বাবিন ঘোষ
সুপ্রীম কোর্টের রায়
এই মামলার রায়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খরচ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত অর্থশক্তির সাথে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতির গভীর সম্পর্ক ব্যক্ত করতে। বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কির “ম্যানুফ্যাকচারিং কন্সেন্ট”-এর বারংবার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ে যখন মাইকেল কলিন্সের লেখা “Costs of Democracy: Political Finance in India” (Oxford University Press, 2018) থেকে বারে বারে উদ্ধৃত করা হয় একেকটি অংশ এই উপরোক্ত সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করার সময়। আইনি প্রশ্নগুলি নিয়ে রায় দেওয়ার পাশাপাশি সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ে বিচারপতিরা ভারতের সামগ্রিক সংসদীয় রাজনীতি এবং সেই রাজনীতিতে অর্থশক্তির বিপুল এবং বিপজ্জনক ভূমিকা নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, সেই একই কথা প্রায় বিগত ৭ দশক ধরেই বামপন্থীরা এবং বিশেষ করে সিপিআইএম বলে চলেছে। প্রখ্যাত বিচারপতি, আইনবেত্তা এবং কেরলের প্রথম বামপন্থী সরকারের প্রাক্তন আইন মন্ত্রী প্রয়াত জাস্টিস ভি আর কৃষ্ণ আয়ারের দ্বারা ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় ঘোষিত ভাতাল নাগরাজ বনাম দয়ানন্দ সাগর মামলার রায় কিংবা আরেক প্রখ্যাত বিচারপতি জাস্টিস কুলদীপ সিংহ’র (যিনি একাধিক পরিবেশ আইন সংক্রান্ত মামলায় অসামান্য কিছু জুরিস্প্রুডেন্সের জন্ম দিয়েছেন) ১৯৯৬ সালের কমন ক’জ বনাম ভারত যুক্তরাষ্ট্র মামলার রায় কে উদ্ধৃত করা হয়েছে অর্থশক্তির বিপজ্জনক ভূমিকা ব্যক্ত করার তাগিদে।
মোদি সরকারের আগেও বাজপেয়ী সরকারের আমলেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সাধারণ নাগরিকের নির্বাচনের প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য জানার অধিকারকে শঙ্কুচিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল ২০০২ সালের Association for Democratic Reforms Vs Union of India মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে। উপরোক্ত রায়ে যে কোনো ভোট প্রার্থীর নামে ক’টি ফৌজদারি মামলা রুজু করা রয়েছে এবং সেই মামলায় অভিযোগের সংক্ষিপ্ত বিবরণী প্রার্থীর হলফনামায় দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যাতে তা জনগণের সামনে পেশ করা যায় এবং সাধারণ নির্বাচক মন্ডলী সেই সমস্ত তথ্য মাথায় রেখেই তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। এই রায়ের ঠিক পরেই তড়িঘড়ি জনপ্রতিনিধত্বমূলক আইনে ৩৩(খ) ধারা অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে সেই রায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশকেই নাকচ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল’ তদানীন্তন বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের তরফে। এই পদক্ষেপের বিরোধীতা সেদিন ও সিপিআইএম সংসদের ভেতরে এবং বাইরে করেছিল’। সংসদের বিতর্কে ৩৩(খ) ধারার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বামপন্থী সাংসদ রা সেদিন যে সকল যুক্তি দিয়ে বিরোধীতা করেছিলেন, সেই সকল যুক্তি ২০০৩ সালের PUCL vs Union of