ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
দ্বিতীয় পর্ব
অর্থনীতি এবং আড়ি পাতা রাষ্ট্র
২০১৯ সালের ১৫ই জানুয়ারি শুশানা জুবফের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। সুশানা একসময় আমেরিকার বড় বিজ্ঞাপন নির্মাতা সংস্থায় কর্মরতা ছিলেন। এই বইতে শুশানা বর্তমানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘আড়ি পাতা ধনতন্ত্র’ (Age Of Surveillance) বলে ব্যাখ্যা করেছেন, তার বইটির নামও তাই। যদিও আমেরিকান প্রেক্ষাপটেই শুশানার মূল বক্তব্য ঘোরাফেরা করেছে তাহলেও বিগ আমেরিকান ড্রিমের মতোই তিনি ধরে নিয়েছেন তার ব্যখ্যা সারা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন ধরে নেওয়াকে দোষ দেওয়া যায় না – বহু সাধারণ আমেরিকানই নিজেদের দেশকে সারা পৃথিবীর কর্তাসম মনে করেন, মার্কিন রাষ্ট্র জনমানসে এহেন ভাবাবেগ পছন্দও করে। নিবন্ধের দ্বিতীয় পর্বে শুশানার সেই বইয়ের কোন রিভ্যিউ করা হচ্ছে না শুধু উল্লেখটুকু রইল যাতে পাঠক মনে রাখেন আড়ি পাতা নিয়ে শুধু ভারতেই হইচই চলছে এমন না। ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করলেও ‘পেগাসাস’ সম্পর্কে ফ্রান্সের সরকার ইতিমধ্যেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং পাঠক মনে রাখবেন এই নির্দেশ দেবার ক্ষেত্রে যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে তারাই ভারত-ফ্রান্সের মধ্যে রাফালে বিমান কেনাবেচায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিল।
প্রশ্ন হল আড়ি পাতা কি রাষ্ট্রের তরফে নেওয়া কোন আধুনিক পদক্ষেপ? ইতিহাস বলছে আদৌ তা নয়, ম্যকিয়াভেলির রচনা ‘দ্য প্রিন্স’কে যদি আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি প্রাথমিক নির্দেশনামা মনে করি তবে সেখানেও এহেন নজরদারির উলেখ ছিল, অবশ্যই সেই সময়ের উপযোগী কায়দায়। আমাদের দেশে সম্রাট আকবরের জনহিতে ছদ্মবেশ ধারন করে বাজার পরিদর্শনের কথা ছোটবেলাতেই আমরা সবাই শুনেছি। ‘জরুরী অবস্থা’ জারী করে সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের তথ্য সরকারী দফতর হতে ‘পাশ’ করাতে বাধ্য করার উদাহরণও রয়েছে। ফলে আড়ি পাতার মূল ব্যাপারটা যতই মোড়ক বদলাক না কেন আদৌ নয়া কিছু নয়, বদলেছে যেটুকু তা হল এহেন নজরদারির তীব্রতা এবং নজরদারি সম্পর্কে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বেহায়াপনার মাত্রা।
শুশান তার লেখা বইতে পুরানো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং হাল আমলের বন্দোবস্তকে আলাদা আলাদা করে দেখিয়েছেন, এটাই স্বাভাবিক, শুশান বস্তুবাদী-দ্বন্দ্বতাত্বিক নন। তাই তার মনন মূলত ‘Take the matter as it is’-কে পাথেয় করে এগিয়েছে। পুরানো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে তিনি বাতিল ঘোষণা করেছেন, একইসাথে গল্প বলেছেন এক নতুন