Site icon CPI(M)

উত্তরবঙ্গের জাতি-জনজাতি ও পরিচিতি সত্তার আন্দোলন প্রসঙ্গে – জীবেশ সরকার….

২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ,রবিবার

পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতি ভারতে তথা আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ক্রমাগত প্রভাব বৃদ্ধি করে চলেছে। শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলি এই পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতায়নের জন্য। ফলত: তা অনেক সময় বিপজ্জনক চেহারায় দেশ ও জনগণের ঐক্য-সংহতির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের জেলাগুলি, যা দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সন্নিহিত, যেখানে নানা জাতি, জনগোষ্ঠী, ভাষা, সম্প্রদায়গত বিরাট বৈচিত্র্য রয়েছে ও আছে নানা বাস্তব সামাজিক সমস্যা। এই অঞ্চল পরিচিতি সত্তা নির্ভর রাজনীতির উর্বর ভূমি।
সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে সেই বিতর্ক নতুন করে প্রকাশ্যে উত্থাপন করে উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরী করা হচ্ছে। দাবী করা হচ্ছে যে রাজ্যকে বিভাজিত করে উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্যে পরিণত করতে হবে। আশঙ্কার বড় কারণ হলো এই দাবী তুলেছেন কেন্দ্রের শাসকদলের উত্তরবঙ্গের একজন সাংসদ এবং তাকে কার্যত সমর্থন করেছে উত্তরবঙ্গের অপর একজন সাংসদ এবং কেন্দ্রের শাসকদলের বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি। আবার এই দু’জন সাংসদকেই এই দাবী উত্থাপন করার দিন কয়েকের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আবার এই আলাদা রাজ্যের দাবীকে সোচ্চারে সমর্থন করে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা ধূপগুড়ি কেন্দ্রের সদ্যপ্রাক্তন বিধায়ক। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) তথা বামপন্থীদের ঐক্য-সংহতির পক্ষে ধারাবাহিক দৃঢ় অবস্থানের একদম বিপরীত অবস্থান নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদলের ক্ষমতা দখলের সঙ্কীর্ণ নীতি বারে বারে উত্তরবঙ্গের পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতি মমতা বন্দোপাধ্যায় জোর গলায় বলেছেন যে তিনি ও তার দল এবং সরকার বিভাজনের নীতির বিরুদ্ধে! সত্যিই কি তাই? তথ্য কিন্তু অন্য কথা বলছে। কামতাপুর আন্দোলনের নেতা সদ্য প্রয়াত অতুল রায়, গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য গঠনের আন্দোলনের নেতা বংশীবদন বর্মন তো এখন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সহযাত্রী। এই বংশীবদন বর্মন যখন হত্যা ও সন্ত্রাসের অভিযোগে জেলবন্দী ছিলেন তখন জেলে গিয়ে তাকে সমর্থন জানিয়ে এসেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা মুকুল রায়। গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের অপর নেতা অনন্ত রায় ‘মহারাজ’ এখনও পর্যন্ত বিজেপি’র সাথে থাকলেও তৃণমূল কংগ্রেস তাকে কাছে পাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

(২)
জনবিন্যাসে অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি। নানা জনগোষ্ঠী, নানা ভাষা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমাহার বিশিষ্ট দার্জিলিং-কালিম্পং পার্বত্য এলাকার পাশাপাশি সংলগ্ন ডুয়ার্স-তরাই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী নেপালীভাষী, গোর্খা, যদিও এই পাহাড়বাসীদের মধ্যেও আছে গোষ্ঠীগত পার্থক্য। চা বাগান অধ্যূষিত জলপাইগুড়ি দার্জিলিং জেলার তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে আদিবাসী জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