India মামলার রায়ে [(2003)4 SCC 399] সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস ভেংকটরামা রেড্ডি ও জাস্টিস এম বি শাহের লিখিত অংশেও খানিক পাওয়া যায়। এই রায়ে উপরোক্ত ৩৩(খ) ধারা কে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে এই মামলায় ভারতীয় জনতা পার্টি ও দল হিসাবে অংশ নেয় (“ইন্টারভেনার”) এবং তাদের তরফে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার পক্ষের সাথে সাযুয্য রেখে যে সওয়াল করা হয়, তা সুপ্রীম কোর্ট মানতে রাজি হন নি। অতএব, এটি একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় যে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেই পেশি শক্তি এবং অর্থশক্তির প্রয়োগ একদম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবেই বাড়িয়ে দেওয়া হয় নির্বাচনী রাজনীতিতে। আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় যে সেই ২০০৩ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনী হোক, বা এই বর্তমান সময়ের নির্বাচনী বন্ডের বিষয় আইনি বা রাজনৈতিক বিরোধীতার প্রশ্ন হোক, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে এক হিরণ্ময় নীরবতা লক্ষ্য করা গেছে। ২০০৩ সালের সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্যা ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আজকের এই নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত আইনি বা রাজনৈতিক লড়াইয়ের আসে পাশেও তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো নেতা নেত্রীকে দেখা যায়নি।
এই মামলার রায়ে (৯৯ এবং ১০০ নং প্যারাগ্রাফে) অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন বিচারপতিরা, যা কিনা কোনো নির্দিষ্ট আইনের বৃত্ত ছাপিয়ে বৃহত্তর একটি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরছে, যা কিনা বামপন্থীরা গোটা দুনিয়া জুড়েই বারে বারে বলে এসেছে। তা হল’, চুড়ান্ত অর্থনৈতিক অসাম্যের একটি পরিস্থিতি, যা কিনা যে কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনিবার্য সামাজিক পরিণতি, সেই অবস্থায় “এক ব্যাক্তি এক ভোট” এর নীতি কেবল মাত্র একটি প্রতীকি রাজনৈতিক সাম্যের-ই জন্ম দেয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই মামলার রায়ে এই বিষয় নিয়ে আর বিশদ আলোচনা হয়নি, কিন্তু এই ইঙ্গিতটুকুও বুঝতে সাহায্য করে যে বামপন্থীদের যে মৌলিক অবস্থান রয়েছে একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সম্পদের সমবন্টন নিয়ে, সেই পদক্ষেপ ব্যাতিরেকে বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থায় ৫ বছরে একবার করে ভোটের আয়োজন করতে পারলেই তা সত্যিকার অর্থে “পার্টিসিপেটিভ ডেমোক্রেসি” হয়ে উঠতে পারেনা। অন্যভাবে বলতে গেলে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সত্যিকারের কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামঞ্জস্য সাধন সম্ভব নয় এই একবিংশ শতকেও।
