২৩ মার্চ ২০২৩, বৃহস্পতিবার
“মাঝ আকাশে থাকা ঘুড়িগুলো বলেছিলো কখনও মাথা নিচু করো না।”
সালটা ১৯০৭, বর্তমানে পাকিস্তান অধিনস্ত পঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার বাওলি গ্রামে
২৮শে সেপ্টেম্বর দুটি সুখবর আসে। প্রথমটি জন্মগ্রহণ করেন ভগৎ সিং আর দ্বিতীয়টি সেদিনই ব্রিটিশদের বার্মার মান্দালয় জেল থেকে ছাড়া পান ভগৎ সিং’র বাবা কিষাণ সিং এবং তার দুই কাকা অজিত সিং ও স্বর্ণ সিং। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে পরিচয় শুরু কথা ফোটার সময় থেকেই। তার সাথে চারপাশের ঘটে চলা ঘটনা মনের জমি তৈরি করতে থাকে। একদম কম বয়েসে ভগত সিং’র ভাবনায় আসে রাইফেল মাটিতে পুঁতলে রাইফেলের গাছ হবে আর তাই দিয়ে ব্রিটিশ উচ্ছেদ করা হবে। মাত্র ১২ বছর বয়েসে প্রত্যক্ষ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড। পরেরদিন হত্যাকান্ডের জায়গায় গিয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন রক্ত ভেজা মাটি। রোজ ফুল দেওয়ার সাথেই শুরু হয় শপথ নেওয়ারও। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে স্কুল ত্যাগ করে রাস্তায় নেমে বিদেশি কাপড় সংগ্রহ করে পোড়ানোর কাজে লেগে পরেন। জণসাধারনের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বার্তা দিতে তার সহকর্মী সুখদেব ও যশপালকে নিয়ে লেগে পড়েন নাটক মঞ্চস্থ করতে। মহাভারতকে আশ্রয় করে কৌরব পক্ষকে ব্রিটিশ আর পাণ্ডব পক্ষকে ভারতীয় সাজিয়ে থিয়েটার করেন, তার প্রথম থিয়েটারের নাম ছিলো “কৃষ্ণ বিজয়”।
কিন্তু অসহযোগ আন্দোলন হুট করে প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভগৎ সিং ভরসা হারাতে শুরু করেন গান্ধীজি এবং তার নরমপন্থী রাজনীতির ওপরে। লাহোরের ন্যাশানাল কলেজে পড়ার সময়ই লাহোরের দ্বারকাপ্রসাদ লাইব্রেরিতে শুরু হয় মার্ক্সবাদী বইপত্র পড়ার এবং বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত হন কর্তার সিং সারাভার দ্বারা। ১৯১৫ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়েসে ফাঁসি দেওয়া হয় তাকে। একই সাথে এই সময়েই ভগৎ সিং বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা কুখ্যাত সেলুলার জেলে থাকার বিবরণ দেওয়া বই ‘বন্দীজীবন’ পড়ে যোগ দেন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশনে। তার কলেজের জয়চন্দ্র বিদ্যালংকারের সূত্রে পরিচয় হয় ‘প্রতাপ’ পত্রিকার সম্পাদক গনেশশংকর বিদ্যার্থীর। শুরু লেখা ভগৎ সিং’র লেখা। নতুন নামে লেখা শুরু হয়। তার প্রথম ছদ্মনাম “বলবন্ত” নামে লিখতে শুরু করেন। এছাড়াও ‘মতওয়ালা’ এবং ‘কীর্তি’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। পাঞ্জাবের ভাষা সমস্যা, ‘সাম্প্রদায়িকতা ও তার সমাধান’, ‘অস্পৃশ্যতার সমস্যা’, ‘ধর্ম ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ এইসব বিষয়ে লেখার মধ্যে দিয়ে অনুভব করেন সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রয়োজনীয়তা।
“পড়ো, আরও পড়ো, আরও পড়া চাই”
পড়া শুরুর সাথে সাথেই শুরু করেন বিতর্ক। ১৯২৮ সালের ৮ ও ৯ই সেপ্টেম্বর দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় এইচ আর’র কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর ভগৎ সিং’র প্রস্তাব অনুযায়ী “সোশ্যালিস্ট” শব্দটা যুক্ত হয়। তবে সেটা যে কোনো সস্তা আলংকারিক বিষয় নয় তাই জোরের সাথে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন। তৈরি করেন “নওজোওয়ান ভারতসভা”। স্কুলছাত্রদের রাজনৈতিক সচেতনতার কাজ শুরু হয়। জনপ্রিয়তা আর যুব সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতায় ভয় পেয়ে লাহোরের পুলিশ “দসেরা মামলায়” মিথ্যে বোমা মারার মামলায় জেলে আটক করে। বিপ্লবী আন্দোলনের খবর বের করতে ব্যর্থ হয়ে ৬ মাস পরে ৬০ হাজার টাকায় জামিন দেওয়া হয় তাকে। এরপরে আসে সাইমন কমিশন। নওজোয়ান ভারত সভার প্রতিবাদ সভায় লাঠি পেটা করে খুন করা হয় লালা লাজপত রায়কে। পুলিশ সুপার স্কট ও ডেপুটি সন্ডার্স হয়ে যায় বদলার লক্ষ্য। সন্ডার্সকে হত্যা করার পর
