মূল এস্টাব্লিশমেন্ট – রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরি ‘এস্টাব্লিশমেন্ট’কে ব্যবহার করা শিখতে হবে
কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের জন্মদিবসে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ওয়েবসাইট তারই একটি বক্তৃতার লিখিত রুপ পুনঃপ্রকাশ করছে। ১৯৮২ সালে ছাত্র সংগঠনের আয়োজনে বক্তা হিসাবে আগামী দিনের আন্দোলন – সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি কিছু কথা বলেন। ছাত্রসংগ্রাম পত্রিকার ৩১শে জুলাই, ‘৮২ সংখ্যায় সেই বক্তৃতার লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি (NBA) ২০১০ সালে প্রমোদ দাশগুপ্ত – নির্বাচিত রচনা সংকলন প্রকাশ করে। লেখাটি সেই বই থেকেই সংগৃহীত।
আপনাদের ছাত্র সংগ্রামের সপ্তদশ বর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি দিনে শেষ বক্তা আমি। আমি আজকে আপনাদের সামনে যে কটা বক্তব্য উত্থাপিত করবার চেষ্টা করব, আশা করব সেগুলো সম্পর্কে আপনারা গুরুত্বসহকারে আগামী দিনে আপনাদের কাজকর্ম পরিচালনার ব্যাপারে বিচার বিবেচনা করবেন। আমি শুনলাম আপনারা গত চারদিন ধরে এখানে অনেক আলাপ আলোচনা করেছেন এবং তাতে অনেক ছাত্র বন্ধুরাও অংশগ্রহণ করেছেন বা তারা শুনেছেন।
আমি যে কথাটা এই ছাত্র সংগ্রাম পত্রিকা সম্পর্কে বলতে চাই তা হচ্ছে এই পত্রিকার প্রচার সংখ্যা যা, বা যা হওয়া উচিত তা কিন্তু না। তার চেয়ে অনেক কম। যা হওয়া উচিত বলছি কেন ? একথা বোধহয় আমাদের শত্রুরা ও স্বীকার করবেন যে কলকাতাসহ পশ্চিমবাংলার ছাত্র সমাজের উপর ছাত্র ফেডারেশনের যা প্রভাব, সেই প্রভাব অনুপাতে ছাত্র সংগ্রাম এর প্রচারসংখ্যা প্রতিফলিত হচ্ছে না।
ছাত্র সংগ্রামের যে ১৭ বছর পূরণ হলো তা অনেকগুলো ঘটনার এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হয়ে এসেছে। এখন সে সাবালক। একে এক সময় ছাত্র সমাজের মধ্যে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। যখন সেই সংশোধনবাদী রাজনীতি গোটা ছাত্রসমাজকে শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়ে পরিণত করার চেষ্টা করছিল তখন ছাত্র সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য সংগ্রাম করেছে ছাত্রসংগ্রাম। তারপরে এসেছে সংকীর্ণতাবাদের যুগ। যে যুগে ছাত্র সমাজের মধ্যে যে হতাশা তাকে বামপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে এবং সেই বামপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ঝোঁককে একটা রাজনৈতিক চাপ দিয়ে ছাত্র সমাজের কাছে পরিবেশন করেছে। তার বিরুদ্ধেও ছাত্রসংগ্রাম সংগ্রাম করে সঠিক পথের কথা বলেছে।
আজকে এই মুহূর্তে ছাত্রসংগ্রামের সামনে যে প্রশ্ন সে সম্পর্কে কয়েকটি কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। এই নির্বাচনের পর বিভিন্ন জেলায় আমি গিয়েছিলাম। এর আগেও নির্বাচনের পরে গিয়েছি। তখন ঢালাওভাবে বলতে পেরেছিলাম যে যুব সম্প্রদায় ও ছাত্র সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ মানুষই বামফ্রন্টের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছে। এবার আর কিন্তু আমি ঠিক সেভাবে, ঢালাওভাবে বলতে পারছি না। কারণ বহু নির্বাচনী ক্ষেত্রে এটা দেখা গিয়েছে যে কংগ্রেসীরা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রদের কংগ্রেসের সমর্থনে বিপুল অংশকে জমায়েত করতে পেরেছিল এবং তাদের নাম যদিও ভোটার লিস্টে নেই, ভোটের বয়স হয়নি তা সত্ত্বেও তাদের দিয়ে জাল ভোট দেওয়ানো হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে নতুন একটা উৎসাহ সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছিল – যে এবার কংগ্রেস জিতবে এবং তাদের চাকরি দেবে। চাকরির আশায় বিভিন্ন এলাকার, বিশেষ করে স্কুলের ছাত্র এই কংগ্রেসী প্রলোভনে পা দিয়েছে। আমি কথাটা উত্থাপন করলাম একারণেই যে এর মধ্যে কংগ্রেসের ভাঁওতা থাকতে পারে। কিন্তু ভাঁওতা বলে উড়িয়ে দিলে পর লোকের মনে যে জিজ্ঞাসা যে প্রশ্ন তার অবসান হয় না।