রায়ে বলা হয়েছে যে আদালতের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে নির্বাচনী বণ্ডের মাধ্যমে প্রদত্ত অনুদানের ৯৪%-ই ১ কোটি টাকা বা তার ও বেশি অর্থমূল্যের। অর্থাৎ, যে সকল দাতারা এই অনুদান দিয়েছেন, তাদের এমনিতেই রাষ্ট্র যন্ত্রের কাছে পৌছে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে কারণ তারা যথেষ্ট ধনী এবং শুধুমাত্র তাদেরই পরিচয় গোপন রাখার জন্য এই গোটা নির্বাচনী বন্ড স্কীমের অবতারণা। রায়ের এই অংশটি (১০৩ নং প্যারাগ্রাফ) আবারো যেন’ বামপন্থীদের উপরোক্ত অবস্থানকেই সমর্থন করে! এবং এই গোপনীয়তা শুধুমাত্র সাধারণ নাগরিকদের কাছে দাতা ও গ্রহীতার পরিচয় আড়াল করে মাত্র। তা কোনো ভাবেই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কাছে দাতার পরিচয় গোপন রাখে না। এ বিষয়ে মাথায় রাখা দরকার যে সমাজের অতি ধনী অংশ (কর্পোরেট সংস্থা) বিশেষ কোনো মতাদর্শগত কারণে নিশ্চই রাজনৈতিক দল কে অনুদান দেবে না। সেই অনুদান দেওয়ার একটি মাত্রই কারণ থাকতে পারে আর তা হল’ সেই রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করতে পারলে এই অনুদানের বিনিময় বহু সুযোগ সুবিধা আদায় করা। কাজেই কোনো কর্পোরেট দাতাই তার অনুদানের তথ্য সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কাছে গোপন করবে না। এ তো আর কোনো গোপন সাক্ষরবিহীন প্রেমপত্র আদান প্রদানের সম্পর্ক নয়! ঘোরতর লেনদেন এবং স্বার্থাণ্বেষণের এক কুশ্রী রাস্তা মাত্র।
সুপ্রীম কোর্টের রায়েও বারে বারে এই “কুইড প্রো ক্যুও” (তুমি আমার স্বার্থ দেখ’, প্রতিদানে আমি তোমার স্বার্থ দেখব’) সম্পর্কের উল্লেখ রয়েছে। ১৯৯৯ সালের জাতীয় আইন কমিশনের নির্বাচনী আইন সংস্কার সংক্রান্ত ১৭০তম রিপোর্টেও এই উল্লেখ রয়েছে যে “most business houses already know where their interest lies and they make their contibutions accordingly to that political party which is likely to advance their interest more”. এই মামলার রায়ের ২০০ এবং ২০১ নং প্যারাগ্রাফে সুপ্রীম কোর্ট এই প্রশ্ন রেখেছেন যে কোনো রাজনৈতিক দল যদি কোনো বাণিজ্যিক সংস্থার থেকে ‘সীমাহীন’ আর্থিক অনুদান পেতে থাকে, সেই সংস্থাকে “পরিবর্তে কিছু পাইয়ে দেওয়ার” তাগিদ বৃহত্তর জনসাধারণের প্রতি সেই রাজনৈতিক দলের দায়িত্বকে ম্লান করে দেবে কিনা। এর সাথে সাথেই উচ্চতম আদালত এই মন্তব্য করেছেন “The reason for political contributions by companies is as open as day light. Even the learned Solicitor General did not deny during the course of the hearings that corporate donations are made to receive favors through quid pro quo arangements.” অর্থাৎ, দেশের সরকারের উচ্চতম আইনবিদ ও সর্বসমক্ষে আদালতের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই কথা স্বীকার না করে পারেন নি যে কর্পোরেট সংস্থার তরফে রাজনৈতিক অনুদানের একমাত্র কারণই হল’ সংস্লিষ্ট দল সরকারি ক্ষমতার কাছে পৌছলে তাদের থেকে পুঁজির সর্বোচ্চায়নের স্বার্থে বিভিন্ন ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা আদায় করা। “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” বা “ধান্দার গণতন্ত্র” প্রসঙ্গে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সমাজবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদরা যে কথা বলে চলেছেন (এমন নয় যে তাদের সবাই বামপন্থী) তার একদম গোড়ার কথাই হল’ পুঁজিবাদের এই উপরোক্ত “কুইড প্রো ক্যুও” নীতি, যা কিনা যে কোনো দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শ্রমজীবি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করে প্রতিদিন, পুঁজির যোগানদার বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মুনাফার ক্রমাগত বাড় বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে গিয়ে।