কোচবিহার-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি-উত্তর দিনাজপুর-দক্ষিণ দিনাজপুরে বড় সংখ্যায় বাস রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এছাড়াও মেচ, রাভা, লুপ্তপ্রায় টোটো জনজাতি, ধীমাল এবং মতুয়া সম্প্রদায় সহ নানা অংশের তপশিলি সম্প্রদায়ের বসতি উল্লেখযোগ্য। মালদা সহ দিনাজপুরে মুসলিম অধিবাসী ও আদিবাসী বিশেষ করে সাঁওতালদের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য।
উত্তরবঙ্গের ২১.৩২৫ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ। রাজ্যের জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশের বাস উত্তরবঙ্গে। দেশ বিভাগের পর অভিবাসনের ফলে উত্তরবঙ্গের ভূমির উপর অত্যাধিক চাপ বাড়ে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কৃষিক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিশ্রমী অভিবাসী ও নমশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ সরল ও কম পরিশ্রমী রাজবংশীদের চেয়ে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে জমিদারী উচ্ছেদ আইন ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমিসংস্কার এবং অপারেশন বর্গা-র ফলে স্থানীয় জোতদাররা যে আর্থসামাজিক প্রতিপত্তি হারায় তার প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে।

রাজনীতি, ক্ষমতায়ন বিষয়গুলি যুক্ত হয়ে যেমন জাত্যাভিমানের জন্ম দেয়, তেমনই সম্পর্কের মনস্তাত্তিক অবনমনও ঘটে। ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তৈরী হয় ‘উত্তরখন্ড’ – ‘উতজাস’-এর মত গ্রামীন জোতদারদের নিজস্ব সংগঠন, যা নানা প্রক্রিযায় শাসক শ্রেণীর মদত পায়। উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তির কিছু ধারার অপব্যাখ্যা ও ভারতভক্তি বিরোধিতাকারী সেই সময়ের প্রচারের রেশ ও হিতসাধনী সংস্থার প্রভাব। উল্লেখ করা দরকার রাজ্যশাসনের সমর্থক কোচবিহারের হিতসাধনী সংস্থা যেমন ভারতভুক্তির বিরোধী ছিল, তেমনই এর বিপরীতে গঠিত হয়েছিল কোচবিহার ‘প্রজামন্ডল’ যা শক্তির দিক থেকে খুব শক্তিশালী ছিল না। এই প্রেক্ষাপটেই পরিবর্ধিত ও কিছুটা রূপান্তরিত চেহারায় সংগঠিত হয় কামতাপুর আন্দোলন ও গ্রেটার কোচবিহার সংগঠন – যার মতাদর্শগত ভিত্তি হয় Identify-র প্রশ্ন, সামনে আসে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বাস্তব কিংবা কল্পিত নানা ঘটনাবলী। ফলে সামাজিক বিন্যাসে বিভেদের জন্ম হয়। অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। আধিপত্য ও আধিপত্যহীনতার বিভেদের পরিবেশ প্রসারিত হতে থাকে। ভূমিপুত্র ও বহিরাগত তকমার লড়াইয়ের ভাষ্য তৈরী হতে থাকে। শাসকশ্রেণী ভোটের রাজনীতির ইন্ধন হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে ও পরিস্থিতি জটিল হতে থাকে। মূলত বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ উপস্থিত হয়।