আজকে বেকারি এবং যে কথা আপনারা সঠিকভাবে উত্থাপন করেছেন অর্থাৎ শিক্ষান্তে চাকরি। সে দাবি প্রত্যেকটি ছাত্রকে আলোড়িত করেছে। তারা পরিষ্কার জানতে চায়, বুঝতে চায় যে শিক্ষান্তে তার ভবিষ্যৎটা কি? এখানে শুধু আমরা পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের সীমাবদ্ধ ক্ষমতা এ কথা বললেই তাদের মনের সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে বলে আমি মনে করি না। আমি অবশ্য এ কথা মনে করছি না যে সব প্রশ্নের জবাব এখনই এই মুহূর্তে দেওয়া যায়। কিন্তু আমি এ কথা নিশ্চয়ই মনে করি যে এইসব প্রশ্নের সমাধানের ব্যাপারে একটা আবহাওয়া সৃষ্টি করা যায়। যে আবহাওয়া একটা ভালো সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ আমরা চাই আর না চাই বেকারির যে তীব্র জ্বালা যন্ত্রণা ছাত্র অবস্থা থেকে মানুষকে বিব্রত করছে এবং তাকে ব্যবহার করার জন্য নানা রকমের ঝোঁক, কখনো নকশালপন্থী কখনো বা কংগ্রেসীরা অপপ্রচারের মাধ্যমে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। আমি কথাগুলো উল্লেখ করছি এই কারনে যে একটা পত্রিকার নিশ্চয়ই সংবাদ পরিবেশন করা, মতাদর্শগত সংগ্রাম করা যেমন দায়িত্ব, তেমনি পত্রিকার এটাও দায়িত্ব যে যাদের মধ্যে এর প্রচার, তাদের মনের প্রশ্নগুলি কি তা খুঁজে বের করা এবং সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করা। চাকরির সমস্যার ব্যাপারে, কিভাবে তার সমাধান হতে পারে – এ সম্পর্কে আপনারা অনেক লেখা লিখেছেন। আলোচনাও সংগঠিত করেছেন। কিন্তু আমি মনে করি এখনো অনেক বাকি রয়েছে। কারণ অনেক সময় এ সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক আমাদের কর্তব্য বা কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়, যেন মনে হয় বোধহয় কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব ! কিছু শিল্প হলে চাকরি হবে? বর্তমান ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বেকার সমস্যার সমাধান যে সম্ভব নয়, আমুল সমাজ পরিবর্তনের যে প্রয়োজন এই চেতনাবোধ আমরা ছাত্র সমাজের মধ্যে কতটা দিতে পেরেছি? সে দায়িত্বও আমাদের নিতে হবে ছাত্রসংগ্রামের মাধ্যমে।
দ্বিতীয় একটি প্রশ্ন। ছাত্রদের মধ্যে একটা প্রবনতা আছে – অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট। অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট আন্দোলনে ঝুঁকে পড়া। এবং এ ব্যাপারে খুব সহজেই লোককে উত্তেজিত করা যায়। ছেলেবেলা থেকেই আমরা অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট এবং সেভাবেই লোককে আমরা শিখিয়ে এসেছি। আমাদের শিক্ষা দীক্ষা – চালচলন – বক্তৃতা সব তাই। কিন্তু আমরা কতটা লোককে শেখাতে পেরেছি – যে establishment created by us অর্থাৎ আমরা তৈরি করলাম – আমার আন্দোলন কি তার বিরুদ্ধে যেতে পারে? আর সেই এস্টাবলিশমেন্ট কে মূল যে এস্টাবলিশমেন্ট অর্থাৎ সমাজের যে রাষ্ট্রকাঠামো, তা পরিবর্তনের জন্য কিভাবে ব্যবহার করতে পারব? এই শিক্ষা আমরা কি ছাত্র সমাজের মধ্যে দিতে পেরেছি? কারণ আপনি শুধু যদি বলেন যে বামফ্রন্ট সরকার আমাদের সরকার এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করা যাবে না – এইটুকু বললে বোধহয় ছাত্ররা খুশি হতে পারে না। বামফ্রন্ট সরকার ছাত্রদেরও সরকার, এই সরকার গঠনের ব্যাপারে তাদের কি অবদান, এই সরকার থাকলে পর তাদের কি লাভ এবং এই সরকারের সাহায্যে, সহযোগিতায় মূল যে এস্টাবলিশমেন্ট রাষ্ট্রযন্ত্র, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে – তাকে কতখানি ব্যবহার করা যাবে। আমার গড়া এস্টাবলিশমেন্ট, আমি তাকে নিশ্চয়ই ভেঙে ফেলতে পারিনা। আমি তাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করবো। সেই কৌশল শিখতে হবে। তার সাথে সম্পর্ক কি হবে তা ছাত্রসমাজকে বোঝাতে হবে এবং বোঝাতে হবে যে এটি তার এস্টাবলিশমেন্ট, নিজের ঘর নিজে কখনো ভাঙ্গে না। নিজের ঘর থেকেই বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করতে হবে, নিজের ঘরে থেকেই বৃহত্তর আন্দোলন সংগ্রামের পরিকল্পনা নিতে হবে। ঘরকে রক্ষা করে – ঘরকে ভেঙে নয়। এই ধারণা আমরা ছাত্র সমাজের মধ্যে কতটা দিতে পেরেছি তার উপরে নির্ভর করবে ছাত্রসংগ্রামের আদর্শগত সংগ্রামের ভূমিকা।
