Site icon CPI(M)

‘Left Zero’ Assembly, Sangh Assembly & Reply of Buddhadev Bhattacharya

bamshunya bidhansabha

চন্দন দাস

তখনও ফেব্রুয়ারি ছিল। ঊনিশ বছর আগে এক শত শেষের দুপুর ছিল সেটিও। বিধানসভায় সেদিনও এক মুখ্যমন্ত্রী বক্তব্য রেখেছিলেন। জবাব দিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতার বক্তব্যের। সেদিন সঙ্ঘ পরিবার রাগে ফুঁসেছিল। মঙ্গলবার আরএসএস খুশি হয়েছে।

ঊনিশ বছর আগের সেই দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। তখন ২০০৬।

বিজেপি’র চিহ্ন তখন নেই বিধানসভায়। তারা তখন বিধানসভার বাইরে তৃণমূলের হয়ে প্রচার চালাচ্ছে। তৃণমূল তখন রাজ্যের বিরোধী দল। তৃণমূলের তৎকালীন দলনেতা ছিলেন পঙ্কজ ব্যানার্জি। তিনি সেদিন বিধানসভায় দীর্ঘ বক্তৃতার এক জায়গায় বলেন,‘‘আজ আপনি মুখ্যমন্ত্রী, আপনি রাজনৈতিক সভা করতে যাচ্ছেন, গিয়ে বলছেন— বিরোধীদের মাথাগুলো আমি ভেঙে দেব, বিরোধীদের হাতগুলো আমি দেব। আপনি যদি বলেন মাথা ভেঙে দেব, তাহলে হুব্বা বা শ্যামল, তারা বলবে, মাথা কেটে নেব।’’

তৃণমূলের কৌশলটি পরিস্কার হয়ে যায় ওই ভাষণে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ‘মাথা ভেঙে দেব’ বলেছিলেন দাঙ্গাকারী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে। তৃণমূল ‘বিরোধীদের মাথা ভেঙে’ দেওয়ার অভিযোগ তুলে আসলে সেদিন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ(আরএসএস)-কে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। আরএসএস তৃণমূলের পক্ষে কাজ করছিল।

সেদিন তৃণমূলের দলনেতার সেই ভাষণের জবাব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বলেছিলেন,‘‘একটা কথা পঙ্কজবাবু বলেছিলেন যে, আমি নাকি বলেছি ‘মাথা ভেঙে দেব।’ আমি শুধু পরিস্কার করে বলছি কী বলেছি। ‘বাবরি মসজিদের সমস্যার সমাধান হয়নি। যাঁরা করেছিলেন তাঁরা মনে করেন ঠিক করেছেন। এই রাজ্যেও কিছু লোক আছেন যাঁরা এই সব সমর্থন করেন তাঁরা যদি এই সব মসজিদ ভাঙার পথে যান তবে তাঁদের মাথা ভেঙে দেব।’ আই রিপিট দ্যাট। তাঁরা যদি এ পথে যান তাঁদের মাথা ভেঙে দেব।’ মাথা ভেঙে দেওয়ার মানে কী তাও আপনি জানেন।’’

সেই সময় তৃণমূলের বিধায়করা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বক্তব্য পেশ করতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন। চিৎকার করতে থাকেন। তা সত্বেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলে যান। তিনি বলেন,‘‘না, না, আরএসএস-এর কাছে কোনো আইন নেই। আরএসএস যে ভাষা বোঝে সেই ভাষায় কথা বলি, আরএসএস যে ভাষা বোঝে সেই ভাষায় কথা বলি। আপনার গায়ে লাগতে পারে, কারণ আপনি যেহেতু তাঁদের সঙ্গে আছেন। হ্যাঁ, আমি ওই ভাষাতেই কথা বলি যে ভাষা মানুষও বুঝবেন।’’

রাজ্যে এখন বিরোধী দল বিজেপি। তার নেতা শুভেন্দু অধিকারী সব সমস্যার কথা বাদ দিয়ে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলকে আক্রমণ করেছেন ধর্ম নিয়ে। তিনি সোমবার তৃণমূলকে ‘মুসলমানদের দল’ অভিহিত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ‘হিন্দুদের কথা’ বলতে চেয়ে বাধা পেয়েছেন বলে দাবি করে তৃণমূলকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এই শিক্ষা তৃণমূলই দিয়েছে। আরএসএস-র কৌশল অনুসারে বিধানসভাতেই তৃণমূলের বিধায়ক সৌগত রায় কৃষকের জমির ধর্ম পরিচয় খুঁজে বের করেছিলেন। বিধানসভাতেই তিনি বলেছিলেন ‘বামফ্রন্ট মুসলমনাদের জমি কেড়ে নিচ্ছে।’ যা ছিল সেদিনকার তৃণমূল-আরএসএস-মাওবাদীদের প্রচারের কৌশল।