ভগৎ সিং ভগবতী চরণ ভোহরা’র স্ত্রী দুর্গাদেবী ভোহরার সাথে আত্মগোপন করে পালিয়ে আসেন কলকাতায়। ছাজুরাম চৌধুরীর কাশিপুরের বাড়িতে প্রথমে আশ্রয় নেন তারপর পুলিশে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে চলে আসেন ১৯, বিধান সরণীর কলকাতা আর্য সমাজ মন্দিরে। যোগাযোগ হয় যতীন্দ্র নাথের সাথে। বোমা তৈরি হাতে কলমে শিখতে শুরু করে। একই সাথে চলতে থাকে পড়াশোনা। দর্শন,সাহিত্য,রাজনীতির পড়াশোনা।
“বধিরকে শোনাতে গেলে জোরালো গলা চাই”
কিছু ইতিহাস রচনা করতে যেমন লাগে জোরালো শব্দ ঠিক তেমনি তা শোনানোর ক্ষমতা। জনবিরোধী দুটি বিল- পাবলিক সেফটি বিল এবং ট্রেড ডিসপিউট বিলের প্রতিবাদে হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক এসোসিয়েশনের সভায় সিদ্ধান্ত হয় সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে বিল পেশের সাথে সাথেই বোমা ফাটানো হবে, লিফলেট বিলি হবে এবং ধরা দিতে হবে পুলিশের হাতে যাতে নিজেদের কথা সবার কাছে স্পটত পৌছনো যায়। ভগত সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। ‘দি হিন্দুস্থান টাইমসে’ সেই দিনই গোটা লিফলেটটি প্রকাশিত হয়। ভগৎ সিং এর লেখা এই লিফলেট এর শেষ প্যারায় বলা হয় “একথা স্বীকার করতে আমরা লজ্জিত যে, আমরা যারা মানুষের প্রাণকে এত পবিত্র মনে করি আমরা যারা স্বপ্ন দেখি সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের যখন মানুষ অটুট শান্তি ও পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে, তারাও মানুষের রক্তপাত করতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু মহাবিপ্লবের বেদীতে ব্যক্তির আত্মাহুতি অনিবার্য, যা আনবে সকলের স্বাধীনতা যা মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণকে অসম্ভব করে তুলবে। ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
সেদিন থেকে ইনকিলাব জিন্দাবাদ হয়ে দাঁড়ালো তাদের অভিন্ন স্লোগান যারা একটি মুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত ভারতের স্বপ্ন দেখেন।
ভগৎ সিং এবং তার সহযোদ্ধারা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না। বরং নিজেদের দোষী বলে জানিয়ে বিচার চলাকালীন নিজেদের বার্তা ও দর্শনকে প্রচার করবেন। তারা ঠিক করেন কোন জাতীয়তাবাদী আইনজীবীর পরামর্শ নেবেন কিন্তু আদালতে তাদের হয়ে দাঁড়াতে দেবেন না। বিচার চলাকালীন তারা ঘোষণা করেন ” আমরা বিনয়ের সঙ্গে দাবি করছি যে আমাদের দেশের ইতিহাস পরিস্থিতি আশা, আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে জানার এক সিরিয়াস ছাত্র ছাড়া আর কিছু নই। আমরা ভন্ডামিকে ঘৃণা করি। আমাদের এই হাতে-কলমে প্রতিবাদ হল প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, যা তার জন্মলগ্ন থেকে শুধু তার অপদার্থতাকেই প্রকট করে তোলেনি, ক্ষতি করার সুদূরপ্রসারী ক্ষমতাকে প্রদর্শন করে এসেছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা যত ভেবেছি তত গভীরভাবে আমরা নিশ্চিত হয়েছি এর অস্তিত্ব রয়েছে শুধু