বাবিন ঘোষ
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কালে বিবিধ রাজনৈতিক/ সামাজিক দল/মঞ্চ বা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদের’ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিসান আন্দোলন, অ-ব্রাম্মহণ্য এবং দলিত জনজাতিসমূহের আন্দোলন, বামপন্থী রাজনীতি, খিলাফৎপন্থী, কংগ্রেসী জাতীয়তাবাদী, হিন্দু ও মুসলমান জাতীয়তাবাদী, উদারপন্থী, প্রায় প্রত্যেকটি পক্ষ থেকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞা নির্মাণ হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় থেকে ১৯৪৭ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন ও দেশভাগের সময়কাল অবধি। এই ব্যাখ্যাগুলি শুধুমাত্র একে অপরের থেকে ভিন্নতায় সীমাবদ্ধ না থেকে বহু সময়েই একে অন্যের বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে, যেমন খিলাফৎ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়ে ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময়কাল অবধি এই সকল দল/মঞ্চ বা গোষ্ঠী আশু রাজনৈতিক অর্জনের উদ্দেশ্যে একে অপরের সাথে স্বল্প বা নাতিদীর্ঘমেয়াদী ঐক্য গঠন করলেও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে এই ভিন্নতার অবসান ঘটেনি। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এই একাধিক এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৈরিতামূলক ব্যাখ্যা ও বোঝাপড়া শেষ পর্যন্ত সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অন্ততঃ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে একটি প্রায় নির্দিষ্ট সংজ্ঞা লাভ করে। জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি এবং তার “কোরোলারি” হিসাবেই “সাম্প্রদায়িকতা”র ও সংজ্ঞা একটি স্পষ্ট ধারণা পায় ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের মধ্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে, ভারতের সংবিধানকে ঐতিহাসিক একটি মাইলফলক হিসাবে মান্যতা দিতেই হবে জাতীয়তাবাদ, সম্প্রদায়বাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার যে কোনো আলোচনায়।
এই সংবিধানকে বস্তুবাদী ঐতিহাসিকতার নিরিখে দেখলে, ভারতে জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের যে ভিন্ন ভিন্ন ধারা বহমান ছিল, তার থেকে একটি উল্লম্ফন হিসাবে দেখা যেতে পারে পরিমাণগত এবং গুণগত, দুই ভাবেই। পরিমাণগতভাবে, দেশভাগের প্রেক্ষিতে ভারতের সংবিধান এ দেশের ইতিহাসে প্রথমবার কেন্দ্রীয় স্তরে মান্যতা দেয় “সংখ্যালঘু সম্প্রদায়” এবং তাদের সামাজিক ও আইনি রক্ষাকবচের। প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে সেই ১৮৫৭’র মহাবিদ্রোহের পরবর্তীতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে উদ্দেশ্যমূলক বিভাজন চালানো হয়েছিল প্রায় প্রতিটি সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে, তার পরিসমাপ্তিতে, আইনের চোখে সমতা (“ইক্যুয়ালিটি বিফোর ল”) এবং ধর্মীয় সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূর্ণ স্বাধীকারকে আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা (“ইক্যুয়াল প্রোটেকশন অফ ল”) প্রদান করে। জাতীয় ঐক্য এবং সহিষ্ণুতার যে আবেদন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রয়োজনে করা হয়েছিল, তা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণার মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায়। গুণগত স্তরে, এই সংবিধান উপমহাদেশের সুপ্রাচীন সভ্যতার যে চিরকালীন বহুত্ববাদী চরিত্র এবং সমনাগরিকত্বের যে ধারণা, তাকে স্বীকৃতি দেয়। সমনাগরিকত্বের এই স্বীকৃতি ব্রাম্মহণ্যবাদের বিপ্রতীপে অবশ্যই এক গুরুত্বপূর্ণ আইনি পদক্ষেপ। প্রাক-আর্য সময়কাল থেকেই গণরাজ্য[2] বা শাসন ব্যবস্থায় সাধারণের অংশগ্রহণের যে ইতিহাস উপমহাদেশে ছিল’, যা একেবারে তৃণমূল স্তরে সম্প্রদায়গত বা অঞ্চলগতভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বহমান ছিল’, তাকে স্বীকৃতি দিয়েই সার্বজনীন ভোটাধিকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর নির্মাণ ঘটে ভারতের সংবিধানের মধ্য দিয়ে। এ দেশের বিবিধ মহাকাব্যের বর্ণনায় বৈদিক যুগের যে সামাজিক ইতিহাসের কিছু প্রতিচ্ছবি যা পাওয়া যায়, তা থেকে স্পষ্ট হয় যে এই বিপুল মহাদেশের শাসন ব্যবস্থা এক এবং অভিন্ন কেন্দ্রিকতার মাধ্যমে চলেনি। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় পান্ডব এবং কৌরব, উভয় পক্ষই জয়লাভের উদ্দেশ্যে বিবিধ রাজ্যের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে কুরুক্ষেত্রের মহারণে অবতীর্ণ হয়। পরবর্তীতে অনুশাসন পর্বে দেখা যায় যে যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির রাজচক্রবর্তী (কেন্দ্রীয় স্তরে রাষ্ট্রশক্তির এক অভিন্ন চিহ্ন) হিসাবে মান্যতা পেলেও গান্ধার থেকে সৌরাষ্ট্র, মগধ, কোশল হয়ে কামরূপ অবধি একেকটি রাজ্য স্বায়ত্ত্ব শাসনেই থেকে যায়, তাদের নিজস্ব সামাজিক স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রেখেই। লিখিত ইতিহাসেও সেই মৌর্য শাসনকাল থেকেই উত্তরাবর্তে এবং দাক্ষিণাত্যেও একেকটি জনগোষ্ঠী বা রাজ্য কিছু সময়কাল কেন্দ্রীয় একটি রাজশক্তিকে মেনে নিলেও বেশির ভাগ সময়, নিজেদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক স্বকীয়তা বজায় রেখেই শাসন ব্যবস্থা চালিয়েছে। শৈব- শাক্ত হয়ে বৌদ্ধ আমল, শৈব পুনরুত্থান বা পরবর্তীতে সুলতানি বা মুঘল আমলেও এর খুব একটা ব্যাতিক্রম হয়নি। অন্যান্য একাধিক কারণের মধ্যে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন ব্যবস্থাও একটি অন্যতম কারণ, যার ফলে যে জাতি ভাবনা ও জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ভারতে ঘটে, সেই জাতীয়তাবাদের সাথে ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের (“নেশন স্টেট”) দর্শনের মৌলিক ফারাক রয়েছে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনে এই ধারা পালটিয়ে যায়। মূলতঃ ব্রিটিশ পুঁজিবাদের স্বার্থে ভারতের সম্পদ লুন্ঠনের যে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা করা হয়, তার আওতায় স্থানীয় স্বায়ত্ত্ব শাসনের এই সকল কাঠামো কে ধ্বংস করে একটি অভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা এক রকম চাপিয়ে দেওয়া হয় এ দেশের মানুষের উপর। উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রেল ও টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উন্মেষের সাথে সাথে এবং পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার আরো প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোগত উন্নতির ফলে এই কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা আরো গতি লাভ করে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানকালে ভারতের সংবিধান এই কেন্দ্রীকতার ভাবনা কে পুরোপুরি পরিহার করতে না পারলেও আঞ্চলিক স্বকীয়তাকে বেশ খানিকটা মান্যতা দিয়ে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পথ খুলে দেয় এবং সংবিধানের একদম প্রথম ধারাতেই ভারত রাষ্ট্রকে কে বিবিধ রাজ্যের একটি সম্মিলন হিসাবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ সংবিধান শুরুতেই মেনে নেয় যে রাজ্য থেকে কেন্দ্রের গঠন হয়েছে, তার উল্টোটা নয়। ভারতের এই বহুত্ববাদী ইতিহাসকে স্বীকৃতি জানিয়েই ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের প্রয়াসকে, সংখ্যালঘু ও জনজাতিসমূহের জন্য নির্দিষ্ট সাংবিধানিক রক্ষাকবচ কে বামপন্থীরা শুধুমাত্র সমর্থন জানিয়েই থেমে যায়নি, বরং রাস্তায় নেমে লড়াই করেছে বারংবার এই সকল সাংবিধানিক পরিকল্পনা কে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে। পর্তুগীজ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে