1 May 2020 ,Friday
সেদিন রাত সাড়ে দশটায় মুখ ফুটলো হামবুর্গ রেডিওর।
সংবাদপাঠক কী স্থির ছিলেন? নাকি আবেগমথিত? সে বিবরণ জানা নেই। কিন্তু ঘোষণাটি জরুরী ছিল — ‘‘বলশেভিকবাদের বিরুদ্ধে এবং জার্মানির জন্য শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করতে করতে K দিয়েছেন ফুয়েরার।’’
দুনিয়া জানলো — অ্যাডলফ হিটলার নেই। নাৎসিদের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষা। স্তালিন কী করছেন? কী বলছেন জেলারেলোসিমো? প্রশ্ন তখন লক্ষ মনে।
সেদিন ছিল ১লা মে। ১৯৪৫।
দেশভাগের আশঙ্কা আর দীর্ঘলালিত স্বাধীনতার সম্ভাবনার মাঝে প্রবল উৎকন্ঠায় জেগে থাকা লক্ষ বুকে সেদিন আবেগ নেমেছিল অলকানন্দার মত।
পৃথিবীর ইতিহাসে অবিস্মরণিয় ১লা মে সেদিনই।
হিটলার আত্মহত্যা করেন তার আগের দিন, ৩০শে এপ্রিল। আর ২রা এপ্রিল পৃথিবী সাক্ষী হলো মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসে সর্বোত্তম অনুঘটক মুহূর্তের — লালফৌজ বার্লিনে ঢুকছে। উড়ছে নিশান। দুনিয়ার সব কবি, কেরানি, বুদ্ধিজীবী, পাদ্রি-পুরুত, অভিনেতা কিংবা বানিয়া তখন জানছে — যে দেশের দু’ কোটি মানুষ প্রাণ দিয়েছে যুদ্ধে, যে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ছেলে শহীদ হয়েছেন শত্রুপক্ষের বুলেটে, সেই ভূখন্ডের বাহিনীর মুখোমুখি নাৎসিবাহিনী চূর্ণ।
৭৫ বছর আগের সেই বসন্তে কলকাতায় কী হয়েছিল? জানিয়ে রেখেছেন কমরেড সরোজ মুখার্জি তাঁর লেখনিতে —‘‘কলকাতার বুকে হিটলারের বার্লিন পতনের সংবাদে বিরাট মিছিল সংগঠিত করে কমিউনিস্ট পার্টি।’’ পরিশীলিত উচ্চারণ, সংযত বাক্য এবং অযথা উত্তেজনা এড়িয়ে চলা শব্দ, আবেগ সেই সময়কার সিংহভাগ কমিউনিস্ট নেতার বৈশিষ্ট্য। সরোজ মুখার্জির বারো শব্দের বাক্যতে তাই সেদিনের কলকাতাকে আজকের মোবাইল-মথিত সময়কালে বিচার করা কঠিন হবে।
আবেগ তখন পলির মত জমতো। কবিতা, গান জেগে উঠতো চাঁদ-সোহাগী ছাদে, একা রাতের পায়চারিতে। ফেটে পড়তো হৃদয় — উত্তাল চল্লিশের স্লোগানে। স্বপ্নে তখন ‘অসমাপ্ত বিপ্লব।’
ভারতে ১লা মে পালন প্রথম হয়েছে মাদ্রাজে। এখন তা চেন্নাই। উদ্যোক্তা ছিলেন মলয়পুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। তখন ১৯২৩। সেদিনই চেট্টিয়ার লেবার কিষাণ পার্টি অব হিন্দুস্থান প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-র নেতা হয়ে ওঠেন। সেদিন মাদ্রাজের দুটি জায়গায় প্রথম মে দিবস উদ্যাপন হয়। একটি সভা হয়েছিল মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিপরীতে সমুদ্রতটে। অন্যটি ট্রিপ্লিকেন বিচে। ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় এই কর্মসূচীর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে রক্তপতাকা উত্তোলনের প্রথম ঘটনাও এটিই। শোনা যায়, শ্রমিকদের রক্তপতাকা উত্তোলনের ঐতিহ্য শুরু করতে চেট্টিয়ারের অনুরোধে তাঁর মেয়ে নিজের লাল রঙের শাড়ি ছিঁড়ে লাল পতাকা তৈরি করে দেন। সেটাই সেদিন উত্তোলিত হয়েছিল।
কেন ১৯২৩? ইতিহাসে পরিস্থিতির বিবেচনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
মাদ্রাজের ঘটনার সময়কালেই দেশে বামপন্থী শক্তির বিকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। ১৯২০-তে তাশখন্দে পার্টি গড়ে উঠেছে। তার আগেই স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়ে গেছে দেশে। কংগ্রেসের গয়া অধিবেসনে সাম্রাজ্যবাদকে চমকে দিয়ে ‘পূর্ণ স্বরাজের’ দাবি উত্থাপন করে দিয়েছেন কমিউনিস্টরা। দেশে শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রণী প্রধানত বামপন্থী এবং কমিউনিস্টরা। উদাহরণ? ১৯২৫ থেকে ১৯২৮ — এই চার বছরে দেশে ৫৯৪টি শ্রমিক ধর্মঘট ও লক আউট হয়। প্রায় ১০ লক্ষ ৯৫ হাজার ৭৪০ জন শ্রমিক এই শ্রমিক আন্দোলনগুলিতে জড়িত ছিলেন। শুধু ১৯২৮-এ বাংলায় ৬০টি ক্ষেত্রে কারখানার মালিক আর শ্রমিকদের বিরোধের ঘটনা ঘটেছিল।
১৯২৯-র মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাকে এই ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। একদিনে ৩২জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এই মামলায়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মেদ, ধরণী গোস্বামী, গোপাল বসাক, সামসুল হুদা, পিসি যোশী, এসএ ডাঙ্গে, গঙ্গাধর অধিকারী, এসএস মিরাজকর,ফিলিপস স্প্র্যাট, বেন ব্র্যাডলে, এসএল হাচিনসন প্রমুখ। সেই মামলায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ ছিল, ১৯২১-এ মুজফফর আহ্মেদ, এসএ ডাঙ্গে প্রমুখ দেশে কমিন্টার্ণ প্রতিষ্ঠার ‘চক্রান্ত’ করেছিলেন।
মে দিবস পালন হয়েছে কারখানায়, শ্রমিক মহল্লায়। তবে ভারতের শ্রমিক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে দারুণ প্রভাব পড়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের।
মে দিবসকে কেন্দ্র করে গান, কবিতা হয়েছে। মুজফ্ফর আহ্মেদের দীর্ঘদিনের সুহৃদ বিদ্রোহী নজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘কুলি মজুর।’ পরবর্তী কালে সুভাষ মুখার্জিসহ আরও অনেকেই মে দিবসের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতা লিখেছেন। পদাতিক কবির ‘মে দিবসের কবিতা অবিস্মরণিয় — ‘‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য/ ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,/ চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য/কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।/চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,/গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,/তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য/ জীবনকে চায় ভালবাসতে।’’ মে দিবসের গান অক্ষয় হয়ে থেকেছে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাধ্যমে।
মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রমিক আন্দোলনের স্পর্ধা এবং সমাজের নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের সম্পর্ক। আজও। এবং সেদিনও।
কিন্তু ভাবীকালের আশ্চর্য ইঙ্গিত রেখে গেছেন হাঁসুলিবাঁকের উপকথার রচয়িতা। মন্বন্তর, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং গ্রাম জীবনের সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন ‘গণদেবতা।’ ১৯৪২-এ প্রকাশিত সেই উপন্যাসে আমরা দেখলাম গ্রামীণ শান্তিপ্রিয় বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত দেবু মাস্টারের মধ্যে প্রবল এক সম্ভাবনা জেগে উঠছে — নিদারুণ এক সঙ্কটের সামনে। আমরা দেখলাম কিভাবে নব্য ধনী, সুদখোর শ্রীহরি ঘোষ হয়ে উঠছে গ্রামের প্রধান, জোতদার। যার সঙ্গে লড়াই হবে পরে। কাকদ্বীপে, খাঁপুরে, পাবনায়। আইপিটিএ আন্দোলনের অন্যতম কারিগর তারাশঙ্কর হাজির করলেন অনিরুদ্ধকে। গ্রামের ‘কম্মোকার’, অসংগঠত শ্রমিক অনিরুদ্ধ শ্রীহরির চক্রান্তে জেলে গেছিলেন। দেবু মাস্টার তাঁর খোঁজে গেছিলেন শহরে। কী জেনে এসেছিলেন মাস্টার? তারাশঙ্কর লিখলেন অনিরুদ্ধর জেল থেকে বেরোনর পরের বিবরণ —‘‘অন্তত সেই কথাই সে বলিয়া গিয়াছে — কলে কাজ করব তো এখানে কেনে করব? বড় কলে কাজ করব। কলকাতা, বোম্বাই, দিল্লী, লাহোর যেখানে বেশী মাইনে পাব, যাব।’’
অনিরুদ্ধ বলে গেলো পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কটের কথা। তাঁদের সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জি, নরেন্দ্র মোদীর ভাবনা কী আর বামফ্রন্টের চিন্তা কী — আমরা পরে জানবো। শ্রম আর পুঁজির সম্পর্ক, অনিরুদ্ধদের পরিযায়ী হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন লাভপুরের কথাকার।
লাভপুর থেকে খুব বেশি দূরে নয় নানুর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কী নানুরের সেই কিশোরকে চিনতেন? যিনি শৈশবেই মা, বাবাকে হারিয়েছিলেন? বড়দাদার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে কলকাতা চলে এসেছিলেন কিশোর। প্রথমে শ্রমিক, তারপর দেশের শ্রমিকশ্রেণীর অন্যতম শীর্ষনেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
অশ্রুকণা তাঁর স্ত্রীর নাম। ‘বিপ্লব’ তাঁর আত্মজ।
তিনি আবদুল হালিম — শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কেন দরকার, দেশে যাঁরা বুঝিয়েছেন তিনি তো তাঁদের মধ্যে অন্যতম। নক্ষত্র।