গোটা দুনিয়ার সামনে ভারতের অপমান ও অসহায় তাকে দেখাতে এবং এ হল দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বৈরাচারী শাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের আধিপত্যবাদের প্রতীক। বারে বারে গোটা জাতির দাবিকে জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত করেছেন কিন্তু দেখা গেছে তার পরিণতি হচ্ছে বাজে কাগজের ঝুড়িতে। তাই আমরা ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাদের কৃতকর্মের শাস্তির জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করলাম যাতে সাম্রাজ্যবাদী শোষকরা জানতে পারে যে ব্যক্তি হত্যা করে আদর্শকে হত্যা করা যায় না। দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটকে ধ্বংস করে গোটা জাতিকে ধ্বংস করা যায় না “
ভগৎ সিং এই সময়ের মধ্যে যুব সমাজের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে চান ইনকিলাব জিন্দাবাদ এবং বিপ্লব শব্দটিকে। বিপ্লব বলতে তারা কি বোঝেন এই প্রশ্ন করা হলে আদালতে তারা জানান– “এই সভ্যতার গোটা ইমারত চুরমার হয়ে যাবে যদি সময় থাকতে তাকে বাঁচানো না যায়। অতএব একটা মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন এবং যারা এর কথা উপলব্ধি করছে তাদেরই দায়িত্ব নিয়ে সমাজকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির উপরে পুনর্গঠিত করা। এই কাজ সমাধা না হলে এবং মানুষের দ্বারা মানুষের শোষণ এবং এক দেশের দ্বারা অপর দেশের শোষণ যা সাম্রাজ্যবাদের মুখোশ পরে আছে বন্ধ না হলে সমাজের সামনে আর যে কষ্ট হোক অবস্থা লীলার বিপদ তাকে রোখা যাবে না এবং যুদ্ধের অবসান ও বিশ্ব শান্তির যুগ উদ্বোধনের সব কথাই ছদ্মবেশহীন কপটতা বলে বোঝা যাবে। বিপ্লব বলতে আমরা বুঝি শেষ পর্যন্ত এমন একটি সমাজব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা যা এইরকম ধ্বংসের ভয়ে ভীত নয় যেখানে সর্বহারার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত যার ফলে আসবে একটি বিশ্ব ফেডারেশন বা বিশ্ব মানবকে উদ্ধার করবে পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দৈন্য থেকে। এই আমাদের আদর্শ এবং এই মতবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ন্যায্য সাবধান বাণী সশব্দে উচ্চারণ করছি।”
মডার্ন রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ইনক্লাব জিন্দাবাদ স্লোগানকে ব্যঙ্গ করার পরে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত তার জবাব দিয়ে তার ট্রিবিউন পত্রিকায় ১৯২৯ সালে ২৪ ডিসেম্বর একটি চিঠিতে লিখেন ” বিপ্লবের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ অনিবার্য নয়। বিপ্লব বোমা পিস্তলের পুজো নয়। কখনো কখনো সেগুলি উদ্দেশ্য সাধনের উপায় মাত্র হতে পারে। কোন কোন আন্দোলনে তাদের ভূমিকা প্রাধান্য পায় সন্দেহ নেই কিন্তু সেই কারণেই তারা এক ও অভিন্ন নয়। অভ্যুত্থান কোন বিপ্লব নয়। শেষ পর্যন্ত তার সেই লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে। যে অর্থে এই বাক্যাংশে বিপ্লব করাতে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো সেই মনোবৃত্তির উন্নতির লক্ষ্যে পরিবর্তনের জন্য সেই অভিপ্সা। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থায় লোকের সাধারণত অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং পরিবর্তনের নাম শুনলেই কাঁপতে থাকে।
