Site icon CPI(M)

Reclaiming The Concept Of The Nation: The Raison D’être

Corporate -Hindutwa Alliance

কর্পোরেট হিন্দুত্ব আঁতাত বনাম ভারতের কৃষকসমাজ

প্রভাত পট্টনায়েক

মূল প্রবন্ধটি ১৩ই জানুয়ারি ,২০২১ তারিখে ইংরেজিতে দ্য কর্পোরেট – হিন্দুত্ব অ্যালায়েন্স অ্যান্ড দ্য পিজ্যান্টস শিরোনামে দ্য টেলিগ্রাফ অনলাইনে প্রকাশিত হয়, সেই প্রবন্ধেরই বাংলা অনুবাদ রাজ্য ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশিত হল।

আমরা এক উৎকট পরিস্থিতির মধ্যে বেঁচে রয়েছি। পৃথিবীজূড়ে একদিকে মানুষ গণবণ্টন ব্যবস্থাকে পুনঃস্থাপনের দাবী করছেন আরেকদিকে কিছু ফাটকা লাভের আশায় বুঁদ হয়ে উৎপাদকেরা ক্রমশ অর্থকরী ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এই দ্বন্দ্বের মধ্যস্ততা করতে হচ্ছে বিভিন্ন সরকারকে। কিন্তু আমাদের দেশ ভারতে এরকম কোন পরিস্থিতির চাপ নেই – এখানে কৃষকেরা খাদ্যশস্য ফসলের চাষেই যথেষ্ট উৎসাহী, জনগণের দাবীও গণবণ্টন সম্পর্কে অনুরূপ। জনগণ এবং কৃষকদের মধ্যে এমন কোন স্বার্থের সংঘাত ভারতে নেই যা সরকারকে মাঝখানে থেকে সমাধান করতে হয়। অথচ এমন পরিস্থিতি সত্বেও খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল চাষে ভারত সরকার কৃষকদের বাধ্য করছে, এর ফলে গণবণ্টন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে।

সরকারের পক্ষ থেকে এধরনের চাপ দেওয়াতেই কৃষিআইনের প্রকৃত উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হয়ে যায়। খাদ্যশস্যের বদলে অর্থকরী ফসল উৎপাদনে লাভ কত বেশী তা বোঝানোর দায় নিয়েছেন সরকারী অর্থনীতিবিদেরা। ভারতে সরকারকে জনসাধারণের মধ্যেকার কোন দ্বন্দ্বের সমাধান করতে হচ্ছে না, বরং বলা যায় সরকারের নিজস্ব স্বার্থ চরিতার্থ করতেই তারা জনগণের উপরে চাপ প্রয়োগ করছেন। এই চাপের বিরুদ্ধেই দিল্লীর প্রবল শীত উপেক্ষা করে কৃষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন। ভারতের পরিস্থিতি আরও উৎকট কারন এখানে জনগণের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত নেই, রয়েছে সরকার বনাম জনসাধারনের দ্বন্দ্ব।

কৃষকেরা চুক্তিচাষের বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং চুক্তিচাষ বাতিলের দাবী জানিয়েছেন। নয়া কৃষি আইনসমুহকে বাহ্যত কৃষকদের স্বার্থবাহী হিসাবে তুলে ধরে সরকার কৃষকদের চুক্তিচাষের দিকেই ঠেলে দিতে চাইছে। আরও একবার মনে রাখতে হবে জনগণের কোন একটি অংশের দাবিতে সম্মতি জানিয়ে সরকার এমন করছে না, বরং সরকার নিজের স্বার্থকেই জনগণের উপরে চাপিয়ে দিতে চাইছে।

এমন কাজের পিছনে সরকারের কি এমন স্বার্থ রয়েছে? কর্পোরেট এবং কৃষিপণ্য বিপণনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির স্বার্থের সাথে সরকারের স্বার্থ মিলে যাচ্ছে একথা এখন স্পষ্ট, যদিও সরকার নিজের পক্ষে যুক্তি হাজির করে ঘোষণা করেছে তারা দেশের স্বার্থেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসলে এভাবেই কর্পোরেটদের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের সাথে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই মিলিয়ে দেওয়াই হল মোদী সরকারের আগমার্কা কাজ। এই মিলিয়ে দেবার উদ্দেশ্যই কর্পোরেট শক্তি এবং হিন্দুত্ববাদের মধ্যেকার আঁতাত – মোদীর আসল কৃতিত্ব এটাই যার জোরে তিনি নিজেকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

