Site icon CPI(M)

Here We Stand, United For Struggle

8marchWebdesk

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। পার্টির রাজ্য ওয়েবসাইট টিম যোগাযোগ করে আমাদের রাজ্যে সংগঠিত মহিলা আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী কমরেড কনীনিকা ঘোষের সাথে। সংগ্রামী অভিনন্দনের সাথেই আমরা কথা বলেছি সারা পৃথিবীতে মহিলাদের লড়াইয়ের প্রসঙ্গে। কথার সুত্রে এসেছে আমাদের দেশ ও রাজ্যে সংগ্রামের প্রেক্ষিত। আন্তর্জাতিক নারী দিবস শুধুমাত্র মহিলাদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয় না- সেই লড়াই ছিল, আছে, বিজয়ী না হওয়া অবধি চলবেও; এর সাথেই কমরেড কনীনিকা ঘোষ স্পষ্ট করেছেন এই লড়াইয়ের রাজনৈতিক – সামাজিক পরিসরের ব্যপ্তি ও গভীরতা। সেই কথোপকথনই লেখার আকারে প্রকাশিত হল।

১) আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। কেন এই দিনটি গুরুত্বপূর্ণ?

১৮৮৯ সালে প্যারি শহরে অনুষ্ঠিত হয় ২য় আন্তর্জাতিকের শ্রমিক সম্মেলনের মঞ্চ। বিশ্ববরেণ্য কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের বক্তৃতায় তোলপাড় হয়েছিল সকলে। সেই মঞ্চেই উচ্চারিত হল নারী-পুরুষ সমানাধিকারের কথা। মহিলারা উপলব্ধি করলেন এমন দাবি আর স্বপ্ন নয়- সত্য। শিল্পোন্নত দেশের নারী শ্রমিকরাও সংগঠিত হতে শুরু করলেন। রচিত হলো ইতিহাস।

এর পরে ১৯০৭, জার্মানির স্টুটগার্টে প্রথম আস্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে সম্পাদক নির্বাচিত হন ক্লারা জেটকিন সম্পাদকের দায়িত্বে নির্বাচিত হলেন। সমাজ পরিবর্তনের দিশারিদের নেতৃত্বেই মহিলাদের আন্দোলন আরও এক ধাপ সামনে এগোল।

নিউ ইয়র্কের দরজি শ্রমিক মেয়েরা ১৯০৮-র ৮ মার্চ ভোটাধিকারের দাবিতে ঐতিহাসিক আন্দোলন শুরু করেন। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে ২৭ আগস্ট দুই কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন ও আলেকজান্দ্রা কোলনতাই-এর পেশ করা প্রস্তাবই গৃহীত হল। প্রতি বছর একটি দিন পালিত হবে পূর্ণ বয়স্কা নারীর ভোটাধিকার দিবস হিসাবে। ৮ মার্চ, ১৯০৮-এর যে দিন নিউ ইয়র্কের দরজি শ্রমিক মেয়েরা ভোটাধিকার দাবি করেছিল, তাই সেই দিনটিই আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে নির্ধারিত হয়। ১৯৭৫-এ রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে ৮মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

২) মহিলাদের আন্দোলন সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার যোগাযোগ কতদুর?

কমিউনিস্ট ইশতেহারটি পড়লেই সেকথা বোঝা যায়। সেই বইতে মার্কস-এঙ্গেলস বলেছিলেন ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। শোষণের পৃথিবীটাকে পালটে দেবার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে যে মজুররা সেখানে মেয়েরাও থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। ১৮৫৭ মনে রাখতেই হয়, ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিল। সেই বছর নিউ ইয়র্কের দরজি মেয়েরা কাজের ঘণ্টা কমানো আর পাশাপাশি মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সেই আন্দোলন বিফলে যায়নি। ১৮৬৪ সাল, প্রথম আন্তর্জাতিকের মঞ্চ থেকে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিকারের প্রশ্নটি তুলে ধরলেন কাল মার্কস। ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস বললেন ‘পুরুষ কর্তৃক নারীর শোষণ প্রকৃতপক্ষে প্রথম শ্রেণি শোষণের দৃষ্টান্ত’। ১৮৭১, প্যারি কমিউনের লড়াইয়ে মহিলারাও সমান বীরত্বে লড়াই করেছিলেন। ‘The red partisan women came to the surface, nobel and devoted the women of antiquity. The women of Paris joyfully gave up their lives on the barricade and execution ground’ লিখে মার্কস সেই লড়াইকেই উর্ধে তুলে ধরেছেন।

৩) দেশ তথা রাজ্যের নারীদের সামনে মহিলা আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে কি বার্তা দেবেন?

