Site icon CPI(M)

Philosophy, Science and Politics in Ancient India: A Discussion (Part III)

Science and Philosophy Cover (3)

প্রাককথন

আগের দুটি পর্বে আমরা বিজ্ঞান দর্শন ও ভারতে জ্ঞানচর্চার অতীত ইতিহাসের সাধারণ প্রবণতা সম্পর্কে বুনিয়াদী কিছু আলোচনা করেছি। ইতিহাসবোধের প্রকৃত অর্থ ঐতিহাসিক শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে সামনে এগোনো। আজকের ভারতে যে কায়দায় অতীত ভারতের চর্চা চলছে তার উদ্দেশ্য ইতিহাসের চর্চা নয়, কিছু মনগড়া ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করে একটি সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে জনমানসে চাপিয়ে দেওয়াই এর রাজনৈতিক কর্মসূচি। ইতিহাসকে নতুন করে নির্মাণের নামে এই অপচেষ্টা আসলে আজকের সমস্যার প্রেক্ষিতে পশ্চাদপদ সামাজিক কাঠামোকে সমাধান হিসাবে তুলে ধরতে চাওয়া বৈ আর কিছুই নয়। শেষ বিচারে এদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে লগ্নী পুঁজির সহায়তা চেয়েছে, কর্পোরেট পুঁজি সেই সহায়তা যোগানোর বিনিময়ে লুঠের শাসন কায়েম করতে চাইছে। সেই আঁতাতের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হয়- একদিকে কর্পোরেট ধনতন্ত্র আরেকদিকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি। নিজেদের দেশের ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ চর্চাকে বাদ রেখে একাজে এগোনো যাবে না। আজকের প্রসঙ্গ বৈদিক সাহিত্যের পর্যালোচনা।  

জ্ঞানচর্চার বস্তুগত বাধ্যবাধকতা ও ঐতিহাসিক বিকাশকে কিভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয় তাকে সহজে, সকলের সামনে তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য।

প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে।

মোট ছয় পর্বের আলোচনা।

আজ তৃতীয় পর্ব।

শ্যামাশীষ ঘোষ

পর্ব ৩

আরো পূর্বের সময়ের সিন্ধু সভ্যতার লিপিগুলির পাঠোদ্ধার না-হওয়া পর্যন্ত প্রাচীন ভারতকে জানার প্রাথমিক উৎস হিসাবে বেদকেই মেনে নিতে হবে – ঋগ্বেদ থেকে শুরু হয়ে, যজুর্বেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ – এবং বেদের সাথে যুক্ত আরণ্যক (আচার পালন), ব্রাহ্মণ (আচারগুলি সংক্রান্ত মতামত), সংহিতা (প্রার্থনা, মন্ত্র) এবং উপনিষদ (দার্শনিক বক্তব্য ও আলোচনা)। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত এই ছশো বছর মুখ্যত বেদ রচনাকাল – বৈদিক যুগ। এর পরে, উপনিষদ। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে উপনিষদের পর্বে এসেই আমরা দার্শনিক চিন্তাধারার মুখোমুখি হতে পারি।

সাধারণভাবে আমরা মনে করি বেদের যুগের মানুষ বেদে বিশ্বাসী ছিলেন। বৈদিক আর্যরা যখন ভারতবর্ষে আসেন, সচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা, দীর্ঘপরমায়ু – এই সব সুনিশ্চিত করার কোনও উপায় তাদের জানা ছিল না – তাই যজ্ঞ। আর ছিল জাদুবিদ্যা – যজ্ঞের সঙ্গে এর উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। যজ্ঞে দেবতাদের অনুরোধ করা হয় প্রার্থীর মনস্কামনা পূরণ করার জন্যে, আর জাদুবিদ্যায় সরাসরি কোনও অতিলৌকিক শক্তির দ্বারস্থ হয়ে ওই প্রার্থনাগুলিই পেশ করা হয়। নিশ্চিত ফল না-মিললেও, নিরুপায় মানুষকে ইষ্টসাধনের জন্যে কিছু-না-কিছু চেষ্টা করতেই হত।

