দেশের স্বাধীনতার পুন্য তিথিতে জনগণের জন্য মহাত্মার বার্তা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারত সরকারের তথ্য এবং সম্প্রচার দফতরের একজন আধিকারিক গান্ধীর সমীপে উপস্থিত হলে, তিনি তাকে বলেন “বলার মতো তার সব রসদ ফুরিয়ে গিয়েছে”। জনগণের উদ্দেশ্যে তার তরফে কোন বার্তা না গেলে ভালো দেখায় না বলা হলে তিনি উত্তর দেন “ আমার কিছুই বলার নেই, যদি এমন স্বাধীনতা অমঙ্গলজনক হয়, তবে তাই হোক” (খন্ডঃ ৮, পৃষ্ঠা – ৯৫৬)
এর পাঁচ মাস পরে তার হত্যা হবার চারদিন আগে, ১৯৪৮ সালের ২৬শে জানুয়ারি দিনটিকেই গান্ধীজী স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করে বলেন “আজ, ২৬শে জানুয়ারিই হল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা লাভ কিংবা চর্চা করার অনেক আগে থেকে এই দিনটিকেই আমরা যথাযথ রুপে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করে এসেছি। এখন আমরা স্বাধীন ভারতে বাস করছি এবং স্বাধীনতা সম্পর্কে আমাদের মোহমুক্তিও ঘটেছে। আপনাদের জন্য না হলেও অন্তত আমার ক্ষেত্রে একথা সত্যি” (খন্ডঃ ৮, পৃষ্ঠা – ৩৩৮)
স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে মহাত্মাই প্রথম ব্যক্তি যিনি উপলব্ধি করেছিলেন দেশের মুক্তি আন্দোলনের সময় যে “স্বাধীনতা প্রাপ্তি” সম্পর্কে যে সকল মনোরম ধারণার নেতৃত্বে তিনি ছিলেন প্রাপ্ত স্বাধীনতার চেহারার সাথে তার অনেকটাই ফারাক ছিল। ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকার, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের অভ্যন্তরীণ সমঝোতার ফলাফলে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার ঢেউ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়াই ছিল তাঁর এমন উপলব্ধির প্রধান কারন। ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে কখনো এমন ঘটেনি, আগে কখনো হিন্দু এবং শিখেরা একজোটে এবং আরেকদিকে মুসলমানেরা একে অন্যকে এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করতে উদ্যত হয় নি – যেমন পরিস্থিতি ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্টের কয়েকমাস আগে আর পরে সৃষ্টি হয়েছিল।
গান্ধী সর্বদা বলে এসেছেন দেশের মুক্তি আন্দোলনের যে রুপরেখা তিনি নির্মাণ করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল সৌহার্দ্য, ঘৃণা কখনোই নয়। দেশের জনগণ যদি সত্যিই সেই পথ অনুসরন করত তবে তার দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো ভয়ানক এবং নির্মম অত্যাচারিদের হৃদয় অবধি নিশ্চিত পরিবর্তন ঘটত। এর বদলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হল যেখানে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তো দূর অস্ত, দেশের জনগণ নিজেদের হৃদয় পরিবর্তন করতেও রাজি হল না।
১৫ই অগাস্টের এক মাস পূর্বে, জুলাই মাসের ১৪ তারিখে তিনি বললেন – ” আমরা বিগত ৩০ বছর ধরে যে পথে চলেছি তাকে অহিংসা নয়, বরং অপ্রতক্ষ্য প্রতিরোধ বলাই সমীচীন। এমনটা তখনই করা হয় যখন ইচ্ছা থাকা সত্বেও কোনও যুদ্ধের দুর্বল পক্ষের দ্বারা অস্ত্রপ্রয়োগে প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হয় না। কেবলমাত্র সিংহহৃদয় মানুষই প্রয়োগ করতে পারে এমন প্রকৃত অহিংসা প্রয়োগে আমরা অক্ষম। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনগুলির আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চিনতে পেরে ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধে উঠে নিজেদের লাখো লাখো সহায়-সম্বলহীন জনগণের কল্যানার্থে একজোট হয়ে না চলে, এমন একজোড়া ভারত তৈরি হয়েছে যার একপক্ষ সর্বদা আরেকজনকে গভীর সন্দেহের চোখে দেখে। অহিংসার প্রকৃত পথে চললে আমরা পৃথিবীর সমীপে মুক্ত ভারতের সম্পূর্ণ অন্য এক ছবি তুলে ধরতে পারতাম।” (খন্ডঃ ৭, পৃষ্ঠা – ৫৭)