এই আলস্যময় মনোবৃত্তির দরকার বিপ্লবী মনোবৃত্তি। নইলে অবক্ষয় শক্তিশালী হয় গোটা মানব সমাজ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দ্বারা বিপথ চালিত হয়।এই অবস্থার পরিণতিতে আছে জড়তা মানবজাতির পক্ষাঘাত। মনুষ্যত্বের সত্তা জুড়ে বিরাজ করুক বিপ্লবী চিন্তা যাতে তার অনন্ত অগ্রাভিযানে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা সংগ্রহ করতে না পারে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সমূহ। পুরনো ব্যবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। সদা এবং সর্বদা নতুনের পথ করে দেয়, যাতে একটা মাত্র “ভালো” ব্যবস্থা পৃথিবীকে বিষিয়ে দিতে না পারে। এই অর্থেই আমরা ধ্বনি তুলি ইনকিলাব জিন্দাবাদ।”
ভগৎ সিং জেলে থাকাকালীন তিনটি প্রধান লক্ষ্য বেছে নেন। প্রথমত বিচারের প্রক্রিয়াটিকে প্রচারের কাজে ব্যবহার করা যাতে বিপ্লবীদের আদর্শ বার্তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, জেলের অভ্যন্তরে প্রতিবাদ, অনশন, ধর্মঘট ইত্যাদির মাধ্যমে উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অমানবিক ও নৃশংস স্বরূপ যাতে সামনে আনা যায় এবং পরিশ্রমী ও নিষ্ঠাপূর্ণ পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে আরও উন্নত করে তোলা। জেলের মধ্যে থাকার সময় ভগৎ সিং চারটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন। ১. সমাজতন্ত্রের ধারণা ২. আত্মজীবনী ৩.ভারতে বিপ্লবী আন্দোলনে ইতিহাস ৪. মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। জলন্ধরের কুমারী লজ্জাবতী লেখা কাগজ গুলি লুকিয়ে জেল থেকে বাইরে এনে পিপল পত্রিকার সম্পাদক ফিরোজ চাঁদকে দেন। ১৯৩১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভগৎ সিং এর ফাঁসি হয়ে যাবার প্রথম জন্ম বার্ষিকতে বিখ্যাত লেখা “কেন আমি নাস্তিক” প্রকাশিত হয় এবং ২৯ শে মার্চে পত্রিকাটিতেই “তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের উদ্দেশ্যে চিঠি” তার কিছু অংশ ছাপা হয়। ছড়িয়ে পড়তে তাকে ভগৎ সিং’র চিন্তা-ভাবনা- চেতনা।
FREEDOM
“men! whose boast it is that ye
come of father’s brave and free,
if there breathe on Earth a slave
are ye truly free and Brave?”
(জেল নোটবুক, পাতা নং১৯)
ভগৎ সিং’র জেল ডাইরির প্রতিটা পাতায় প্রগতিশীল, সমাজতান্ত্রিক, মুক্তচিন্তার প্রসারে পড়াশোনার ছাপ পড়তে থাকে। মার্ক্স,এঙ্গেলস, লেলিন- তাদের রচনা, স্পষ্ট করতে থাকে রাষ্ট্র, ধর্ম, শ্রেণী সম্বন্ধে ধারণা। জাপানের ছাত্রদের একটি সমাবেশ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতা, পুঁজিবাদ ও ব্যবসাবৃত্তি নিয়ে, তার লেখা উল্লেখ পাওয়া যায় ভগৎ সিং’র জেল নোটবুকে। জেল নোটবুকের ৪০ নং পাতায় লেখা হয় ধর্ম সম্পর্কে কাল মার্কস এর লেখা “মানুষই ধর্মকে সৃষ্টি করেছে ধর্ম মানুষকে নয়। যেসব মানুষ তাদের স্বরূপ উদ্ভাবন করতে গিয়ে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে অথবা নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে ধর্ম তাদেরই এক আত্মসংবিত,আত্ম অনুভূতি। মানবজাতি জগত বহির্ভূত কোন সমূর্ত সত্তা নয়। তার নিজের জগৎ, রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়েই তার অস্তিত্ব, তার জীবন। মানুষের তৈরি সমাজ ও রাষ্ট্রই ধর্মকে উৎপন্ন করে, পৃথিবী সম্পর্কে একটি বিকৃত মানসিকতা গড়ে তোলে কারণ তারা নিজেরাই একটি বিকৃত পৃথিবীতে অধিষ্ঠিত। ধর্ম এই জগতের সাধারণ তত্ত্ব, তার জ্ঞানমন্ডলের মর্মবস্তু,এর সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তিমালা.. তাই ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হলো সেই জগতের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ যে জগতের আধ্যাত্মিক সৌরভ হল ধর্ম।”