গোয়ার সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রেই হোক, ভাষাভিত্তিক মহারাষ্ট্র রাজ্য গঠনের দাবিতে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র আন্দোলন হোক, কাশ্মীরি মানুষের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা শেখ আবদুল্লার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকার কে বরখাস্ত করে তাঁকে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখার বিরোধীতায় হোক কিংবা নেহরু-বিধান রায়দের কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বাংলা-বিহার সংযুক্তিকরণের সফল বিরোধীতা হোক, এই বহুত্ববাদী সংস্কৃতির রক্ষায় ও প্রসারে বামপন্থীরা সংসদের ভেতরে এবং বাইরে চিরকাল লড়ে গেছে। এই বাচিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, সংখ্যালঘু মত ও তার মতাবলম্বীদের ধর্মাচরণের অধিকার এবং, সার্বজনীন ভোটাধিকার মিলিয়েই আধুনিক সময়ের উপযোগী একটি রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামো যে নির্মাণ হয়, তা বামপন্থীরা এ দেশের ইতিহাসে একেবারে সংগঠিতভাবেই চর্চা করে চলেছে চিরকাল।
ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ১৯৭৬ এর আগে সংবিধানে নির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত ছিল না এবং ১৯৭৬ এ শুধুমাত্র প্রস্তাবনা অংশেই (“প্রিয়াম্বল’) লিপিবদ্ধ করা হয়। নব্য হিন্দুত্ববাদীরা এই তথ্যটিকে বারংবার আউড়ে যায় আজকাল এইটা বোঝানোর উদ্দেশ্যে, যে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা জরুরি অবস্থার সময় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি শব্দ মাত্র, যার না আছে সংবিধান প্রণয়নের ইতিহাসে কোনো স্থান আর না আছে কোনো গ্রহনযোগ্যতা এই দেশের সর্বসাধারণের কাছে। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ এর দেশভাগকে তারা রেফারেন্স হিসাবে চালিয়ে দিতে যায় ধর্মীয় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের মতাদর্শগত বুনিয়াদ হিসাবে। এই বক্তব্য ইতিহাসের বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের সংবিধানে বহু প্রকার দুর্বলতা চিহ্নিত করেও বামপন্থীরা অবশ্যই এ কথা স্বীকার করেন যে শ্রেণীগতভাবে উৎপাদক শ্রেণী সমূহের বিশেষ কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিলনা সংবিধান পরিষদে (একমাত্র নির্বাচিত বামপন্থী প্রতিনিধি দেশভাগের ফলস্বরূপ বাদ পড়ে যান সংবিধান পরিষদ থেকে)। কিন্তু সেই সংবিধানের মধ্যেই যে সকল প্রগতিশীল ভাবনা রয়েছে, সেই সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাতে হবে মেহনতি মানুষের স্বার্থে পরিচালিত বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রসারে এবং খেটে খাওয়া মানুষের স্বার্থেই সংবিধানের হাজারো দুর্বলতার মধ্যেও তার প্রগতিশীল সমস্ত অংশকে রক্ষা করতে হবে প্রতিক্রিয়ার আক্রমণের থেকে। এর বিপ্রতীপে সঙ্ঘ পরিবারের নেতৃত্বাধীন গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির সংবিধানের যাবতীয় প্রগতিশীল অংশকে বিকৃত ব্যাখ্যা করে পঙ্গু করে দিতে তৎপর। হিন্দুত্ববাদীদের তরফে ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত উপরোক্ত প্রচার এই রকমই ইতিহাস বিকৃতির এক প্রচেষ্টা।
হিন্দুত্ববাদীরা এ প্রসঙ্গে দুটি তথ্যকে চেপে দিতে চায়। একঃ হিন্দু মহাসভার (হিন্দুত্ববাদীদের তদানীন্তন রাজনৈতিক মঞ্চ) কোনো প্রতিনিধি সংবিধান পরিষদে সরাসরি নির্বাচিত না হওয়া সত্ত্বেও তাদের বেশ কিছু সদস্য এবং তিনজন প্রাক্তন সভাপতি সংবিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন কগ্রেসের টিকিটে নির্বাচিত হয়ে এবং কংগ্রেসের নিজেরই রক্ষণশীল অংশের থেকে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডনের মত নেতারা পরিষদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন যাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে হিন্দুত্ববাদীদের অনেক ক্ষেত্রেই মিল ছিল। দুইঃ সংবিধান পরিষদে যখন স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র নিয়ে বিশদে দিনের পর দিন আলোচনা চলেছে, এই সকল উপরোক্ত সদস্য (হিন্দু মহাসভার সদস্যরাই হ’ন কিংবা কংগ্রেসের রক্ষণশীল নেতৃত্ব) কেউ একবারের জন্যেও রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরোধীতা করেন নি। ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণার জন্য আজকের বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের অন্যান্য বহু নেতার যে ঔৎসুক্য দেখা যাচ্ছে, তাদের পূর্বসূরীরা সংবিধান পরিষদের কোনো একটি বৈঠকেও এ প্রসঙ্গে একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। অতএব, সংবিধান নির্মাণের একদম সূচনাপর্ব থেকেই স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা যে ধর্মনিরপেক্ষ হবে, তা সর্বসম্মতিক্রমেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, যদিও ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধরন টা ঠিক কী রকম হবে, তা নিয়ে সংবিধান পরিষদে যথেষ্ট বিতর্ক চলে তিন বছর ধরে।
এই সিদ্ধান্তের পিছনে দুটি বড় কারণ ছিল’। একঃ ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি দেশভাগের যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যে বিষবৎ পরিণতি লাভ করে, তার পুনরাবির্ভাব সংবিধান পরিষদের সকল সদস্যই এড়াতে চেয়েছিলেন, সে উদারপন্থী হোক বা রক্ষণশীল। এই কারণে কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রগঠনের দাবি যে আরেক প্রস্থ দুর্গতির সূচনা করবে জাতীয় জীবনে, সে বিষয়ে সংবিধান প্রণেতারা ওয়াকিবহাল ছিলেন। দুইঃ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে কোনো রকমের ধর্মীয় বিশ্বাসের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা খাপ খায় না, এই বিষয়ে কংগ্রেসের তদানীন্তন ক্ষমতাশালী অংশের (মূলতঃ নেহরুর নেতৃত্বে) স্পষ্ট মত ছিল। তদুপরি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাসঞ্জাত জাতীয়তাবাদ সদ্য সমাপ্ত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসাবে কাজ করেছিল এবং যুদ্ধের শেষে সোভিয়েত রাশিয়ার মহাশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ এবং উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিঃশর্ত সমর্থনের কারণেও কংগ্রেসের রক্ষণশীল অংশ এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যরাও ধর্মীয় জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের পক্ষে সওয়াল করা থেকে বিরত থেকেছিলেন’।
সংবিধান নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার ঠিক আগের একটি দশক জুড়ে একের পর এক উপনিবেশবাদ বিরোধী গণ আন্দোলন ভারতবর্ষে গ’ড়ে ওঠে যা কোনো একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে বাংলার বিপ্লবীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে মহারাষ্ট্রে ও তদানীন্তন পাঞ্জাব প্রদেশে। এই বিপ্লবীদের একটা গুরুতপূর্ণ অংশ পরবর্তীকালে বামপন্থী রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি তথা বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব হয়ে ওঠেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক সশস্ত্র যুব অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক প্রশাসন লক্ষ্য করে যে উত্তোরোত্তর অহিন্দু যুব সম্প্রদায় এবং নারীরাও আকৃষ্ট হচ্ছে এই সশস্ত্র আন্দোলনের প্রতি। চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের আশ্রয়দাতা হিসাবে পরবর্তীকালে পুলিশের তদন্তে যাদের নাম উঠে আসে, তাঁদের একটা বৃহদংশ দরিদ্র মুসলমান কৃষক এবং সুর্মা উপত্যকার চা বাগিচার শ্রমিক ছিলেন। ১৯৩৬ সালে সারা ভারত কিসান সভার প্রতিষ্ঠা হয় এবং ক্রমবর্ধমান কিসান আন্দোলনেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কৃষক সমাজের অংশগ্রহণ দেখা যায়। এই ক্রমবর্ধমান জঙ্গী মেজাজ এবং হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ আন্দলনে সন্ত্রস্ত ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫ এর ভারত সরকার আইন, ১৯৩৭ এর প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচন, ইত্যাদি সংস্কার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়’ আন্দোলনেও হিন্দু মুসলমানের ঐক্য এবং ১৯৪৬ এর দাঙ্গার আবহেই নৌ সেনার বিদ্রোহ এবং তার প্রেক্ষিতে মূলতঃ কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে রশিদ আলি দিবসের আন্দোলনে অভূতপূর্ব হিন্দু মুসলমান ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে এক দিকে তেলেঙ্গানার সশস্ত্র কৃষক আন্দোলন অন্য দিকে তেভাগার বীরত্বপূর্ণ লড়াই সংগঠিত হতে থাকে, যা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে শাসক শ্রেণীর কাছে বিপদলক্ষণ হিসাবে দেখা দেয়। ভারত সরকারের তদানীন্তন হোম-পলিটিকাল ডিপার্ট্মেন্টের একের পর এক রিপোর্টে এই বিবরণ লেখা হতে থাকে যে গণ আন্দোলনের ক্ষেত্রে “ক্রমবর্ধমান বলশেভিক প্রভাব” পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই রকম একটা অত্যন্ত ঘটনাবহুল দশকের অতিক্রান্তে, যে দশকে একই সাথে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে জঙ্গী গণ আন্দোলন, দুই ঘটে চলে ভারতবর্ষে; সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত এবং জাতিবিদ্বেষী বীভৎসার বিরুদ্ধে সোভিয়েত শক্তির চোখ ধাঁধানো জয় ঘটে, সেই দশকের শেষে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সংবিধানের গণপরিষদের সদস্যদের পক্ষে খুব বেশি দক্ষিণপন্থী অবস্থান গ্রহণ কঠিন ছিল। অতএব, সংবিধান পরিষদের কার্যাবলীর লিখিত বিবরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ হঠাৎ করে ১৯৭৬ এ বসিয়ে দেওয়া কোনো শব্দবন্ধ নয় এবং সংবিধান প্রণয়নের সময় থেকেই তদানীন্তন রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগঠন ব্যাতিরেকে ভারতের মতন বিরাট এবং সামাজিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে উপায়ন্তর ছিল না।
ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বহুত্ববাদের এই ঐতিহাসিক এবং সাংবিধানিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে বামপন্থীরা বদ্ধপরিকর থেকেছে চিরকাল, কারণ সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকলে শ্রেণীর লড়াই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই এই কারণেই কিসান আন্দোলন বা শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রবেশের বিরুদ্ধে থেকেছেন বামপন্থী সংগঠকেরা। আর্য সমাজের সংগঠন থেকে উঠে আসা স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী কিসান সভার প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হ’ন আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সমর্থক বাল গঙ্গাধর তিলকের উপনিবেশবাদ বিরোধী অনমনীয় মনভাব এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব থাকার কারণে তাঁকে সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নেতৃত্বে মেনে নিতেও বামপন্থীরা পিছিয়ে আসেন নি। বাংলায় জমিদারি বিরোধী জঙ্গী তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল হাজি মহম্মদ দানেশ কিংবা প্রাক্তন খিলাফতি মহম্মদ আব্দুল্লাহ রসুল কে রেখেই দুর্বার শ্রেণী আন্দোলন সংগঠিত হয়। ৪৬ এর ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার সময়েও লক্ষ্য করা যায় যে কিসান সভার প্রভাব রয়েছে এমন সব অঞ্চলে দাঙ্গা ঘটতে পারেনি বা ছড়াতে পারেনি।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভারতে বামপন্থীদের ভূমিকা বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষেই থেকেছে চিরকাল। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে মূলতঃ হিন্দু উদবাস্তুদের যে স্রোত এসে পৌছয় পশ্চিম বাংলায়, তা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এবং হিন্দু মহাসভার সঙ্কীর্ণ রাজনীতির পক্ষে এক উর্বর জমি তৈরি করেছিল। কিন্তু বামপন্থীদের উদ্যোগেই সেই জনগোষ্ঠীকে শ্রেণী আন্দোলনের পথে পরিচালিত করা সম্ভব হয়, যার ফলশ্রুতিতে উদবাস্তু আন্দোলন এক ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭১ এ পশ্চিম পাকিস্থানের সামরিক শাসকদের তরফে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যে অকথ্য অত্যাচার শুরু করা হয়, সেই সময়েও উদবাস্তুদের পক্ষ নিয়ে, নৃপেন চক্রবর্তী ও জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সবার আগে বামপন্থীরাই আন্তর্জাতিক সীমানা খুলে দিয়ে উদবাস্তু শিবির নির্মাণের দাবি তোলে। মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানিয়ে সিপিআইএমের তরফে চিকিৎসকদের দল অবধি পাঠানো হয় বাংলাদেশে। আশির দশকের মধ্যভাগে শাহ বানো মামলা এবং সেই মামলার রায় কে এক প্রকার নাকচ করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত আইন প্রণয়নের প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিরোধিতায় কোনো স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক ফায়দার কথা না ভেবেই স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করে বামপন্থীরা। ত্রিপুরায় আদিবাসীদের রাজনৈতিক সামাজিক দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, দেশ জুড়ে আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির বুনিয়াদি দাবির পক্ষে কেন্দ্রীয় স্তরে আইন পাশ করানো হ’ক, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়ে রাস্তায় নেমে জাতিদাঙ্গা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে হোক বা এই সময়কালের এনআরসি-সিএএ বিরোধী আন্দোলন হোক, দিল্লীর দাঙ্গা বা বিলকিস বানোর গণধর্ষন মামলায় অপরাধীদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমাপ্রদর্শনের বিরোধীতা হোক, জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের দৃঢ় অবস্থান থেকেছে স্বাধীন ভারতে। মূলতঃ বৃহৎ বুর্জোয়া- ভূস্বামীদের দ্বারা প্রণীত ভারতের সংবিধানের প্রতিটি প্রগতিশীল অংশের রক্ষার লড়াইয়ে বামপন্থীরাই এ দেশে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছে, যেখানে বৃহৎ বুর্জোয়া ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ হেনেছে সংবিধানের উপর। অতি সম্প্রতি জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে যে উন্মাদনার সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার, তার বিরুদ্ধেও ১৯৯১ সালের উপাসনার স্থানসমূহ সংক্রান্ত আইনের যথাযথ প্রয়োগের দাবি রেখে বারাণসী জেলা আদালতের রায়ের স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে বামপন্থীরা।
বহুত্ববাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বামপন্থীদের ট্র্যাক রেকর্ড আজও অমলিন রয়ে গেছে।।
Tejani, Shabnum, “Indian Secularism: A Social and Intellectual History, 1890-1950”, Orient Blackswan (2010), pp. 234-250.
রাহুল সাংকৃত্যায়ন, ‘জয় যৌধেয়’ দ্রষ্টব্য।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন, ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ দ্রষ্টব্য
Article 1. (1) India, that is Bharat, shall be a Union of States.
Constituent Assembly Debates, Vol. VII, proceedings from 8th November, 1948- 24th November, 1948.
Shiva Rao, B., The Framing of India’s Constitution: Select Documents, Vol, IV (1968), Government of India Press, Nasik.
Silvestri, Michael, Policing ‘Bengali Terrorism’ in India and the World Imperial Intelligence and Revolutionary Nationalism, 1905-1939, Palgrave Macmillan (2019)
সারা ভারত কিসান সভার ইতিহাস, হরকিসেন সিং সুরজিৎ