গান্ধীর অবদান ব্যাখ্যায় অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়, নিজস্ব বিশ্বাস অনুযায়ী তিনি প্রানত্যাগের আগের মুহূর্ত অবধি মহাপাতক সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লড়াই করেছেন। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার মৌষলপর্ব থেকেই; কলকাতায় ১৯৪৬ সালের ১৬ অগাস্ট মুসলিম লিগ “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে” পালনের ঘটনা দেশে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়তে ইন্ধনরূপ ছিল, গান্ধী জনমানসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
দাঙ্গা যখন ক্রমশ শহরের পরিধি ছাপিয়ে উঠে গ্রামে গ্রামে প্রবেশ করে, তিনি অন্য সব কাজ ফেলে ঐক্যের বানী প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই একতার বানী এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে প্রচারের কাজে তাকে বাংলার অন্তর্গত নোয়াখালী জেলায় বসবাস শুরু করতে হয়েছে। কিছুদিন বাদে ঐ কাজেই নোয়াখালী ত্যাগ করে বিহারে গেছেন, পাঞ্জাবে যেতে চেয়েছিলেন – কলকাতায় ফিরে আসেন, পুনরায় দিল্লীতে যান। সেই সময় প্রতিদিন সকালে প্রার্থনাসভা শেষ করেই তিনি ব্যাস্ত থাকতেন সাম্প্রদায়িক হিংসার মোকাবিলায়, দাঙ্গাপীড়িতদের সুরক্ষায় এবং রিফিউজিদের প্রয়োজনীয় সংস্থানের বন্দোবস্ত করতে।
গান্ধী বুঝেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিষের মাত্রা সকলের মধ্যে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে কোন একজন যদি ঐক্যের কথা প্রচার করতেও চায়, তাকে যুযুধান দুইপক্ষের উন্মাদেরাই নিশানা করবে। এমন পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের ঝুঁকির সম্ভাবনার কথা জেনেও তিনি সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধে নেমেছিলেন। জানুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে রাজকুমারি অমৃত কৌরের সাথে গান্ধীর কথাবার্তায় এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়; ‘কোন উন্মাদের বুলেটে প্রান হারাতে হলে’ তিনি হাসিমুখে তার সম্মুখীন হবেন – মহাত্মা বলেছিলেন। তিনি প্রত্যয়ী ছিলেন মৃত্যুর মুহূর্তেও তার চেতনায় কারোর প্রতি ক্রোধ থাকবে না। এই কথাবার্তার ঠিক দুদিন পরেই যা ঘটেছিল সেরকম কোন সম্ভাবনার প্রতি তার বক্তব্য ছিল “আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠান করবেন স্বয়ং ঈশ্বর আর বিষাদভরা এক সুর বইবে আমার অধর জুড়ে।”
স্বাধীনতা আন্দোলনে গান্ধীর অনুগামীরা ক্রমশ দেশের ক্ষমতায় আসীন হবার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে পড়ছিলেন, একথা কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে তিনিই সবার আগে বুঝেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের এক বছর পূর্বে, ১৯৪৬ সালের জুলাই মাসে লেখা একটি চিঠিতে সেই আক্ষেপের প্রমাণ মেলে – চিঠির শিরোনাম ছিল “এক দুঃখজনক প্রপঞ্চ”। এই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন “আমার ঠিকানায় এমন অজস্র চিঠি আসছে যাতে পত্রলেখকেরা বিধানপরিষদের সদস্য হবার আর্জি পেশ করেছেন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের তুলনায় আত্মস্বার্থ কামনাকে উর্ধে স্থান দিতে চাইবার বাসনাই বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতির এক সাধারণ ইঙ্গিত, একথা অনুমান করে আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ছি…… বিধানপরিষদে সদস্য হবার আবেদনপত্র পাঠানো সংক্রান্ত ব্যাধির প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যেই আমি এই চিঠি লিখতে বসেছি, কারা বিধানপরিষদের সদস্য হবেন সেই ব্যাপারে আমার তরফে কোনোরকম হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা যেন কেউ না করে।” (খন্ডঃ ৭, পৃষ্ঠা – ১৮৬)
কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যা বেড়ে ভয়ানক চেহারা নেয়, নিজস্ব সহায়কদের থেকে গান্ধী সেই খবর পেয়েছিলেন। ১২ই জানুয়ারি সান্ধ্যকালীন প্রার্থনাসভার কাজ শেষ হলে অন্ধ্রপ্রদেশের এক বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা – দেশভক্ত কোন্ডা ভেঙ্কটাপ্পায়া’র চিঠি থেকে উদ্ধৃতিসহ পরেরদিন থেকে তিনি অনশন শুরু করার ঘোষণা করেন। সেই চিঠিতে উল্লেখ ছিল – ” বহুবিধ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার অনুষঙ্গে আমার মতে কংগ্রেস কর্মীদের নৈতিক বিচ্যুতিই হল বর্তমানে প্রধান সমস্যা। আমি দেশের অন্যান্য প্রদেশের কথা জানি না, কিন্তু আমার এখানে অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার আস্বাদন তাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে …… সংগঠনের ভিতরে নানা কাজে, বিধানসভা ও বিধানপরিষদের বহু সদস্যের আর্থিক উন্নতিকল্পে ব্যস্ততায় এবং মন্ত্রীদের নানা ক্ষেত্রে দুর্বলতা প্রকাশে জনগণের এক বড় অংশের মধ্যেই সরকারের প্রতি বীতরাগ জন্মেছে, বলা চলে জনমানসে বিদ্রোহের মেজাজ তৈরি হয়েছে। কংগ্রেসের প্রতি অভিসম্পাত করা ছাড়াও জনগণের বক্তব্য এর চাইতে ব্রিটিশ সরকার ভালো ছিল” (খন্ডঃ ৭, পৃষ্ঠাঃ ৩০২-৩০৩)
কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা নতুন এই মানসিকতা গান্ধীকে কংগ্রেসের ভবিতব্য নিয়ে চিন্তিত হতে বাধ্য করে। তার জীবনের শেষের দিকে কংগ্রেসের দলীয় সংবিধানের খসড়ায় তিনি লেখেন ” বর্তমানে কংগ্রেস যে চেহারায় রয়েছে তাকে বড়জোর প্রচারমূলক সংগঠনের পাশাপাশি কেবল একটি সংসদীয় প্রতিষ্ঠান বলা চলে। বিবিধ শহরাঞ্চল ব্যাতিরেকে সামাজিক, নৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রক্ষিতে ভারতের সাত হাজার গ্রামীণ এলাকার এখনও বহু পথ চলা বাকি রয়েছে। গনতান্ত্রিক কাঠামোয় পরিণত হবার লক্ষ্যে দেশের নাগরিক সক্ষমতাকে সামনে এগিয়ে এসে সামরিক ক্ষমতার উর্ধে আসীন হতে হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সাথে ক্ষমতা প্রদর্শনের যাবতীয় অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় কংগ্রেসের থাকা উচিত নয়। এই কারনেই এবং একইধরনের আরও অনেক কারনে কংগ্রেসের উচিত পার্টি সংগঠনের বর্তমান কাঠামোটিকে বাতিল ঘোষণা করা। বর্তমান ভারতের নিয়মবিধি মোতাবেক একটি ‘লোক সেবক সংঘ’ গঠন করে আমাদের এগিয়ে যাওয়া উচিত যা সময়ের দাবী অনুযায়ী প্রচলিত আইনব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংশোধনে সক্ষম থাকবে। অর্ধশতাব্দীরও বেশী সময় ধরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা স্বীকার করছেন যে স্বপ্নের জন্য তিনি লড়াই করেছিলেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট সেই স্বাধীনতা আদৌ অর্জন করা যায়নি, ক্ষমতার বলে বলিয়ান হয়ে তাঁর প্রাক্তন শিষ্যরাই এমন স্বার্থপর এবং কুচক্রী হয়ে পড়েছেন যে নিজের হাতে গড়ে তোলা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের গোটা সংগঠনটাকেই তিনি বাতিল করে দিতে চান – একমাত্র গান্ধীর পক্ষেই এতটা হিম্মত দেখানো সম্ভব ছিল। সত্যের উপলব্ধি প্রকাশের হিম্মতের জন্যেই তাকে প্রকৃত মহাত্মা বলা যায়, যিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন তার গোটা জীবনটাই লক্ষ্যভেদে ব্যার্থ।
৮ই অক্টোবর – ১৯৯৪
ওয়েবডেস্কের পক্ষে বাংলা অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