বিশ্বনাথ গুপ্ত
রাজনীতি মানে তো রাজার নীতি নয় ; নীতির রাজা। বাংলা ব্যাকরণের আঙ্গিকে ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস। অর্থাৎ রাজনীতি মানে শ্রেষ্ঠ নীতি। আর সেই নীতি তখনই শ্রেষ্ঠ, যখন তা মানুষের কল্যাণ সাধন করে। এই রাজ বা শ্রেষ্ঠ নীতি তো ব্যবহার হয় রাষ্ট্রনীতির প্রয়োগে। আর সেই নীতি কার্যকর করতে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় থাকে রাজনৈতিক দল। তারাই ঠিক করে এই রাষ্ট্রনীতির অভিমুখ। আমাদের মতো দেশে অধিকাংশ মানুষের গণতান্ত্রিক মতামত দানের মাধ্যমে গঠন হয় সরকার। কিন্তু তারপর! দিন যায়, বছর যায় – মানুষের কল্যাণময় শ্রেষ্ঠ নীতির আর প্রয়োগ ঘটে না!
একটি নির্বাচিত সরকার ঘটা করে দায়িত্ব নেয় মানুষের, দেশের নাগরিক সুরক্ষার ! কি তার ন্যুনতম দায়িত্ব? অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান – এটা তো মৌলিক দাবী দেশের একজন নাগরিকের ; কিন্তু তার সাথে যুক্ত হয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কর্মসংস্থান। আর একটি দেশ ও তার নাগরিকের কল্যাণের স্বার্থবাহী ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে একমাত্র মার্কসীয় অর্থনীতির প্রয়োগে। রাষ্ট্র বুঝে নেবে – নাগরিকদের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব স্বাস্থ্য, শিক্ষা আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সকলে খেয়ে পড়ে বাঁচার মতো বাঁচবে। সকলে দেশের জন্য যোগ্যতা অনুযায়ী দেবে আর দক্ষতা অনুযায়ী পাবে। এ কোনো স্বপ্নকথা নয় ; এটাই মার্কসীয় অর্থনীতির ছন্দে চলা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই উদাহরণ আজও বিদ্যমান। বিংশ শতাব্দীর দুইয়ের দশকে যার প্রকৃষ্ট বীজ বপন হয়েছিল রাশিয়ায়। আর এই বিশ্বাস নিয়ে দেশে দেশে কাজ করে একমাত্র কমিউনিস্টরা ; আমাদের দেশে সিপিআই(এম) এই প্রত্যয়েই চলে।
কিন্তু বাস্তবের ভারত ? শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের দায়িত্ব ক্রমশঃ দেশের বিজেপি সরকার নিতে নারাজ! পরিণতিতে, এই মানবসম্পদ – এখন বেসরকারি হাতে! ফলে, টাকা যার সে-ই শিখবে, আবার সে-ই অসুস্থতা মুক্ত হয়ে জীবন ফিরে পাবে। আর কর্মসংস্থান? দেশজুড়ে তথাকথিত উন্নয়নের ঢক্কানিনাদ, “আচ্ছে দিন” -এর শ্লোগান! কাজ নেই ; কাজ চলে যাচ্ছে – হাহাকার! একে বলা হয় – Job Lost Growth বা কর্মচ্যুত উন্নয়ন! বেসরকারি বড়ো বড়ো বিনিয়োগকারীরা এখন ফাটকা কারবারে ব্যস্ত। চাপ কম ; শ্রমিক নেবার দরকার নেই, উৎপাদন কি করবে কোনো ভাবনা নেই, উৎপাদন করার কাঁচামাল কেনার তাগিদ নেই! আর তাই মানুষের হাতে বেসরকারি ক্ষেত্রে কাজ নেই, মজুরি নেই ; বর্তমানে উৎপাদন পুঁজির চেয়ে ফাটকা পুঁজির পরিমাণ প্রায় ১৫ গুণ বেশি! যতটুকু বেসরকারি উৎপাদন সংস্থা বেঁচে আছে, তাঁরাও শিল্পে কর্মী ছাঁটাই করছে। দেশের সরকার, তার অধীন সরকারি লগ্নীকরা শিল্পগুলিকে “বিলগ্নীকরণের পথে চলার নীতি” গ্রহণ করে চলেছে। সরকারি সম্পদ বিক্রি চলছে বেসরকারিদের হাতে!