(৩)
উত্তরবঙ্গের জাতিগত পরিচিতি সত্তার রাজনীতির সবচেয়ে পূরাতন হলো দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার নেপালী / গোর্খা জনগোষ্ঠীর আলাদা গোর্খাল্যান্ড গঠনের দাবী – যে আন্দোলন আশির দশকে সুবাস ঘিসিং-এর গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট (GNLF) এর রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে দার্জিলিং পার্বত্য এলাকাকে উত্তপ্ত করে তুলেছিল। এর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল রাজ্যের সমতল এলাকাতেও।
গোর্খা জাতিসত্তার বিকাশ ও অধিকার রক্ষার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সর্বদা সচেষ্ট বলেই দার্জিলিং পার্বত্য এলাকায় রাজ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সিদ্ধান্ত পার্টি ও বামফ্রন্ট সরকারই গ্রহণ করেছিলো। সি.পি.আই.(এম) নেতা তথা সাংসদ আনন্দ পাঠক ১৯৮৫ সালে সংসদে এই দাবী উত্থাপন করেই বেসরকারি বিল এনেছিলেন। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার তাতে সম্মতি দেয়নি। আবার ‘গোর্খাল্যান্ড’ আন্দোলনের গতিধারা ব্যাখ্যা করার নামে কিছু অনৈতিহাসিক প্রবণতাও দেখা যায়। কিছু প্রাবন্ধিক বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ব্রিটিশ শাসনাধীন ১৯৪৬ সালে দার্জিলিং এর কমিউনিস্ট বিধায়ক কমরেড রতনলাল ব্রাক্ষণ ও গণেশলাল সুব্বা (পরে পার্টি থেকে বহিস্কৃত) ‘গোর্খাস্তান’ বিষয় সম্বলিত যে চিঠি লিখেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিত উল্লেখ না করে চিঠিটাই শুধু উল্লেখ করে থাকে। আসলে এই সময়ে একটি পরিকল্পনা করা হচ্ছিল দার্জিলিংকে আসাম বা উত্তরপূর্বাঞ্চলের সাথে যুক্ত করে দেবার। উক্ত চিঠিটিতে এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করা হয় – আর সে সময় ছিল ব্রিটিশ শাসিত ভারত। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে কমিউনিস্ট পার্টির দার্জিলিং জেলা কমিটি ১৯৫৪ সালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে দার্জিলিং পার্বত্য এলাকার জন্য রাজ্যের মধ্যেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন (Regional Autonomy)-র দাবী জানায়। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস দলের জেলা কমিটি দাবী করে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল (Union Territory)-র।

তিস্তা-মহানন্দা দিয়ে অনেক জল প্রবাহিত হবার পর আশির দশকে উত্তপ্ত দার্জিলিং পাহাড়ে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার ও মুখ্যমন্ত্রী কমরেড জ্যোতি বসুর আন্তরিক প্রচেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও জি.এন.এল.এফ সুপ্রিম সুবাস ঘিসিং-এর মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় Darjeeling Gorkha Council (DGHC) -যাকে বামফ্রন্ট সরকার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সংস্থা হিসাবে সহযোগিতা করেছে। এই চুক্তির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো যে সুবাস ঘিসিং আলাদা রাজ্যের দাবী থেকে সরে এসেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। পরে রাজ্য সরকার ও দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল (DGHC) কে সংবিধান স্বীকৃত স্বশাসিত সংস্থার অধিকার দেবার জন্য ষষ্ঠ তপশীলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিধানসভায় প্রস্তাব গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠায়। কিন্তু বিজেপি ও জাতীয় কংগ্রেস দুই দলেরই অসহযোগিতার কারণে সংশ্লিষ্ট বিলটি লোকসভার Standing Committee তে হিমঘরে পরে থাকল। সমস্যাও জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকল – যা চাইছিলো বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী শক্তি ও দলগুলি।

তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের উদ্যোগে GTA গঠিত হলেও, ক্ষমতা ও মর্যাদার দিক দিয়ে আগের DGHC থেকে তা দুর্বল। এছাড়া চুক্তিতে আলাদা রাজ্যের দাবীকে স্বীকৃতি (Keeping on record the demand of separate State Gorkhaland) দান। আঞ্চলিক স্বাশাসিত সংস্থা হিসাবে GTA কার্যকরি হয়নি। তার অন্যতম কারণ স্বশাসিত সংস্থার প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অবাঞ্ছিত আচরণ। যা গোর্খা জাতিসত্তার আবেগ ও মর্যাদাকে আঘাত করে। এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয় বিজেপি - যে বিজেপি প্রতিটি নির্বাচনের সময়ে ‘গোর্খাল্যান্ড’ পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রæতি দিয়ে পর পর নির্বাচনে দার্জিলিং-এ জয়লাভ করেছে। আবার এই সুযোগ জঝঝ পাহাড়জুড়ে তাদের কৌশলী Micro Level Social Engineering এর মাধ্যমে পাহাড়ের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। 
বর্তমানে দার্জিলিং। কালিম্পং পাহাড়ে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বল উপস্থিতি এবং গোর্খা জাতিসত্তার বিকাশ ও আকাঙ্খার প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী শক্তির দুর্বলতা পরিস্থিতি বিপজ্জনক দিকে যাবার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। প্রকৃত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে শ্রেণীগত আন্দোলন ও সামাজিক বিষয়গুলিকে সেই আন্দোলনে অঙ্গীভূত করার দায়িত্ব বামপন্থীদের তথা সি.পি.আই (এম) কেই পালন করতে হবে। কেন না গোর্খা জাতির মর্যাদা রক্ষা, পাহাড়ের আর্থ-সামাজিক বিকাশের আন্দোলন ও নেপালী ভাষার অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভুক্তির আন্দোলনের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার সি.পি.আই (এম)ই বহন করে।