লিঙ্গ বৈষম্য আজও ঘুচল কই! আজও তো সমাজে মেয়েদের শ্রমের দাম নেই, নেই সমকাজে সমান মজুরি, নেই নিরাপত্তা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীই হোক না ধানের বীজতলা রোপণ করা কৃষক অথবা তথ্য প্রযুক্তিতে কাজ করা তরুণী বা ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিক মেয়েরা যে আজও নারী হিসাবে – নাগরিক হিসাবে- শ্রমিক হিসাবে শোষণের শিকার। তাই তো আমরা আজও লড়ি-লড়ি মহিলাদের অধিকারের লড়াই- সমতার লড়াই। ‘মন কি বাত’-এ প্রধানমন্ত্রীর বড় বড় ভাষণ অথচ বেকসুর খালাস হয়ে যায় হাথরসের ধর্ষকদের মধ্যে তিনজন, তখন প্রতিবাদ করতে পথে নামছি আমরা। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের ছেড়ে দিয়ে গলায় মালা পরিয়ে বরণ করে নিচ্ছে বিজেপি। আমাদের এ লড়াই আরও তীব্র করতেই হবে। বিজেপি-আরএসএস’র দর্শনের ভিত্তি মনুবাদ। সেই শাস্ত্রে কি রয়েছে? স্ত্রীর অন্যতম কর্তব্য হলো পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া, সন্তানহীন নারী মানে তার বেঁচে থাকারও অধিকারটুকুও প্রায় নেই। লেখা রয়েছে ‘পতিপুত্রহীন রমণীর রন্ধিত এবং পরিবেশিত অন্ন খেলে একশো বছর তপ্ত লৌহকুণ্ডে বাস করতে হয়’। মনু পুরুষদের সাবধান করে বলছেন নারীর সব সময় ব্যাভিচারিণী হবার প্রবণতা থাকে আর তাই সব বর্ণের পুরুষের উচিত সর্বদা স্ত্রীকে পাহারায় রাখা (মনুস্মৃতি ৯/৬) ।

আজকের ভারতে এহেন মনুবাদীরাই দেশের কর্ণধার। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে, কর্পোরেটের স্বার্থে নীতি রচনা করছে এরাই, মানুষের কষ্ট,ঘামে-শ্রমে অর্জিত অর্থের মূল্য তাদের কাছে। আজকের নারী দিবসে নারীর প্রকৃত অধিকারের লড়াইয়ের সঙ্গেই রয়েছে জীবন-জীবিকার লড়াই, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে লড়াইও সেই স্রোতেই মিলেছে। আর এ লড়াইয়ের পদপ্রান্তেই মিলে যায় আমাদের রাজ্য ও দেশ কারণ আমাদের রাজ্য আজ দুর্নীতির শিখরে, সর্বত্র যেদিকে তাকাই দুর্নীতি আর চুরি- লুট। নিয়োগ দুর্নীতি পৌঁছেছে নজিরবিহীন উচ্চতায়। অর্থের বিনিময়ে হাজার হাজার ভুয়ো নিয়োগ হচ্ছে। যোগ্য প্রার্থীদের নম্বর কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাঁসখালি বা বীরভূম-জলপাইগুড়ি- বাসন্তী- গলসী বা ডেবরা প্রতিদিন ধর্ষিতা মেয়েদের স্বজনের কান্নায় যখন বাতাস ভারী হচ্ছে অথচ মাননীয়া ফরমান দিচ্ছেন ‘ছোট্ট ঘটনা’ অথবা প্রশ্ন তুলছেন ‘লাভ অ্যাফেয়ার’- ছিল বলে! কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থে দেউচা পাঁচামীতে অবৈজ্ঞানিক খোলামুখ কয়লাখনির বরাত দিয়ে উচ্ছেদ করে দিতে চাইছে আদিবাসীদের। সেই আদিবাসী মহিলাদের জীবন বাঁচানোর লড়াকু সংগ্রামে আমরা আছি, তাকে আরও দৃপ্ত করার কথা উচ্চারণ করতেই হবে আজকের নারী দিবসে।