একুশ শতকের তৃতীয় দশকে, ফাটকা পুঁজি বাজার দখল করছে! ধান্দার গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করছে রাজনীতির আঙ্গিনা। ফুটে উঠছে কাজ হারানো আর কাজ না পাওয়ার যন্ত্রনা! সংগঠিত হচ্ছে দেশজুড়ে মানুষ। কৃষি ভিত্তিক দেশে কৃষকের দাম নেই! আত্মহত্যার লম্বা লাইন বাড়ছে! বাড়ছে লিঙ্গভেদের সমস্যা – নারী নির্যাতন! বিলকিস বানুর মতো নারীরা প্রায় প্রতিদিন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়! দেশ সামাল দেবার দায়িত্বে থাকা দেশের সরকার নিজেই আজ বেসামাল! ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটা নাটকীয় ভঙ্গিতে বোঝাতে ব্যস্ত – কুচ নেহি হুয়া! আর তাই – “সংগঠিত হতে দিওনা সব যন্ত্রণা আর ক্ষোভকে।” সেকারণেই, “কভি মত্ ভুল, Divide & Rule” তত্ত্বের আমদানি করছে এদেশের শাসক দল বিজেপি। “কখনও বর্ণভেদে, কখনও ধর্মভেদে বিভক্ত করে দাও এই ক্ষোভে ফেটে পড়া সংগঠিত শক্তিকে। এভাবেই রাজনীতির সাথে যুক্ত করো ধর্মকে! শুরু করে দাও ভুখা পেট নিয়ে জাতপাত আর সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি! নতুন মগজ ধোলাই করো ইতিহাস শিক্ষা বিকৃতি ঘটিয়ে!” সুতরাং আমাদের বামপন্থীদের লড়াইটা এখন ধর্মযুক্ত রাজনীতিকে ধর্মমুক্ত করে সংগঠিত করতে হবে গরীব মানুষকে তার অর্থনৈতিক আন্দোলনে, শোষণ যন্ত্রনার মুক্তির শপথে। তাই অঙ্কের নিয়মে দেশের বর্তমান অবস্থার সমীকরণে সৃষ্ট “রাজনীতি + ধর্ম = সাম্প্রদায়িকতা” কে পাল্টে ফেলে তৈরী করতে হবে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত রাজনীতি।
অপরদিকে, এদেশের অঙ্গরাজ্য, আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ১১ বছর ধরে শাসনভার চালাচ্ছে একটি দক্ষিণপন্থী দল তৃণমূল কংগ্রেস।
“বদলা নয় বদল চাই” – এর শ্লোগান দেওয়া দলটা ১১ বছর ধরে প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে গেছে বামপন্থীদের উপর। তবুও বামপন্থীরা রক্তাক্ত হয়েও, মানুষের দাবী নিয়ে রাস্তায়। “পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে” বলে যারা অমৃত কথা ছড়ালো, তারাই এরাজ্যে একের পর এক নির্বাচনে, প্রশাসনকে দাঁড় করিয়ে রেখে, মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেয় নি এই বলে, “দাদা বা বৌদি, কাল ভোট দিতে যাবেন না! অথবা ভোটের দিন বুথ পর্যন্ত পৌঁছাতে না দিয়ে বলতে শোনা গেছে, মাসীমা বাড়ি যান! আপনার ভোট হয়ে গেছে! কিংবা ভোটে বিরোধীদের প্রার্থী না দিতে দেওয়া!” শুধু ব্যক্তি অপমান নয়, গণতন্ত্রকে ICCU তে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে রাজ্যের এই টিএমসি সরকার।