পরিস্থিতির উৎকটতাকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারেঃ বিভিন্ন সময়ে দক্ষিনপন্থী সরকারগুলির তরফে কর্পোরেটদের স্বার্থবাহী নীতিসমূহের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে দেশের জনগণের অন্তত একটি ছোট অংশের স্বার্থরক্ষার অজুহাত দেওয়া হত। ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে আক্রমনের যুগে মার্গারেট থ্যাচারের কাজকর্মকে দেশে মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা নিবারণ এবং বৃহত্তর জনসাধারনের অসুবিধার অজুহাতে ন্যায্য বলা হত। কিন্তু ভারতে জনসাধারনের কোন অংশের কোনোরকম দাবী না থাকা সত্বেও সরকার একের পর এক ভিত্তিহীন এবং একচোখা সিদ্ধান্ত চপাইয়ে চলেছে। এই কায়দাতেই দেশের জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে গণবণ্টন ব্যবস্থাকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এসবকিছুই করা হচ্ছে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষায়। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যাবস্থায় এমন ঘটনা অভুতপূর্ব।

২০১৯-এর নির্বাচনে জনগণের সমর্থন আদায় হবার দোহাই দিয়ে পছন্দসই ‘সংস্কার’ প্রণয়নের দাবী সরকার করতেই পারে। কিন্তু এমন দাবী বহুক্ষেত্রেই বস্তুত ভ্রান্ত। প্রথমত এমন কিছু করা নীতিগত দিক থেকে সমীচীন নয় – একটা নির্বাচনে জিতে যাবার অর্থ এটা নয় যে সরকার যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। দ্বিতিয়ত, এধরনের দাবী আরও বেশী অকেজো এই কারনেই যে ২০১৯ সালের নির্বাচন কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারের দাবীতে তারা জিতে আসেনি। আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় এমন কোন সংস্কারের কথা নির্বাচনপর্বে তারা উচ্চারণটুকুও করেনি, পুলওয়ামা এবং বালাকোটে বিমানহানাই ছিল প্রধান ইস্যু। তৃতীয়ত এদের হাতে পড়ে রাজনীতির এমন মাত্রায় পণ্যায়ন হয়েছে যার ফলে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার আর কোনো তাৎপর্যই নেই।

এখন নির্বাচনী লড়াই যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ। বিপক্ষের লোক ভাঙ্গিয়ে এনে নির্বাচনে লড়াই করা আজকাল খুবই সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেই কাজে খরচও হয় অনেক। ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, ক্ষমতায় আসীন হতে যথাযথ মূল্য ধরে দিয়ে অন্য দল থেকে কাউকে ভাঙ্গিয়ে আনার কাজ এখন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে পরিনত হয়েছে। এই কারণেই যে রাজনৈতিক দল অন্যদের তুলনায় অধিক আর্থিক সংগতিপূর্ণ, ক্ষমতা দখলের লড়াইতে তারাই অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকছে। কর্পোরেটদের হাতে লক্ষ্মীর ভাঁড়ার থাকায় নির্বাচনী যুদ্ধজয়ে আর্থিক সাহায্যের জন্য তাদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা আবশ্যিক যার বিনিময়ে কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষা করার দায়টুকুও স্বীকার করতে হয়। পণ্যায়িত রাজনীতির যুগে কর্পোরেটদের থেকে পাওয়া অর্থের যথাযথ যোগানের জোরে একটি সাম্প্রদায়িক বিভাজনকামী রাজনৈতিক শক্তি গোটা ব্যাবস্থার উপরে সহজেই কর্তৃত্ব কায়েম করতে পারে। কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া আসলে আর্থিক যোগানের বিনিময়ে সরকারের কর্মসূচী।

কর্পোরেটরা এহেন গাঁটছড়া থেকে ভালই সুবিধা আদায় করেছে – কিন্তু তাদের মধ্যেও একটি অংশ, বলা চলে ভুঁইফোড় কর্পোরেটরা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশী গুছিয়ে নিতে পেরেছে। ফ্যসিজম অ্যান্ড বিগ বিজনেস বইতে ড্যানিয়েল গুয়েরিন লিখেছেন ১৯৩০ সাল নাগাদ জার্মানিতে নাৎসিদের সাথে নিজেদের সম্পর্কের জোরে টেক্সটাইল এবং অন্যান্য পণ্যোৎপাদনকারী সাবেক কর্পোরেটদের তুলনায় যুদ্ধাস্ত্র এবং উৎপাদনশিল্পে প্রয়োজন হয় এমন যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কর্পোরেটরা অনেক বেশী লাভবান হয়েছিল। জাপানেও ১৯৩১ নাগাদ যে ফ্যসিস্তধাঁচের সরকার ক্ষমতাসীন হয় তাদের সাথে সুসম্পর্কের জেরে মিৎস্যুই এর মতো সাবেকি ব্যবসায়ি প্রতিষ্ঠানকে পিছনে ফেলে অনেকটাই উপরে উঠে এসেছিল শিনকো জাইবাৎস্যু’র আনকোরা প্রতিষ্ঠান। যদিও আজকের ভারতের পরিস্থিতি ১৯৩০-এর সময়কার জার্মানি কিংবা জাপানের তুলনায় অনেকটাই আলাদা হলেও ভারতীয় কর্পোরেটদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে একই কায়দায় সরকারের তরফে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেবার ঘটনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভারতে কৃষকরা এতেই সবেচেয়ে বেশী ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