(৪)

উত্তরের জেলাগুলির চা বাগান অধ্যুষিত এলাকায়, প্রতিটি চা বাগানে যতজন শ্রমিক তার চেয়ে চারগুণের বেশি তাদের পরিবারের সদস্য যারা চা বাগানের শ্রমিক নন। এদের বাস্তুজমির নিশ্চয়তা নেই – কিন্তু সাথে আছে কর্মসংস্থানহীনতার উদ্বেগ। শিক্ষার কিছুটা সুযোগ পেলেও অনেকেই নিরাপদ জীবিকা পাচ্ছে না। আদিবাসী সমাজের নানা সামাজিক সমস্যাগুলির মধ্যেও ইতিবাচক অবস্থান নিয়ে যখন এই সমাজের তরুণ প্রজন্ম মূল সামাজিক প্রবাহে থাকতে আগ্রহী হয়, তখন তাদের কাছে আকাঙ্খা (Aspiration)-র সাথে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মর্যাদা (Dignity)-র বিষয়টি। সুতরাং শুধুমাত্র কিছু পাইয়ে দিয়ে আদিবাসী সমাজের এই তরুণ প্রজন্মের আত্মমর্যাদার বিষয়টির নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়।

এই ফাঁক দিয়ে RSS সহ নানা বিভেদপন্থী শক্তি এই সব এলাকায় Social Engineering এর মাধ্যমে তৎপরতা বৃদ্ধি করে চলেছে। এর সাথেই যুক্ত করেছে RSS বা বিজেপি’র মতাদর্শগত ভাবনার ছায়ার
আলাদা ‘উত্তরবঙ্গ’ রাজ্য গঠনের দাবী। সুতরাং আদিবাসী নেতা বা বিজেপি সাংসদদের মুখে আলাদা রাজ্যের দাবীটি কোন কাকতালীয় বিষয় নয়।
উত্তরবঙ্গের এই অংশে চা বাগান শ্রমিক আদিবাসী সমাজের মধ্যে পরিচিতি সত্তার রাজনীতি এতটাই প্রভাব সৃষ্টি করেছে যে চা বাগান শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের যৌথ মঞ্চ গঠন করে ন্যূনতম মজুরীর দাবীতে শক্তিশালী আন্দোলন সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রামে এদের বড় অংশই জনগোষ্ঠীগত পরিচিতিকেই প্রাধান্য দেয়। এছাড়া শিক্ষিত নবীন প্রজন্ম তাদের শিক্ষা জীবিকার পাশাপাশি পরিচিতি (Identity)-র ও আত্মমর্যাদা (Dignity)-র স্বীকৃতির প্রশ্নে নিজেদের আবেগ ও আকাঙ্খাকে সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে বিচার বিবেচনার প্রত্যাশী। যদিও এই প্রশ্নে বামপন্থীরা সততই দায়বদ্ধ ভূমিকা পালনে সচেষ্ট।

(৫)
উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক জেলাগুলিতে উদ্ভুত এই পরিচিতি সত্তার আন্দোলনগুলিকে অনুধাবন করে সঠিক অবস্থান গ্রহণের জন্য কয়েকটি বিশেষ বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার।

• স্বাধীনতার পূর্বে কোচবিহার ছিল ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত করদ মিত্র রাজ্য। ভারতভূক্তির পর রাজ্যের একটি জেলাতে পরিণত হওয়ার বিষয়টিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বঞ্চনার উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে থাকে।