“সততার প্রতীক” বলে যে দলের কর্মীরা গলা ছেড়ে চিৎকার করতো, যে দল দেওয়ালে দেওয়ালে, ব্যানারে, ফ্লেক্সে আঁকিবুকি করতো “সততা” বলে, সেই দলের সততা এখন এক কঠিন প্রশ্নের মুখে। ইদানিং আর “সততার প্রতীক” বলে টিএমসির কাউকে বলতে শোনা যায় না! সারদা, নারদা, রোজভ্যালী, সদ্য শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি, গরু পাচার, কয়লা পাচারে জর্জরিত গোটা দলটা! সাথে, বিজেপিকে পাল্লা দিয়ে চলছে তৃণমূলের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি! “ভোটার তুমি ভোট লাইনে দাঁড়াও ; ‘মানুষ’ পরিচিতি ভুলে যাও ; পরিচিতি হোক তোমার ‘হিন্দু’ ভোটার কিংবা মুসলিম ভোটার।” আখেরে সুবিধা! দুর্বৃত্তায়ন ভুলে যাবে মানুষ। সাথে থাকবে প্রতিশ্রুতির লালিপপ। ‘যৎসামান্য দেব, আর অনেক কামাবো’ পেশায় যুক্ত হচ্ছে বাংলার শাসকের রাজনীতি। পেশা আজ শুধু চাকরি বা ব্যবসায়ে সীমাবদ্ধ থাকছে না! রাজনীতিকে ব্যবহার করে, অসৎ জীবিকা নির্বাহের পেশা আজ টিএমসির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এশুধু তৃণমূল দলের জন্য নয় ; যারা এই তৃণমূল দল থেকে সময় বিশেষে এরাজ্যে বিজেপিতে যাচ্ছে, তারাও দুর্নীতি মুক্ত নয় ; কেউ হচ্ছেন দল পালটে বিজেপির এমএলএ, কেউবা টিএমসিতে যোগদান করে বিজেপির বিধায়ক থেকে, হয়ে যাচ্ছেন পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান, আবার কেউ হচ্ছেন বিরোধী দলনেতা! এদেরও দেখা গেছে নারদ ষ্ট্রিং অপারেশনের ভিডিওতে! কিন্তু এদের ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত নেই! কেন?
আসলে, নিজেদের দুর্নীতির পর্দা ফাঁস যাতে না হয়, সেজন্য বিজেপিতে যাওয়া বা সখ্যতা। ভাবটা এমন – বিজেপি যেন ওয়াশিং মেশিন। তাই এরাজ্যে দুর্নীতির ক্ষেত্রে “চোর ধরো, জেল ভরো” শ্লোগান পশ্চিমবাংলায় টিএমসি বিজেপি – দুই দলের ক্ষেত্রেই সত্য। রাজনীতির আঙ্গিনায় আজ বামপন্থীদের শ্লোগান দিতে হচ্ছে – “চোর ধরো, জেল ভরো।” এ বাংলা কখনও এই শ্লোগান শোনার জন্য অভ্যস্ত ছিল না! কিন্তু বাধ্য হচ্ছে মানুষ, বাধ্য হচ্ছে বামপন্থীরা এরাজ্যের রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত করতে। তাই, অঙ্কের নিয়মে রাজ্যের বর্তমান অবস্থার সমীকরণে সৃষ্ট “রাজনীতি + দুর্নীতি = দুর্বৃত্তায়ন” কে উপড়ে ফেলে তৈরী করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি। আর এই দেশ ও রাজ্যের শাসকদল দুটির বিরুদ্ধে এক্ষেত্রে সঠিক লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছে বামপন্থীরা। টিএমসি -বিজেপির বিরুদ্ধে আজ ওদের দ্বৈত নকল খেলা ভাঙ্গার প্রকৃত খেলায় জনগণের সঠিক দিশা বামপন্থা – যার নেতৃত্বে সিপিআই(এম)। আর তাই সংসদ বহির্ভুত পথকে বেছে নিতে রাস্তার আন্দোলনেই আছে বামশক্তি। মানুষের কল্যাণে, আজ সেই বহুমুখী লড়াই-ই পথ দেখাবে – এক নতুন ভোরের।