পশুচারী জীবনে যজ্ঞ ছিল সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান। কৃষিজীবী সুস্থিত জীবনে সমৃদ্ধি বাড়ার সাথে সমস্যাও বাড়ল। বিশ্বাস ছিল যজ্ঞে হব্য ও স্তব দিয়ে দেবতাদের খুশি করতে পারলে ইপ্সিত ফল পাওয়া যাবে। সাধারণভাবে যথাকালে ফসল ফলত, অকস্মাৎ রোগব্যাধি না হলে মানুষ দীর্ঘজীবীই হতেন, শক্তিতে ও অস্ত্ৰে উৎকর্ষ থাকলে শত্রুজয়ও সম্ভব হত – তা যজ্ঞ করা হোক বা না-হোক। মানুষ ছিল এমনই অসহায় যে, মনে এ ধরনের আশ্বাস না থাকলে সে বেঁচে থাকতেই পারত না।

আরও একটি বিমূর্ত বিশ্বাস ছিল: এ বিশ্বচরাচর নিয়ন্ত্রণ করছে একটি অমোঘ শুভশক্তি – দিনরাত্রি বা ঋতুগুলির নিয়মিত পর্যায়ক্রম এই শক্তিরই প্রকাশ। এই বিশ্বাসগুলিই ছিল সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। এভাবেই ধর্মবিশ্বাস একধরণের সংহতি আনে। মানুষকে বিশ্বাস করানো হয় যে, এটিই বিশ্বের অন্তর্গত এক নৈতিক ভিত্তি এবং মানুষ সেই ভাবে প্রকৃতির অনুসরণ করলে সমাজ চলতে পারে নিয়ম মেনে, এতেই মানুষের মঙ্গল।

কিন্তু প্রকৃতি বারবার নিজেই নিজের নিয়ম ভাঙে; মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি যায় টলে। মানুষ দেখে প্রকৃতি, জীবন, সমাজ যেমন ভাবে চলার কথা, তেমন ভাবে চলছে না। সাধারণ বুদ্ধিতে জীবনের জটিলতার কোনও ব্যাখ্যা মিলছে না। আকাঙ্খিত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার জন্যে সে কল্পনা করে দেবতার – নিজেরই শক্তিমত্তার এক প্রতিরূপ। পরে এই দেবতারাই রাষ্ট্রশক্তির নিয়ন্ত্রক রূপকে প্রতিভাত হল – এ রূপক হল রাষ্ট্র পরিচালক ও ন্যায়াধীশের।

যজ্ঞের উপকারিতা, দেবতাদের স্বরূপ, দেবতাদের পছন্দ, সৃষ্টির রহস্য, ইহলোক এবং পরলোক, মৃত্যুর পরে মানুষ ঠিক কোথায় যায়, কীভাবে যায়, সেখানে তাদের কী হয়, ইত্যাদি নানা ধরণের সংশয়, প্রশ্ন মানুষকে আলোড়িত করেছে। এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেল দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস অথবা অবিশ্বাস। অনুচ্চারিত যে-প্রশ্নটি এর অন্তরালে ছিল: কোথাও তাঁরা সত্যিই আছেন তো? ন্যায়শাস্ত্ৰে প্রথম প্রমাণ হল প্রত্যক্ষ, ইন্দ্ৰিয় দিয়ে জানা। কেউ সত্যিই ইন্দ্রকে কোনওদিন দেখেনি। আরও সংশয়: এই বিশ্বচরাচর কে সৃষ্টি করেছেন? গভীর সংশয় দেখা দেয়: দেবতারা যদি মঙ্গলময় ও মানবহিতৈষী হন, বিশ্বসংসার নিয়ন্ত্রণ করেন, তবে মানুষকে পীড়া দেয় এমন শক্তিকে তাঁরা এ সংসারে প্রবেশ করতে দিলেন কেন? এই বিরোধ টান দেয় আস্তিক্যের মর্মমূলে।

মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের কেন্দ্ৰে মৃত্যু। মৃত্যুই একমাত্র যা চূড়ান্ত। কাজেই মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে সংশয় অমোঘ। তখনকার সমাজ এই সংশয়কে ভাষায় উচ্চারণ করেছে এবং ঋষিরা সে-উচ্চারণকে বেদের মধ্যে সংরক্ষণও করেছেন। আজও এ সংশয়ের কোনও সমাধান মেলেনি, এইখানে দাঁড়িয়ে আজকের মানুষ একই রকম অসহায় বোধ করেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বলছেন: ‘যে সমাজে দেবতাদের ওপরে বিশ্বাসের ভিত্তিতেই তখনকার একমাত্র ধর্মানুষ্ঠান – যজ্ঞ – আচরিত হত, সে-সমাজের সাহিত্যে সেই দেবতাদের অস্তিত্ব, সর্বজ্ঞাত্ব, মঙ্গলময়ত্ব, সর্বশক্তিমত্তা ও মানবহিতৈষীতা এবং যজ্ঞের প্রণালী ও তার উপযোগিতা নিয়ে যদিও বা কারও কারও মনে প্রশ্ন উঠেও থাকে, তবু সে সব প্রশ্ন ধর্মগ্রন্থে সংরক্ষিত হল কেন? এ সব প্রশ্ন তো সমকালীন ধর্মাচরণের মূলে আঘাত করছে, এগুলো তো অগ্রাহ্য করে বিলোপ করাই হত সমাজস্বার্থের অনুকুল। সম্ভবত, সংশয়-সূচক সূক্ত বা অংশগুলির রচয়িতা বলে যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁদের বাইরেও সমাজের বৃহৎ একটি অংশের মধ্যেও এ-জাতীয় সংশয় পরিব্যাপ্ত ছিল। যাঁদের নামে সংশয়সূচক অংশগুলি শাস্ত্ৰে বিধৃত হয়ে আছে তাঁরা তখনকার সমাজে এতটাই সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন যে, তাঁদের রচনা, তাঁদের সংশয় ও প্রশ্ন অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল না। এর মধ্যে এক ধরনের মৌলিক সত্যনিষ্ঠার প্রমাণ আছে: মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত এত স্তব যদি স্মৃতিতে ধারণ করে রাখা, তাহলে সেই সময়েরই মানুষের সংশয়ের প্রকাশই বা কেন থাকবে না? ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদে এই সংরক্ষণ প্রাচীন মনস্বীদের উদারতার একটি নজির, এবং এর উত্তরাধিকারী হিসাবে আমাদের একটা গর্বের বিষয়’।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতবর্ষে কতকগুলি বড় বড় পরিবর্তন দেখা দেয় – লোহার ব্যবহারে বিস্তৃততর জমি চাষ করা সম্ভব হল, ফসলে উদ্ধৃত্ত দেখা দিল। এই উদ্ধৃত্ত সঞ্চিত হল অল্প কিছু ধনীর হাতে – লোক খাটিয়ে জমিতে ফসল উৎপাদন এবং কুটিরশিল্পজাত বস্তু নির্মাণ করিয়ে, বাণিজ্যের মাধ্যমে। অধিকাংশ মানুষই খুবই গরিব, জমিতে বা শিল্পের কারখানায় পরিশ্রম করতেন। সমাজ স্পষ্টত দুটি শ্রেণিতে ভাগ হয়ে গেল ধনী ও দরিদ্র। যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান বাড়তে লাগলো। সম্পূর্ণ পরোপজীবী পুরোহিত শাস্ত্রকার শ্রেণির উদ্ভব হল – সমাজে এঁদের প্রতিপত্তি সর্বোচ্চ। বিভাজন দেখা দিল কায়িক শ্রম ও মানসিক শ্রমের তারতম্যে। কায়িক শ্রম থেকে ছুটি পাওয়া এই পুরোহিতশ্রেণি শাস্ত্র নিৰ্মাণ এবং বহু প্রকারের দীর্ঘস্থায়ী জটিল প্রকরণের বহু যজ্ঞ উদ্ভাবন ও অনুষ্ঠান করতে লাগলেন; কায়িক শ্রমকে দেখা হলো নিচু শ্রেণির বলে।