• ইংরেজ আমলে দীর্ঘদিন দার্জিলিং পাহাড় ছিল Partial Excluded Area, তাই জাতীয় আন্দোলনের প্রভাব সেখানে পৌঁছেছিল কার্যত কমিউনিস্ট পার্টির গঠনের পর – যদিও জাতীয় আন্দোলনের অনেক নেতা নানা সময়ে দার্জিলিং পাহাড়ে গিয়েছেন। ব্যতিক্রমী মনোভাবের মধ্যে পরিচিতিসত্তার পাশাপাশি এটিও মানসিক উপাদান হিসাবে কাজ করে।

• আদিবাসী বা রাজবংশী সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলিকে উপেক্ষা না করে বা বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক শ্রেণী আন্দোলনের অংশ হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং বৃহত্তর সমাজের দায়িত্ব হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিকাশ, ভাষা একাডেমী গঠন সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি ইতিবাচক ভাবেই দেখতে হবে।

• বর্তমান উদারআর্থিক নীতির সময়ে ধান্দার পুঁজিবাদ (Corny Capitalism) বৈষম্য, আকাঙ্খার পাশাপাশি অস্বাভাবিক ভাবে আত্মমর্যাদাহীন সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা সৃষ্টি করে এক জনগোষ্ঠীকে অপর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে শোষকের আসল চেহারাকে আড়াল করে। উত্তরবঙ্গ এই চক্রান্তের বাইরে নয়।

• নানা ঐতিহাসিক ও আর্থসামাজিক কারণে আসাম সহ উত্তরপূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি তৎপর। ভৌগলিক ও জনবিন্যাসের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে উত্তরবঙ্গের এই অংশের স্থানীয়রা আসাম বা উত্তরপূর্ব ভারতের স্থানীয়দের কাছাকাছি। স্বাভাবিক ভাবেই আসামের প্রতিটি রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা (CAA/NRC)সহ এই অঞ্চলে প্রভাব ফেলে থাকে।



পশ্চিমবঙ্গের উত্তরের এই প্রান্তিক জেলাগুলিতে উদ্ভত পরিচিতি সত্তার আন্দোলন ও জনজাতির বিষয়গুলিকে সি.পি.আই(এম) বস্তুনিষ্ঠভাবেই বিচার করে। কোন কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে কমরেড লেনিনের শিক্ষাই হলো – ‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ’। পরিচিতি সত্তার আন্দোলনকে যান্ত্রিকভাবে বিরোধিতা করতে থাকলে জনজাতিগুলি থেকে বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি পায়, আবার শুধু সমর্থনের ¯ শ্রোতে গা ভাসালে শ্রেণী আন্দোলন ও ঐক্য সংহতি বিপন্ন হয়। এক্ষেত্রে অনুধাবন ও অনুসরণ করতে হবে সি.পি.আই (এম) উনবিংশতিতম পার্টি কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাব, যেখানে বলা হয়েছে – “পার্টি ও বাম আন্দোলনচায় সমস্ত সম্প্রদায়ের নিপীড়িত অংশের মানুষকে সমবেত করে ব্যাপকতর আন্দোলন সংগঠিত করতে এবং একটি বাম গণতান্ত্রিক মঞ্চ গড়ে তুলতে। বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া শ্রেণী ও দলিতদের জীবনজীবিকা ও সামাজিক সমস্যার প্রশ্নে পার্টিকে সুনির্দিষ্টভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। যাতে শ্রেণীগত প্রশ্ন ও সামাজিক প্রশ্নকে একসঙ্গে মোকাবিলা করে জাতপাত ভিত্তিক বিভাজনের ক্ষতিকর প্রভাবের মোকাবিলা করা যায়”।

এটাই উদ্ভুত সমস্যাগুলি নিরসনের পথে এগিয়ে যাবার বস্তুনিষ্ট পদ্ধতি – যা আন্তরিকভাবেই অনুসরণ করতে হবে।


———

শেয়ার করুন