একের পর এক গ্রাম পঞ্চায়েত যখন শুধু লুটেরাদের স্বর্গ রাজ্যে পরিণত হচ্ছে, যখন আবাস যোজনার দুর্নীতিতে মানুষ নামছে রাস্তায়, যখন আবাস যোজনায় ঘর চাইতে যাওয়া আরজুনা বিবিকে অত্যাচার করে পুলিশ আর তার লড়াইকে সহমর্মিতা জানাতে মহিলা সমিতি গেলে সে তার দু’চোখ ভরা প্রত্যয় নিয়ে বলে আমাকে ওরা অত্যাচার করলেও টলাতে পারবে না তখন সেই সাহসকে কুর্নিশ জানিয়ে প্রত্যয়ী লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথই তো আজকের নারী দিবসের ডাক।

৪) একদিকে কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করা মেয়েরা অন্যদিকে গৃহপরিচালিকার কাজ করা মেয়েরা দুক্ষেত্রেই এরা বঞ্চিত নিষ্পেষিত একসাথে মিলিত লড়াই কিভাবে হবে?

এখানেই ইতিহাস থেকে বর্তমানের সবটা একসুত্রে এসে মিলে যায়। ইতিমধ্যেই আমরা আলোচনা করলাম ইতিহাসে আজকের দিনটি মূলত শ্রমজীবী মহিলাদের লড়াইয়ের বার্তাবাহক। সেই লড়াই যত দিন এগিয়েছে ততই পরিসর বাড়িয়েছে। সেই দিন থেকে আজকের সময়ে মেয়েরা কিছুটা এগিয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু মূল লড়াই এখনও জারী রয়েছে। কর্পোরেট সেক্টরে কাজ করলে কি শোষণ হয় না? মহিলাদের লড়াই এখানেই বিশ্বজনীন শ্রমজীবীদের লড়াইয়ের সাথে এক রেখায় দাঁড়িয়ে যায়। গৃহপরিচারিকার পরিচয়টুকুই সব নয়, একজন মহিলার সমস্যা কার্যত গোটা পরিবারের সমস্যা। ফলে শ্রমজীবী মহিলার লড়াই সেই অর্থে শ্রমজীবীদেরই আন্দোলন সংগ্রাম। একে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ভুল, সমস্ত ক্ষেত্রের মহিলাদের একজায়গায় এনে লড়াইকে আরও শাণিত করাই লক্ষ্য। আমাদের সংগঠন সেই উদ্দেশ্যেই ‘একসাথে’ হওয়ার বার্তা দেয়। আগামী ১০ তারিখ ছাত্র-যুবদের লড়াই, একইসাথে সরকারী কর্মচারীদের ন্যায্য দাবীতে ধর্মঘট। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে যেকোনো লড়াইতে আমরা সংগ্রামী মানুষের সহযোদ্ধা, এই অনুভবেই আমাদের পথ চলা জারী রয়েছে। কমরেড লেনিন যখন ক্লারা জেটকিনকে বলেছিলেন ‘The women worker acted splendidly during the revolution. Without them we should not have been victorious’- সেই ঐতিহ্যকেই বারে বারে নিজেদের সময়ে চর্চায় নিয়ে আসতে হয়, আমরা সেই পথেরই পথিক। লড়াইয়ের অঙ্গীকার করার দিন ৮ মার্চ, জান কবুল মান কবুল প্রস্তুত থাকার দিন ৮ মার্চ। প্রতিদিন নতুন আলোর সন্ধানে ছুটে চলার দিনই ৮ মার্চ।

সবাইকে আজকের দিনে অভিনন্দন জানাই।

শেয়ার করুন