যদিও আমি জানি এস এফ আই তাদের সদস্যসংখ্যা বাড়াবার ব্যাপারে স্কুলের উপর জোর দিয়েছেন, তবুও আমি বিশেষ করে বলব যে স্কুলে তাদের সংগঠন কিন্তু এখনও সেরকম শক্তিশালী নয়। স্কুলে যদি সংগঠন শক্তিশালী হয়, কলেজগুলিতে ভালো কর্মী পেতে অসুবিধা হবে না। সেখানেও আমরা ভালো সংগঠন গড়ে তুলতে পারবো। একটি কথা না বলে আমি পারছি না। সেটা হচ্ছে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব – এখন যারা ছাত্র জীবন শেষ করেছেন তাদের উপর রয়েছে। ছাত্ররা ছাত্র আন্দোলনের নেতা নন এই পরিস্থিতি বেশি দিন চললে পর আমাদের সামনে যে সব বিপদ আসবে – সংকট আসবে তা মোকাবিলা করা সম্ভবপর হবে না। আমরা যদি কলেজে কলেজে, স্কুলে স্কুলে সেই সেই প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নেতা না তৈরি করতে পারি অর্থাৎ এখনো যদি বাইরে নেতার উপরই নির্ভরশীল হতে হয় তাহলে আগামী দিনে আন্দোলনের যে দুর্বলতম জায়গা সেটা থেকে যাবে। ছাত্রসংগ্রাম এই নতুন নেতৃত্ব অর্থাৎ ছাত্রদের মধ্য থেকে যে নেতা সৃষ্টি করার ব্যাপারে, সেই প্রশ্নে বহুল পরিমাণে সাহায্য করতে পারে। ছাত্রসংগ্রামকে প্রাণবন্ত করার জন্য আমি আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ করবো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের – প্রত্যেকটির না হলেও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টার সৃষ্টি করা দরকার। কারণ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেভাবে চলছে সেভাবে চললে পর আমাদের শিক্ষা জগতে এক বিরাট সংকট তারা সৃষ্টি করবে। সে ব্যাপারে যেমন শিক্ষক সংগঠনের দায়িত্ব আছে তেমনি ছাত্র সংগঠনেরও দায়িত্ব আছে। শিক্ষার অগ্রগতি, শিক্ষার মান উন্নত করা, যে সমস্ত শিক্ষানীতি সরকার গ্রহণ করছে সেইসব সম্পর্কে জনমত সৃষ্টি করার ব্যাপারে ছাত্রদের একটা বিরাট দায়িত্ব আছে। আমি বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে শুনেছি যদিও ছাত্রসংগ্রাম এবং ছাত্র ফেডারেশন বহু আলোচনা সংগঠিত করেছেন তবুও প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যাপারে গ্রামে-গঞ্জে এখনো ছাত্র অভিভাবকদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। এটা পুরানো হলেও, এই কর্মসূচি এখনো লোকের মধ্যে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন আছে। কারণ প্রতিক্রিয়ার শক্তি এর উপর দাঁড়িয়ে ছাত্রসমাজ শিক্ষকসমাজের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার সুযোগ পাচ্ছে। তাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা প্রচার করার চেষ্টা করছে, যে এই নীতির ফলে শিক্ষার মান কমে গিয়েছে। এবং আরো অনেক কিছু ব্যাপার আছে যেমন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এরপর আর পরীক্ষা হবে না ! এই সব ব্যাপারেই আমি মনে করি যে ছাত্র সংগ্রাম – তার প্রচারযন্ত্র আরো প্রখর হওয়া দরকার। প্রসার হওয়া দরকার এবং এর যারা পরিচালক তাদের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আলোচনা সংগঠিত করা দরকার।
আপনাদের এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি দিনে আমি শেষ বক্তা। আমি যা বললাম তা সব শেষ না। আমি শুধু আপনাদের কাছে অনুরোধ করলাম। আগামী দিনে আপনারা যখন কাজে যাবেন, আমি যে কটা কথা বললাম সেগুলো আপনারা একটু চিন্তা করবেন। এবং তা আপনাদের আগামী দিনের কাজে যদি সাহায্য করে তাহলে আমি সুখী হব। আমি আমার বক্তৃতা আর দীর্ঘ করতে চাই না। শুনেছি এরপর গান হবে। সেই গান শুনেই সমাপ্তি দিনের সমাপ্তি হোক এই ইচ্ছা জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
*প্রচ্ছদের বাংলা হেডলাইন ওয়েবসাইট টিমের নিজস্ব।