ভারতীয় সমাজে শ্রেণি বিভাজন নিয়ে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ বলেছেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুই বর্ণই যেহেতু ভারতীয় সমাজে সবথেকে বেশি কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন, তাঁরাই ছিলেন সমাজের বৌদ্ধিক, নান্দনিক, বৈজ্ঞানিক ও দর্শনসহ অন্যান্য আত্মিক সম্পদের স্রষ্টা – অন্যদিকে সমাজের বাকি অংশ তৈরি করল বস্তুগত সম্পদ। তাই ভারতে শোষক ও শোষিতের মধ্যে যে বিভাজন, তা সম্পন্ন হয়েছিল বৌদ্ধিক ও কায়িক শ্রমের মধ্যে, পারমার্থিক ও লৌকিক জগতের মধ্যে। এই দুই বিরোধী ক্ষেত্রের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কই হল আমাদের বৌদ্ধিক ও কায়িক পরিশ্রমভিত্তিক সামগ্রিক সমাজের ভিত্তি’।

ঋগ্বেদের যুগে প্রত্যক্ষ সৃষ্টি থেকে স্রষ্টার সন্ধান চলছিল, কারণ তাদের অভিজ্ঞতায় তারা দেখত, বীজ, অণ্ড বা কারণ ছাড়া কাৰ্য, অর্থাৎ শস্য-বৃক্ষ বা অণ্ডজ প্রাণী হয় না। নগর সভ্যতায় পুরোহিত-শ্রেণি চিন্তাজগতের বস্তুকে শাস্ত্ৰে বিধিবদ্ধ করে ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব ঘটায়। দেহ ও আত্মার পৃথক সত্তার স্বীকৃতি হাজির হল। আত্মাকে অভিহিত করা হলো দেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসাবে। এই তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজনের ফলস্বরূপ আত্মাই সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে লাগল। আত্মা নিয়ে পুরোহিত-শাস্ত্রকাররা যখন আলোচনায় মগ্ন, তখন সাধারণ মানুষ দেহের পুষ্টি, ক্ষুধার খাদ্য, পরনের বস্ত্র, রোগের ওষুধ, বিপদের সমাধান, ঋণের বোঝা ও শোধ না-করতে পারার যন্ত্রণায় দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে।

সমাজ-সংগঠনের অর্থাৎ উৎপাদন, বণ্টন এবং এগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানবিক সম্পর্কগুলির উপর সাধারণ মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারালো; এলো এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ। অতিলৌকিকে তার বিশ্বাস টলে গেছে; ইহলোকে সুখ নেই; সুখকর পরলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় শাস্ত্রকাররা তাঁদের মোক্ষম অস্ত্রটি নির্মাণ করেছিলেন: জন্মান্তরবাদ। কী ব্রাহ্মণ্য, কী বৌদ্ধ, কী জৈন, কী আজীবিক সব ধর্মমতই জন্মান্তরকে স্বীকার করে নিয়েছে। ইহলোকের অচরিতাৰ্থ বাসনা, পরজন্মে পূরণ হবে। কিন্তু জীবনের অর্থ যাদের কাছে নানা কারণে নিগ্রহ ভোগ করা, তাঁদের কাছে জন্মান্তর তো বিভীষিকারূপে দেখা দেবেই। শাস্ত্রকাররা প্রতিকার বাতলে দিলেন: মুক্তি, মোক্ষ। বাস্তব জীবনে যদি একাগ্র ধ্যানে ‘ব্রহ্মস্বরূপ’ অনুভব করতে পারো, তাহলেই জন্মান্তর থেকে ছুটি। লক্ষণীয়, এ যুগে বৌদ্ধ, জৈন, ব্রাহ্মণ্য, আজীবিক সকলেই মোক্ষ, মুক্তি, নির্বাণের বিধান দিচ্ছেন।