মঙ্গলবার বিজেপি’র বাড়িয়ে দেওয়া বল পেয়ে লক্ষ্য ভেদে এগিয়ে গেছে তৃণমূলও। রাজ্যের যাবতীয় সমস্যা ফেলে মমতা ব্যানার্জি নিজের ‘ব্রাহ্মণ’ পরিচয় জানিয়েছেন। তিনি শিব মন্দিরের দিকে মাথা রেখে রাতে ঘুমোতে যান, তা বলেছেন বিধানসভায়। তাঁর সরকার হিন্দুদের তীর্থ স্থানগুলির জন্য কী কী করেছেন, তার বিস্তৃত বিবরণ এই ফাঁকে তিনি দিয়ে রেখেছেন। আর সেই সময় বিধানসভার অধিবেশনের বাইরে ‘আমি হিন্দু আমি গর্বিত’ লেখা গেঞ্জি আর গেরুয়া পাগড়ি পড়ে ঘুরে বেরিয়েছেন মানুষের ভোটে জেতা বিজেপি’র বিধায়করা— হিন্দুত্বের চলমান পোস্টার হিসাবে।

বামফ্রন্ট যখন সরকারে বিধানসভায় আরএসএস-র প্রচারক ছিল তৃণমূল। এখন বিধানসভা আরএসএস-র প্রচারভূমি হয়ে উঠেছে। সঙ্ঘ পরিবার তাই চেয়েছিল। আরএসএস লোকসভায় আছে। কেন্দ্রীয় সরকার চালাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবারই। সেই আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভাতেও জাঁকিয়ে বসছে— শাসক, বিরোধী দুই দলের সাহায্যে।
‘বাম শূণ্য’ বিধানসভার এই হলো অন্যতম প্রাপ্তি।

বিধানসভায় আলোচনা হওয়ার কথা রাজ্যের মানুষের সমস্যার কথা। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। কেন? আলোচনা হওয়ার কথা বিধানসভায়। রাজ্যে কাজের অভাব। এবারের রাজ্য বাজেটে কর্মসংস্থানের কোনও উল্লেখই নেই। কাজের সুযোগ নিয়ে সরকার কী ভাবছে— আলোচনা হওয়ার কথা বিধানসভায়। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন কার্ডধারীদের দশ শতাংশের কম— কেন? তাহলে এত কার্ড করার সরকারি দাবির অর্থ কী? কণ্যাশ্রীর তালিকায় ছাত্রীদের সংখ্যা কমে গেছে কেন? পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পথে এত ছাত্রী কেন? মহিলাদের জন্য বরাদ্দের ৭৪শতাংশ টাকা শুধু মাত্র একটি প্রকল্পে— লক্ষ্মীর ভান্ডার। মহিলাদের স্বনির্ভরতা, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণে বরাদ্দ কেন নামমাত্র? সংখ্যালঘু ছাত্রদের ঐক্যশ্রী প্রকল্পে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৪শতাংশ কমলো কী করে? রাজ্য থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। তাঁদের রাজ্যে ফিরে আসার, এখানে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার কী হলো?

এমন অনেক সমস্যার আলোচনা হওয়ার কথা বিধানসভায়। কিন্তু তার বদলে বিধানসভা প্রায় ধর্মসভা হয়ে উঠলো মঙ্গলবার।

এই প্রকল্প সঙ্ঘের অনেকদিন চলছে। প্রমাণ বেশ কিছু। যেমন ২০ জুন, ২০২২। বিধানসভায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে জেলবন্দী পার্থ চ্যাটার্জি একটি দৃষ্টি আকর্ষণী বক্তব্য পেশ করেন। সেই প্রসঙ্গে ভাষণ দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। বেলা সাড়ে ১২টা থেকে পৌনে ২টো পর্যন্ত। এক দীর্ঘ ভাষণ। সেখানেই তাঁর মুখ থেকে শোনা যায়,‘ধর্ম নিয়ে যদি কেউ পুরাণ, বেদ-বেদান্ত, তপোবন থেকে শুরু করে শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা এই সব নিয়ে কথা বলেন আমি তাকে স্যালুট জানাব। কারণ এগুলি ধর্ম নয়, এগুলি ইতিহাস। ধর্মের সাথে ইতিহাসের একটা যোগাযোগ থাকে। আমাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস তিনটি ভাগে বিভক্ত। একটা অতীত, একটা মধ্যযুগীয় এবং আর একটা বর্তমান।’ (Assembly Proceedings, official report, June session, 2022, from 10th June to 24th June, 2022)।

মমতা ব্যানার্জির ইতিহাস জ্ঞান নিশ্চিতভাবেই এখানে আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু পুরাণ, বেদের মত গ্রন্থ পৌরাণিক কাহিনী, ইতিহাস নয়। সঙ্ঘ এসবকে ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করে। আর ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ঐতিহাসিকরা বারবার প্রমাণ করেছেন যে, সঙ্ঘের বক্তব্য ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্তের অন্যতম অংশ এই মিথ্যা ইতিহাস নির্মাণ। সঙ্ঘের সেই বিপজ্জনক বক্তব্যই খাস বিধানসভায় প্রচার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

শেয়ার করুন