কর্পোরেটদের স্বার্থ বা আরও নির্দিষ্ট করে বলা চলে উপরোক্ত ভুঁইফোড় কর্পোরেটদের স্বার্থসমূহ চিহ্নিত মোদী জাতীয় স্বার্থের অজুহাতে এদের ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন তার আমলে প্রভূত ব্যাক্তিগত সম্পদ জাতীয় সম্পদ হিসাবে ব্যাবহৃত হয়েছে, এবং সেই যুক্তিতেই সম্পদ সৃষ্টিকারী এই বিশেষ অংশের স্বার্থরক্ষা করা সরকারের অগ্রাধিকার। এজন্যেই এইসব ভুঁইফোড় কর্পোরেটদের যাবতীয় দাবির সামনে দেশের জনগণের মাথা পেতে দেওয়া উচিত কারন এদেরই সম্পদে সকলের সংস্থান হচ্ছে।

একসময় দেশ বা নেশনের অস্তিত্বকে দেশের জনগণের সাথে সম্পৃক্ত ধরা হত, মোদী সরকার সেই সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দেশকে কতিপয় ভুঁইফোড় কর্পোরেটদের সাথে একাকার করে দিয়েছে। নয়া কৃষি আইনসমূহ সেই বদলেরই বার্তাবাহক।

এমন নীতি আসলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সপ্তদশ শতাব্দির ইউরোপে ওয়েস্টফেলিয়ান শান্তি চুক্তির ফলে যে রাষ্ট্রের ধারণা গড়ে ওঠে তা ছিল মূলত সাম্রাজ্যবাদী। সেই ধারণায় জনগণের অবস্থান নির্ধারিত ছিল কেবলমাত্র দেশের জন্য আত্মত্যাগের আহ্বানে সীমাবদ্ধ। এর বিপরীতে ভারতের মতো দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যে রাষ্ট্রদর্শন গড়ে ওঠে তা স্বজাতির ধারণা প্রসূত – অর্থাৎ মানুষের আত্মীয়তার ধারণায় সম্পৃক্ত। এই ধারণায় দেশের চরিত্রে সবার জন্য অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা প্রোথিত। এমন রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই হল জনগণের কল্যানে ক্রমোন্নতি সাধন। মোদী সরকারের আমলে রাষ্ট্রের অভিধা এমন ধারনার একেবারেই উল্টো, বরং তারা ক্রমশই ইউরোপীয় ধাঁচের সেই রাষ্ট্র কাঠামোর দিকে সরে যাচ্ছে যার শেষ পরিণতি ছিল ফ্যসিবাদ।

মোদী সরকারের এমন বিশ্ববীক্ষার প্রতি একশো আশি ডিগ্রি বিরোধিতা জানাতে দিল্লী সীমান্তে জড় হয়েছেন। হিন্দু, মুসলমান, শিখ সম্প্রদায়ের কৃষকেরা একে অন্যের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে তুলে ধরেছেন। কর্পোরেটদের হাতে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দেবার বিরোধিতা করে আসলে তারা আমাদের দেশকে কর্পোরেটদের সাথে একাকার করে দেখাবার যে রাজনীতি, তারই বিরোধিতা করছেন। গণবণ্টন ব্যাবস্থা চালু রাখার পক্ষে দাঁড়িয়ে আসলে তারা রাষ্ট্রকে দেশের জনগণের কল্যানে নিজের পূর্বঘোষিত ভূমিকার পুনঃস্মরণ করাচ্ছেন। রাষ্ট্রের যে ধারণাকে আজ মোদী সরকার ধ্বংস করে দিতে চাইছে কৃষকেরা আসলে সেই জনকল্যানকারী রাষ্ট্রের ধারনাকেই পুনর্নির্মাণ করছেন।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word