সবশেষে সুপ্রীম কোর্ট নির্বাচনী বন্ড স্কীম এবং তার সাথে সাথে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এক্ট, জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইন, কোম্পানি আইন এবং আয়কর আইনের সংস্লিষ্ট সংশোধনীগুলি কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে খারিজ করে দেন।
এর সাথে মোট ৬টি নির্দেশ জারি করা হয় সুপ্রীম কোর্টের তরফেঃ
১। স্টেট ব্যাঙ্ক অবিলম্বে এই বন্ড ইস্যু করা বন্ধ করবে।
২। স্টেট ব্যাঙ্কের তরফে ১২ই এপ্রিল ২০১৯ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২৪ অবধি যত নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করা হয়েছে, তার সমস্ত বিশদ তথ্য, যেমন কে কত টাকার বন্ড কবে কিনেছে, তা জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে।
৩। স্টেট ব্যাঙ্ক সকল রাজনৈতিক দলের নাম প্রকাশ করবে যারা এই বন্ডের মাধ্যমে টাকা পেইয়েছে উপরোক্ত ১২ই এপ্রিল ২০১৯ থেকে যার মধ্যে বিশদ তপ্তহ্য থাকবে কবে কোন রাজনৈতিক দল কত টাকার বন্ড এনক্যাশ করে অনুদান গ্রহণ করেছে।
৪। উপরোক্ত সকল তথ্য স্টেট ব্যাঙ্কের তরফে নির্বাচন কমিশন কে ৬ই মার্চ ২০২৪ এর মধ্যে জানিয়ে দিতে হবে।
৫। নির্বাচন কমিশনের তরফে সেই সকল তথ্য ১৩ই মার্চ ২০২৪ এর মধ্যে প্রকাশ করতে হবে তাদের ওয়েবসাইটে।
৬। যে সকল বন্ড এখনো ভাঙিয়ে টাকা নেওয়া হয়নি, সেগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে স্টেট ব্যাঙ্ককে।
অতঃ কিম?
উপরোক্ত নির্দেশাবলী মহামান্য প্রধান বিচারপতি জাস্টিস চন্দ্রচূড় এবং আরো ৩ জন বিচারপতির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়, যাকে কিনা আইনি পরিভাষায় “লিডিং জাজমেন্ট” বলা হয়। এর পাশাপাশি আরেক বিচারপতি জাস্টিস সঞ্জীব খান্না এই “লিডিং জাজমেন্ট”-কে সমর্থন করেই তাঁর নিজের আরেকটি রায় দেন যাকে কিনা “সেপারেট বাট কংক্রারিং ওপিনিয়ন” বলা হয়। লিডিং জাজমেন্টের ২ এবং ৩ নং পয়েন্ট অনুযায়ী একেকটি কোম্পানী কত টাকার বন্ড কিনেছে এবং একেকটি রাজনৈতিক দল কত টাকার বন্ড ভাঙিয়ে টাকা নিয়েছে বিগত ৫ বছরে, সেই তথ্য আগামী ১৩ই মার্চের মধ্যে জনসমক্ষে আসবে। এবারে, বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেসের মত দলের তরফে এই কথা বলে হতেই পারে যে, কোন কোম্পানী নির্দিষ্টভাবে কোন রাজনৈতিক দলকে কত টাকা দিয়েছে এই ৫ বছরে, সেই তথ্য জানাতে কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্কের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই লিডিং জাজমেন্ট অনুযায়ী। কাজেই একেকটি দাতা কোম্পানীর সাথে একেকটি গ্রহীতা রাজনৈতিক দলের বিগত ৫ বছরের এই সরাসরি লেনদেনটা এই তথ্যের মাধ্যমে জনসমক্ষে আনার ক্ষেত্রে এখনো বাধা সৃষ্টি করার রাজনৈতিক অপচেষ্টা চালানো হতে পারে।