একনায়কত্ব, বিপ্লবী একনায়কত্ব, বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে লেনিনের লেখার উল্লেখ থাকে তার নোটবুকে। কমিউনিস্টদের লক্ষ্যের কথা, কমিউনিস্ট ইশতেহারের কথা স্পষ্টত উল্লেখ করতে দেখা যায় তার নোটবুকে। নির্ধারিত দিনের একদিন আগেই ২৩ শে মার্চ ভগৎ সিং,সুখদেব এবং রাজগুরুর ফাঁসি হবার কিছুক্ষণ পূর্বেও ভগৎ সিং পড়ছিলেন লেনিনের জীবনী।
“জীবিত ভগৎ সিং এর থেকে মৃত ভগৎ সিং ব্রিটিশ শোষকদের জন্য কাছে আরও বেশি বিপজ্জনক হবে। আমার ফাঁসির পর আমার বিপ্লবী আদর্শের সৌরভ আমাদের সুন্দর এই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। এই আদর্শ যুব সমাজকে উদ্দীপিত করবে এবং দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য উদ্বেল করে তুলবে এবং এর ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পতন আরো ত্বরান্বিত হবে। এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
একদম শেষ মুহুর্তে দাঁড়িয়েও আদর্শের স্থির বিশ্বাস, আস্থা যা এক উদাহরণ হিসেবে থেকে যায়। সেদিনের ভগৎ সিং’র বিশ্বাস দেশের প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের কাজ। প্রতিবছর সারা দেশে যেভাবে শাহাদাত দিবস পালন করা হয় সেভাবে ঠিক সেভাবেই যাতে তার আদর্শ,ভাবনা, বিশ্বাস প্রসারিত হয় আজকের যুবসমাজের মধ্যে সেটাই আমাদের রাজনৈতিক দায়িত্ব।
” অনেকে করে তাপ শোক,
চায় পুত্রটা সুপুত্র হোক
যেমন আদর্শে ভগত সিং,
আনন্দে ঘর ভরা ভরা
চিরসুখে রবে যে তারা
আসবে ইপ্সিত সেই দিন..”
অনেকগুলো দশক পেরিয়ে গেছে। সেই ১৯০০ সালের পরে এই পৃথিবীর বুকে একটা মহামারি এসেছে। আমাদের দেশের স্বাধীনতার এতোদিন পরেও ভগত সিং’র না পড়া লেনিন রচনাবলীর পাতা গুলো পড়ে ওঠা হয়নি এই দেশের যুব সমাজের। আজও সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় ভেবে উঠতে পারেনি স্মার্ট ফোনের যুগের যুবসমাজ। আত্মকেন্দ্রীকতার জামানায় সকলের জন্য ভাবনাটাই অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার চক্রান্ত আছে যুব সমাজের মগজে। আত্মবলিদানের আগে যে ভারতের স্বপ্ন দেখে গেছিলেন ভগৎ সিংরা, তার উল্টো পথে হাঁটছে এই দেশ। সাম্পদায়িকতা, জাত পাত, অস্পৃশ্যতা আজও প্রান কাড়ছে এই দেশের জনগনের। এই দেশের মানুষই মারছে এই দেশের মানুষকে। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৫ জনের বেশি বেকার। প্রতিমাসে বেকার বাড়ছে। অসংখ্য সরকারি শুণ্যপদের চিরতরে অবলুপ্তি ঘোষনা হচ্ছে। ছাঁটাই বাড়ছে সর্বত্র। আজও নীচু জাতের ছাত্রের প্রাণ যায় শুধুমাত্র উঁচু জাতের জন্য নির্ধারিত পাত্র থেকে জল খেয়ে ফেলার জন্য! এই দেশ অবশ্যই দেখতে চাননি ভগৎ সিং’রা। গরিব আর বড়লোকের যে ফারাক কমাতে চেয়েছিলেন ভগৎ সিং’রা আজ তা বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। দেশের সম্পত্তি একে একে বেচে দেওয়া হচ্ছে গোটা কতক লোকের হাতে। দেশের বেকারদের কোনো নিরাপত্তা নেই। রাষ্ট্র আজ কাজ দেওয়া থেকে হাত তুলে নিতে চায়। এই দেশ কখনওই দেখতে চাননি ভগৎ সিং’রা।
এই ২৩শে মার্চ, ৯৩ তম শাহাদাত দিবসে এই বেরোজগারের ভারতেকে আদানি-আম্বানিদের হাতে বেচে দেওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুবসমাজকে একজোট করার শপথ নেওয়া হোক। ইনকিলাব জিন্দাবাদ উচ্চারিত হোক প্রতিটা ভুখা পেটের সাথে। এটাই সময়ের ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরুকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়।