এ ছিল অনিবাৰ্য কিন্তু ধীরগতির এক প্রক্রিয়া – ঋগ্বেদের প্রাথমিক এক প্রকৃতিনিষ্ঠ সমন্বয়ের মনোভাব থেকে, মানুষ প্রবলভাবে বিশ্ববিদ্বেষী, দেহবিদ্বেষী হয়ে উঠল।বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে সন্ত্রম বিস্ময়ের চেয়ে এর সম্ভাব্য বিপদ ও আতঙ্কতেই মানুষ বেশি বিপর্যস্ত। মানুষের কাছে দেহ দুঃখভোগের আধারমাত্র। তত্ত্ব প্রতিপাদনকারীদের কাছে সমস্ত আরাম ও বিলাস ছিল আয়ত্তের মধ্যে; আত্মার প্রাধান্য স্বীকার করলে তাঁদের কোনও ক্ষতি নেই, উপরন্তু সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখা সম্ভব। আত্মার তত্ত্বটা এত সূক্ষ্ম যে সাধারণ মানুষ সহজে বোঝেও না। আত্মা কোনও আশু প্রয়োজন সিদ্ধ করে না, যন্ত্রণা লাঘব করে না। নানারকম অত্যাচার ভোগ করে তো দেহ!

পরের যুগে জ্ঞানকাণ্ডে, আরণ্যক উপনিষদে আগেকার সংশয়ের উত্তর আর মিলল না; যজ্ঞ তখন গৌণ একটি ধর্মক্রিয়া; আত্মব্রহ্মতত্ত্ব নিয়ে চর্চাই হয়ে উঠল মুখ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বচরাচর, মানুষের শরীর, ইন্দ্রিয়, মন এবং এগুলির সঙ্গে বহির্জগতের সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ছিলই। যোগ হল নতুন কিছু সংশয়, আত্মা ও ব্রহ্ম এবং তাদের সম্পর্ক নিয়ে, মরণোত্তর অবস্থান নিয়ে। সমাজপতি, শাস্ত্রকার ও পুরোহিতদের সমবেত চেষ্টায় মানুষের জীবনদর্শন ও ধর্মাচরণের লক্ষ্য একেবারে বদলে গেল। পরলোকের অস্তিত্ব স্বীকৃত হল। সাধারণ মানুষ জানলেন, মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, আত্মা থাকে, অতএব পরলোক আছে, স্বর্গ নরক ও পুনর্জন্ম আছে – আর আছে কর্মফল। নতুন প্রশ্ন জন্মাল মুখ্যত এইগুলি নিয়েই।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে ‘মৃত্যুর পর চেতনা নেই’ বললেন যাজ্ঞবল্ক্য। আবার উপনিষদের আত্ম-ব্রহ্মতত্ত্বের তিনিই মুখ্য প্রবক্তা। তত্ত্ব ও ব্যবহারিক জীবনে অসঙ্গতি দেখা দিতে লাগল। যাজ্ঞবল্ক্যের দ্বিধাহীন উক্তিতে আত্মা, পরলোক, জন্মান্তরের সযত্ন রচিত ইমারত যে বিধস্ত হয়ে যায়, তা তিনি জানেন। তবু বলছেন, উপলব্ধি বা মননজাত তত্ত্বকে তিনি অস্বীকার করেন কী করে? মরণোত্তর আত্মার সংজ্ঞা তাঁর যুক্তিবুদ্ধির কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না তাই দৃঢ়স্বরে তা অস্বীকার করলেন। সমাজের বহু মনীষীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই এরকম ছিল: কোথাও প্রত্যয়, কোথাও সংশয়, কোথাও স্পষ্ট নাস্তিক্য।