যদিও কোম্পানী আইনের সংশোধনীটা খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রীম কোর্ট, যার ফলে কোম্পানীগুলিকে ১৯৮৫ এবং ২০১৩ সালের আইন মোতাবেক বার্ষিক প্রফিট এন্ড লস একাউন্টে অনুদানের পরিমাণ এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল/দলগুলি যাকে/যাদের অনুদান দেওয়া হয়েছে তা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা থেকে যাচ্ছে; তাদের ক্ষেত্রেও বিগত ৫ বছরের বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনুদানের যাবতীয় তথ্য বার্ষিক আয় ব্যায়ের হিসাবে অন্তর্গত করার আইনি দায়িত্ব থাকছে কিনা (অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের এই রায়ের কোনো retsrospective effect হচ্ছে কিনা) তা নিয়েও এই সকল কায়েমী স্বার্থের তল্পিবাহকেরা বাধা দিতে পারে। ঠিক এই প্রসঙ্গেই বিচারপতি শ্রী সঞ্জীব খান্নার “সেপারেট বাট কংকারিং ওপিনিয়ন” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাঁর রায়ের ৭৭, ৭৮ এবং ৭৯ নং প্যারাগ্রাফে নির্দেশ দিয়েছেন যে “লিডিং জাজমেন্টের” নির্দেশাবলীর সাথে সাথেই জাতীয় নির্বাচন কমিশন কে স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে প্রাপ্য বন্ড কেনার তথ্যের সাথে প্রতিটি গ্রহীতা রাজনোইতিক দলের একাউন্টে বন্ড ভাঙিয়ে টাকা নেওয়ার তথ্য মিলিয়ে সামগ্রিক ভাবে এই লেনদেনের তথ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এ সত্ত্বেও রায়ের বিভিন্ন অংশ, শব্দবন্ধকে কাজে লাগিয়ে, তাদের চুলচেরা টেকনিকাল বিশ্লেষন করে এই correlation টা এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো হবে। সেই তথ্যটুকু পেলে এ দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বাণিজ্যিক সংস্থার ভূমিকা নিয়ে একটি দুর্দান্ত বিপজ্জনক অধ্যায় আরো পরিষ্কার ভাবে মানুষের সামনে আসবে। সেই তথ্য প্রকাশের দাবিতেও সংসদ এবং আদালতের ভেতরে এবং বাইরে বাম-গণতান্ত্রিক তথা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সংগ্রাম জারি রাখা প্রয়োজন।
কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে দুরাত্মার ছলের অভাব হয়না। এই রায়ের ফলে দেশের রাজনীতিতে বাণিজ্যিক পুঁজির তরফে রাজনৈতিক অনুদানের মারফৎ নিজেদের মুনাফার এজেন্ডা পূরণের চেষ্টা থেমে যাবে না। ফ্যাসিবাদী রাজনীতির অপরিমিত অর্থের নিয়মিত যোগান এবং হিংসা সৃষ্টি করে জনগনকে প্রতিমুহুর্তে সন্ত্রস্ত করে রাখার ক্ষমতার প্রয়োজন হয়। ইতিহসবিদ এডাম টুজ-এর লেখা “Wages of Destruction:The Making and Breaking of the Nazi Economy” তে ফ্যাসিবাদের এই বিপুল অর্থের নিয়মিত যোগানের প্রয়োজনীয়তা বিশদে ব্যখ্যা করা হয়েছে। ১৯৩৩-১৯৪৫ এর জার্মানিতে যে পদ্ধতিতে এই আদিম লুন্ঠন চালানো হয়েছিল ফ্যাসিস্ট নাৎসী দল এবং তাদের সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, তার হবহু প্রয়োগ যে একবিংশ শতকের ভারতে করা সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। সেই প্রচেষ্টা মূলতঃ চলবে সাধারণ মানুষকে সর্ব্বস্বান্ত করে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের আরো বাড় বৃদ্ধি ঘটিয়েই। কাজেই, এই নির্বাচনী বন্ড স্কীম বাতিল হলেও অন্য কোনো উপায়ে অন্য কোনো নামে এই চেষ্টা চলতেই থাকবে। বিশেষতঃ পুঁজিবাদ যতই সঙ্কটে পড়বে এই সব অপচেষ্টা আরো নগ্ন রূপ ধারণ করবে। সংবিধান প্রদত্ত অধিকারসমূহ প্রয়োগ করেই আদালতের ভেতরে এবং বাইরে শ্রমজীবি জনতার এর বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই-ও তাই জারি রাখতে হবে।