সামাজিক ব্যবস্থার নির্মাণগাথার যা মানুষের মনোভাব, চেতনার অন্তর্জগত এবং সম্ভাব্য মানসিক চাহিদা সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। এই নতুন ব্যবস্থা যাকে তিনি ‘আড়ি পাতা ধনতন্ত্র’ (Age Of Surveillance) বলেছেন তা কাজ করে বিগ ডেটা অ্যানালিসিসের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থা প্রথমে ক্রেতাদের, পরে সম্ভাব্য ক্রেতাদের নিশানা করে। তাদের মনের ভিতরটা পড়ে ফেলাই এই বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য। শুশানের বক্তব্য আজকের সভ্যতায় ডিজিটাল প্রযুক্তি রাষ্ট্রকে গোপনে নজরাদারি করে জনগণের মেজাজ পড়ে ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে – এর চরম লক্ষ্য অবশ্যই সম্ভাব্য সামাজিক অস্থিরতা (Potential Social Unrest) প্রতিরোধ করা। রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুটা বোঝেন এমন যে কেউই এই অবধি পড়ে বুঝবেন রাষ্ট্র যদি সত্যিই এটা করতে পারে তবে চালু ব্যবস্থাটা চিরায়ত রাখার দিকে তারা একধাপ এগিয়ে যাবে, ফলে এহেন গবেষণা কিংবা নির্দিষ্ট সামাজিক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যেকোনো মূল্যের খরচ করতে তারা অবশ্যই রাজী হবে। এই কথাই আমরা এই নিবন্ধের প্রথম পর্বে বলেছিলাম। তাই অর্থনীতির প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য।
শুশান যাই লিখুন (অত্যন্ত দুঃখের সাথে তিনি তার বই শুরু করেছেন হোমারের লেখা সাইক্লপসের আস্তানায় বন্দীর চোখের জলের সাথে আজকের ডিজিটাল দুনিয়ায় অদৃশ্য জালে বন্দী জনগণের তুলনা করে), আসলে বিষয় সর্বদাই বস্তুগত। মুনাফাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রানভোমরা, ফলে কোন একটা নতুন সামাজিক বন্দোবস্ত তখনই বাস্তবোচিত যদি তা চলতি ব্যবস্থায় বাড়তি মুনাফার সন্ধান দেয়। মার্কেট রিসার্চ, পাবলিক রিলেশন সম্পর্কিত মোটা মোটা কেতাব কিংবা ম্যানেজমেন্ট শাস্ত্রের সময়োপযোগী পাঠ্যসূচি সবই সেই মুনাফার লক্ষ্যে আবর্তিত। এন এস ও’ নির্মিত ‘পেগাসাস’ রাষ্ট্রকে নজরদারি চালানোর কাজে সমৃদ্ধ করেছে ঠিকই, কিন্তু আসলে এর পিছনে রয়েছে চলতি ব্যবস্থাটাকেই টিকিয়ে রাখার তাগিদ। সেই তাগিদ মুনাফার মালিকদের স্বার্থরক্ষার, যা চলছে তাই যদি চলে তবে যারা এই ব্যবস্থার ফলে রসেবসে আছে তাদের স্বার্থরক্ষার। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলচ্ছেদ চায় কমিউনিস্টরা, মার্কসবাদ প্রমান করেছে একটা সংকট থেকে নিস্তার পেতে পুঁজিবাদ জন্ম দেয় আরেকটা নতুন এবং আরও বেশি ভয়াবহ সংকটের, হচ্ছেও তাই।