যম-নচিকেতার আলোচনায় দেখা যায়, মৃত্যুর পর কী, এই ব্যাপারে স্বয়ং দেবতাদের মধ্যেও সংশয়। ধর্ম নাকি এতই সূক্ষ্ম যে সহজে বোঝা যায় না। নচিকেতার প্রশ্নগুলির কোনও উত্তর নেই। যম স্বয়ং বলছেন বিষয়টি দুর্জ্ঞেয়, বিদ্যাটি গুরুমুখী, যুক্তির জগতের বাইরে এর অবস্থান। তাই ওই জ্ঞান সৌভাগ্যবান মুষ্টিমেয় কয়েক জনের ভাগ্যেই জুটবে। কর্মকাণ্ডে ছিল বেদশিক্ষার মহিমা, জ্ঞানকাণ্ডে এল জ্ঞানের মাহাত্ম্য, আত্মব্রহ্ম-উপলব্ধির প্রয়োজনীয়তা। কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে, এ সবের দ্বারা আত্মজ্ঞান হয় না। আত্মা যাঁর কাছে নিজেকে প্রকাশ করে, কেবল তিনিই জানতে পারেন। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মজ্ঞান যুক্তি ও জ্ঞানের স্তর থেকে সরে চলে গেল রহস্যের স্তরে, সম্পূর্ণ অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত লোকে। এবং, এইরকম শুধু ভারতবর্ষে নয় পৃথিবীর সমস্ত ধর্মতত্ত্বে।

সব-কটি উপনিষদ মিলেও একটি সুসংহত দর্শন পাওয়া যায় না। উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে, প্রায় দু-আড়াইশো বছর ধরে বিভিন্ন স্থানে, কালে, বিভিন্ন মনীষীর চিন্তার সংকলন এই উপনিষদ সাহিত্য; ফলে এর মধ্যে কোনো সংহত কিংবা যুক্তিপূর্ণভাবে সংগঠিত বিশ্বতত্ত্ব খোঁজাও বাতুলতা। যে যার অভিজ্ঞতা অকুণ্ঠভাবে ব্যক্ত করে গেছেন। তারা জানতেনও না যে তাঁরা ‘উপনিষদ রচনা করছেন’। ফলে বহু পরস্পরবিরোধী উক্তির সমাহার রয়ে গেছে এর মধ্যে। দেশে চিন্তার জগতে আত্মা, পরলোক ও জন্মান্তরকে অবলম্বন করে যে নতুন হাওয়া বইছিল তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এঁরা প্রত্যেকে নিজের উপলব্ধি ও মনন গ্রন্থনা করে রেখে গেছেন, তাতে সৌষম্য ও সংহতি বজায় রইল কিনা সেটা লক্ষ করার দায়ও তাঁদের ছিল না।  

সমাজের ভিতরে নানা পরিবর্তন আসছিলো। মননজগতে যেমন পুর্বানুবৃত্তির মতো অনেক প্রাচীন উপাদান রয়ে যায়, তেমনই প্রাচীনকালে যা অভাবনীয় ছিল এমন বহু লক্ষণ ও উপাদানও দেখা দেয়। ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রকাররা সমগ্র বেদকেই অর্থাৎ সংহিতা-ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদ চারটি অংশকেই অপৌরুষেয় অর্থাৎ দৈব আদেশ বা প্রকাশ বললেন, যদিও এর সবটাই মানুষেরই রচনা। অনেক প্রয়াসে, অনেক যত্নে, আৰ্যসমাজ বহু বিরোধী মতবাদকে খণ্ডন করে, আত্মসাৎ করে, আগন্তুক ধর্মমতকেও অধিগ্রহণ করে সমাজে একটি সংহতি নির্মাণের চেষ্টা করছিল। অনিবার্য যন্ত্রণার সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও সম্পর্ক, যাকে সংশয়ে দীর্ণ মানুষ বাতিল করতে চেয়েছে, সেই অনিবাৰ্য পরিবর্তনকে দৈব প্রকাশ, অপৌরুষেয় বলে ব্যাখ্যা না-করলে সমাজ তাকে গ্রহণ করবে কেন? উদ্দেশ্য যেন-তেন-প্রকারে সামাজিক সংহতি রক্ষা। উপনিষদে, বহির্বিশ্ব জড়জগৎ জীবজগৎ শরীর আত্মা পরলোক এসব নিয়ে দ্বিধাহীন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য শুরু হল টীকাভাষ্যের। শংকরাচার্য ওই ঐকমত্য দেখাবার জন্যে বিস্তর কসরত করলেন। অসম্ভব বিদ্বান ও বুদ্ধিমান এবং গভীর শাস্ত্রজ্ঞানের অধিকারী শংকর নানা রকম ভাবে – অনেক সময়েই গায়ের জোরে – ভাষ্য নির্মাণ করে একটি সংহতিপূর্ণ মতবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন – অদ্বৈত বেদান্ত। কিন্তু ব্যাপারটা ওইখানেই থামল না। নানা শাখায় ও মতভেদে এর পরিবর্তিত ও বিবর্তিত সংস্করণ নির্মিত হয়েই চলল। স্পষ্টতই, এ সব তত্ত্ব সাধারণ লোক প্রায় বুঝতেই পারতেন না।  তাঁদের কাছে জীবনসংগ্রামটা কঠিনতর বাস্তব ছিল, তাই তাঁরা এ সব বোঝবার চেষ্টা করার অবকাশই পেতেন না। তাঁদের বোঝানো হল উচ্চ-ত্রিবর্ণের নিঃশর্ত পদসেবা করাই তাঁদের পরকালের উন্নতির একমাত্র উপায়। শেষ কথা হল, আত্মা আছে, এটি মেনে নেওয়া। সংশয়ী একটুও টলল না, বিশ্বাসীর তো প্রথম থেকেই কোনও সমস্যাই ছিল না। রাজা, রাজন্য, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, জিজ্ঞাসু ব্রহ্মচারী ও অন্যান্য কিছু ব্রহ্মসন্ধানী ব্যক্তিই এই নতুন তত্ত্বগুলি সম্বন্ধে আগ্রহী রইলেন।

এদিকে সমাজের প্রত্যন্ত দেশে তখন বহু নামে যজ্ঞবিরোধী, বেদবিরোধী নানা প্রস্থানের উদয় হয়েছে, তারা বেদ ও যজ্ঞ বাদ দিয়েও দিব্যি রইল। বেদবিরোধী প্রস্থানগুলি, যে সব সংশয়বাদী মূল বৈদিক ধর্মধারার বাইরে চলে যাচ্ছিল, তাঁদের তত্ত্বে সংহত হয়ে রয়ে গিয়েছিল এইসব সংশয়। এইসব সংশয়ের অনেকগুলিরই অন্তরালে প্রবাহিত ছিল নাস্তিক্য। সংশয়গুলির উত্তর পাওয়া গেল না অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। অতএব সংশয়ের তথা নাস্তিক্যের ভিত্তিও রয়ে গেল। আর রয়ে গেল প্রশ্ন করার, তর্ক করার এক সজীব ধারা – বিশ্ব জ্ঞানচর্চায় যা এক অসামান্য অবদান।

ঋণ স্বীকার:

১) সুকুমারী ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য

২) সুকুমারী ভট্টাচার্য – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য

৩) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে

৪) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – লোকায়ত দর্শন

৫) Debiprasad Chattopadhyay – Science and Philosophy in Ancient India

৬) Debiprasad Chattopadhyay – History of Science and Technology in Ancient India – The Beginnings

৭) হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় – চার্বাক দর্শন

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত

Spread the word