২০০৮ থেকে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজি গাড্ডায় পড়েছে, অর্থনীতির ভাষায় মন্দা নেমে এসেছে বিশ্ববাজারে, এই মন্দা আসলে যোগানের মন্দা না – যেমনটা পুঁজিবাদী অর্থনীতি সাফাই দেয়। মন্দা আসলে চাহিদার, কারন পুঁজিবাদ চক্রাকারে তার ক্রেতা হারায়, সেই লোকসান পূরণ করতে পণ্যের দাম বাড়ায় আবার দাম বাড়িয়ে দেবার ফলে ক্রেতার সংখ্যা আরও কমে। এই অবস্থায় মুনাফার রথ আটকে পড়ে বলেই নিজের জন্য পুঁজি বিশ্বজূড়ে অবারিত দ্বার চায় – তারই পোশাকি নাম বিশ্বায়ন। অর্থাৎ যখন খুশি যেখান থেকে খুশি পুঁজি নিজের বিনিয়োগের কিছুটা, অনেকটা কিংবা পুরোটাই ভিটে-মাটি-চাটি করে নিয়ে চলে যাবে, অন্য কোন দেশে থাবা বসাবে এবং বাড়তি মুনাফা কামিয়ে নেবে – যেখান থেকে সে চলে যেতে চাইবে তাকে আটকানো যাবে না, যেখানে সে ঢুকতে চাইবে সেখানেও বাধা দেওয়া চলবে না – একেই বলে উদার অর্থনীতি। কিন্তু এতকিছু সত্বেও ২০০৮ হতে লগ্নী পুঁজি (Finance Capital) যে সংকটে পড়েছে তার থেকে এখনো মুক্তির দিশা খুঁজে পায় নি। একের পর এক দেশ থেকে পুঁজি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে – সেই দেশগুলিতে তৈরি হয়েছে কাজের জন্য হাহাকার, মূল্যবৃদ্ধি এবং এই দুইয়ের প্রভাবে জনজীবনে সার্বিক সংকট, কিন্তু ঠিক কোন দেশে গেলে তার ঝামেলা চুকে যাবে সেই পথ পুঁজি পাচ্ছে না। এহেন অবস্থায় বিনিয়োগ পথ বেছে নিয়েছে ফাটকার যাতে উৎপাদন, নির্মাণ কিংবা কর্মসংস্থান কিছুই হয় না অথচ মুনাফা বেড়ে যায় অনেকগুণ – ফাটকা মুনাফার লোভে জিভ বেরিয়ে আসা এই ব্যবস্থারই নাম দেওয়া হয়েছে ধান্দার ধনতন্ত্র (Crony Capitalism)।
তাই শুশান জুবফ ব্যাপারটা যেভাবে দেখেছেন তার সবটা ঠিক না, ‘আড়ি পাতা ধনতন্ত্র’ আসলে নতুন কিছু নয়, এ হল ঐতিহাসিক প্রয়োজনে পুঁজিবাদের নতুন বর্ষাতি যা সর্বদাই হাহাকাররত জনগণের সম্ভাব্য রোষের ভয়ে ভীত। বলা বাহুল্য চলতি সংকটের আক্রমনে জর্জরিত জনগণের ভীষণ রোষ তো আর লাইব্রেরীর টেবিলে বসে লেখা গবেষণাপত্র না যে বেছে বেছে ঠিক এই এই স্থানে পুঁজিবাদ লুকিয়ে রয়েছে তাকেই শুধু আক্রমন করবে, জনগণ বস্তুগত সত্যকেই আঁকড়ে ধরেন। তারা নাটের গুরু চিনে নেবেন খুব সহজেই, ফলে আক্রমণটা নেমে আসবে রাষ্ট্রের পরিচালকবৃন্দের উপরেই – পুঁজিবাদ এই সত্য ভালো বোঝে, রাষ্ট্রপরিচালনায় যুক্ত রাজনৈতিক শক্তি বোঝে আরও বেশি কারন তার গদি হারানোর ভয় থাকে, দেশে বিদেশে ছুটে বেড়ানো ফিন্যান্স পূঁজির মতো তার চরিত্র আদৌ বিমূর্ত নয় যে! ফলে জনগণ কখন কি ভাবছে, কি করছে সেই খোঁজ রাখতে রাষ্ট্র বাধ্য – ফলে ‘আড়ি পাতা’ এবং ‘পেগাসাস’। পুঁজিবাদী শোষণ ব্যাপারটা আগাগোড়া একটা বিশ্বজনীন বন্দোবস্ত বলেই আমেরিকায় বসে লেখা শুশান জুবফের অনুভব ভারতের মাটিতেও প্রযোজ্য হয় – একইকথা খাটে মার্কসবাদের ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ পূঁজির শোষণ যেমন আন্তর্জাতিক, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক তার বিরুদ্ধে লড়াই। আমেরিকা থেকে ঝাড়খন্ড অবধি সেই লড়াই চলছেই – সেই লড়াই চলবেই।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে – সৌভিক ঘোষ